প্রিয় বেগম পর্ব-০৮

0
1388

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_৮
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

(নায়কের নামটা একটা প্রাসঙ্গিক কারণে চেঞ্জ করা হয়েছে, কেন তা ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন)

তটিনী, শবনম আর আয়শা শেহজাদের ফুপুর মেয়ে। ওদের মধ্যে তটিনী সবার বড়। শবনম মেঝ আর আয়শা সবার ছোট। সাফায়াত তাদের বড় ভাই। বেশিরভাগ সময় তারা সুলতান মহলে থাকে। সুলতান মহলের একচ্ছত্র অধিকার শেরতাজ সাহেব এবং শাহজাহান সাহেবের পাশাপাশি তাদের বোন শাহানার নামে। যদিও শ্বশুরবাড়িতে বসতভিটা স্থাপন করেছেন কিন্তু উনার স্বামী দূরপ্রবাসে থাকায় তিনকন্যা নিয়ে একা থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সন্তানদের নিয়ে তিনি সুলতান মহলেই থাকেন। মাঝেমধ্যে স্বামীগৃহে যান ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘুরতে।

এবার ভাইবোন সবাই মিলে পরিকল্পনা করে যাত্রাপালা দেখতে এসেছে। যদিও শেরতাজ সাহেবের ঘোর আপত্তি মেয়েদের পালা দেখতে যাওয়া নিয়ে কিন্তু শাহানার কন্যারা আধুনিকা মনা হওয়ায় মামুর কথায় তারা তেমন কর্ণপাত করেনা।

ঘোড়ার টগবগিয়ে ছুটে চলা দেখে অপরূপা আর সুভা গাড়িতে বসা অবস্থায় মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখলো কি সুন্দর টগবগ করে ছুটছে ঘোড়াগুলো!
অপরূপার খুব ইচ্ছে একদিন ঘোড়ার পিঠে চড়ে সে ছুটবে দেশ থেকে দেশান্তর। পাশে আরও একটি ঘোড়ার পিঠে থাকবে তার এক যোদ্ধা। রূপকথার রাজপুত্তুর ঠিক যেমন ঠিক তেমন একটা রাজপুত্তুর।

তার ঘোর কেটে গেল শবনমের প্রশ্নে,

তুমি তো তোমার বাড়ি যেতে বললে না রূপা।

অপরূপা শবনমের কথায় লজ্জা পেল। সংকুচিত গলায় বলল,

সুভার পাশেই আমাদের বাড়ি।

সুভার হাতটা সে চেপে ধরে রাখলো সত্যি সত্যি বাড়ির কথা বলে না দেয়ার জন্য। এত বড় বড় মানুষ তার বাড়িতে গেলে চাচী তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলবে? না। এতে রূপা অপমানিত হবে বরঞ্চ। বিশ্বাস নেই যদি সবাই মিলে হঠাৎ করে উপস্থিত হয়? দাদীজানকেই বা সে কি উত্তর দেবে?

সুভা ফট করে বলে উঠলো,

আমার বাড়িতে গেলে আমি আপনাদেরকে ওদের বাড়িতেও নিয়ে যাব। আচ্ছা আপনারা সত্যি যাবেন তো?

সুভার প্রশ্নে সবাই হাসতে লাগলো। সুভা ওদের কাছে উত্তর না পেয়ে শেহজাদকে জিজ্ঞেস করলো,

সাহেব সত্যি যাবেন তো? আমার মা কাকীরা সত্যি খুব খুশি হবে।

শেহজাদ আশ্বাস দিয়ে বলল,

যাব কোনো একসময়।

সুভা খুশিতে আটকানা হয়ে দু হাত উল্লাস করতেই অপরূপা তার হাত নামিয়ে বলল,

কি করছিস? এমন কেউ করে?

সুভা ওকে গুঁতো দিয়ে বলল,

তুই বোবা বলে আমাকেও বোবা সেজে বসে থাকতে হবে বুঝি?

তটিনী বলল,

রূপা তুমিও সুভার মতো কথা বলো। বলো তো দেখি তোমার বাড়িতে কে কে আছে?

দাদীজান আর ছোট চাচা, ছোট চাচী। চাচীর দুটো ছেলে।

আর কেউ নেই? তোমার মা বাবা?

