প্রিয় বেগম পর্ব-০৮

0
1299

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৮
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

শেহজাদের কোনো সাড়াশব্দ না দেখে সাফায়াত কক্ষের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলো, ‘ ভাইজান আসবো? আছেন আপনি? ‘
কোনো উত্তর এল না। বিছানার একপাশে সাদা পর্দা ফেলানো তাই কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে আড়ষ্টভঙ্গিতে পুনরায় ডাকলো, ‘ ভাইজান! ‘
বিছানায় একটা পা দেখতে পেল সে। রূপা ঘুমোচ্ছে। তাও এত তাড়াতাড়ি! সে কক্ষে ঢুকার সাহস করলো না। রসাইঘরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো সায়রা কাজ করছে। সে সোহিনীকে ডাকলো,

‘ সুহি বেরিয়ে এসো। কথা আছে। ‘

সায়রা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। কি এমন কথা সোহিনীর সাথে? সোহিনী বেরিয়ে গিয়ে বলল,

‘ জ্বি ভাইজান। বলুন। ‘

‘ আমার সাথে আসো তো। ‘

সায়রা রসাইঘরের দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো। তার নাকের অগ্রভাগ কাঁপছে। কি এমন কথা যেটা তাকে বলা যেত না? রেগেমেগে পুনরায় কাজে ফিরে গেল সে।
তটিনী এসে ঝাঁজালো গলায় বলল,

‘ কুমু আপা গিয়েছিলে কোথায়? আমার কাপড়চোপড় কোথায় রেখেছ?’

‘ তোমার আর তোমার সোয়ামির কাপড় কক্ষে রাখছি। চোখ হাতে নিয়া হাঁটলে আমি কি করব? ‘

‘ কার সাথে কথা বলছো ভুলে যাচ্ছ তুমি? ‘

মুখ মোচড়ে কাজে মনোযোগ দিল কুমুদিনী। খোদেজা বলল,

‘ সায়রা রূপা কোথায় গেল শুনি? ‘

‘ কক্ষে নিশ্চয়ই। ‘

‘ শেহজাদ এখনো বেরোয়নি? ‘

‘ হয়ত না। ‘

**

রূপা অবেলায় ঘুমোচ্ছে কেন? খোঁজ রাখোনি? আর ভাইজান কোথায় দেখেছ? ‘

সোহিনী উত্তর দিল।

‘ না দেখিনি। রূপা তো আমাদের সাথেই ছিল। কক্ষে এল কখন? ‘

‘ ও শুয়ে আছে। মনে হয় শরীর খারাপ করেছে। তাই দেখার জন্য ডেকেছি তোমাকে। ‘

বলতে সোহিনি কক্ষে পা রাখলো। সাফায়াত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো। সোহিনী বিছানায় নজর দিতেই দেখলো অপরূপা বন্দুক ধরে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। শোয়ার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে তাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। একদম অস্বাভাবিক। তার ভয় করলো।
হঠাৎই চিৎকার দিয়ে উঠলো টেবিলের দিকে তাকিয়ে। সাফায়াত হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে বলল,

‘ কি হয়েছে? ‘

সোহিনী চেঁচিয়ে উঠে ছুটে গেল। শেহজাদের মাথা কোলে তুলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে ডাকলো,

‘ ভাইজান। আল্লাহ রক্ত ঝড়ছে। সবাইকে ডাকুন। ‘

সাফায়াতের পা থমকে গিয়েছে, মুখের কথা হারিয়েছে শেহজাদকে ওই অবস্থায় দেখে। সোহিনী শেহজাদের মুখ ধরে ডাকতে লাগলো,

‘ এই ভাইজান! উঠুন। হায় আল্লাহ!’

সাফায়াত ডাকে, সোহিনীর ক্রন্ধনে সকলেই এসে হাজির হলো কক্ষে। সায়রা ছুটে এসে শেহজাদকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,

‘ হায় আল্লাহ ভাইজানকে তো কিছু আগেই সুস্থ দেখলাম। কে এমন জুলুম করেছে আমার ভাইজানের সাথে? ভাইজান উঠুন। ‘

সিভান কেঁদেকেটে বলল,
‘ কে মেরেছে ভাইজানকে? ‘

অপরূপাকে ওই অবস্থায় দেখে সকলেই আরও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। তটিনী এসে তার মুখ ধরে ডাকাডাকি করলো। শবনম পানি নিয়ে এল। অপরূপার জ্ঞান ফেরেনা। এদিকে কাশীম আর কামীল এসে কাঠের চৌকিখাটে শেহজাদকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলো।
সবাই ধারণা করছে অপরূপার হাতের বন্দুক দ্বারা শেহজাদের মাথায় আঘাত করা হয়েছে। কিন্তু কেউ বুঝে উঠতে পারছেনা কেন অপরূপা শেহজাদকে আঘাত করতে যাবে। সকাল, দুপুরেও দুজনেই কেমন হাসিখুশি ছিল। সন্ধ্যায়ও তটিনী আর শেরহামের বিষয় নিয়ে দুজনেই হাসাহাসি করছিলো। সব ঠিক ছিল তাদের মধ্যে। তাহলে কি এমন হলো যার কারণে সে এভাবে আঘাত করে বসলো?

খোদেজা কান্নায় ভেঙে পড়ে কপালে হাত চেপে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে বসে আছেন। এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না অপরূপা শেহজাদকে আঘাত করেছে। যদি শেহজাদের বন্দি হওয়ার আগে এমন ঘটনা ঘটতো তাহলে বিশ্বাস করতে এতটা কষ্ট হতো না। তিনি তো নিজের চোখে দেখেছেন শেহজাদের অনুপস্থিতি তাকে কতটা পুড়িয়েছে। ভাইয়ের প্রেমিকা কথাটাকে মুছে দিয়ে কেমন দায়িত্ববান স্ত্রী হয়ে উঠেছিল সে। কত মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠছিলো তাদের মাঝে। তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো?
অপরূপার চেতন ফিরলো বহুকষ্টে, বহুক্ষণ পর। জ্ঞান ফেরার পরপরই সে ভালো করে কথা বলতে পারলো না। বালিশে মাথা ফেলে চোখ বুঁজে রাখলো। অথচ সবার কথা সে শুনতে পাচ্ছে। কান মাথায় একসাথে ঝিঁঝি শব্দে ভার হয়ে আছে। যেন পুরো পৃথিবীটা তার উপর ঘুরছে। পেটের ভেতর দলা পাকিয়ে আসছে কিছু একটা। গলার কাছে এসে আটকেও থাকলো। ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কেন হচ্ছে তা সে বুঝে উঠতে পারছেনা। তবে এটা বোধগম্য হচ্ছে তার দ্বারা কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে। প্রায় অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পর তার হঠাৎ মনে পড়লো শেহজাদকে। শেহজাদের হাসি হাসি মুখখানা মনে পড়ার পর সে একপ্রকার লাফ দিয়ে উঠে বসলো। সবাইকে তার কক্ষে দেখে প্রচন্ড বিস্ময়ে বলল,

‘ আপনারা আমার কক্ষে কেন? কি হয়েছে? ‘

সবার চাহনি তাকে ভীত করে তুলছে। সকলের চোখমুখ ফোলা, গোমড়ামুখ। শেহজাদ ফেরা অব্দি কেউ তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারবে না, এমনটা বলে গিয়েছে সাফায়াত তাই কেউ কিছু না বলে কক্ষ ত্যাগ করলো। অপরূপা বসে রইলো কক্ষে। হঠাৎ করে শরীরটা খারাপ লাগছে তার। বুকের কম্পন থামছেনা। শুলেও কাঁপছে, বসলেও কাঁপছে। সম্রাট কোথায় জিজ্ঞেস করেছে কেউ উত্তরটুকু দেয়নি। হঠাৎ টেবিলের পাশে মেঝেতে লাল রঙের কিছু দেখতে পেল সে। বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে হাত দিয়ে মুছতেই হাতে রক্ত লেগে গেল। কার রক্ত? একমুহূর্তও বিলম্ব না করে অস্থির হয়ে টলতে টলতে রসাইঘরের দিকে যেতেই শাহজাহান সাহেবকে দেখতে পেল। ডেকে বলল,

‘ আব্বাজান শুনুন। ‘

শাহজাহান সাহেব থামেন। মেয়েটা আব্বাজান ডাকলে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। কিন্তু কি হয়ে গেল আজ? উনি বিশ্বাস করবেন না অপরূপা জেনেশুনে শেহজাদকে আঘাত করতে পারে। শেহজাদ না ফেরা অব্দি শান্তি নেই। তিনি থামলেন। অপরূপা এসে মাথার একপাশ চেপে ধরে অন্য হাতে রক্ত দেখিয়ে বলে,

‘ মেঝেতে কার রক্ত? সম্রাটের কিছু হয়েছে? আপনারা লুকচ্ছেন আমার কাছ থেকে? ‘

‘ তুমি কিছুই জানোনা? ‘

অপরূপা দ্বিধাগ্রস্তের মতো তাকালো। সে কিছু জানবে কি করে? সে তো কুমু আপাকে খুঁজতে গিয়েছিল। আর তারপর কক্ষে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল হয়ত। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। নাহলে হুট করে শরীর খারাপ লাগবে কেন? মেঝেতে রক্তই বা কেন?

শাহজাহান সাহেবকে কিছু বলতে হলো না। সায়রা এসে বলল,

‘ ভাইজান হাসপাতালে। মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। তুমি ভাইজানকে আঘাত করেছিলে? কক্ষে তো আর কেউ ছিল না। তোমার হাতে বন্দুক ছিল। মিথ্যে বলবে না রূপা। ‘

অপরূপার কপালে সাথে সাথে কুঞ্চন ধরে গেল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বলল,

‘ আমি? আমি মারবো উনাকে? এটা তুমি ভাবলে কি করে? আমি কি এতদিনে কারো বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি এতটুকুও? এতবড় কথা কি করে বলতে পারো তুমি? ‘

‘ ভাইজান আসুক। সব পরিষ্কার হবে। বড় ভাইজান তো নেই মহলে যে তাকে সন্দেহ করব। ওই কক্ষে তুমিই ছিলে। ‘

অপরূপার দুচোখ জলে ভরে উঠলো। সে চোখ মুছে নিয়ে চড়া গলায় বলল,

‘ আবারও সাবধান করছি সায়রা। এমন কথা বলার আগে দুবার ভাবো অন্তত। আমি কল্পনাও করতে পারিনা সম্রাটকে আঘাত করবো। উনি তোমার ভাইজান হলে আমার স্বামী। আমি কেন উনার ক্ষতি চাইবো? আমি তো ঠিকেই আছি উনার জন্য। মরা থেকে বেঁচে ফিরেছি উনার জন্য। তাহলে কেন মারতে চাইবো? ‘

‘ বেশ। ভাইজান ফিরুক। আমাদের সন্দেহ ঠিক না বেঠিক বুঝা যাবে। ‘

শাহজাহান সাহেব বলল,

‘ সায়রা থামো। তোমার ভাইজানকে ফিরতে দাও। আগে দোয়া করো সে যেন সহিসালামতে ফিরে আসে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। ‘

অপরূপা কক্ষে ফিরে এল। তার হাতে রক্ত শুকিয়ে এসেছে। মাথাটা ঝিমঝিম করেই যাচ্ছে। সে বসে থাকতে পারলো না। শুয়ে পড়লো পুনরায়। সায়রার কথাগুলো যেন সব দুঃস্বপ্ন। সম্রাট এখনি আসবেন কক্ষে, হেসেমেতে তার সাথে মজা উড়াবে। ভাবতে ভাবতে ফের ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

ঘুম ভাঙলো ফুলকলির চেঁচামেচিতে। ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে। বুকটা ধড়ফড় করছে। গায়ে ঘাম দিয়েছে। ফুলকলি বলল,

‘ তোমার জামাইরে হাসপাতাল থেইক্যা আনছে। ‘

অপরূপা দ্রুতপায়ে বিছানা থেকে নেমে একপ্রকার ছুটতে ছুটতে হাজির হলো সদর কক্ষে। সকলেই তার দিকে তাকালো তখনি। শেহজাদ কেদারায় মাথা এলিয়ে বসে আছে চোখ বুঁজে। মাথায় পুরু ব্যান্ডেজ। চোখমুখ শুকনো হয়ে আছে। অপরূপা নিজেকে সংযত করলো। শেহজাদের নিকটে গিয়ে সাফায়াতকে বলল,

‘ কক্ষে নিয়ে যাই উনাকে? ‘

খোদেজা বলল,’ না। শেহজাদ বলুক কি হয়েছিল তখন। কে মেরেছে ওকে? কার এত বড় স্পর্ধা? ‘

সাফায়াত বলল,
‘ মামীমা ভাইজান অসুস্থ ভীষণ। কথা বলার অবস্থায় নেই। ডাক্তার ছাড়তে চাইলেন না। ভাইজান থাকতে চাচ্ছেন না তাই নিয়ে এসেছি। সকালে সব জবাবদিহি হবে। ‘

শাহানা বলল,
‘ বোকার মতো কথা বলছো তুমি সাফায়াত। জানতে হবে না কে তার ক্ষতি চায়? রূপা হলে ওই কক্ষে কি করে তাকে একা ছাড়বে? ‘

অপরূপা শেহজাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শেহজাদ চোখ খুলে তার দিকেই তাকিয়েছিল। অপরূপার চোখের কাতরতা তাকে প্রশ্ন করছে ‘ আপনি কি বিশ্বাস করেন আমি আপনাকে মেরেছি? ‘
শেহজাদ কেদারা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আমি কক্ষে যাচ্ছি। এখন কোনো কথা বলতে চাইনা। সবাই যে যার কাজে যান। ‘
অপরূপা ওর নিকটে এসে বলল,
‘ উনাদের বলুন সত্যিটা কি। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। উনারা বলছেন আমি নাকি আপনাকে আঘাত করেছি। অন্য কেউ আঘাত করবে এটাও অস্বাভাবিক। তাহলে সত্যিটা কি? ‘
‘ কিছু বলতে চাই না এখন। পথ ছাড়ো তুমি। ‘
অপরূপা ওর রুক্ষ ব্যবহারে কষ্ট পেল। বলল,
‘ কিন্তু আপনি কিছু না বললে সবাই ধরেই নেবে যে আমি আপনাকে আঘাত করেছি। আপনি যা বলবেন আমি তা-ই বিশ্বাস করে নেব। ‘
শেহজাদ বলল,
‘ তাহলে জেনে রাখো, তারা যা বলছে তা-ই সত্যি। তুমিই আঘাত করেছ আমাকে। কেন করেছ তার কারণ তুমিই ভালো জানো। ‘
খোদেজা বলে উঠলো,
‘ ওর স্পর্ধা দেখেছ সবাই? কত অবলীলায় মিথ্যে বলে চলেছে তখন থেকে। কেন তুমি ওকে আঘাত করেছ? উত্তর দাও। ‘
অপরূপা শেহজাদের দিকে চেয়ে আছে। শেহজাদ রুক্ষ স্বরে বলল,
‘ আম্মা আমি কোনো চেঁচামেচি শুনতে চাই না এই মুহূর্তে। রূপা কক্ষে যাও। ‘
‘ আমি সত্যি..
শেহজাদ উঁচুস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
‘ কক্ষে যেতে বলেছি। ‘
অপরূপা কক্ষে চলে গেল। শেহজাদ পুনরায় ধপাস করে কেদারায় মাথা এলিয়ে বসলো। সবটা এত অসহ্য লাগছে কেন? চারপাশটা এত অশান্ত। সে নিতে পারছেনা আর।

শেরহাম সদর দরজা পার হয়ে সবার দিকে চোখ বুলাতেই শেহজাদকে দেখে কপাল ভাঁজ করলো। আবার কি নাটক চলছে এখানে? এর মাথা ফাটলো কে? তটিনী তাকে দেখে শেরতাজ সাহেবের পেছনে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল। শেরহামের চোখ তার দিকে পড়তেই লাল হয়ে এল। তটিনী শুকনো ঢোক গিলে দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় পেছনে ফিরতেই শেরহাম একইভাবে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। আরও জোরে দৌড় দিল সে। জীবনেও এই লোকের সামনে পড়বে না সে। নাতিপুতির নানী না হয়ে সে মরতে চাই না।

