#প্রিয়_বালিকা |অন্তিম|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
খুব জাঁকজমকভাবে সাজানো হয়েছে রৌদ্রের তৈরি রাজকীয় মসজিদটি।একাধিক উঁচু মিনার আর অসংখ্য গম্বুজ দিয়ে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে।মসজিদের বাহির অংশটা না আকর্ষণীয় তার থেকে বেশি আকর্ষণীয় মসজিদের ভিতরের সাজ সজ্জা।অসংখ্য তীব্র পাওয়ারের সোনালি সাদা আলোই ভিতররটি জ্বল জ্বল করছে।রয়েছে বিশাল ঝাড়বাতি। মেঝেতে রয়েছে মোলায়েম কার্পেট।সব মিলিয়ে এ যেন কোনো রাজ প্রাসাদের থেকে কম নয়।আজ এখানেই সকলের থেকে দোয়া নিবে একজোড়া বাবুইপাখি।শুরু করবে এক টুকরো সোনার সংসার।
বর সেজে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র।বুকে হাত গুঁজে রেখেছে।একপা ভাঁজ করে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে।দৃষ্টি সামনে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা আভার দিকে।আভাকে সাজানো হচ্ছে।রৌদ্র করুণ চাহনিতে তাকেই দেখছে।প্রায় একঘন্টা হলো।তখন থেকে মেক-আপ আর্টিস্টগণ আভার মুখে ফোমের মতো একটি জিনিস দিয়ে ঘষামাজা করে করছে।রৌদ্র এবার খানিকটা বিরক্তির সুরে বলল,
– আচ্ছা আর কতক্ষণ লাগবে আপনাদের?
একজন আর্টিস্ট আমতা আমতা করে বলল,
– জ্বী মাত্রই তো বেজ করে আই মেক-আপ টাচ করলাম।আরো খানিকটা সময় লাগবে।
আভা চোখ বন্ধ রেখেই রৌদ্রকে বলল,
– আপনি এতো তাড়া দিচ্ছেন কেন?বললাম তো নিচে থেকে ঘুরে আসুন মেক-আপ শেষ হলে আপনাকে টেক্সট করবো।
রৌদ্র রাগে কটমট করে বলল,
– এখন আমি বর সেজে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াবো নাকি?
সহসা কেউ এসে রৌদ্রের থায়ের সাথে বারি খেল।তাতে রৌদ্র তার জায়গা থেকে কিছুটা সরে সামনে চলে গেল।মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল পুতুলের মতো একটি মেয়ে।যার মাথার ঠিক মাঝখানে গোলাপি রঙের হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে তালগাছের মতো একটি ঝুঁটি বাঁধা।রৌদ্রের থায়ে বারি খেয়ে সে নাকে একটু ব্যাথা পেয়েছে।রৌদ্রের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে নাক ডলছে সে।রৌদ্রের কপাল কুঁচকে এলো।বাচ্চাটা কার ভেবে ঘাড় কাত করল রৌদ্র।বাচ্চাটি রৌদ্রকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে সন্দিহান স্বরে বলল,
– ও আচ্ছা তাহলে তুমিই গ্রুম?ব্রাইড কোথায়?
মেয়েটির আদো আদো স্বরের এমন বাক্যে চমকিত হলো রৌদ্র।বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো বাচ্চাটির দিকে।বিস্মিত স্বরে বলল,
– তুমি কে বাবু?এই ঘরে কি করো?
মেয়েটির গম্ভীর জবাব,
– মাম্মা বলল ব্রাইড এখানে।আর ব্রাইড মাম্মা’স ফ্রেন্ড।
চট করে চোখ খুলে ফেলে আভা।মেক-আপ আর্টিস্টদের থামিয়ে নজর রাখে রৌদ্রের সামনে দাঁড়ানো গোলাপি ফ্রক পরা মেয়েটির দিকে।বলে,
– মাম্মা’স ফ্রেন্ড?তোমার মা কে বাবু?
মেয়েটি রৌদ্রের থেকে নজর সরিয়ে আভার দিকে তাকায়।আভাকেও পা থেকে মাথা অবধি অবকলন করল।বলল,
– তুমি ব্রাইড।
আভা কিছু বলার আগেই রৌদ্র বলল,
– হ্যাঁ ও ব্রাইড।তোমার আম্মুর নাম কি বাবু?
মেয়েটির সহজ সরল জবাব,
– পূর্ণতা।সবাই পূর্ণ বলে ডাকে।
আভা ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।চেয়ার থেকে উঠে সে পুতুলের মতো মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো।গাল টেনে বলল,
– আম্মু কোথায় তোমার?
মেয়েটি তর্জনির ইশারায় দরজার দিকে দেখালো।সকলে নজর ফেলল দরজায় নীল শাড়িতে একটি যুবতীর উপর।সে ঠোঁট প্রসারিত করে আভা এবং তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।রৌদ্র বিগলিত হেসে পূর্ণতাকে বলল,
– কেমন আছো?
পূর্ণতা নম্র স্বরে জবাব দিলো,
– জ্বী ভাইয়া ভালো আছি আপনি কেমন আছেন?
-জ্বী ভালো আছি।ও তোমার মেয়ে?
রৌদ্রের অবাক স্বরে করা প্রশ্নের জবাবে ধীর গতিতে উপর নিচ মাথা নাড়ে পূর্ণতা।রৌদ্রের চোখ আরো বড় হয়ে যায়।অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
– তোমার বিয়ে হলো করে?আর এতো বড় মেয়েই বা হলো কবে?
রৌদ্রের কথায় স্মিত হাসে পূর্ণতা।চোখের ইশারায় বোঝায় একটু পর বলছি।এগিয়ে আসে আভার দিকে।আভা এখনো তব্দা হয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে।সে বিশ্বাসই করতে পারছে না পূর্ণতা তার সামনে।সে পূর্ণতাকে ই-মেইল পাঠিয়েছিল।কিন্তু পূর্ণতা তার ই-মেইল পেয়ে সত্যি সত্যি হাজির হবে তা সে কল্পনাও করেনি।পূর্ণতা আভাকে আলতো জরিয়ে ধরে বলল,
– কেমন আছিস আভা?আমাকে তো হয়তো চিনতেই পারিসনি।
আভা অবাক স্বরে বলল,
– ভালো আছি রে।তুই সত্যি আসবি আমি ভাবতেও পারিনি।ওর বাবাও এসেছে?
পূর্ণতার মেয়ের দিকে ইশারা করে বলল আভা।পূর্ণতা নিচু হয়ে মেয়েকে আদুরে স্বরে বলল,
– আম্মু তুমি বাহির থেকে একটু ঘুরে এসো তো।
মেয়েটি মায়ের আদেশের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও ব্যয় করে না।মায়ের কথা মতো তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করে সে।পূর্ণতা মেয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে উদাসীন স্বরে বলে,
– ওর বাবা নেই।
চমকে ওঠে রৌদ্র আভা উভয়ে।পূর্ণতার কথার মর্মার্থ বুঝতে না পেরে চেয়ে বয় পূর্ণতার দিকে।পূর্ণতা ঘাড় ঘুরিয়ে আভার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে।বলে,
– এখান থেকে যাওয়ার পর বড়লোক ছেলে দেখে মা আমার বিয়ে দেয়।প্রীতি হওয়ার পর আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।এখন ও ওর মতো আছে আমি আমার মতো মেয়েকে নিয়ে বেশ আছি।
আভা আনমনেই বলে,
– সিঙ্গেল মাদার?!
মাথা নেড়ে সায় দেয় পূর্ণতা।কৌতুহলী রৌদ্র জিজ্ঞেস করল,
– ডিভোর্স হলো কেন?
– নারীর মায়া বড়ই বিষাক্ত।কেউ আপনার নারীর বিষাক্ত মায়ায় জরায় তো কেউ পরনারীর বিষাক্ত মায়ায় জরিয়ে আপন নারীকে অস্তিত্বহীন করে।
আভা বলল,
– বিয়ে করিসনি কেন?
– আমি তো বেশ আছি মেয়েটাকে নিয়ে।আমার আর কাউকে চাই না।
রৌদ্র আভা দুজনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ এক শ্বাস।পূর্ণতা থমথমে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল,
– আরে আভা তোকে তো একদম রাজরানি লাগছে রে।আর ভাইয়া আপনাকেও তো রাজার মতো লাগছে।
বলেই হাসে পূর্ণতা। আভা এবং রৌদ্রও হাসে।আভাকে আবার সাজানোর জন্য তোড়জোড় শুরু হয়।
লাল টকটকে ভারি লেহেঙ্গা সাথে সাদা পাথরের গহনায় সাজানো হয় আভাকে।শরীরর প্রতিটি কোণায় অলংকৃত তার।শুধু নাক ছাড়া।গলা,হাত,কান,টিকলি,টায়রা সবকিছুতে একদম অপ্সরা লাগছে।ছোট্ট ছোট্ট ডায়মন্ডে তৈরি ভারি গহনায় আভাকে আরো উজ্জ্বল লাগছে দেখতে।গোল্ডেন শেরওয়ানি পরেছে রৌদ্র।মাথায় বরের টোপর।ঠোঁটে চাপা হাসি।হাতে হাত দিয়ে চলছে দু’জন। পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মসজিদের ভিতরে।ভিতরে প্রবেশ করতেই ইমাম,মুয়াজ্জিন, কাজী তাদের সালাম দিলো।রৌদ্র সবাইকে আলিঙ্গন করে কুশলাদি বিনিময় করলো।সকলের সাথে আরাভ এবং অভয়ও রয়েছে তাদের অপেক্ষায়।মেয়েকে রানী রূপে দেখে খুশিতে চোখ ভরে উঠলো আরাভ সাহেবের।অভয়ও অপলক দৃষ্টিতে বোনকে তৃপ্তি সহকারে দেখছে।কি দেয়নি রৌদ্র তার বোনকে?একদম রানীর মতো তাকে সাজিয়ে তুলেছে।আরাভ এবং অভয়ের মুখে একই সাথে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।রোদেলা গর্বের সাথে বলে উঠলো,
– একে বলে পুরুষ।একটা টাকাও বাবার থেকে নেয়নি।বউয়ের জন্য যা কিছু কিনেছে সব নিজের টাকায় নিজের পছন্দে।
রৌদ্র মাথা নত করে ফেলল মায়ের কথায়।হামিদও হেসে ছেলের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,
– বাবা প্রস্তুত তো আরেকবার কবুল বলার জন্য?আগেরবার তো আমরা দেখতে পারিনি এবার আল্লাহ্ ভাগ্যে রেখেছে।
রৌদ্র বাবাকে আলিঙ্গন করে।হামিদ এবং রোদেলা মাসের এক তারিখেই আগে এসেছে।বিয়ের জন্য সকল কেনাকাটা সবকিছু রৌদ্র এবং তার মা মিলে করেছে।আভার সাথে সাথে সকলেই গিফট দিয়েছে রৌদ্র।আরাভ সাহেব বললেন,
– চলো সবাই বসি।
অভয় গিয়ে অহনার পাশে দাঁড়ায়।অহনার কোল থেকে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তাকে আদর করতে করতে সকলের সাথে গিয়ে বসে।সেদিকে মায়াভরা চাহনিতে তাকিয়ে থাকে পূর্ণতা।মনে মনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাবল তার জীবনটাও হতে পারতো একটু অন্যরকম।একটু সুখের, একটু দুঃখের,একটু খুনসুটি মাখা,একটু সোহাগা।এভাবে তার হাত খোপার মতো অগোছালো না হলেও পারতো।
কিছুক্ষণ হাদিস ও কুরআন সম্পর্কে আলোচনা শেষে আবারো বিয়ে পড়ানো শুরু করলো কাজী সাহেব।নিকাহমানায় তারা স্বামী স্ত্রী তাই এখন কবুল না বললেও চলবে।তবু আরো একবার কবুল বলার আবদার করে রৌদ্র।তাই মুখে মুখেই আবারোও বিয়ে পড়ায় কাজী।রৌদ্রকে কবুল বলতে বলা হলে সে নিজের হাতে থাকা আভার হাতটা জোরে চেপে ধরে আভার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আভার চোখে চোখ রেখে তিন বার “কবুল” বলে দেয় রৌদ্র।আভাও রৌদ্রের চোখে দৃষ্টি রেখে “কবুল” বলে।আবারো স্বামী স্ত্রী হিসেবে একে অপরকে কবুল করলো দু’জন।
বিয়ে শেষে কিছু এতিম দুস্থ মানুষদের ভরপুর খাওয়ানো হয়।রৌদ্র আভা তাদের কাছে গিয়ে তাদের কাছে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে।রৌদ্র সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
– সকলে ভালো করে খাবেন।আর আমাদের জন্য দোয়া করবেন।আমি যেন এই মেয়েটাকে সবসময় সুখী রাখতে পারি দোয়া করবেন।এই মেয়েটা আমার জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত সেরা উপহার।
আভা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে তার স্বামীর দিকে।ইশশ!লোকটাকে আজ একদম রাজার মতো লাগছে।কি সুন্দর ব্যাক্তিত্ব তার।আভা যতবারই তাকে দেখে ততবারই তার ব্যাক্তিত্বের প্রেমে পড়ে।
রৌদ্র আভার কিছু সুন্দর সুন্দর মুহুর্তে ফ্রেমবন্দী করা হলো।আভা রৌদ্রের বুকের বামপাশে নিজের ডান হাত আলতো করে রেখে বলল,
– জীবনে একটা আফসোস রয়ে যেত জানেন?
রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কি?
– এই যে আমার বিয়ে হলো কিন্তু আমি সাজলাম না,বেনারসি পড়লাম না,গহনা পড়লাম না।বিয়ে নিয়ে সবার কত স্বপ্ন থাকে আমারও ছিল।কিন্তু পূরণ হলো না এই আফসোসটা রয়ে যেত।
রৌদ্র আভার সামনের চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে নরম সুরে বলল,
– ভাবলে কি করে তোমায় কোনো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দিবো আমি?
পরমুহুর্তেই কিছু ভাবার ভঙ্গিতে বলল,
– এই এক মিনিট তুমি তো বেনারসি পরা না লেহেঙ্গা পরা!তাহলে এখন বেনারসি পরার জন্য কি আরো একবার কবুল বলতে হবে?
আভা শব্দ করে হেসে ফেলে।রৌদ্রের বুকে হালকা আঘাত করে বলল,
– থাক হয়েছে আর কবুল বলতে হবে না।এই নিয়ে ছয়বার বলে ফেলেছি।
রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কেন তুমি আমার জন্য আরো তিনবার কবুল বলতে পারবে না?
আভার হাসি চওড়া হলো।সে রৌদ্রের গাল টেনে দিলো।রৌদ্র বিরক্ত হয়।মুখ ফোলায়।আভা হিসহিসিয়ে বলে,
– তা তো পারো তিনবার কেন হাজার বার পারবো কিন্তু এমন ভারি গহনা,জামা,মেকআপ আর করতে পারবো না।
রৌদ্র চোখ বন্ধ করে আভার টিকলির উপর ঠোঁট ছুঁয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে চুম্বন করে।অদুরে স্বরে বলে,
– থাক আর বলতে হবে না কবুল।এখন কবুল বললেও তুমি আমার না বললেও তুমি আমার।
~সমাপ্ত