#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_৫
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
[কপি নিষিদ্ধ। শেয়ার দিতে পারেন ]
ডাকাতদল মহল ছাড়তেই বাড়িতে হৈহৈ রব পড়ে গেল। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে শাহজাহান সাহেব, শেরতাজ সাহেব, খোদেজা আর হামিদা ছুটলো কন্যাদের কক্ষের দিকে। সায়রা আর সোহিনীও তখন বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে।
কন্ঠে প্রবল উৎকন্ঠা মিশিয়ে বলল, আম্মা বাইরে গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে কেন? খোদজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তাদের সারামুখে হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো?
সায়রা আর সোহিনী বলল, না আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। কি হয়েছে বলবেন?
মহলে ডাকাত ঢুকেছে।
সায়রা আর সোহিনী আঁতকে উঠে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় আতঙ্কে। বলে, আম্মা কে যেন চিৎকার দিয়েছে সেই শব্দশুনে আমাদের ঘুম ছুটে গিয়েছে। বিদ্যুৎও নেই। ভাইজান আর সাফায়াত ভাই ঠিক আছে?
শাহজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেব ততক্ষণে বন্দুক নিয়ে ছুটে যায়। পেছন পেছন বাকিরাও ছুটে । বাড়ির কাজের বুয়াগুলো বিলাপ করতে থাকে ভয়ে।
সবার তখন টাকাপয়সা গয়নাগাটি বিষয়ে চিন্তা ছিল না। চিন্তার বিষয় ছিল কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা এ বিষয়ে। ভীতিগ্রস্ত পায়ে সম্রাটের কক্ষের দিকে যেতেই হারিকেন আর তলোয়ার হাতে শেহজাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সবাই। সায়রা ডাক দিল
ভাইজান!
শেহজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে সবার দিকে চোখ বুলালো। সবার চোখে ভয়,ত্রাসের কুন্ডলী দেখে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো
ঠিক আছ আমার বোনেরা।
সবাই এগিয়ে আসে। সায়রা ডুকরে কেঁদে বলে
জ্বি ভাইজান। ওরা কি আপনাকে আঘাত করেছে? আপনি এখানে কেন? কে ওভাবে চিৎকার করেছে?
খোদেজা ছুটে এসে পুত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কেঁদে উঠে চেঁচিয়ে। শেহজাদ শান্ত গলায় বলে
আমি ঠিক আছি আম্মাজান। কাঁদবেন না।
তাহলে কে ওভাবে চিৎকার করেছে?
শাহজাহান সাহেব বলেন
অপরূপা! কোথায় সে? সায়রা সোহিনী অপরূপার কক্ষে যাও।
মেঘমন্দ্র গলায় শেহজাদ বলে উঠে
তার দরকার নেই।
সবাই তার দিকে তাকায়। শেহজাদ হারিকেন উপর করে ধরে। লম্বা বারান্দাটির এককোণায় গুটিসুটি মেরে কেন্নোর মতো গুটিয়ে হেলে পড়ে আছো সিঁদুর রঙা শাড়ি পড়া অপরূপার শরীর। তার ছাড়া পাওয়া চুল গৃহতলে শায়িত। মুখটা দেখা যাচ্ছে না কেশপাশের আড়ালে ঢাকা পড়ায়। তবে শ্বেতবিবর পা জোড়া প্রকাশ্য। শেহজাদের তলোয়ারের আঘাতে কাটা পড়েছে তার হাতের বাহু। রক্ত ছিলকে এবং গায়ে ঢলে পড়ায় সম্রাটের পাঞ্জাবিতে রক্ত লেগে গিয়েছে। তলে রক্তের চিহ্ন আর অপরূপাকে এমন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ভয়ে প্রায় আঁতকে উঠলো সবাই।
শেহজাদকে দেখামাত্রই কেঁদে উঠে সর্বশক্তি দিয়ে সে ধাক্কা দিয়ে কোণায় গিয়ে পড়েছিল অপরূপা। এবং সাথে সাথেই অচৈতন্য বরণ করে নিয়েছে।
খোদজা হায় হায় করে উঠে বলল
মেয়েটাকে নষ্ট করে দিল? ও খোদা এটা কি করলে তুমি? বিয়ের পর স্বামীর ঘর করতে পারলো না মেয়েটা।
শেহজাদ মায়ের আহাজারি থামিয়ে দিয়ে বলে
আম্মা থামুন। আমার মনে হয় এমন কিছু হয়নি। ওকে আক্রমণ করতে চেয়েছিল ও পালিয়ে এসেছে। ভুল করে আমিই ওকে আঘাত করেছি।
শাহজাহান সাহেব গলা চড়িয়ে বলেন
এটা কি ঠিক করেছ? মেহমানকে এভাবে আঘাত করেছ। উপরওয়ালা রুষ্ট হবেন পুত্র। আমরা কি করে নিশ্চিত হলাম যে সে ডাকাত?
খোদেজা কড়া গলায় বলে,
ও তো বলেছে ভুলে মেরেছে। এভাবে চড়াও হচ্ছেন কেন?
হামিদা বেগম সিভানকে নিয়ে ঘটনাস্থলে এল। বলল
ফুলবানুকে পাওয়া যাচ্ছে না ভাবীজান।
সবার বুক ধ্বক করে উঠে। তন্মধ্যে সাফায়াতও উপস্থিত হয়।
শেহজাদ ভাই কালু মিয়া আর মফিজের গায়ে গুলি লেগেছে। অবস্থা গুরুতর। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছিনা।
শেহজাদ অপরূপার দিকে তাকায়। বলে
এদিকে এই মেয়েটা এই অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আমার হাতে একটা নিষ্পাপ প্রাণ আঘাত পেয়েছে এটা আমি মানতে পারছিনা।
সাফায়াত নিথর হয়ে পড়ে থাকা অপরূপার দিকে তাকায়। সায়রা আর সোহিনী ততক্ষণে অপরূপার কাছ ঘেঁষে বসে। রক্ত দেখায় তারা অপরূপাকে ধরতে ভয় পাচ্ছে। শেহজাদ সাফায়াতকে বলে
দ্রুত ডাক্তার বাবুকে আসতে বলো সাফায়াত। আমি এই মেয়েকে চত্বরে নিয়ে যাচ্ছি
তারপর ফুলবানুকে খুঁজবো। কালু মিয়া আর মফিজের চিকিৎসা হবে। আম্মা আর কয়েকটা হারিকেন জ্বালিয়ে দিন। বিদ্যুৎ তার কেঁটে দেয়া হয়েছে। বাতি জ্বলবে না। দ্রুত যান। ভীত হবেন না।
খোদেজা আর হামিদা চলে যায়। শেহজাদ এগোয় অপরূপার দিকে। সায়রা আর সোহিনীর চোখ ভিজে উঠে অপরূপাকে ওই অবস্থায় দেখে। মেয়েটার উপর অনেক ঝড় যাচ্ছে
তারা বুঝতে পারে তা। শেহজাদ এসে পাঁজাখোলা করে তুলে নিতে নিতে বলে
পরে তোমরা তাকে বলোনা যেন যে আমি তাকে কোলে নিয়েছি। সে আমায় ঘৃণার চোখে দেখে।
ভাইয়ের দিকে বিস্ময়বিহ্বলিত চোখে তাকায় দুবোন। তাদের ভাইজানকে অপরূপা ঘৃণার চোখে দেখে? অথচ সে রূপনগরের সম্রাট। রূপনগরের রূপের ধারক, বাহক। রূপনগরের কত চোখ ঝলসানো রূপসী তাদের প্রাণপুরুষ হিসেবে শেহজাদ চায়। দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। যার দরাজ গলার স্বর শুনে নারী মাতোয়ারা হতে বাধ্য হয়, গভীর চাউনির দিকে তাকালেই হৃদপিণ্ডে কাঁপুনি ধরে, সুলতান মহলের উত্তরাধিকার স্বত্বে নয়, যে নিজগুণে সকলের কাছে পরিচিত, যার সাহসীকতা, বুদ্ধিমত্তা, পরোপকারীতা, ন্যায়পরায়নতা আর উদারতায় মানুষ মুগ্ধ, যে পুরো রূপনগরে ন্যায় বিচারের মজলিশে উত্তম ফয়সালা দানকারী তাকে একটি ক্ষুদ্র মানবী ঘৃণার চোখে দেখে? কি কারণ? যদিও দেখে তাতে কি যায় আসে?
স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান এসেও যদি সম্রাট শেহজাদ সুলতানকে একথা বলে তাও তিনি তা কানে তুলবেন না। একজন অতিশয় নগন্য কন্যার ঘৃণাকে কেন তিনি এত প্রাধান্য দিলেন তা বেশ ভাবিয়ে তুললো দুই বোনকে। পরক্ষণে মনে হলো অপরূপার ভাবনায় সঠিক। কারণ সে তো সম্রাট শেহজাদকে চেনে না। যদি চিনতো তাহলে যে দুচোখ দিয়ে ঘৃনা ছুঁড়েছে সে দুচোখকেই ঘৃণা করতো সে।
অপরূপাকে চৌকির উপর শুয়ে দিয়ে বোনদের কৌতূহলী চোখদুটোকে এড়িয়ে ফুলবানুর খোঁজে বেরিয়ে পড়লো শেহজাদ। ডাক্তার চলে এসেছে। অপরূপা চিকিৎসা চলছে। ডাক্তারের কথায় কালু মিয়া আর মফিজকে রূপনগরের হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মতিবানুর আহাজারি শোনা যাচ্ছে। ফুলবানু তার আপন চাচাতো বোন। স্বামী তালাক দেয়ার পর মতিবানুর সাথে সুলতান মহলে কাজের খোঁজে আসে সে। শেহজাদের শরণাপন্ন হয়ে কাজ নেয়। তার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে খোদেজা তাকে রেখে দেয়।
মফিজের সাথে তার নিকাহ হওয়ার কথাবার্তা চলছিল মহলের ভেতর। খোদেজা ঘটক ছিল। সপ্তাহখানেক পর তাদের নিকাহ হতো শেহজাদকে জানানোর পর।
শেহজাদ ফুলবানুকে স্নেহ করে ফুলকলি ডাকে। ফুলকলিও সাহেব ভাইজানকে নিজের পর সবচাইতে বেশি ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে, জায়নামাজে বসে সবার আগেই সে সাহেব ভাইজানের জন্য দোয়া করে, হায়াত খোঁজে। সাহেব ভাইজান রূপনগরের প্রাণ।
সেই ফুলকলির অনুপস্থিতি শেহজাদকে বড়ই চিন্তা আর ভয়ে ফেলে দিয়েছে। সায়রা আর সোহিনী হারিয়ে গেলে যেমনটা লাগতো ঠিক তেমনটা লাগছে। অস্থির লাগছে।
খোদেজা বিলাপ করা শুরু করেছে ওদিকে। ডাকাতদল সোনাদানা, নগদ টাকা পয়সা, আর জমিজমার কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছে।
শাহজাহান সাহেব কেদারায় বসে রইলেন চুপচাপ। জমিজমার কাগজপত্র দিয়ে কি করবে তারা?
অপরূপার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। তবে চেতনা ফেরেনি। সায়রা আর সোহিনী তার গলার পাশে নখের আঁচড় দেখে আঁতকে উঠলো।
ডাক্তারের দেয়া ঔষধ লাগিয়ে দিয়ে হাতপাখার বাতাস করতে করতে ডাকলো
অপা! ওঠো। অপা কিচ্ছু হয়নি তোমার।
কয়েক লগ্ন পর,
ফুলকলিকে না পেয়ে শেহজাদ ফিরে এল হতাশাগ্রস্ত হয়ে। এসেই কাষ্ঠাসনে বসে পড়লো পরাজিত ভঙ্গিতে। বসেই চোখের আঁখি পতিত করলো সায়রা আর সোহিনী দ্বারা ঘিরে থাকা কন্যাটির দিকে। অনুতাপ নিয়ে ভাবে এর আগে এমন ভুল সে কখনো করেনি।
তন্মধ্যে চত্বরে পুলিশ তার দলবলসহ প্রবেশ করলো। সম্রাট, শাহাজাহান সাহেব, শেরতাজ সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন। পুলিশ অফিসার বললেন
ফুলকলির খোঁজে আমাদের টিম কাজ করছে। আমরা তাকে খুঁজে পাব শীঘ্রই। আরো একটা খবর আমরা নিয়ে এসেছি সেটা হলো আশপাশের চার পাঁচটা গ্রামে খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কোনো কাজী বাড়িতেই অপরূপা আর রহমানের নিকাহ পড়ানো হয়নি। সুতরাং রহমান নামের কেউই অপরূপার স্বামী নয়।
শেহজাদ আশ্চর্যান্বিত গলায় প্রশ্ন করে
তারমানে অপরূপা মিথ্যে বলছে?
হ্যা, মিথ্যে বলছে। তাদের বিয়েই হয়নি। তবে অপরূপার গ্রামে গিয়ে জানতে পেরেছি একজনের সাথে অপরূপার অল্পদিনের পরিচিত ছিল, এবং তার সাথেই অপরূপা ঘর ছেড়েছে। তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতো। ওই লোকটার খোঁজ করা হচ্ছে। তাকে পেয়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।
শেহজাদ জানতে চায়
অফিসার আজকের ঘটনার সাথে অপরূপা কোনোভাবেই কি সংযুক্ত?
আমরা সন্দেহ করছি। কিন্তু অপরূপার প্রেমিককে না পাওয়া পর্যন্ত তা নিশ্চিত করে বলতে পারছিনা। আপনারা তাকে চেখে চোখে রাখবেন।
শেহজাদ পণ করলো অপরূপাকে সে চোখে চোখেই রাখবে।
চলবে….