________________

তটিনী শেরহামের খাবার বেড়ে ফুলকলিকে বলল, ‘ যাও দিয়ে এসো। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি ঘুম। খবরদার সত্যি কথা বলবে না। ‘

ফুলকলি খাবার নিয়ে ভয়ে ভয়ে শেরহামের কক্ষের দিকে যেতেই শেরহামকে বন্দুক, পিস্তল আর তলোয়ারের পাশে বসে থাকতে দেখে পুনরায় রসাইঘরে ফিরে এসে বলল,

‘ আল্লাহ’র ওয়াস্তে আমাকে ছাড়ো বাপু। আমার ভয় করে ওই মানুষকে দেখলে। এত এত অস্ত্র নিয়া বইসা আছে। হাত কাটছে তারপরও শান্তি নাই। কি ভয়ংকর লোক!’

তটিনী বলল,

‘ কেউ নিয়ে যাওনা। ঠিক সময় খাবার না পেলে আমার নাম ধরে চিল্লাচিল্লি করবে। সোহিনী নিয়ে যা দয়া করে। ‘

সোহিনী খাবার নিয়ে গেল। টেবিলের উপর থালা রেখে বলল,

‘ ভাইজান খেয়ে নিয়েন। আর কিছু প্রয়োজন হলে বলুন। ‘

‘ তনীকে ডাক। ‘

সোহিনী কিছু বলার সাহস করলো না। রসাইঘরে এসে তটিনীকে বলল, তোমাকে ডাকছে।

তটিনী সাথে সাথে রান্নাঘরের দক্ষিণের সিঁড়ির বেয়ে উঠে সেখানে বসে পা ঝুলিয়ে বলল

‘ আম্মা কিছু একটা করুন। আমি আজ মরে গেলেও ওই লোকের কাছে যাব না। মরে যাব তবুও যাব না। কসম। ‘

ফুলকলি বলল, ‘ ওখানে গিয়ে মরেন। কম কষ্টে মরবেন। ‘

‘ চুপ। একদম চুপ। তুমি খাবার দিতে গিয়ে ভয়ে চলে এসেছ। আর আমি রাত কাটাই বুঝেছ? ‘

শাহানা জিভে কামড় দিয়ে বলল,

‘ ছিঃ ছিঃ তুমি দিনদিন ছোট হচ্ছ? গুরুজনদের সামনে কি যা তা বলা শুরু করেছ তনী? তুমি কচি খুকি নও। ‘

তটিনী লজ্জিত হয়ে বলল,

‘ দুঃখীত আম্মা। মাফ করুন। আর বলব না। ‘

শাহানা মাথা নাড়তে নাড়তে ভাত বাড়তে লাগলেন। খোদেজা চুপচাপ বসে আছে। কোনো কথা বলছেন না।

____________

শেহজাদ দরজা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করতেই অপরূপা তার কাছে হেঁটে এল। শেহজাদ চোখ তুলতেই ওর ফোলা রক্তজবার ন্যায় চোখদুটো দেখলো। অপরূপা নিজেকে সামলে বলল,
‘ আপনি কি এই কক্ষে থাকবেন নাকি আমি থাকবো? ‘
‘ থাকতে পারো। আর নিশ্চয়ই আঘাত করবে না। ‘
বলেই ড্রয়ারের কাছে গিয়ে হাতের রূপোর ঘড়িটা খুলতে লাগলো।
অপরূপা রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
‘ কেন অপরাধীকে শাস্তি দিচ্ছেন না? কেন এত উদাসীন আপনি? যখন দোষারোপ করছেন তখন শাস্তিও দিন। আমি যার জন্য এই মহলে আছি সে আমাকে অবিশ্বাস করছে, আমি দম নিতে পারছিনা। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। চারপাশে আঁধার দেখছি। এত কষ্ট আগে কখনো হয়নি।
শেহজাদ ঘড়ি খোলা বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অপরূপা ওর পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা ঠেকিয়ে এবার চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলল,

‘ আপনি আমার সবচাইতে কাছের মানুষ। আপনি ছাড়া আমার এতটা আপন কেউ নেই। আপনি আমাকে সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করেন, ভালোবাসেন। আপনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। আমি শেষ হয়ে যাব। আমি আপনাকে আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসার চেষ্টা করে যাচ্ছি, আপনি আমাকে এতটা দূরে সরিয়ে দেবেন না। খোদার কসম করে বলছি আমি সজ্ঞানে আপনাকে আঘাত করার কথা ভাবতেও পারিনা সম্রাট। আপনি আমার একমাত্র আশ্রয় যেখানে আমি নিরাপদে থাকি। আপনার মৌনতা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। কিছু অন্তত বলুন। ‘

শেহজাদ ওর হাতদুটো নামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ কান্না বন্ধ করো। আর শুয়ে পড়ো। যাও। আমি তোমার কথা শুনবো। ‘

অপরূপা স্থির চেয়ে থেকে শান্ত হয়ে গেল। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো চুপচাপ। তার ফোঁপানির চোটে গা দুলতে লাগলো। গতকালকের রাতটাও তাদের মধুর কেটেছিল। সম্রাটের ভালোবাসায় সে ডুবে গিয়েছিল পুরোপুরি। আজকের রাতটা দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক। খোদা কেন তার সাথে প্রতিবার এমন করে? ভালোবেসে বাঁচতে চায় সে। তারপরও এমন হয় তার সাথে। এবার সে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে সম্রাটকে। তাহলে কি এটাও তার ভুল ছিল? ফোঁপানি কান্নায় রূপ নিল। শেহজাদ আলো নিভিয়ে পাশে শুয়েছে ততক্ষণে। পশ্চিমের পর্দাটা ঝুলিয়ে দেয়া হয়নি। জানালাও খোলা। চাঁদের কিরণ এসে ঘর আলোকিত করে বিধায় জ্যোৎস্না রাতে সে জানালা বন্ধ করেনা। অমাবস্যার সময় বন্ধ করে দেয়া হয়। আলো নিভিয়ে দিলেও ঘরটা মৃদুমন্দ আলোকিত।
অপরূপা নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা। পাশের মানুষটি এতটা শক্ত কেন? হায় মানুষ এত সহজে কি করে পরিবর্তন হয়ে যায়? কান্নার তোড়জোড় বাড়তে লাগলো আরও।
মাথার যন্ত্রণায় অপরূপাকে শান্ত করানোর কথা মাথা আসেনা শেহজাদের কিন্তু কোথাও একটা তীব্র কষ্ট হয়। বুকের একটাপাশ খিঁচে ধরে রাখে। অশান্ত লাগে, হাঁসফাঁস লাগে।
কোমর টেনে অপরূপাকে কাছে টেনে আনতেই অপরূপা তার স্পর্শ পেয়ে শান্ত হয়ে গেল।
কিন্তু পরক্ষণেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আরও উতলা হয়ে উঠলো মনটা। শেহজাদ তার সারামুখে অসংখ্য চুম্বন করে বলল, ঘুমাও চুপচাপ। আমাকে জ্বালাবে না আর। ‘
অপরূপা তার গলা ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ধারালো দাঁড়িতে ঠোঁট দাবিয়ে চুম্বন করে বলল,
‘ না না। আরও। ‘

