প্রিয় বেগম পর্ব-১০

0
1389

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_১০
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

আকাশে তারার মেলা বসেছে। চাঁদের জ্যোৎস্নাভা নদীর টলটলে পানিতে পড়ায় পানি চিকচিক করছে। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে ট্রলারের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে ছোট, মাঝারি নৌকাগুলো।
শেহজাদকে ডেকেও কোনো সাড়া না পেয়ে ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল সাফায়াত। চন্দ্রসুধার মুক্ত দানার মতো ছড়ানো আলোকচ্ছটা গায়ে মেখে পূর্বদিক হয়ে পেছনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে শেহজাদ। তার চওড়া কপালের ভাঁজে হাজারো প্রশ্নের আঁকিবুঁকি স্পষ্ট কেলি করছে। সাফায়াত ধীরপায়ে হেঁটে শেহজাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। এর আগেও ইন্দিরাপুরে গিয়েছে তারা। তবে এবার পথ যেন ফুরোচ্ছে না। তাদের গন্তব্য বসু মল্লিক বাড়িতে। তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর সুভাষিণী বসু মল্লিকের কাছে।

সাফায়াত সাহস সঞ্চয় করে বলল,

তুমি কি রূপার কথা ভাবছো?

কিছু মুহূর্ত পিনপতন নীরবতার ঢেউয়ে ভেসে গেল। শেহজাদ উত্তর করলো,

হ্যা। ও-ই রূপা।

সাফায়াত উত্তেজিত বোধ করলো।

কি করলে নিশ্চিত হলে যে এই মেয়েটাই রূপা?

শেহজাদ তার দিকে তাকালো। তার চোখের কোণায় লালচে আভা দেখা গেল। ফুলকলিকে দেখার পর থেকেই তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তার নগরে অশুভ ছায়ার আগমন তাকে অস্থির করে তুলেছে। এককালের অন্ধকার, কুসংস্কার, নোংরামি, ভন্ডামি আর অশুভ ছায়া থেকে মুক্ত করে এই নগরকে তার সুশ্রী রূপ ফিরিয়ে দিতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে শেরতাজ আর শাহজাহান সুলতান এই দুই ভাইকে। তারপর সময়ের পরিক্রমায় বংশের সম্রাট হিসেবে শেহজাদের কাছে সেই দায়িত্ব আসে। তেইশ বছর বয়স থেকে সে রূপনগরের সম্রাট হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। আর আজ বয়স ত্রিশে পদার্পণ। এই সাত বছরে সে রূপনগরকে আগলে রেখেছে পরম মমতায়। সুশৃঙ্খল, শান্তি বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনে খুবই কোমল মনের পরিচয় দিয়েছে, আবার প্রয়োজনে তার কঠোর রূপ দেখেছে রূপ নগরের মানুষ।
সে-ই সম্রাট আজ রূপনগরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত। আতঙ্কিত বছরখানেক আগে দেখা এক সন্ধ্যেবালিকার জীবন নিয়ে। ভাগ্য তার নিজস্ব কায়দায় রূপাকে তার মহলে নিয়ে এসেছে।
কি অদ্ভুত নসিব রূপার! একদিন একসময় একমুহূর্তের জন্য হলেও যে-ই শেহজাদ সুলতান তাকে ভেবে এক একটা রজনী নির্ঘুম কাটিয়েছিল সেই শেহজাদ সুলতানই তাকে ডাকাত আখ্যা দিয়েছে। ভাবতেই শেহজাদের মনের গহীনে তুমুল সংঘর্ষ সংগঠিত হয় ভাবনার দোলাচলে। কেন রূপার এই পরিণতি! কাকে ভালোবেসে?

সাফায়াত উত্তর না পেয়ে ফের জানতে চাইলো,

আমি তো রূপাকে ভুলতেই বসেছি। সেই কখন বসন্তের সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল। আরও একটা বসন্ত তো চলেও গেল। রোজ তো কত মানুষের সাথে পরিচিত হয় মনে থাকে ক’জনকে? ও রূপা হতেই পারে না। রূপা তো এমন না।

ধূমায়িত চুরুটের শেষ অংশটুকু নদীর পানিতে ছুঁড়ে ফেলে শেহজাদ তাকালো সাফায়াতের দিকে। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সহিত বলল,

আমি বোধহয় ওকে ওইদিন ওইটুকু না দেখলেও চিনতে পারতাম সাফায়াত।

সাফায়াত তার বিশ্বাস দেখে হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

এখন কোথায় যাবে?

মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে শেহজাদের কন্ঠস্বর।

সুভার কাছে। ও আমায় মিথ্যে গল্প শুনিয়েছিল।

সাফয়াত ভাবনায় বুদ হয়ে ভাবে, রূপনগরের সম্রাট কি কোনোভাবে ওইদিন নিজের হার দেখেছিল সেই কালো পোশাকে আবৃত চক্ষুদর্শিনীর কাছে?

____________

মন্দির থেকে ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। ধূপধোঁয়া আর শঙ্খধ্বনিতে মেতে আছে মল্লিক বাড়ির আঙিনা। এক বৃদ্ধা থালা হাতে মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়াতেই চোখ পড়লো বাড়ির কর্তার সাথে হেঁটে আসা দু’জন সৌম্যদর্শন পুরুষ লোকের দিকে। তাদের কোথায় যেন দেখেছে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছেনা বৃদ্ধা। নবু বলে ডাক দিতেই বেগুনী রঙের শাড়ি পরিহিত একটা মেয়ে ছুটে এসে বলল,

কি হয়ছে? এত চিল্লাও ক্যান?

কে আইছে দেখ।

নমস্কার! আমরা রূপনগর থেকে এসেছি।

সাফায়াতের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটি মাথা ঢাকে আঁচল টেনে।

কাকে চান?

সাফায়াত উত্তর দেয়।

সুভাষিণী আছে বাড়িতে?

বৃদ্ধা আর মেয়েটি একে অপরের দিকে তাকাতেই বুড়ো বলে উঠে,

রূপনগরের সম্রাট আইছে। বসতে দাও গিন্নি। শকুন্তলার পরিচালকও বটে।

একপ্রকার হৈচৈ পড়ে গেল বাড়ির অন্দরমহলে। উঠোনে কেদারা পেতে বসতে দেয়া হলো সাফায়াত আর শেহজাদকে।

শেহজাদ তাদের এত আপ্যায়ন দেখে বিরসমুখে বলল,

সুভাকে একটু ডেকে দিন। আমরা তার সাথে কথা বলতে এসেছি। খুব জরুরি।

বাড়ির কর্তা নাতনীকে ডেকে পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা একটা যুবতী মেয়ে উঠোনে পা রাখলো। তার বিস্মিত চোখজোড়া চকচক করছে কৌতূহলে।

সাহেব আপনারা!

শেহজাদ বুড়োকে বলল,

চাচামশাই আমরা একটু কথা বলতে চাইছি।

হ, কন। সমস্যা নাই। আমি যাইতাছি ভিতরে। আপনেরা কথা কন। জল বাতাসা মুখে না দিয়ে যাইবেন না।

জ্বি।

বুড়ো যেতেই সুভা সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করে,

আজও ওর সম্বন্ধে জানতে এসেছেন সাহেব? ও তো কখনোই আপনার কথা জানতে চায়নি।

সাফায়াত হতবিহ্বল চোখে শেহজাদের দিকে তাকায়। শেহজাদ তা তোয়াক্কা করেনা। প্রশ্ন করে,

তুমি কি আমার সাথে রূপনগরে যেতে পারো সুভা?

সুভা চরম বিস্মিত হয়ে বলে,

আমি? রূপনগর? কেন?

ওখানে তোমার সই বন্দি হয়ে আছে।

দ্বিগুণ বিস্ময়ে সুভার মুখ হাঁ হয়ে থাকে।

অপু?

হ্যা। যাকে আমি রূপা নামে চিনি।

কিন্তু অপু তো রহমানের সাথে সাহেব।

শেহজাদ রোষানলে দগ্ধ হয়ে বলল,

রহমান ওকে দক্ষিণা ঘাটে ফেলে রেখে পালিয়েছে।

সুভা শেহজাদের একের পর এক বিবৃতিতে অবাক হচ্ছে। এবার সে নিজেই তাদেরকে চমকে দিয়ে বলল,

আমি জানতামই রহমান এমন কিছু একটা করবে। আমি অপুকে অনেক সাবধান করেছি সাহেব। ও আমার কথা শুনেনি।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে