#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_১২
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
দিনটা শুক্রবার। সকাল থেকেই মহলে রান্নাবান্নার ধুম পড়েছে। শাহানা আর তার তিন কন্যারা মহলে থাকলে মহলটা মেতে থাকে। খোদেজা আর হামিদার সাথে শাহানার মধ্যকার সম্পর্ক বেশ মজবুত। রসাইঘরে কুমু আর টুনু সকালের রুটি বানাচ্ছে। গরুর মাংসের ডাল পাকাচ্ছে শাহানা। সুগন্ধে ম ম করছে রসাইঘরের আশপাশ। রসাইঘরে শেহজাদের আগমন কাজের বুয়াদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিল। তারা কপাল অব্দি ঘোমটা টেনে নিল সাথে সাথেই।
শেহজাদ আসামাত্রই খোদেজার কাছে গেল। চারপাশে আধো আধো চোখ বুলিয়ে গলার স্বর খানিকটা খাদে নামিয়ে বলল,
আম্মাজান আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। যদি আপনার সময় হয়।
খোদেজা তজবী জপতে জপতে কুমু আর টুনুকে এটাওটা আদেশ দিচ্ছিলেন। সকাল সকাল ছেলের মুখ দর্শন করতে পেরে খুশি হয়ে দোয়া পড়ে ছেলের মাথায় ফুঁ দিলেন। শেহজাদ মাথা নামিয়ে মায়ের দোয়া নিয়ে বলল,
একটু জরুরি। ফুপু আপনারা পরে সব জানতে পারবেন। আম্মাকে যেতে দিন।
শাহানা আর হামিদা হাসিমুখে সায় জানালো।
শেহজাদ বেরোচ্ছিল। শাহানা বলল,
আর কতদিন আম্মা আম্মা করে মায়ের পেছনে ঘুরঘুর করবে? এবার তো মায়ের আঁচল ছেড়ে বউয়ের আঁচল ধরার সময় এসেছে।
শেহজাদ রসাইঘর থেকে বেরুতে বেরুতে জবাব দিল,
সে সময় হলে দেখা যাবে।
সময় কখন হবে?
সময় কথা বলবে। আম্মা তাড়াতাড়ি আসুন। আমাকে বেরোতে হবে।
খোদেজা সবার সাথে মুচকি হেসে শেহজাদের পেছন পেছন বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল,
কিছু হয়েছে পুত্র? কেন এত জরুরি তলব?
ভীত হবেন না। আপনার কাছে পরামর্শ চাইছি। আমার কক্ষে আসুন। এখানে বলতে চাই না।
শেহজাদ মাকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা খানিকটা ভাজিয়ে দিয়ে বলল,
আম্মা আমি সবসময় আপনার কাছ থেকে উত্তম ফয়সালা পাই। তাই মনে হয়েছে সবটা আপনাকে জানানো উচিত। আমার বিশ্বাস আপনি সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। উত্তেজিত হবেন না। আমি একথা কাউকে বলিনি।
খোদেজা খানিকটা ভীত হয়। মোলায়েম কন্ঠস্বরে বলে,
তুমি আমার শক্তি। আমি তোমাকে আমার নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি শেহজাদ। যা তুমি কাউকে বলোনি তা আমাকে বলতে চাচ্ছ এটা শুনে আমার গর্ব হচ্ছে। বলো কি বলতে চাও।
শেহজাদ তার বিছানার কাছে হেঁটে গেল। বালিশের উপর থেকে একটা কৌটা বের করে, সেখান থেকে একটা চকচকে বাহুবন্ধনী বের করে খোদেজাকে দেখাতেই খোদেজা বড় বড় চোখ করে তাকায়। বুক ধড়ফড়িয়ে উঠে। উত্তেজনায় প্রায় ঘাম ছুটে মুখে। কম্পিত হাতে শেহজাদের হাত থেকে বাহুবন্ধনীটা নিয়ে তুলে ধরে চোখের সামনে। টলটলে দিঘীর মতো ভরে উঠে অক্ষিকোটর। শেহজাদ ডাকে,
আম্মা!
খোদেজা মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে। বলে,
এই বাহুবন্ধনী তুমি কোথায় পেলে? এটা তোমার জন্য অশুভ পুত্র। তোমার ধ্বংস, তোমার জন্য অপবিত্র। কোথায় পেয়েছ?
এত উত্তেজিত হবেন না আম্মা। এটা আমি কক্ষের বাইরে দালানের এককোনায় পড়ে থাকতে দেখেছি।
খোদেজা হাতের মুঠোয় সেটি চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
এটা আমি পুড়িয়ে দেব। ছাই করে দেব।
অবশ্যই দেবেন। কিন্তু ভেবে দেখেছেন এটা কোথা হতে এল? এই অশুভ বাহুবন্ধনী কার হাত থেকে খসে পড়ে গেল?
খোদেজা আর ভাবতে চায় না। দু’পাশে ঘনঘন মাথা নেড়ে বলে,
আমি জানতেও চাই না শেহজাদ। শুধু এটুকু জেনে রেখো এসব তোমার জন্য অশুভ। তুমি এসব থেকে দূরে দূরে থাকবে। আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করুক। আমি এটা পুড়িয়ে ফেলতে যাচ্ছি।
মা যেতেই শেহজাদের কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। এই বাহুবন্ধনী অপরূপার হাত থেকে পড়েনি তো?
_______________
সায়রা ঘাটে বসে পা দিয়ে পানি নাড়তে নাড়তে বলল,
অপা কোথায় গেল! ডুব দিয়েছে সে কখন উঠার নামগন্ধ নেই। হাত বেশিক্ষণ ভেজা থাকলে তো খুব ক্ষতি হবে।
ঘুম থেকে তুলে অপরূপাকে সবাই গোসলখানায় নিয়ে এসেছে তাদের সাথে। গোসল করে নিলে তার ভালো লাগবে। ওর সারামুখে তেল চটচট করছে। কে এভাবে তেল দিয়ে দিল? তাকে মনে মনে বেশ বকেছে অপরূপা। এভাবে কাউকে তেল দিতে সে দেখেনি। কপাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে তেল পড়ছিলো। তাই সেও গোসল করে নেবে ভাবলো। যদিও হাতটা ভেজালে ক্ষত শুঁকবে না তারপরও কিছু করার নেই।
মহলের নারীদের জন্য মহলের পেছনে গোসলখানা করা আছে । স্বচ্ছ জলপুকুরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
এদিকে কোনো পুরুষমানুষের আনাগোনা নেই।
মহিলাদের কন্ঠস্বরও সেই গোসলখানার বাইরে যায় তাই গোসলখানা নিরাপদ। কাপড়চোপড় বদলানোর জন্য আলাদা কক্ষ আছে।
অপরূপা অনেকক্ষণ পর ডুব দিয়ে উঠলো। শাড়ি, চুল তার গায়ে লেপ্টে রয়েছে। ডুব দিয়ে উঠেই সবাইকে বিস্মিত চোখে তাকাতে দেখে ফিক করে হেসে বলল,
ভয় পেয়েছ?
সায়রা তার মুখে পানি ছুঁড়ে বলল,
এতক্ষণ কিভাবে থাকতে পারলে?
আমি পারি।
আয়শা,শবনম সাঁতার কাটছে। অপরূপা ঘাটে উঠে গেল। কাপড় বদলানোর কক্ষে ঢুকে আবার বেরিয়ে এল। বলল,
আমি কি পোশাক পড়বো?
সোহিনী বলল,
আপাতত তটিনী আপার একটা পোশাক রেখেছি ওটা পড়ো। তোমাকে ভালো মানাবে।
তটিনী বলল,
হ্যা ওটা কিন্তু একদম নতুন।
কুমু আর টুনু এসে বলল,
মা বেগম খবর পাঠাইছে। আপনাগোরে তাড়াতাড়ি আসতে কইছে। বেশিক্ষণ পানি ঘাটলে জ্বর বাঁধাইবেন।
সায়রা বলল,
যাচ্ছি যাচ্ছি।
অপরূপা নতুন পোশাক গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এল। একটা খয়েরী রঙের পোশাক। সেলোয়ার-কামিজ আর রেশমি সুতোর ওড়না। তাকে কি অপূর্ব লাগছে পোশাকটাতে। একদম নতুন অপরূপা। তাদের অমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপরূপা বলল,
খুব খারাপ লাগছে? ওভাবে দেখছ কেন সবাই?
সবাই একসাথে ফিক করে হেসে উঠে পানি হাতের পানি ছুঁড়ে বলল,
অপরূপার মতোই লাগছে।
অপরূপা হাত দিয়ে মুখে পানি পড়া আটকে ঘাটে নামতে নামতে ডান হাতের সাহায্য তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে বলল,
চুল থেকে তেল সরেছে? ওভাবে কি কেউ তেল দেয়?
সবাই হাসাহাসি করতে বলল,
তেল দেওয়ার পরেই ঘুমিয়েছ। আর আজ সুস্থ হয়ে আমাদের ভাইজানকে বকছো?
না বকছি না। উনাকে ধন্যবাদ দেওয়া প্রয়োজন।
স্বচ্ছ জলে নিজের মুখ দেখে অপরূপা আবারও সবার দিকে তাকালো। বলল,
সবাই ওভাবে দেখছো কেন? নিশ্চয়ই আমাকে কাপড়টাতে মানাচ্ছে না।
তটিনী জলের উপর উঠে দাঁড়ালো। বলল,
দারুণ লাগছে।
তোমাকে এরূপ অবস্থায় রহমান দেখলে কি বলতো বলোতো তোমরা ।
সবাই সমস্বরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই অপরূপা পালিয়ে গেল।
সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
_________
বোনদের কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও। কুমু জানালো সবাই গোসলখানায় গিয়েছে। স
সাফায়াত এসে শেহজাদকে জানালো,
ওরা কেউ নেই। রূপার কক্ষটাও খালি। তুমি এখন গিয়ে দেখতে পারো ওর কক্ষে কিছু পাও কিনা। ওখানে কিছু না কিছু পেতে পারো।
শেহজাদ তার পালিত খরগোশ দুটিকে খেতে দিয়েছে সবে। সাফায়াতের কথায় দাঁড়িয়ে পড়ে শেহজাদ। বলে,
তুমি বারান্দায় থাকো। কেউ এলো সাবধান করবে।
কেউ নেই। যেতে পারো।
শেহজাদ বেরিয়ে পড়লো। রূপার কক্ষটির সামনে গিয়ে থামলো। কেউ নেই দেখে ধীরপায়ে কক্ষে প্রবেশ করে সবখানে তন্নতন্ন করে খুঁজলো কিছু পাওয়া যায় কিনা। যা পেল তা পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
বেশকিছুক্ষণ পর পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। চোখ ফেরাতেই পর্দার পেছনে পা জোড়া দেখতে পেল। মেয়েটার পড়নে খয়েরী রঙের সেলোয়ার। চুল থেকে হয়ত পানি পড়ছে তাই মেঝে ভিজে যাচ্ছে। সেলোয়ার কামিজ যেহেতু পড়া তারমানে বোনরা কেউ। সে বলল,
গুরুত্বপূর্ণ জিনিস খুঁজতে এসেছি। শব্দ করবে না।
অপরূপা হতবাক চোখে শেহজাদের অনেকটা পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। এতবড় একজন মানুষ কিনা তার ঘর হাতাচ্ছে!
কোনো শব্দ না পেয়ে শেহজাদ সামনে ফিরতেই অপরূপাকে দেখে হতচকিত হয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। অথচ তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে হকচকিয়ে গিয়েছে। সগর্বে দাঁড়িয়ে থেকে
আঙুল দিয়ে কপালের একপাশ ঘষে কেশে উঠে জানালার দিকে তাকাতেই দেখলো সাফায়াত কপাল চাপড়াচ্ছে। আর মাফ চাইছে।
অপরূপা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চেহারা শান্ত, স্বাভাবিক।
শেহজাদ তার চোখে চোখে একপলক তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চুপচাপ বের হয়ে যেই সাফায়াতের কান টেনে ধরলো ঠিক তখনি বাকিরা এসে উপস্থিত। তটিনী বলল,
আরেহ ভাইয়ার কান টেনে ধরলে কেন? কি হয়েছে?
শেহজাদ কান ছেড়ে দেয়। দৃঢ় গলায় বলে,
না কিছু না।
পেছন থেকে অপরূপা বলল,
উনি কক্ষে কিছু খুঁজছিলেন।
সাফয়াত বলল,
হ্যা, খুঁজছিল তো। খরগোশ খুঁজছিলো। ওর খরগোশ এদিকে পালিয়ে এসেছিল। আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হলো সেটি রূপার কক্ষে প্রবেশ করেছে তাই ভাইজানকে বললাম খুঁজে দেখতে। ও তাই দেখছিল। রূপা অন্য কিছু না। বিশ্বাস করো।
অপরূপা বলল,
দেখে মনে হচ্ছিল কিছু চুরি করতে এসেছে।
শেহজাদ হতভম্ব চোখে তাকায় তার দিকে। বাকিরাও কপাল চাপড়ে জিভে কামড় দেয়। সায়রা সোহিনী তাকে কক্ষের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়ে বলে,
হায় খোদা! কাকে চোর বলছো?
অপরূপা বলল,
কেন? আমি ডাকাতি করিনি না দেখেও উনি আমাকে ডাকাত বলতে পারলে, উনি চুরি করছেন দেখে আমি কেন চোর বলতে পারব না? এটা উনার মহল বলে? একদম না। আমি অবশ্যই সত্যি কথা বলব। উনি চুরিই করছিলেন। চোর চোর চোর।
চলমান….