________________

তটিনী যা ভেবেছিল তার কিছুই হয়নি। শেরহাম চেঁচিয়ে তাকে ডাকেনি। সে মহাখুশি। সায়রাদের সাথে থাকবে সে। পাশাপাশি তিনটা চৌকি পাশাপাশি লাগিয়ে তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা। সকলেই কথা বলছিল শেহজাদকে নিয়ে। শেরহামের কথা প্রায় মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে তার। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো ঠিক তখনি শাহানা এসে বলল,
‘ শেরহাম খেয়েছে? খেলে থালাবাসনগুলো কেউ নিয়ে আসোনি কেন? ‘
সোহিনী বলল,
‘ ভাইজান আমাকে বকবে। তনী আপুকে যেতে বলেছিল। ‘
তটিনী বলল,
‘ অসম্ভব। আমি যাব না। ‘
শাহানা বলল,
‘ ওকে তো অতিথিশালার দিকে যেতে দেখেছি। তনী যাও নিয়ে এসো। দিনদিন ফাঁকিবাজ হচ্ছ। ‘
শেরহাম নেই যেতে তো সমস্যা নেই। তটিনী মহাবিরক্ত হয়ে দ্রুতপায়ে কক্ষে চলে গেল। দেখলো বাসনে চামচ পড়ে রয়েছে। চার ভাগের একভাগও খায়নি শেরহাম। না খেলে না খাক। ভাত না গিললে কি হবে ছাঁইপাশ সব খায় ওই লোক। ফালতু চিন্তা করার সময় নেই। কিন্তু এতগুলো ভাত নষ্ট করলো শয়তানটা। তটিনী মনে মনে গালাগালি করলো। থালাবাসন সব নিয়ে চলে আসার সময় ধপ করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। থালাবাসন টেবিলে পুনরায় রেখে দিয়ে দু তিন পা পিছু হেঁটে শেরহামের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। শেরহাম কোনো কথা বললো না। তার মুখ গম্ভীর। মেজাজ খারাপ। সামাদের উপর খেপেছে ভীষণ। গালাগালি করে এসেছে। তটিনী কথা খুঁজে পেল না। শেরহাম গায়ের পোশাক খুললো। তটিনী চোখ সরিয়ে নিল। বেয়াদব লোক। ছোট বোনের সামনে জামা খুলে ফেলছে। তার চোখের যেনা হচ্ছে। ছিহ। শেরহামের চোয়াল শক্ত। আলমিরা হতে পোশাক বের করে গায়ে পোশাক জড়ালো। তারপর দেয়ালের কোণায় গাঁথা তলোয়ারের খাপ হাতে নিয়ে তা হতে তলোয়ার বের করে তটিনীর দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো। তটিনীর বুক ধড়ফড় করে উঠলো। গলা শুকিয়ে এল। ঠোঁট শুকিয়ে চৌচির।
শেরহাম হারিকেনের আলো বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে দিল। হারিকেনের আলোয় বিছানায় বসে ধারালো চকচক করতে থাকা দুটো তলোয়ার একটা অপরটার সাথে ঘষাঘষি করতে লাগলো। তটিনী ভয়ে ভয়ে এগোলো। দরজা খুলে একছুটে পালাবে সে। কিন্তু তার আগেই শেরহাম এসে খ্যাঁচ শব্দে তলোয়ার তুলে আক্রমণ করে বসতেই তটিনী এসে জাপটে ধরলো ওর গলা। হু হু করে ফুঁপিয়ে উঠে বলল,

‘ আর কখনো মারবো না বললাম তো ভাই।’

শেরহামের কি হলো কে জানে। রুক্ষ মেজাজেও হাসি পেল তার। তটিনী গলা জড়িয়ে তার ঘাড়ে নাক ঠেকিয়ে নাক টানছে। শেরহাম তলোয়ার ফেলে দু’হাতে তার শরীরটা আগলে ধরতেই তটিনীও আরও শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরলো। কাছে এলেই সে ভুলে যায় কার কাছে এসেছে সে। ঘোরের মাঝে খেয়ালই ছিল না কিভাবে তার পিঠটা এসে বিছানায় ঠেকেছে। পিটপিট করে চোখ খুলতেই মুখের উপরে আরও একটা মুখের অবস্থান লক্ষ করলো সে। তার তপ্ত নিঃশ্বাস পুড়িয়ে দিচ্ছে তার শরীর। বলিষ্ঠ হাতজোড়া তার উদর উন্মুক্ত করে সেখানটাতে দুহাত চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতেই তটিনী চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিল। পুরুষালী ঠোঁটজোড়ার বলিষ্ঠ চুম্বন তার ঘাড় গলা ভিজিয়ে দিয়ে ঠোঁট দখলে নিয়ে দংশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে