#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_৭
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
রাস্তায় উঠতেই একটা ভ্যানগাড়িকে পাশ দিয়ে যেতে দেখা গেল। সুভা চালককে চিনতে পেরে ডাক দিল।
এই রাজু ভাই। একটু দাঁড়াও।
রাজু দাঁড়ালো। সেলোয়ার-কামিজ পড়া আর বোরকা পরিহিত মেয়েটাকে চিনতে তার দেরী হলো না। রোজ সে দু’জনকে স্কুলে যেতে দেখতো। বোরকা মেয়েটা আমজাদ তৈমুরের মেয়ে। তার চোখদুটো দেখা ছাড়া কোনোদিন চেহারা দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। সে ভ্যানগাড়ি নিয়ে এগিয়ে আসে। বলে
কই যাইবা? পালা দেখতে যাইবা?
সুভা মাথা। উৎফুল্লচিত্তে বলে
আমারে আর অপুরে একটু নিয়া যাও। কাল পয়সা দিয়া দিবো। নিয়া যাও না গো।
সে কি যাইতে রাজী হইবো?
অপরূপা রাজুর নেশাগ্রস্ত চোখ দেখে ভড়কে গিয়ে সুভার হাত চেপে ধরে।
আমার ভয় করে সুভু।
সুভা অভয় দিয়ে বলে,
কিছু হবে না। হেঁটে যেতে যেতে পালা শুরু হয়ে যাবে। চল।
অপরূপার হাত ধরে সে টেনে নিয়ে যায়। ভ্যানগাড়ির উপর চেপে বসে। আকাশে তারার মেলা আর ঝোপঝাড়ে জোনাকিপোকার কিলবিলানি দেখতে দেখতে দুই বান্ধবী খিলখিল করে হাসে। রাজু খেই হারায়। কিছু আগেই দুই বোতল ঢকঢক করে গিলেছে সে। সুভা আর অপরূপা খেয়াল করে ভ্যানগাড়িটা এলোমেলো চলছে। কিছুক্ষণ এদিক, কিছুক্ষণ ওদিক। তারা চিৎকার করে উঠতে যাবে তার আগেই ভ্যানগাড়িটা বিলের মধ্যে পড়ে যায়। সুভা অপরূপার হাত ধরে লাফ দিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যায়।
রাজু গাড়িসহিত বিলের মধ্যে গিয়ে পড়ে। এমন বিকট শব্দ শুনে হুড়মুড় করে এসে থামে কয়েকটা জিপ গাড়ি। তার পেছনে একের পর এক সারি সারি মোট ছয়টা ঘোড়ার গাড়ি
জিপ থেকে ধুপধাপ নেমে আসে কয়েকটা লোক আর মহিলা। পদধ্বনির শব্দে নুপুরের শব্দ পাওয়া যায়।
অপরূপা আর সুভা কাত হয়ে পড়ে থাকে। আর্তনাদ করে। মনে হলো হাঁড়গুড় ভেঙে গেল। টর্চ হাতে দু তিনজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখে সুভা ধীরেধীরে উঠে বসলো। অপরূপা ওভাবেই পড়ে রইলো। সুভা ওমাগো বাবাগো বলে রাজুকে যে-ই গালাগালি করে উঠলো ঠিক তখনি টর্চলাইট হাতে তার সামনে এসে উপস্থিত হলো এক আগন্তুক। সুভা কখনো এই গ্রামে এমন পুরুষমানুষ দেখেনি। দেখো মনে হচ্ছে কোনো রাজপুত্তুর। সাদা রাজকীয় পাঞ্জাবির উপর হাতা কাটা কালো কোর্ট।
রাশভারি গলায় বলে উঠলো,
মুখের ভাষা তো মাশাল্লাহ!
সুভা লজ্জা পেয়ে গুটিয়ে গেল। লোকটা অপরূপার দিকে টর্চ মারলো। অপরূপা মুখটা নিকাবে ঢাকা। বড়ই ব্যাথাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো সে আগন্তুক লোকটার দিকে। লোকটা হাত বাড়িয়ে দিল।
অপরূপা হাত ধরলো না। লোকটার পিঙ্গলবর্ণ চোখজোড়ায় চোখ পড়তেই লজ্জায়, আড়ষ্টতায়, সংকোচে কুঁকড়ে গেল সে। হৃদস্পনন্দন বেড়ে গেল অচিরাৎ। লোকটা তার চাউনি দেখে কিছুক্ষণ নীরব থেকে কপাল ভাঁজ করলো। একটা অল্পবয়সী এমন জেদ দেখাবে তা বিলক্ষণেও ভাবতে পারেননি তিনি । অপরূপার হাতটা খপ করে ধরলো। টেনে তুলতে তুলতে বলল
কি অদ্ভুত! এসব বাচ্চা মেয়েদেরকে তাদের অভিভাবক রাতবিরেতে ছাড়ে কেন?
দাঁড় করিয়ে দিয়ে অপরূপার হাত ছেড়ে দিল সে। তারপর পায়ে হেঁটে গাড়ির কাছে চলে গেল। অপরূপা ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারলো না। পেছন থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো
এই মেয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছ নাকি?
অপরূপা পায়ের গোড়ালি তুলে তাকালো।
মাথা নাড়লো।
তটিনী, শবনম, আয়শা নামের তিনজন মেয়েকে দেখে সুভা কৌতূহল দেখিয়ে প্রশ্ন করলো
আপনারা কারা? এতগুলো ঘোড়ার গাড়ি! বাবাহগো এ জন্মে দেখিনি।
গাড়ির কাছে হেঁটে যাওয়া লোকটাকে দেখে সুভা আঙুল তাক করলো।
উনি কে?
মেয়েগুলোর পাশের লোকটা বলে উঠলো,
উনি রূপনগরের সম্রাট শেহজাদ। আমি তার ভাইবন্ধু সাফায়াত কবির। রূপনগর থেকে এসেছি আমরা। সুলতান মহলের সদস্য। যাত্রাপালার লোক। উনি যাত্রাপালার ডাইরেক্টর।
সুভা আর অপরূপা একে অপরের দিকে তাকালো। বিস্ময়ে হা হয়ে গেল ওদের মুখবিবর।
সুভা বলল,
সত্যি!
সাফায়াত মাথা দুলিয়ে বলল
হ্যা, সত্যি।
আমরাও যাত্রাপালা দেখতে যাচ্ছি। মাগোমা কতবড় বড় মানুষের সাথে দেখা হয়ে গেল।
সাফায়াত শুনে খুশি হয়ে বলল,
আচ্ছা।
মহিলাগুলোর গায়ে রাজকীয় পোশাক। মাথা ঢাকা ওড়নায়। অলংকৃত সাজগোজ।
তোমাদের নাম কি?
সুভা সোৎসাহে বলল,
আমি সুভা। ও..
অপরূপা ওর হাত চেপে ধরলো। যাকে যাকে পরিচয় দেওয়া সে পছন্দ করে না।
সুভা ফিক করে হেসে উঠলো। বলল,
ওর নাম রূপা।
রূপা! কার নাম?
শেহজাদ নামের লোকটা হাজির হলো। হাতে পানির বোতল। সাফায়াত অপরূপাকে দেখিয়ে বলল,
ওর নাম রূপা। আর ওর নাম সুভা। তারাও নাকি পালা দেখতে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে দর্শকদের সাথে দেখা হয়ে গেল। ভালোই হলো।
শেহজাদ অপরূপার দিকে তাকালো। বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
ভালো। এই নিন পানি।
অপরূপা শঙ্কিত মনে বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। সম্রাট ওর হাবভাব দেখে সাফায়াতকে বলল
চলো। পানি খেতে বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে।
সুভা ছোঁ মেরে বোতল কেড়ে নিয়ে পানি খেতে খেতে বলল,
ও মুখ খোলোনা সবার সামনে।
শেহজাদ আর তার লোকজন সেখান থেকে সরে পড়লো। তারা যেতেই নিকাব সরিয়ে পানি খেল অপরূপা। সে পায়ে বেশি ব্যাথা পেয়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ঘোড়ার গাড়ির সামনে গিয়ে থামলো। রাজুকে তোলা হয়েছে বিল থেকে। সে আহত হয়েছে। লোকজন তাকে অন্য একটা ভ্যানগাড়িতে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাফায়াত অপরূপাদের কাছে এসে বলল
এই মেয়েরা একজন মাতালের গাড়িতে চড়ে যাত্রাপালা দেখতে যাচ্ছ তোমরা? সাহস তো কম না। বাড়ি থেকে ছাড়লো কিভাবে? আর ছাড়লেও একজন পুরুষ মানুষ সাথে রাখতে হয়। পথঘাট তো নিরাপদ না। কেমন মা বাবা তোমাদের?
অপরূপা মিনমিন করে বলল,
আমাদের পেছন পেছন একজন এসেছিল। আমরা উনার আগেই ভ্যানে উঠে গিয়েছিলাম।
অনেক চালাকির কাজ করেছ।
অপরূপা পানির বোতলটা সে বাড়িয়ে দিল।
আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আমরা আসি।
সুভা ফিঁকে হেসে বলল,
আসি। আচ্ছা রাণীমাকে দেখতে পাব না? মানে মঞ্চে যিনি রাণীমা সাজেন তার কথা বলছি। উনার কথা সবাই বলে। আজ যদিও দেখব কিন্তু এখন দেখলে মন্দ হয় না।
সাফায়াত তার কৌতূহল দেখে হেসে বলল,
পেছনের গাড়িতে আছে সে। তবে এখন দেখা করা যাবে না।
সুভার মন খারাপ হলো। অপরূপার হাত ধরে বলল
আচ্ছা আসি।
মেয়েগুলো খিকখিক করে হাসছিল। শেহজাদ নামক লোকটি ধমক দিয়ে বলল,
এত হাসছো কেন?
দুঃখীত শেহজাদ ভাই। আর হাসছি না।
তোমরা গাড়িতে গিয়ে বসো। দেরী হয়ে যাচ্ছে ইতোমধ্যে। সাফায়াত গাড়ি ছাড়ো।
অপরূপা ভদ্রলোকের ধমকাধমকি শুনে ভয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দু পা বাড়ালো। তার পা টা মনে হচ্ছে মচকে গিয়েছে, একপাশে ছিলে যাওয়ায় সেখানে জ্বলুনি অনুভব হচ্ছে।
শেহজাদ গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলো। অপরূপাকে ওভাবে হাঁটতে দেখে সাফায়াতকে ইশারা করলো গাড়ি না ছাড়তে।
দাঁড়ান।
সুভা আর অপরূপা থমকে গেল। মানুষটার মুখের সম্বোধনে তাদের ভালো লাগলো। শেহজাদ এসেই বলল,
আমাদের গাড়িতে জায়গা আছে। আপনারা চাইলে উঠতে পারেন। এভাবে যেতে পারবেন না বেশিদূর। মঞ্চ এখনও অনেক দূর।
অপরূপা মাথা নেড়ে বলল,
না। আমরা যেতে পারব। বলার জন্য কৃতজ্ঞ।
শেহজাদ সুভাকে বলল,
আপনারা নিশ্চিত যে একা একা যেতে পারবেন?
সুভা মাথা নাড়লো।
তাহলে গাড়িতে উঠুন। আপনার সই নিশ্চিন্তে যেতে পারবে। পেছনে সবাই মহিলা।
তার আচরণে অপরূপার মন ঘামলো। তাই সে ফিরে তাকাতেই লোকটার পিঙ্গলবর্ণ চোখে চোখ পড়তেই বেনামা ধুকপুকানি টের পেল হৃদপিণ্ডে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল।
জিপ গাড়িতে চড়তে পারবে শুনে সুভা এক লাফে উঠে গেল গাড়িতে। সে জানে সে উঠলে অপুও উঠতে বাধ্য।
সুভা গাড়িতে উঠেই মেয়েগুলোর সাথে হাসলো। বলল,
আমার খুব শখ ছিল এমন গাড়িতে চড়বো। আজ পূরণ হয়ে গেল।
মেয়েগুলো হাসলো তার কথায়।
সুভার কাজে শেহজাদও খুশি হলো। বলল
ভালো মেয়ে। এবার আপনিও উঠে যান পর্দারজনী।
অপরূপা এমন উদ্ভট সম্বোধনে পেছন ফিরে পুনরায় শেহজাদের দিকে তাকালো। চোখ অন্যত্র সরিয়ে বলল,
জ্বি।
আহত পায়ে এগোতেই পায়ে ভর সামলাতে না পেরে শেহজাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে গেল। উচ্চরবে ডাকলো
ও আল্লাহ!
শেহজাদের হাতের ভাঁজে গিয়ে ওর হাতটা পড়লো। শেহজাদ শক্ত করে ধরে বলল,
আস্তে। সুভা আপনার সইকে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করুন। উনি পায়ে বেশি ব্যাথা পেয়েছেন।
লজ্জায় দু কপোল রক্তিম হয়ে উঠলো অপরূপার। দৃশ্যমান গুচ্ছ গুচ্ছ তৃণকেশের নীচে ঘন কালো চোখদুটিতে লাজ ভেসে উঠলো।
শেহজাদ সুভার হাতে তার হাত তুলে দিয়ে বলল,
আমাদের টিমে ডাক্তার আছেন। আপনি ডাক্তারকে আপনার পা দেখাবেন। এখন গিয়ে বসুন।
অপরূপার দুচোখ কৃতজ্ঞতায় চকচক করে উঠলো। সে শুনেছিল রূপ নগরের মানুষ এমনিই। অতিথি আপ্যায়ন ও সন্ত্রাসমুক্ত এলাকার মানুষগুলো খুবই উদার। আজ তার প্রমাণ পেল।
গাড়িতে উঠার সময় মেয়ে তিনজন সাহায্য করলো অপরূপাকে। সুভা বসে বলল
ও পায়ে আঘাত পেয়েছে বেশি। আমার হাত ছিলে গিয়েছে শুধু।
মেয়ে তিনটে উৎসাহ দেখিয়ে বলল,
এই রূপা তুমি নিকাবটা তোলো। একটু দেখি।
অপরূপা আগ্রহ দেখালো কিন্তু ঠিক তক্ষুণি তাকালো গাড়ির সম্মুখে বসা শেহজাদ নামক লোকটার দিকে। দর্পনে চোখাচোখি হওয়ায় প্রচন্ড লজ্জায় দু’পাশে মাথা নাড়াতে লাগলো।
মেয়েগুলো বলে উঠলো,
দেখাও না। দেখাও না। আমরা তো মেয়ে। নিকাব তোলো।
ঠিক তখনি কড়া মেঘমন্দ্র গলাটি ভেসে এল।
এসব কেমন আদবকায়দা তোমাদের? চাইছেনা তারপরও জোরাজোরি করছ?
দুঃখীত ভাইজান। আর বলছি না।
অপরূপার খারাপ লাগলো। নিজেকে আচ্ছামতো বকে দিল এই বলে যে তার জন্য মেয়েগুলোকে বকা শুনতে হলো।
সাফায়াত হেসে বলল,
রূপাকে দূর থেকে দেখে প্রথমেই মনে করেছি ডাকাত। ডাকাতেরা আজকাল বোরকা পড়া শুরু করেছে। কিন্তু সুভাকে দেখে ভুল দূর হলো। তখন ভাবলাম এদের সাহায্য দরকার।
বলেই সাফায়াত হেসে উঠলো।
শবনম নামের মেয়েটি বলে উঠলো,
ডাকাতের এত সুন্দর চোখ থাকেনা ভাইজান। রূপার চোখ দুটো দেখে ডাকাত মনে হবে? হ্যা মনচোর বললে সমস্যা নেই।
বলেই সশব্দে হাসতে লাগলো সবাই মিলে।
সুভা তাদের সাথে বকবক করতে লাগলো। অপরূপা শুধু তাদের প্রশ্নে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
সাফায়াত একসময় বলে উঠলো,
সায়রা আর সোহিনী আসার জন্য পাগলপ্রায়। মামু আসতে দিল না। তুমি মামুকে বলতে পারতে।
শেহজাদ কাগজের পেপার চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে বলল,
পরের বার আনবো। সিভানও আসতে চাইবে তাই কিছু বলিনি।
সুভা তাদের কথার মাঝে বলে উঠলো
বসু মল্লিক বাড়িতে আপনাদের আমন্ত্রণ। আমাদের বাড়িতে যাবেন কিন্তু। আমার মা কাকীরা খুব খুশি হবে। সবাই এত এত খুশি হবে যে..
অপরূপা ওর হাত চেপে ধরে বলে,
একটু কম কথা বল না।
সে ভেবেছিল সামনে বসা লোকটা হয়ত বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। কিন্তু অপরূপাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা বলে উঠলো
সুভা তুমি বলতে থাকো। আমি একটুও বিরক্ত হচ্ছি না।
সুভা বকবকর শুরু করলো উৎসাহ পেয়ে।
চলবে….