অপরূপা চুপ হয়ে গেল। সুভা বলল,

ওর বাবা তো অনেক আগেই মারা গেছেন। ওর মা অন্যকোথাও থাকে।

অপরূপার চোখজোড়া দেখে সুভা আর কিছু বলল না। তটিনী বলল,

দুঃখীত রূপা। কষ্ট পেওনা।

না। পাইনি। মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করাটা স্বাভাবিক।

সাফায়াত বলে উঠলো,

তোমাদের দু’জনকে আমাদের মহলে আমন্ত্রণ দিলে যাবে?

সুভা খুশি হয়ে হেসে বলল,

দাওয়াত দিয়েছেন এটাই তো অনেক সাহেব। যদি কখনো রূপনগরে যাই সুলতান মহলে যাবই।

সুভা ফের সবাইকে উদ্দেশ্য প্রশ্ন করলো,

আচ্ছা এখানে সাহেবদের কার বউ কোনটা?

তার প্রশ্ন শুনে ভ্যাঁবাছ্যাকা খেল সবাই। শেহজাদ মৃদু শব্দ করে হেসে উঠলো। হো হো করে হেসে উঠে সাফায়াত বলল,

ওরা তিনজনই আমার বোন।

আর উনার?

শেহজাদকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করতেই তটিনী কিছু বলে উঠার আগেই শেহজাদের কথায় থেমে গেল।

ওরাও আমার বোন। ফুপাতো বোন।

সুভা নখে কামড় দিল লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে।

অপরূপা তার কান্ড দেখে মিটমিট করে হাসলো। তটিনী খেয়াল করলো মেয়েটা হাসলে তার আঁখিজোড়াও হাসে।

রাস্তার দু’পাশের নির্জন বনঝাড়ের নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে জিপটি ছুটে চললো গন্তব্যে। মাথার উপর মস্ত বড় চাঁদটিও যেন তাল মিলিয়ে ছুটছে তাদের সাথে। হেসেমেতে যাত্রাপালার কাছাকাছি পৌঁছুতেই তাদের গাড়ি থেমে গেল। টগবগিয়ে ছুটে চলা ঘোড়াগুলোও হ্রষধ্বনিতে মেতে উঠে থেমে গেল। দূরে কোথাও বাদ্যযন্ত্র বাজছে আর রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন হচ্ছে। অপরূপা দেখলো প্রকান্ড মাঠটা আলোকবাতিতে জ্বলজ্বল করছে। সাথে কত লোক সমাগম। ছোটাছুটি করছে। মঞ্চে গান পরিবেশন হচ্ছে এখনো। লোকজনে পরিপূর্ণ কি সুন্দর চারপাশটা! যেন মেলা বসেছে। অপরূপার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। পায়ের ব্যাথা অল্পসময়ের জন্য ভুলে গেল যেন।

ঘোড়ার গাড়ি থেকে পরপর নেমে এল মঞ্চের শিল্পীগুলো। তারপর পা বাড়ালো মঞ্চের দিকে। শেহজাদ আর সাফায়াত গাড়ি থেকে নামামাত্রই ঘিরে ধরলো লোকজন। হাতে হাত বুকে বুক মিলিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে একজন পাগড়িওয়ালা লোক এগিয়ে এসে বলল,

ডিরেক্টর সাহেব মহল থেকে আর কারা এসেছেন?

শেহজাদ তটিনীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। অপরূপা আর সুভার কথা জানতে চাইলে বলল তারা আমাদের পরিচিত ছিল না তবে পথে পরিচিত হয়েছে। অপরূপাকে ইঙ্গিত করে বলল, উনি পায়ে আঘাত পেয়েছেন। কক্ষে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে ভালো হয়। আমাদের ডাক্তার সাহেবকে ওই কক্ষে পাঠিয়ে দিন।

পাগড়িওয়ালা পানের লাল পিচকিরি ফেলে বলল

হ্যা হ্যা অবশ্যই।

কথা বলা শেষ করে শেহজাদ অপরূপার দিকে চেয়ে বলল,

ওদের সাথে যান । ডাক্তার সাহেব যাবেন। পা দেখাবেন। আমি ব্যস্ত থাকব তাই মনে নাও থাকতে পারে সেই কারণে আগেভাগে বলে দেওয়া।

অপরূপা কৃতজ্ঞতা সহকারে মাথা দুলিয়ে বলল,

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বাড়িতে পৌঁছে গরম পানি ঢেলে দিলে বোধহয় আরাম লাগবে। এতকিছুর প্রয়োজন পড়তো না।

গরম পানিতে সব ব্যাথা উপশম হয় না। আপনি ডাক্তার হলে বিশ্বাস করতাম। যান।

এই যাহ ভালো কথার মধ্যে একটা ত্যাড়া কথাও বলে দিল লোকটা। অপরূপা সুভার হাতের ভাঁজে হাতের ভর রেখে কোনোমতে কষ্টেসৃষ্টে হেঁটে গেল মঞ্চের পেছনের ভবনটিতে। সুভা বলল

ভালোই হয়েছে বল। নইলে কি এসব দেখতে পেতাম?

অপরূপা থেমে থেমে ভবনটির দিকে তাকালো। ভবনটির আগাগোড়া লালনীল বাতি দিয়ে সাজানো।শিল্পীরা তাদের নিজ নিজ কক্ষে চলে যেতেই শবনম পিছু ফিরে বলল

এই তোমরা আসো না। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমরা পালা শুরু হলেই যাব। ততক্ষণ এখানে আরাম করব।

অপরূপা বলল,

আমাদের নিয়ে শুধু শুধু ঝামেলা করছেন।

আয়শা বলল,

এটা কোনো কথা হলো? গল্প করতে করতে আমরা কত পরিচিত হয়ে গিয়েছি। আর পরিচিত একজন মানুষ আহত হয়েছে আমরা তাকে সাহায্য করব না? এসো। এ নতুন নয়। রূপনগরবাসীরা কিন্তু এমনি। এখানকার মানুষ কি মিশতে পছন্দ করে না নাকি?

অপরূপা বলল,

না না এমনটা না। আচ্ছা ঠিক আছে। আপনারা যা বলবেন তাই হবে।

তটিনীদের সাথে অপরূপা আর সুভা একটি সুশোভিত কক্ষে চলে গেল। সেখানে সুসজ্জিত শয়নাবস্থা করা আছে। হাতমুখ ধুঁয়ে নিল সবাই মিলে। অপরূপা বসে আছে। তটিনী বলল

এই মেয়ে। এখুনি মুখ খোলো। এখানে কিন্তু ভাইজানরা কেউ নেই।

অপরূপা নিকাব খুলতে যাবে ঠিক তখনি এক পৌঢ় ডাক্তার এসে হাজির হলেন। বললেন

রূপা আর সুভা নামক রোগীদের দেখতে এসেছি। আমি কি সঠিক কক্ষে এসেছি?

সুভা বলে উঠলো,

হ্যা হ্যা এই কক্ষে।

ডাক্তার এসে বসলেন। সুন্দরী রমণীদের দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন,

কে রূপা আর সুভা?

সুভা বলল,

আমি সুভা ও রূপা। আমি হাতে আঘাত পেয়েছি। ও পায়ে। এই দেখুন ওর পা।

ডাক্তার ছিলে যাওয়া অংশে তরল ঔষধি মাখিয়ে দিতে যেই নেবে ঠিক তখনি অপরূপা পা গুটিয়ে নিয়ে বলল

একি! না না আপনি আমার পা ছুঁবেন না। আপনি আমার বাবার বয়সী।

পৌঢ় ডাক্তার বিষম খেয়ে বাকিদের দিকে চোখ ঘুলিয়ে তাকালো। বাকিরা তখন হাসছে।

ডাক্তার তার পা টেনে গভীর পর্যবেক্ষণ করে বলল,

তোমার পা মচকে গিয়েছে। তুমি ভালোই ধৈর্যশালী নারী। এমন ব্যাথা নিয়ে এতক্ষণ কিভাবে চুপ করে আছ?

অপরূপার মনে হলো, বুড়ে ডাক্তার বেশি কথা বলছে।

ঠিক তখনি ডাক্তার অপরূপার পা ধরে মালিশ করতে করতে দিল এক মোচড় দিল, সাথে সাথে অপরূপার চিৎকারে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠলো পুরো কক্ষ । ব্যাথায় যন্ত্রণায় চোখ ফুঁড়ে জল নেমে গেল অপরূপার।

কক্ষের দরজা নড়ে উঠলো তখন। শেহজাদ উঁকি দিয়ে বলল

কে চিৎকার দিল?

তটিনী বলল

রূপা। ওর পা নাকি মচকে গিয়েছিল। এখন সব ঠিকঠাক।

শেহজাদ একঝলক অপরূপার দিকে তাকিয়ে দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল।

সুভা ছিলে যাওয়া অংশে একটা বাদামী রঙের ঔষধ লাগিয়ে দিল ডাক্তার। তারপর রূপাকে কিছু খাওয়ার ঔষধ দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে সাফায়াত এসে বলল

পালা শুরু হচ্ছে। তোমরা এসো। রূপা তোমার পায়ের অবস্থা কেমন?

রূপা মাথা ঝুঁকে বলল,

জ্বি ঠিক আছি।

ঠিক আছে। তটিনী সবাইকে নিয়ে সবাই চলে এসো।

সাফায়াত যেতেই শবনম অপরূপার নিকাব তুলে দিতে দিতে বলল,

আরেহ বাবা মুখ না দেখালে যদি কখনো কোথাও দেখা হয় চিনবো কি করে?

নিকাব তুলে দেয়ার সাথে লজ্জা পেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে দু-হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো অপরূপা।

সবাই সমস্বরে দেখে ফেলেছি, দেখে ফেলেছি বলে হেসে উঠতেই শেহজাদ দরজা ঠেলে ঢুকলো।

কোথায় তোমরা? এত দেরী করছো কেন?

অপরূপা তার গলার স্বর শুনে সাথে সাথে পিঠ করে বসে নিকাব তুলতে লাগলো তড়িঘড়ি করে। তার মুখমন্ডলের একপাশ প্রতিভিম্বে স্পষ্ট ফুটে উঠলো।

শেহজাদ কিছু মুহূর্তের জন্য থমকালেও দ্রুত প্রস্থান করলো কক্ষ থেকে। বাকিরা হি হি করে হেসে উঠল বলল,

পাগল মেয়ে। তোমাকে আয়নায় দেখা যাচ্ছিলো।

অপরূপা ভূত দেখার মতো চমকে তাকালো তাদের দিকে। সবাই অট্রহাসিতে ফেটে পড়ে বলল,

কোনো সমস্যা নেই। উনি তোমার ভাইজানের মতো।

অপরূপা মিইয়ে যাওয়া গলায় মিনমিন করে বলল,

জ্বি।

সে নিজেও জানে মানুষগুলো খুব ভালো। তারপরও কেমন অবর্ণনীয় অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে আছে মনপঞ্জর।

অতিথিদের বসার জন্য আলাদা আসন বসানো হয়েছে। রূপা আর সুভা তাদের পেছনে গিয়ে বসলো। তটিনী অনেক ডেকেছে রূপা যায়নি। তারা এখানে ঠিক আছে। পালা শুরু হওয়ার সাথে সাথে সাফায়াত আর শেহজাদ মঞ্চের পেছন থেকে বেরিয়ে এল। ব্যস্তপায়ে হেঁটে এসে তটিনীদের পাশের সারিতে গিয়ে বসলো। যেখানে বসলো ঠিক সেখান থেকে অপরূপাকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। চোখাচোখি হওয়ায় অপরূপা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মঞ্চে চোখ রাখলো। শেহজাদ নিজেই সেখান থেকে সরে বসলো। এত বাচ্চা একটা মেয়ের সামনে এত জড়িমায় নিজেকে নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে সে।

পালা শেষ হতে হতে লোকজন হৈহৈ করে উঠে সন্তোষী ধ্বনিতে মাতিয়ে তুললো। প্রকান্ড মাঠজুড়ে সবার উল্লাস সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। লোকেমুখে শিল্পী আর পরিচালকের নাম নিয়ে যশোগান প্রচার হলো। নানান রকম বাদ্যযন্ত্র, বাঁশির আওয়াজের মুখরিত হলো সমগ্র প্রাঙ্গন।

অপরূপা আর সুভা একপাশে এসে দাঁড়ালো। লোকজন দলে দলে বিভক্ত হয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুভা বলল

উনাদের আর দেখতে পাচ্ছি নে কেন?

রূপা বলল,

আশ্চর্য! তুই কি উনাদের সাথে যাবি নাকি? আমার কাছে পয়সা আছে। অনেকেই গাড়িতে করে যাবে। চল রাস্তায় গিয়ে উঠি।

তোর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।

হচ্ছে কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে? চল।

তারা পা বাড়িয়েছে তখুনি রহিম চাচার মুখোমুখি হলো। রহিম মিয়া কড়া মেজাজ দেখিয়ে বলল

কই আছিলি তোরা? খুইজতে খুইজতে পাগল হইয়্যা গেলাম। তোগো কিছু হইলে তোর দাদী আমার আস্ত রাখবো? চল।

পরক্ষণে খুঁড়িয়ে হাঁটা অপরূপাকে খেয়াল করে বলল

পায়ে কিতা হইছে?

ব্যাথা পেয়েছি চাচা। তেমন কিছু না। চলো। দাদী পয়সা দিয়েছিল। একটা ভ্যান ডেকে নাও। বেশিদূর হাঁটতে পারব না।

অপরূপার পাশের বাড়ির চাচা রহিম মিয়া। মেয়েটাকে সে বড়ই স্নেহ করে। তার সন্তানহীনা স্ত্রী কুমুও অপরূপাকে স্নেহ করে। এইতো কদিন হলো অপরূপার কাছ থেকে সে কোরআন পাঠ করা শিখেছে। এখন ভালোই পড়তে পারে। সন্ধ্যাবেলায় হাদিস শুনতে যায়। মনদিল ঠান্ডা হয়ে যায়। আর মনে মনে ইচ্ছে পোষণ করে অপুর মতো একটা কন্যা যেন তার কোলে আসে।

রাস্তায় ভ্যানগাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। সব মানুষদের দখলে। একটা ভ্যানে গাদাগাদি করে বসে সবাই যাত্রা করছে। অপরূপা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বলল,

পা ব্যাথা হয়ে গেল সুভু।

সুভা বিরক্তি গলায় বলল,

সাহেবদের কিছু বলে আসিনাই। উনারা কিছু মনে করবে না?

অপরূপা চুপ হয়ে গেল। তাই তো এটা তো সে ভেবে দেখেনি।

শেহজাদ আর সাফয়াতকে সে দূর থেকে দেখেছে। তারা আলোকচিত্র গ্রহণের যন্ত্রগুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অন্য কোনোদিকে নজর দেয়ার নজির নেই।
মানবিকতার কাতিরে মানুষগুলো তাদের সাহায্য করেছে এ ঋণ সে কোনেদিন শোধ করতে পারবে না।

সুভা গলায় অনুযোগ মিশিয়ে বলল,

বলবে মেয়েগুলো কেমন?

অপরূপা বলল,

এরকম ভাবছিস কেন? উনাদের সাহায্য চিরকাল মনে থাকবে। তুই উল্টাপাল্টা ভাবছিস। উনারা কিছু মনে করবেন না। আচ্ছা তুই যাহ। যদি দেখিস উনারা ওখানে আছেন তাহলে বলে আয় যে আমরা চলে যাচ্ছি।

রহিম মিয়া ধমক দিয়ে বলল,

এই কোত্থাও যাইলে আমি একা একা চলি যাইবাম কইয়া দিলাম।

সুভা বলল,

যাচ্ছি না বাপু।

প্রায় বিশ পনের মিনিট পর একটা চার চাকার গাড়ি এসে থামলো তাদের সামনে। চালক গলা বাড়িয়ে বলল,

কই যাইবা?

রহিম মিয়া বলল,

ফুলবাড়ি। যাইবা?

হ। যামু। একজন পাঁচ পয়সা করে দেওন লাগবো।

সুভা বলল,

তিনজন দশ পয়সা দেব। অত টাকা নাই।

আইচ্ছা উঠি পড়ো।

তারা গাড়িতে উঠে বসলো। গাড় চলতে শুরু করলে জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতের মধ্যিখান দিয়ে বয়ে চলা সরু রাস্তা দিয়ে।

গাড়িতে চলতে শুরু করলে সুভা অপরূপাকে ফিসফিস করে বলল,

সাহেবটারে আমার ভালা লাগছে।

অপরূপা পিলে চমকে উঠে বলল,

কোনটা?

ওই কালো কোট পড়ছে উনি। দুগ্গা মা আমার জন্য এমন একটা রাজপুত্তুর ছুঁইড়া ফালাও।

অপরূপা ফিক করে হেসে উঠে বলল,

স্কুলের বুড়ো মাস্টারকেও তুই ছাড় দিসনি। এখন আবার সুলতান মহলের সম্রাটকে।

বলেই হেসে উঠলো সে। সুভাও হাসলো।

তন্মধ্যে রহিম মিয়া খেঁকিয়ে উঠে বলল,

এই হালা। গাড়ি হুনদিকে নিয়া যাস? আমাগো বাড়ির পথ তো ওইদিকা। জঙ্গলের ভিতুর গাড়ি ঢুকাস ক্যান?

চালক কোনো কথা বললো না। গাড়ির গতি বাড়িয়ে লুঙ্গির গোছ থেকে ধারালো চাকু বের করে বলল,

চুপচাপ গাড়ি থেমে নেমে পড়। শব্দ করলে মারা পড়বি।

অপরূপা আর সুভা আঁতকে উঠলো।
রহিম মিয়া চেঁচিয়ে উঠতে যাবে ঠিক তখনি রুমাল বের করে তার নাকে চেপে দিয়ে এক লাতিতে তাকে ফেলে জঙ্গলের পথে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেললো গাড়ির চালক।

অপরূপা গলা চড়িয়ে বলল,

এই কে আপনি? গাড়ি থামান বলছি। সুভা লোকটার চুল ধরে ধুমধাম দিয়ে বসলো।

লোকটা গাড়ি থামিয়ে দিতেই অপরূপা আর সুভা চট করে লাফ দিয়ে ছুটলো দিকবিদিক না তাকিয়ে। নিকাব তুলে অপরূপা ঘনঘন দম ফেললো। সুভা ভয়ে কেঁদেই দিল। অপরূপা বলল

রাস্তায় উঠতে হবে আমাদের। কাঁদার সময় না এটা সুভু। দৌড়া।

পেছনে দানবটির পদধ্বনি ভেসে আসছে। ভয়ে অপরূপার গলা শুকিয়ে এসেছে। সে আর দম নিতে পারছে না। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। পা টা চলছে না। মড়মড় শব্দ করছে কোথাও। দমবন্ধ হয়ে আসছে।

মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সুভা। অপরূপা কিছুদূর গিয়ে মুুখ থুবড়ে পড়তেই দেখলো পেছনে সুভা নেই। সুভার গগনবিদারী চিৎকার ভেসে আসছে। অপরূপা চোখে ঝাপসা দেখলো। চেঁচিয়ে উঠে ডাকলো,

হে খোদা! তুই কোথায় সুভা?

সুভা ডাকলো

এখানে। আমাকে নিয়ে যা। ভয় করছে আমার।

সাথেই সাথেই মুখ চেপে ধরায় তার গোঙানির শব্দ শোনা গেল। অপরূপা বহুকষ্টে দাঁড়িয়ে সেই পথে পুনরায় ছুটে যেতেই তার পেছনে টর্চ হাতে একটা লোক এগিয়ে এল। বলল,

কে?

অপরূপা চমকে উঠে ফিরলো। চোখের উপর টর্চের আলো পড়ায় শেষ আশাটুকু নিভে যাওয়ায় সে কেঁদে উঠে প্রচন্ড ভয়াতুর গলায় বলল,

কেন এমন করছেন আমাদের সাথে? সুভুকে ছেড়ে দিন। কে আপনারা?

তার মুখ থেকে টর্চের আলো সরে গেল ধীরেধীরে। ব্যাক্তিটি বলে উঠলো,

আমি রহমান। ভয় পাবেন না।

লোকটা এগিয়ে এল টর্চ হাতে। অপরূপা পিছিয়ে গিয়ে বলল,

কে আপনি? ডাকাত? চোর? কে?

আমি মানুষ। আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে