প্রিয় বেগম (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব-০১

0
1642

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_০১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

সভাসমাবেশে বড় আসনটিতে শেরহাম বসা। সামাদ আর মুরাদ তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে শেরহামের সৈন্যদের পদচারণা। ডাকাতির অভিযোগে অনেকজন বন্দি ছিল শেহজাদের আদেশে। তাদের মুক্তি দিয়েছে শেরহাম। তারা মুক্তি পেয়ে উন্মাদের মতো বিচরণ করছে চারপাশে। সায়রা সোহিনীদের আটকে রেখেছে খোদেজা। প্রয়োজনের বেশি এদিকওদিক ঘুরঘুর করা যাবেনা। তাদের নিরাপত্তারক্ষী তাদের শেহজাদ ভাইজান বন্দি। বিপদ চারপাশে ওঁৎ পেতে আছে। শুধুমাত্র তটিনীকেই দেখা যাচ্ছে।
অপরূপা ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে অঙ্গীকার পত্রের পুনঃপাঠ মনোযোগ দিয়ে শুনলো। অতি আশ্চর্যান্বিত হয়ে ভাবলো কি এমন হলো যার কারণে সম্রাট উনাকে ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন? সম্রাটই বা কোথায়? বিদেশ ভ্রমণ কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাহলে কি উনাকে বন্দি করে রেখেছে শেরহাম সুলতান? মহলের ভেতর প্রবেশের রাস্তা খুঁজে পেল না অপরূপা। শেহজাদের কোনো বিশ্বস্ত সৈন্যকেই সে দেখতে পাচ্ছে না। তারমানে তারাও বন্দি! এছাড়া গুটিকয়েকজনকে দেখা গেল যারা শেরহামের হয়ে কাজ করছে। যে সম্রাট তার আদেশই পালন করবে এটাই স্বাভাবিক। তটিনীর দিকে চোখ গেল অপরূপার। দ্বিতল চত্বরে দাঁড়িয়ে মনোযোগ রেখেছে সভায়। তার পোশাক আশাক আর সাজ দেখে মনে হচ্ছে সে মহলের বেগম। মহলের মেয়েরা তো এমন পোশাক পড়েনা! এক সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু এত পরিবর্তন হয়ে গেল কি করে? তটিনী কি বিবাহিত! কিন্তু তার স্বামী কে? শেহজাদ সুলতান কোথায়?
তীব্র কৌতূহল দমিয়ে সে সাফায়াতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। সাফায়াত তটিনীর সাথে কথা বলা শেষে সভার একপাশে এসে দাঁড়ালো। শেহজাদের ক্ষমতায় অর্থসচিব ছিল সে। কোষাগারের সমস্ত হিসেবনিকেশ সে রাখতো। তাছাড়া নগরের সমস্ত কিছুর দেখভাল সে করতো। শেহজাদ বলতো সে ঘর হলে সাফায়াত সেই ঘরের খুঁটি। নিজের সমস্ত দায়িত্ব আজ সামাদ নামের লোকটার হাতে তুলে দেয়া কি এক অবিমিশ্র যন্ত্রণার সাফায়াত ছাড়া তা কেউ জানেনা। বড় ভাইজান এর ফল ভোগ করবে। কে জানে তখন অনেক দেরী না হয়ে যায়। সাফায়াত তার অঙ্গীকারপত্র সামাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে আসার সময় এক সাহিত্যবিশারদ হঠাৎই বলে উঠলেন,
‘ আরেহ সাফায়াত সাহেব সম্রাট এভাবে হুট করে দেশ ছাড়লেন। আর আমরা জানিনা? আগামী যাত্রাপালার কি খবর তাহলে?’
সাফায়াত কিছু বলবেই তার আগেই বিকট শব্দে বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠলো। মুরাদ এসে তাকে নিয়ে গেল। কিছুদূরে এসে সাফায়াত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুরাদকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ তোদের সব কটাকে দেখে নেব আমি। শেহজাদ সুলতান একবার বেরোতে পারলে তোদের একটারও গর্দান রাখবে না। ‘
মুরাদ হো হো করে হেসে উঠে চলে গেল। সাফায়াত হনহনিয়ে চলে যেতে পা বাড়াবে তখনি একটা রমণীর সাথে ধাক্কা লাগলো। পেছনে ফিরে দুঃখীত বলতে যাবে তার আগেই রমণীর চোখের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মুখের একটাপাশ দেখিয়ে নিজেকে চেনাতে সাহায্য করলো অপরূপা। সাফায়াত কোনো কথা ছাড়াই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। দুজনেই বুঝতে পারলো তাদের এখানে কথা বলাটা ঠিক হবে না তাই সাবধানতা অবলম্বন করে সুকৌশল অন্দরমহলে নিয়ে এল অপরূপাকে। শেরহামের সৈন্যরা সকলেই সভাসমাবেশের আশেপাশে। বহুকষ্টে অপরূপা অন্দরমহলের পা রেখে সাফায়াতের সাথে দ্রুত পায়ে এগোলো। নিরাপদ স্থানে এসে সাফায়াত জিজ্ঞেস করলো,

‘ রূপা! তুমি কোথায় ছিলে? কোথায় খুঁজিনি আমরা তোমাকে? এই সাতদিন আমি নিজেই খুঁজেছি তোমাকে। ‘

রূপা বলল,

‘ আমি এক জেলের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। অসুস্থ হয়ে পড়ায় এতদিন ফিরতে পারিনি। সম্রাটকে দেখতে পাচ্ছিনা। কোথায় উনি? ‘

সাফায়াত তাকে সবটা বিস্তারিত খুলে বলার পর অপরূপা বিস্ময়াহত, স্তব্ধ। সম্রাট বন্দি, ক্ষমতাচ্যুত, আর তটিনীকে নিকাহ করেছেন শেরহাম সুলতান! শেষমেশ তটিনীর কপালে এটা লেখা ছিল! সাফায়াত আরও বললো,
‘ ভাইজান ঠিকঠাক কিছু খাচ্ছে না। গ্রিলে আঘাত করতে করতে হাতটা প্রায় আঘাতপ্রাপ্ত। ‘

সেসব শুনে অপরূপার বর্ণনাতীত অসহ্য একটা ব্যাথা অনুভূত হলো। শেহজাদের দেখা পাওয়ার জন্য সে উতলা হয়ে উঠলো।

হঠাৎ নারী পদধ্বনি কানে আসতেই সাফায়াত আর অপরূপা দুজনেই ভড়কে গেল। অপরূপা ওড়নায় মুখ ঢেকে নিল পুনরায়। ঘাড় ফিরাতেই তটিনীকে দেখতে পেল। তটিনী সরু চোখে চেয়ে আছে। তার চেহারা শুকিয়েছে। চোখের নীচে পুরু কালি। দুঃখ ঠিকরে পড়ছে। অপরূপা পারেনা তার সমস্ত দুঃখ বুলিয়ে দিতে। অন্যরকম একটা বিষাদে বুক ভার হয়ে এল। সে তটিনীর খারাপ চায়নি কভু। কিন্তু তারপরও তটিনীর দুঃখের জন্য সে দায়ী। এই বিচিত্র জীবনে মাঝেমধ্যে আমরা জড়াতে না চেয়েও জড়িয়ে যায় ভুলের সাথে। ভুলত্রুটি ইচ্ছাকৃত না হলেও “মানুষ মাত্রেই ভুল” একথা প্রমাণের স্বার্থে অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে যায়।

‘ ভাইজান কে উনি? ‘

সাফায়াতের মনে হলো সে অপরূপাকে দেখলে প্রতিক্রিয়া করবে। শেরহামকে বলে দেবে। কিন্তু তটিনী কিছুই করলো না। অপরূপা ধীরে ধীরে ওড়না সরিয়ে নিল মুখ থেকে। তটিনীর চোখদুটোরও রঙ পাল্টালো তার সাথে। অবাকান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অপরূপার দিকে।

‘ তুমি? এতদিন কোথায় ছিলে? তুমি জানো তোমার কারণে মহলের আজ এই অবস্থা। শেহজাদ ভাইয়ের এই অবস্থা। আমার এই অবস্থা কার জন্য জানো? আমার কথা ছাড়ো। আমি তো গেলাম জাহান্নামে। তোমার স্বামীর কথা ভাবো। সে তো বন্দি হয়েছে তোমার কারণে। তোমাকে উদ্ধার করার জন্য সবকিছু শেরহাম সুলতানের হাতে তুলে দিয়েছে। ‘

অপরূপা সুধীর গলায় বলল,
‘ আমি সবটা শুনেছি। আপনার এই পরিণতির জন্য যদি আমাকে দায়ী করেন তাহলে আমার কিছুই করার নেই। আমার এই পরিণতির জন্যও শেরহাম সুলতান দায়ী। আমি নিজেই ভুক্তভোগী। সেখানে সান্ত্বনাবাণী আমি শোনাবো না। কিন্তু আমার জন্য মহলে কিংবা নগরে কারো ক্ষতি হোক তাও আমি চাই না। আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করব শেরহাম সুলতানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। ‘

সাফায়াত তটিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে বোন।
তুমি মামীমাকে জানিয়ে এসো রূপা এসেছে। উনি একটু হলেও শান্ত হবেন। ‘

তটিনী মৃদু মাথা নেড়ে চলে গেল। সাফায়াত বলল,
‘রূপা চলো। বড় ভাইজানের কানে যাওয়ার আগে দেখা করতে হবে। ‘

অপরূপা মুখ ঢেকে নিল। সাফায়াতের সাথে চলে গেল। সাফায়াত কয়েদখানার উদ্দেশ্যে চললো অপরূপাকে সাথে নিয়ে।
অপরূপার বুকের ভেতর তখন তোলপাড় হচ্ছে। মানুষটা কেমন আছে এখন? কি করে সে উদ্ধার করবে?

****

একই মহলের ভেতরে, সেই মহলের একটা প্রাণ যার পদচারণায় মুখোরিত হতো মহলপ্রাঙ্গন সেই মহলের চতুর্থ ভবনের কোণায় অন্ধ কুঠুরির একটা কক্ষে সেই প্রাণটা বন্দি।
ছোটবেলা থেকেই দেশ বিদেশ চষে বেড়ানো প্রাণটার নিজের বন্দিদশা নিজেরই সহ্য হলো না। তাই তো সহ্যর সীমা পেরিয়ে যেতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে, লোহার গ্রিল ঝাঁকিয়ে নিজের এই বন্দিদশা হতে মুক্তি চেয়েছে। যখন শরীরে ক্লান্তি নেমে আসে তখন খোদাতায়ালার স্মরণ হতেই শান্ত হয়ে বসে পড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। এই সংকট থেকে তিনি নিশ্চয়ই তাকে উদ্ধার করবেন। রূপাকেও সহিসালামতে ফিরিয়ে আনবেন।
প্রচন্ড ধৈর্যশালী মনটা তারপরও মাঝেমাঝে বেপরোয়া হয়ে উঠে। রূপা এখনো আসছেনা কেন? কোথায় সে? নাকি এভাবে তাকে হারিয়ে দিয়ে অতল গহ্বরে নিজেও হারিয়ে গেছে? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।

রক্ষীরা আটকালো সাফায়াত আর অপরূপাকে। সাফায়াত বলল,
‘ বেগম এসেছেন। দেখা করতে দিতে হবে। ‘
‘ কিন্তু। ‘
‘ কোনো কিন্তু নয়। পথ ছাড়ো। ‘
রক্ষীরা পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। শেরহামকে খবর দিতে চলে গেল। অপরূপা সাফায়াতের পিছু পিছু ছুটলো দ্রুতপায়ে।

কমলা রঙের বাতি জ্বলছে কুঠুরিতে।
গলির দুপাশে সবগুলো কয়েদে বন্দি সৈন্যরা। অপরূপা আর সাফায়াতকে দেখে তারা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলো উৎসুক চোখে। অপরূপা তাদের দিকে একে একে তাকালো ব্যাথিত চোখে। কেমন আকুল চোখে মুক্তির আশায় তাকিয়ে আছে সকলে।
শেহজাদের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো তারা।

মাঝারি আয়তনের কক্ষটির গ্রিলের ওপাশে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে হাঁটুর উপরে দু-হাত ঠেকিয়ে ভাবনায় মগ্ন হয়ে বসেছিল শেহজাদ। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ এ কয়েকদিনে ফ্যাঁকাশে হয়ে এসেছে।
সাফায়াতের ডাকে ধ্যান ভাঙলো। ধীরেধীরে উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত করে গ্রিল ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ তোমার আসতে এত দেরী হয় কেন? নাকি আমি এখানে আছি বলে তোমার আমাকে মনেও পড়ছে না। এখন কি মনে করে এলে? কার খবর এনেছ?
আম্মা আব্বা বড়চাচা কেমন আছে? রূপার কোনো খবর এনেছ?’

সাফায়াত ঠোঁট কামড়ে উত্তেজনা চেপে বলল,

‘ স্বয়ং রূপাকে নিয়ে এসেছি ভাইজান। ‘

শেহজাদের মসৃণ কপালে ভাঁজ পড়লো। কৌতূহলী হয়ে উঠলো দুচোখ। সাফায়াতের পেছন থেকে ধীরেধীরে উঁকি দিল অপরূপা।
শেহজাদ কপাল কুঞ্চন করে তাকালো।
অপরূপাকে আগাগোড়া দেখে কপাল মসৃণ হয়ে এল।
সাফায়াত বলল,
‘ আমি বাইরে পাহাড়া দিচ্ছি রূপা। কথা সেড়ে নাও দ্রুত।’
সাফায়াত চলে যেতেই অপরূপা শেহজাদের দিকে পুনরায় তাকালো। শেহজাদ এখনো অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার এলোমেলো চাউনি, পান্ডুর মুখ, রোষাবিষ্ট চেহারায় ধীরেধীরে নেমে আসা শীতলতা দেখতে দেখতে ধীরপায়ে এগিয়ে এল অপরূপা। পূর্বে এতটা অপরিপাটি কখনো দেখেনি সে সম্রাটকে। সামনাসামনি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে গ্রিল ধরে বলল,
‘ এটা কি করলেন আপনি? আমার জন্য ক্ষমতা উনার হাতে তুলে দিলেন? আর উনি খুশি হয়ে আপনাকে মাথায় তুলে রেখেছে।’
শেহজাদ নিস্পৃহ কন্ঠে বলল,
‘ ক্ষমতা দিয়ে কি করব? ‘
অপরূপা সাথেসাথেই বলে উঠে,
‘ আমাকে দিয়ে কি করবেন? ‘
পেছনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে শেহজাদ কপাল উঁচিয়ে বলল,
‘ সে কথা পরে আলোচনা হবে। এতদিন কোথায় ছিলে? ‘
‘ জেলেবাড়িতে। অসুস্থ ছিলাম তাই আসতে পারিনি। আপনি জানতেন আমি আসব? ‘
‘ বিশ্বাস ছিল। আর আমার বিশ্বাসকে সত্যি করাটাই রূপার কাজ। ‘

অপরূপা টলটলে চোখজোড়া আড়াল করার চেষ্টা করে স্মিত হেসে বলল,
‘ নিজের এ কি অবস্থা করেছেন? হাত দেখি। ‘

শেহজাদ হাতদুটো পেছনে লুকিয়ে রেখে বলল,

‘ তোমাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি ফিরে এসেছ এটা আমার কাছে প্রশান্তির। যতবার হারিয়ে যাবে ততবারই এভাবে ফিরে এসো। আমি প্রত্যেকবার তোমার অপেক্ষায় থাকবো। ‘

‘ আর যদি না আসি? ‘

‘ তাহলে বুঝবো কেউ কখনোই কারো ছিলাম না। ‘

অপরূপা আক্ষেপসুরে বলে,

‘ আপনি আমার জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে দিলেন। আর আমি কিছুই করতে পারলাম না আপনার জন্য। ‘

‘ এবার করবে। ‘

‘ কি করব আমি? ‘

‘ চেষ্টা করলে উপায় বের হবে। পরাগ পাহাড়ের জাদুকরদের সাথে যেভাবে লড়েছ, শেরহাম সুলতানের সাথে ঠিক একইভাবে লড়তে হবে। ‘

‘ আমি পারব?’

‘ আর কে পারবে? রূপা কি দুটো আছে যার মুখ চেয়ে থাকবো আমি।’

অপরূপার দুচোখ চকচক করে উঠলো। সুপ্রসন্ন কন্ঠে বলল,

‘ আপনি আমার আশায় ছিলেন? ‘

শেহজাদ তার আনন্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ হ্যা। কারণ রূপা সাহসী, বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ। আমার বেগম বলে কথা । আমার অনুপস্থিতিতে তাকে সবাইকে আগলে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। সবকিছুর দেখভাল করতে হবে। আমার আর আমি যাদের ভালোবাসি তাদের। ‘

সাফায়াত এসে বলল,
‘ রূপা দ্রুত এসো। ‘
সাফায়াত চলে যেতেই অপরূপাও যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। ফের ছুটে এসে গ্রিল ধরলো। শেহজাদ সরু চোখে তাকালো। গ্রিলে হাত দিতেই অপরূপা হাতটা নিয়ে হতভম্ব হয়ে দেখলো হাতের তালুতে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে, আঙুলগুলো ফুলো, কালচে দাগ হয়ে গেছে। সে অতি আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ হাত দিয়ে কেউ গ্রিল ভাঙে? কি অবস্থা করেছেন হাতের?

অপরূপা ওর বাম হাতের তালুতে আঙুল ছুঁয়ে দিতে ব্যস্ত। শেহজাদ ডান হাতে তার কপালের সামনে চলে আসা উড়ো চুল সরিয়ে দিতে দিতে গালের পাশে হাত রাখতেই অপরূপা শক্ত হাতটা গালের সাথে, কানের সাথে চেপে চোখ বুঁজে রইলো। শেহজাদ তার অন্য হাতটেনে এনে মুঠোয় নিয়ে শক্ত চুম্বন বসিয়ে বলল

‘ রাতের খাবারটা তুমি নিয়ে এসো। হাতের ব্যাথায় খেতে পারিনি এতদিন। তোমার হাতে খাব। ‘

কি সহজ সরল আবদার!
অপরূপা আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না। শেহজাদের দিকে আর একপলকও না তাকিয়েই চলে এল সাফায়াতের পেছনে। সাফায়াত ওকে দেখে বলল,

‘ চলো। ভাইজানকে এখান থেকে বের করার উপায় বের করতে হবে। তার আগে বড় ভাইজানের সাথে আপাতত তর্কে জড়ানো যাবে না। ‘

অপরূপা সম্মতি জানিয়ে তার পেছনে যেতে যেতেই হাতটা বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলো। সম্রাট তার শক্তি, উৎসাহসঞ্চারী, অনুপ্রেরণা, ভালোবাসা, প্রথম ও শেষ প্রেম।

**********

খোদেজা অপরূপাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। অপরূপাকে উনাকে ধরতেই উনি অপরূপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ ওখানে আমাকে যেতে দেয় না। আমি একবার দেখবো শেহজাদকে। ‘
অপরূপা সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘ আপনার ছেলে ভালো আছে। এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি দেখে এসেছি। সায়রা রাতের খাবার তৈরি আছে? ‘
সায়রা জানান দিল, ‘ হ্যা। কিন্তু ভাইজান ভাত খান না। সাফায়াত ভাই ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন। ফেরত নিয়ে এসেছেন। কলা রুটি খেয়েছেন কাল। সকাল থেকে এখনো সেই একটা রুটি খেয়েছেন। তোমাকে কিছু খাবে বলেছে? ‘
অপরূপা বলল,
‘ না। সেসব বলেননি। আজ রাতে মাছ মাংস ডাল দেব। আর কাল সকালে জর্দ্দ-বিরিঞ্জ বানিয়ে দেব। অবশ্যই খাবেন। ‘
তাদের কথা থেমে গেল সোহিনীকে দেখে।
সোহিনী ছুটে এসে অপরূপাকে ভীত চোখে চাইলো। বলল,
‘ ভাইজান ডাকছেন তোমাকে। ‘
সাফায়াত বলল,
‘ তোমাকে যেতে হবে না রূপা। আমি যাচ্ছি। ‘
সাফায়াত চলে গেল। শেরহামের চেঁচামেচি ভেসে আসছে। তটিনীরও চেঁচামেচি। অপরূপা সায়রাদের সাথে যেতেই শেরহাম তাকে দেখে কটমট স্বরে বলল,

‘ এইই তোমার সাহস কি করে হয় আমার কথা অমান্য করে ওর সাথে দেখা করতে যাওয়ার? এত সাহস কোথায় পাও? এত স্পর্ধা! এতকিছু হলো মরলো না। ‘

অপরূপা কঠিন চোখে চেয়ে থাকলো। তটিনী বলল,
‘ তুমি সবকিছু পেয়ে গেছ। এবার শেহজাদ ভাইকে ছেড়ে দাও। ‘
‘ ছাড়ব না। ও যতদিন আমার কাছে এসে বশ্যতাস্বীকার করবে না ততদিন ওকে আমি ছাড়ব না।’
অপরূপা ঝাঁজালো সুরে বলল,
‘ আপনার কি মনে হচ্ছে আপনি উনাকে বন্দি করে রাখবেন আর আমরা চুপচাপ তা দেখবো? সবখানে ছড়িয়ে দেব আপনি সম্রাটকে বন্দি করে অভিষেকের আয়োজন করেছেন। মাত্রই তো অভিষেক হয়েছে। দেখবো কত ভালো করে নগর পরিচালনা করেন। ডাকাতকে অর্থসচিব বানিয়েছেন। সে সব লুটেপুটে খেয়ে চলে যাবে। তখন আপনার কি হাল হয় তা আমি দেখবো। সেই সময় শেহজাদ সুলতানের শরণাপন্ন হতে হবে। ‘

শেরহাম আঙুল তুলে বলল
‘ এই চোপ। আমি কি এতটাই অযোগ্য যে নগর পরিচালনা করতে পারব না? ‘

‘ আপনি অযোগ্য না। আপনি লোভী। বোকা, ঠক। নিজের ভাইয়ের সাথে যে এমন আচরণ করতে পারে সে কখনোই ভালো রাজা হতে পারে না। ‘

‘ চুপ। ও আমার ভাই নয়। ও পালিত পুত্র। আর এত ফটরফটর করছো কোন সাহসে? আমি গলা টিপে মারলে কে বাঁচাবে? ‘

সাফায়াত চেঁচিয়ে বলল,
‘ আপনি কিসব কথা বলছেন? আপনি এখন ছোট ভাইয়ের বেগমের গায়ে হাত তুলবেন? ‘

তটিনী বলল,
‘ অভ্যাস হয়ে গেছে কি করবে? নিজের বেগমের গায়ে হাত তুলে সেখানে ভাইয়ের বেগম কি যায় আসে? নোংরা লোক। ‘

শেরহাম অগ্নিশর্মা হয়ে তটিনীর হাত চেপে ধরে কক্ষের দিকে টেনে নিয়ে গেল। শাহানা বলল,
‘ শেরহাম ছাড়ো। কি করছো? ওর সাথে কেন এমন করছো? ‘
সাফায়াত মাকে আটকে বলল,
‘ তটিনী আত্মরক্ষা জানে আম্মা। কাঁদবেন না। ‘

***

শেরহাম তটিনীকে কক্ষে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে মেরে বলল,
‘ এই তুই ওদের সামনে আমার দিকে আঙুল তুলেছিস কেন? ‘
তটিনী ফিরে বলল,
‘ তো কি তোমার গান গাইবো? ‘
শেরহাম এগিয়ে আঙুল দ্বারা মুখ চেপে ধরে বলল,
‘ গান গাইবি। সবার সমস্যা কি? শুধু শেহজাদ শেহজাদ করা ছাড়া কিছুই পারিস না? লজ্জা করে না স্বামী থাকতে বিবাহিত একজনের নাম গাইতে সারাক্ষণ। নাকি তাকে ধ্যান জ্ঞান সব দিয়ে রেখেছিস বলে খুব জ্বলে? ‘

তটিনী ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কক্ষের এককোণা থেকে তলোয়ার তুলে নিয়ে শেরহামের দিকে বাড়াতেই শেরহাম হাতে গিয়ে আটকে তা ফের ছুটে গিয়ে তটিনীর কপালে গিয়ে ঠেকতেই চেঁচিয়ে উঠে কপাল চেপে সাথেসাথেই তার গায়ের উপর ঢলে পড়লো তটিনি। তটিনীর কপালের সাথে সাথে শেরহামের হাতেও রক্তের স্রোত বয়ে গেল। আর তার চিৎকারে ছুটে এল সবাই মিলে। কক্ষের প্রবেশ করামাত্রই সাফায়াত শেরহামেকে ঘুষি মারতে লাগলো একনাগাড়ে। শেরহাম বুঝতেই পারেনি এভাবে আক্রমণ করে বসবে সাফায়াত। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার নাকমুখ ফেটে গেল।
তটিনী চোখ বুঁজতে বুঁজতে বলল,

‘ ভাইজান ভুল আমার। ‘

চলমান….
রিচেক করা হয়নি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে