#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_৪
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
[কপি নিষিদ্ধ। শেয়ার দিতে পারেন ]
জ্বীনপরী ছিল সাহেব। জ্বীনপরী। আগুনের মতো জ্বলন্ত মুখ। তিনবার চাবুক মারতেই আমার নাথা ঘুইরা উঠছিলো সাহেব । দেখুন সাহেব মারের দাগ পইড়া গেছে। আমারে বাড়ি যাওনর অনুমতি দেন সাহেব। আমি এখানে আসতাম না আর।
শেহজাদ বিরক্ত মুখে কুতুবের দিকে তাকিয়ে রইলো। পিঠে কালশিটে দাগ বসে গেছে তিনটে।
তুমি থামবে? কোনো জ্বীনপরী নেই এই মহলে। সত্যি করে বলো কাকে দেখেছ?
কুতুব হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল
খোদার কছম সাহেব। জীবনেও অমন জিনিস আমি মহলের আশেপাশে দেহিনাই। ওইডা মানুষ ছিল না।
দ্বিতল ভবন চত্বরে দাঁড়িয়েছিল অপরূপা। কুতুবের আজগুবি কেচ্ছা শুনে শেহজাদ বিরক্ত হয়ে আধমরা লোকটার দিকে তাকালো। লোকটার পাশেই পড়ে রয়েছে পানি। তারমানে কেউ তাকে পানি খাইয়েছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছু একটা বার্তা দিতেই সে হাঁক ছেড়ে ডাকলো
সাফায়াত!
বলো ভাইজান।
সায়রা সোহিনীকে ডাকো।
জ্বি।
সায়রা আর সোহিনী হাজির হলো। কুতুব বললো
না সাহেব। আমি মহলের কন্যাদের চিনি। ওই কন্যারে আমি কখনো দেখিনি। সে জ্বীনপরী ছিল।
এনারা ছিলেন না।
শেহজাদ এবার কটমট গলায় বলে
এই ওকে কেউ কমলবিলে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলো। দ্রুত। যাও।
কুতুব ভয়ে কাতর হয়ে লুঙ্গির গোছ তুলে দিল এক দৌড়। সায়রা, সোহিনী আর সিভান হি হি করে হেসে উঠলো। সিভান হাসতে হাসতে বলল,
চিকনা কুতুব মনে হয় সুন্দর বউয়ের কথা বলেছে শেহজাদ ভাইজান।
বলেই সে হি হি করে হাসতে লাগলো।
শেহজাদ কৌতূহলী চোখে তাকালো তার দিকে। সম্রাটকে তাকাতে দেখে সিভান সায়রার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
ভুল হয়ে গেছে ভাইজান।
সায়রা সিভানের গাল টেনে দিয়ে বলল
ছিঃ তুমি এসব কি বলছ সিভান? ও এখানে কেন আসবে?
শেহজাদ সন্দিহান কন্ঠে বলল,
সুন্দর বউ কে?
কথাকে গুরুত্ব দেওয়ায় সিভান উঁকি দিয়ে শেহজাদের দিকে তাকালো। বলল
দাদাজান কাল যে সুন্দর বউ নিয়ে এসেছিল সে।
সায়রা ওর মুখ চেপে ধরে বলল
ওর কথা কানে নেবেন না ভাইজান।
তুমি চুপ থাকো। ও মিথ্যে বলছে সেটা তুমি জানলে কি করে? ও সত্যিও তো বলতে পারে। ওই মেয়ের এত দুঃসাহস কি করে হয় আমার লোকেদের গায়ে হাত তোলার? এত স্পর্ধা তার? আব্বা আপনি কাকে মহলে এনেছেন?
শাহজাহান সাহেব ধীরপায়ে হেঁটে এসে পুত্রের কাঁধে হাত রেখে বলে
শান্ত হও। আমি অপরূপার কাছে এক্ষুণি যাচ্ছি। জানতে চাইবো সে এটা করেছে কিনা।
আলবাত সে-ই করেছে আব্বা। আপনি না জেনেশুনে একটা অপরিচিত মেয়েকে মহলে নিয়ে এলেন? এটা কি ঠিক হলো? আপনার কাছে এটা মোটেও আশা করিনি আমি। তারউপর সন্দেহ আমার দ্বিগুণ বেড়েছে।
কারো কথায় কর্ণপাত না করে মহল চত্বর ছাড়লো শেহজাদ। অপরূপা দ্বিতল ভবনের চত্বরে দাঁড়িয়ে পুরোটা শুনলো চুপচাপ। সে অনুতপ্ত নয় একটুও।
_________________
তীব্র আগ্রহ নিয়ে সায়রা আর সোহিনী অপরূপার কাছে জানতে চায় কেন সে এমনটা করেছে। অপরূপা তাদের সবটা বলে। একটা মানুষ মুখ খুলছেনা তারপরও কেন তারউপর জুলম করা হচ্ছে? এখানকার পুলিশও কি মহলের সাহেবদের কথামতো চলে? নইলে এভাবে তাদের হাতে আইন তুলে দেয়া কেমন কথা? সায়রা আর সোহিনী চুপ থাকে। পরক্ষণে হেসে উঠে। বলে মারটা কিন্তু দারুণ দিয়েছ অপা। নইলে তিন চাবুকের আঘাতে বেহুশ?
বলেই দু’জন সশব্দে হেসে উঠে। অপরূপা তাদের সাথে হাসে। প্রশ্ন করে
আচ্ছা যাত্রাপালার কথা বলছিলে না তোমরা? যাব না?
সায়রা চেহারা মলিন হয়।
নারীশিল্পীর গায়ে নাকি চাকু মেরেছে ওই সন্ত্রাসটা। তাই মঞ্চ সাজবে না।
যাকে পেটাচ্ছে উনি?
জ্বি।
অপরূপা চুপ থাকলো। বলল
সে যাইহোক অমনভাবে মারার চাইতে তো একেবারে মেরে ফেলায় ভালো। আমি মানুষের কষ্ট সইতে পারিনা।
তুমি কোমলমতি তাই। এসব আমরা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত। শেহজাদ ভাইজানের কাছে ছাড় পাওয়া মুশকিল।
অপরূপা লোকটার নাম শুনেই বিরক্ত হয়। উপরদিক থেকে লোকটা যতটা সুকুমার সুদর্শন ভেতরটা ঠিক ততটাই নিকৃষ্ট। তার কাছে একজন পুরুষই শ্রেষ্ঠ। যার কঠিন রূপ কখনো সে দেখেনি।
__________
সন্ধ্যায় নামাজ কালাম আর জিকির সেড়ে রসাইঘরে রাতের খাবারের আয়োজনের দুম পড়ে। সকালের জন্য রুটি বেলছে মতিবানু। পান খাওয়ার কারণে জিহৃবা আর দাঁত সারাক্ষণ লাল হয়ে থাকে তার। রুটি বেলতে বেলতে মুগ্ধ চোখে অপরূপার দিকে বার কয়েক তাকায় সে। আর তার বোকামির কথা মনে করে দাঁত খেলিয়ে হাসতে ইচ্ছে হয়। সে তো রাজার ঘরের রাণী হওয়ার মতো মেয়ে। সে কিনা ঘর ছেড়েছে এমন একজনের হাত ধরে যার দুকূলে কেউই নেই।
অপরূপা পিঁড়িতে বসে তরকারি কেটে দেয়। সিভানের আম্মা হামিদা বেগম তার তরকারি কাটা দেখে। টুকটাক প্রশ্ন করে। যেমন, বাড়িতে কে ছিল? আগে রান্নাবান্না করতো কিনা। পড়াশোনা কতটুকু করেছে? কোরআন পড়তে পারে কিনা? নামাজ কালাম পারে কিনা।
অপরূপা তার জবাব দেয়। সবটা শুনে খোদেজা মাঝেমাঝে মেয়েটাকে আড়াল হতে দেখে। তার সহজ সরল চেহারার পেছনে যেন লুকিয়ে আছে কঠিন এক তেজস্বী রূপ। হামিদা বেগম জানতে চায়, কুতুবকে মারার সময় হাত কাঁপেনি?
অপরূপা ঘাড় নাড়ে। লোকটা চাইলে আমাকে আটকাতে পারতো কিন্তু সে আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়ছিল। তাই মারতে সুবিধা হয়েছে।
হামিদা হেসে উঠে। খোদেজা বলে,
এমন ভুল আর করোনা। শেহজাদ চুপ থাকবে না। যেমন আছ তেমন থাকো। তোমার স্বামীর খোঁজ পেলেই চলে যাবে।
আমি এখানে থাকতে আসিনি মা বেগম। খোদেজা চুপ হয়ে যায়।
পিতৃ-মাতৃহীন বড় হলে এই একটাই সমস্যা। যার একূলওকূল নেই তার হাত ধরে তুমি পালালে।
আমার জায়গায় থাকলে আপনি আরও আগে পালাতেন।
খোদেজা আশ্চর্যান্বিত চোখে চেয়ে থাকে। কি অদ্ভুত! মেয়েটা ফটরফটর করে কথা বলেই যাচ্ছে। শেহজাদের সামনে এভাবে কথা বললে তো সমস্যা।
খোদেজা এবার চুপসে যায়।
তোমার স্বামী যদি আর না ফেরে কোথায় যাবে তুমি?
ভাগ্য আমাকে যেদিকে নিয়ে যায়।
কথোপকথনে ভাঁটা পড়ে।
তন্মধ্যে শাহজাহান সাহেব ডাক পাড়েন।
অপরূপা তোমার সাথে কথা আছে। বেরিয়ে এসো।
হাত ধুঁয়ে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে যায় অপরূপা। শাহজাহান সাহেব হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগোয়। অপরূপা উনার পেছন পেছন হাঁটে। নীচুস্বরে জানতে চায়
উনার কি কোনো খবর পেয়েছেন?
আমার পুত্র লোক পাঠিয়েছে । ওখানাকার বাসিন্দা, মাঝি, জেলেদের বক্তব্য তোমার স্বামী তাদের কাছে তোমার খোঁজ করতে যায়নি।
অপরূপা ব্যাথিত হয়।
শাহজাহান সাহেব প্রশ্ন করে,
তোমার স্বামী ক’টায় তোমাকে ঘাটে রেখে গেছে?
যোহরের আজান পড়ছে সবে। ঠিক সেসময়।
শাহজাহান সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। চোখদুটো চকচক করে উঠে অভিশঙ্কায়।
তোমার থেকে কিছুটা দূরে একটা জাহাজ ছিল?
অপরূপা ভাবে। তারপর বলে
হ্যা ছিল। ওরা ট্রলার থেকে বড়বড় বাক্স তুলছিল ঘাটে। ঠিক তারপরেই পুলিশ আসে। কিন্তু পুলিশ ঘাটে পৌঁছার আগেই তারা চলে যায়।
পুলিশ তোমায় কিছু বলেনি?
নাহ। পুলিশের পিছু পিছু একজন বুড়ি আর তার দুটো নাতি নাতনি আসে। আমি তাদের সাথে ঘাটে বসে থাকি। এতপ্রশ্ন কেন জিজ্ঞেস করছেন ?
শাহজাহান সাহেব অপরূপাকে চমকে দিয়ে বলেন
জাহাজটা ডাকাতদের ছিল। ওরা তোমাকে একা পেয়েও কোনো ক্ষতি করলো না কেন? তুমি কি জানতে না ওরা ডাকাত?
অপরূপা হা করে চেয়ে থাকে।
ডাকাত?
হ্যা ডাকাত। ওরা ডাকাত ছিল। তাই তো পুলিশ এসেছে।
অপরূপা কপালে হাত দেয়।
তুমি সত্যিই জানতে না ওরা ডাকাত ছিল?
না। আমি কি করে বুঝব ওরা ডাকাত ছিল। ওরা তো আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই ছিল।
তোমার মনে কি প্রশ্ন জাগছে না ওরা কেন তোমার ক্ষতি করলো না।
আমার কাছে ওরা কি-ই বা পেত। তাই হয়ত।
অপরূপার গায়ে কাঁটা দেয়। সে ডাকাতদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তখন? কি ভয়ানক!
আমার পুত্র সন্দেহ করছে তোমার সাথে ওদের কোনো যোগসূত্র আছে। নইলে ওরা তোমার ক্ষতি করলো না কেন?
শেহজাদের কথা শোনামাত্রই অপরূপার গাত্রদাহ হয়। সে খানিকটা কড়া গলায় বলে,
আপনার পুত্র একটু বেশি বুঝেন। আশ্রিত হয়ে এসেছি তাই বলে আমাকে যা তা বলবেন উনি? আমি ডা*কাত?
তুমি অযথা তাকে ভুল বুঝছো মেয়ে। ওর কথায় যুক্তি আছে। ও যুক্তি ছাড়া কথা বলে না। তুমি বিষয়টা একটু ভেবে দেখো। ও কিন্তু ভুল কথা বলেনি। আমরা ইতোমধ্যেই পুলিশকে সবটা জানিয়েছি। পুলিশ মহল অঙ্গনে বসে আছে।
তারা জানতে চায় কোন কাজী বাড়িতে তোমাদের নিকাহ হয়েছে? কাবিননামাটা তোমার কাছে না থাকলেও উনার কাছে পাওয়া যাবে।
অপরূপা শুকনো ঢোক গিলে। সত্য লুকোতে আমতাআমতা করে বলে, আমি কিচ্ছু জানিনা । কিছুর নাম জানিনা। কিচ্ছু না।
শাহজাহান সাহেব বলে উঠেন,
তুমি না বললে তুমি দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছ। এত শিক্ষিত হয়ে তুমি নাম জানো না? তুমি কিন্তু শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী অপরূপা। কিছু জানো না এটা সম্রাটের পক্ষে বিশ্বাস করা কষ্টকর হবে।
শাহজাহান সাহেব বলেন,
তুমি বলতে না চাইলে বলো না। সম্রাট ইতোমধ্যে তোমার গ্রাম ইন্দিরাপুর, তারপর পলাশপুর, সিন্দুপুরের সব কাজী বাড়িতে খোঁজ নিচ্ছে। সত্যিটা বেরিয়ে আসবে।
অপরূপার চোখভর্তি জল দেখা যায়।
আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন ?
শাহজাহান সাহেব হাসেন। অপরূপার মাথায় হাত রেখে হেসে বলেন,
কাবিননামায় তোমার বরের সব তথ্য থাকবে। তাকে খুঁজতেও সুবিধা হবে। তোমার ব্যাপারে সব জানার পর বুঝলাম তাকে খুঁজে পাওয়াটা খুব জরুরি।
অপরূপা কিছুক্ষণর ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে চোখের জল ছেড়ে দেয়। বুকে চিবুক ঠেকিয়ে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে
ফোঁপানির চোটে তার শরীর কাঁপে। কাঁপতে কাঁপতে সে উচ্চারণ করে,
আমাদের নিকাহ রাতে হতো। তা হয়নি।
তার মুখ নিঃসৃত বাক্যটুকু শাহজাহান সাহেবের কর্ণগোচর হওয়ার পূর্বেই তিনি প্রস্থান নিয়েছেন।
_______________________
রাত্রি নিঝুম, নিস্তব্ধতায় মহলের পাশের ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পর্বত হতে বন্য শেয়াল কুকুরের বেওয়ারিশ ডাক ভেসে আসে। অপরূপার চোখে খুব তাড়াতে নিদ্রা নামে না। নিদ্রা নামে ভোররাতে। আজও তাই। মরার মতো ঘুমে বিভোর হয়ে আসে সে। পুরো সুলতান মহল তখন অন্ধকার আর ঘুমগ্রস্থের মতো সুনসান, নীরব, নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। আকাশে চাঁদ নেই। আকাশটাও মেঘলা। যে কেউ সহজেই ভয়ংকর নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করবে এমন ভয়ংকর হয়ে আছে সুলতান মহল। রূপনগরের প্রধান সড়ক ধরে দলে দলে ডাকাত সৈন্য এসে ঘেরাও করলো সুলতান মহল। তাদের হাতে জ্বলন্ত আগুনের মশাল। সদ্য শায়িত ক*ব*রস্থান হতে চুরি করা কাপনের কাপড় নিয়ে প্রাচীর টপকালো খুব সুনিপুণ ভঙ্গিতে। কাপনের কাপড় বাড়িতে রাখলেই মানুষ মরার মতো ঘুমায় এটা তাদের বিশ্বাস।
প্রাচীর টপকে, মহলের পেছনের বড় পাকুড় গাছটির মাধ্যমে লতাপাতার সাহায্যে ছাদ টপকে আরও একটি গোপন পন্থা অবলম্বন করে দলে দলে ডাকাতদল ঢুকে পড়লো মহলে। মহলের অভ্যন্তরে সবাই ঠিক মরার মতো ঘুমিয়ে আছে।
দলে দলে ভাগ হয়ে একেকটি কামরায় ঢুকে পড়ে তারা। যা পায় তাই হাতিয়ে নেয়। সারাবাড়ির বৈদ্যুতিক তার কেটে ছিন্নভিন্ন করে দেয় তারা। একটা দল গিয়ে থামে অপরূপার কক্ষটির সামনে। কমলা রঙের স্বল্প আলোর বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগানো ছিল তার ঘরটিতে। সে বাল্ব বন্ধ করে মাথার উপর হারিকেনের শিখা ছোট করে জ্বালিয়ে রেখে ঘুমায় সে । তার পুরোনো অভ্যাস। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। হারিকেনের মৃদু আলো তার ঘুমন্ত মুখে পড়তেই ডাকাতদলের একজন সবাইকে ইশারায় থামিয়ে দেয়। সবাইকে আদেশ দেয় চলে যাওয়ার জন্য। সবাই তার আদেশ মেনে চলে যায়। মুখোশে আবৃত ডাকাতসৈন্য পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসে অপরূপার কাছে। ঘুমন্ত মুখটার উপর ঝুঁকে পড়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে চুপচাপ। ভারী নিঃশ্বাসের আঁচড় পড়ে অপরূপার মুখে। তার নড়চড় টের পেয়ে দ্রুত সরে পড়ে ডাকাতসৈন্যটি। হাতড়ে পুটলি থেকে তার সমস্ত গহনা আর লাল শাড়িটা নিজের পুটলিতে ঢুকিয়ে অপরূপার ঘুমন্ত মুখটির দিকে পুনরায় তাকায়। তারপর পায়ের বীভৎস আওয়াজ তুলে বেরিয়ে ঢুকে পড়ে অন্য কক্ষে।
তীব্র অস্বস্তি, উদ্বেগ, অশান্ত মনে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলো অপরূপা।
হারিকেনের শিখা বাড়িয়ে নিল। কক্ষের দরজা খোলা দেখতেই বক্ষপঞ্জর কেঁপে উঠে তার। দরজা বন্ধ করেনি সে তারমানে এই নয় দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছে। কে এসেছিল তার ঘরে। এজন্যই তার এরকম অস্বস্তি লাগছে? কে হতে পারে?
ভয়ে তার বুক ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে। পা জোড়া অসাড় হয়ে আসে। চোখে ঝাপসা দেখে।
ঘর থেকে বেরিয়ে কে কে বলে ডেকে কিছুদূর চলে যেতেই একজন ডাকাত সৈন্য পেছন থেকে এসে চেপে ধরে তার মুখ। অপরূপা নখ দিয়ে খামচে ধরে গোঙাতে থাকে। ডাকাত সৈন্যের নোংরা হাতে স্পর্শ থেকে রক্ষা পেতে কেঁদে উঠে, চেঁচানোর চেষ্টা করে।
একসময় সফল হয় ততক্ষণে তার কবরীবন্ধ কেশপাশ ঝুপ করে ছড়িয়ে পড়ে মধ্যদেশে, শাড়ির আঁচল খসে পড়ায় গলার পাশে পাঁচ আঙুলের নখের ছাপ বসে যায়।
তারপরও সে ছুটে নিরুদ্দেশে অন্ধকারে। হারিকেনটি ছিটকে পড়ে ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে যায়।
সাথে সাথেই শেহজাদের ঘুম ভেঙে যায়। ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে বসে সে। উঠে দেয়ালে সুইচ টিপতেই বাল্ব জ্বলে না। সে তার মাথার উপরের টর্চ খুঁজতে থাকে। সেটিও পায় না। অথচ সেটি সে ঘুমানোর আগেই মাথার উপর রেখেছে।
ধপ ধপ ধপ পায়ের আওয়াজ কানে ভাসে। শক্ত হয়ে জমে যায় সে। দেশলাইকাঠি জ্বালিয়ে হারিকেন খুঁজে নেয়। হারিকেনে আলো জ্বালিয়ে গমগম স্বরে “কে” বলে উচ্চস্বরে ডাক দিতেই
সেই পায়ের শব্দগুলোতে এবার দৌড়ানির আভাস টের পায় সম্রাট। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বার্তা অনুসরণ করে সে হারিকেনের আলোয় একদম কমিয়ে নীরবে পা ফেলে বেরিয়ে পড়লো কক্ষে থাকা প্রকান্ড তলোয়ারটি সাথে নিয়ে।
সে ঘর বেরোনোর সাথে সাথেই পায়ের শব্দগুলো ছাদের দিকে উঠতে থাকে। বাইরে বিকট শব্দে গোলাগুলির শব্দ হয়। আগুনের ঝলকানি মহলের ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সকলের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয় শেহজাদ। ঘাম দিতে থাকে কপালে। ডাকাতদের দল কি করে প্রবেশ করেছে অন্দরমহলে? এ অবিশ্বাস্য!
তৎক্ষনাৎ তীব্র বেগে ছুটে আসা একটি শরীর এসে পিঠে বাড়ি খায়। ক্রুদ্ধ হয়ে পেছনে ফিরে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করতেই অদ্ভুত শব্দ করে তার গায়ের উপর ঢলে পড়ে এক কোমলমতি নারী শরীর। মজবুত হাতের বেষ্টনী দ্বারা আবৃত করে হারিকেন উপরে তুলে মুখাখানা দেখার চেষ্টা করে সে। প্রবল আঘাত, ভয়, আতঙ্কে ছোট হয়ে আসা কন্যাটির দুচোখ ব্যাথার জল টলমল করতে করতে গড়িয়ে দুপাশে।
শেহজাদ দেখলো মেঘের কোলে একটি চাঁদ যে নিজেকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য পুরোপুরি নিস্তেজ হওয়ার পূর্বে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে
আমি ডাকাত নই। অ-প- রূপা।
শেহজাদ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে উচ্চারণ করে,
রূপা!
চলবে……