প্রিয় বালিকা পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
327

#প্রিয়_বালিকা |২৫+২৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

ঝুম বর্ষায় ছাতা মাথায় খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে আভা।পাজামার অনেকটা অংশ বর্ষার পানি আর কাঁচা রাস্তার কাঁদার দখলে।বিকেলের দিকে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল সে।হঠাৎ করে আকাশ ফেড়ে নেমে এলো রহমতের পানি।এখনো সন্ধ্যা হয়নি তবে হওয়ারও বেশি বাকি নেই।রৌদ্রের সাথে কথা বলার পর থেকে তার মনটা খুব খারাপ।তারপর কয়েকবার রৌদ্রের ফোনে কল করেছিল সে।কিন্তু কল রিসিভ হয়নি।বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে আর পঁচিশ কি ত্রিশ কদম পাড় হলেই মুন্সি বাড়ি।প্রধান ফটকে এসে থেমে গেল আভা।চোখ জুড়ে নেমে এলো বিস্ময়ের ছাপ।ঠোঁট দু’টো আপনা আপনিই আলগা হয়ে গেল।ছাতা ধরে থাকা হাতটি ঢিল হতে শুরু করে।বর্ষা এবং বাতাসে তৈরি ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে আসছে সুর্দশন যুবক।ওভার সাইজ সাদা টিশার্ট আর ঢোলা ঢালা একটি কালো কার্গো প্যান্টস।পিঠে একটি কালো ব্যাগ। বর্ষায় ভিজে জুবুথুবু।সে কপালে সূক্ষ্ম ভাজ নিয়ে আভার সামনে এসে দাঁড়াল। আভা অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
– আপনি?কখন এসেছেন?

লোকটি আভার কথায় পাত্তা না দিয়ে সোজা আভার হাত ধরে বসে।টেনে মেইন রোডের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বেপরোয়া স্বরে বলে,
– চলো বিয়ে করবো।

যেন আকাশ ভেঙে পড়ে আভার মাথায়।হতভম্ব হয়ে ঠোঁটের ফাঁক বারিয়ে দেয়।মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায় তার। বিস্ময় স্বরে জিজ্ঞেস করে,
– কিহ্!

লোকটা তার কোনো কথাকে গ্রাহ্য করে না।তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।বৃষ্টি থেমে গিয়েছে।আকাশও পরিষ্কার। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান দিবে।মস্তিষ্কে প্রাণ আসতেই দাঁড়িয়ে পরে আভা।টান দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে অস্থির ভঙ্গিতে বলে,
– রৌদ্র কি করছেন আপনি?পাগল হয়ে গিয়েছেন?কি বলছেন এসব?বিয়ে মানে?

রৌদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর করে,
– বিয়ে মানে বিবাহ,নিকা,শাদী,ম্যারেজ বোঝা গেল এবার?চলো।

রৌদ্র আভার হাত ধরে আবারও টেনে নিয়ে যেতে চায়লো।আভা আবারও নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়।পূর্বের ভঙ্গিতে বলে,
– কি বলছেন আপনি এসব?বাড়ির সকলে জানে এই কথা?নাকি হুট করে বিয়ের ভুত চেপেছে আপনার মাথায়?

রৌদ্রের মুখ এবার রাগে লাল হয়ে যায়।তেজি স্বরে বলে,
– আমি বুঝতে পারছি এই ফ্যামিলি,মম,ড্যাড,বাবা,মায়ের জন্য বসে থাকলে জীবনেও আমার বউয়ের ভাত খাওয়া হবে না।আই মিন বউয়ের হাতে রান্না ভাত।একপক্ষ বলে ছেলেকে যেতে দিবো না অন্যপক্ষ বলে মেয়েকে যেতে দিবো না।তার থেকে বরং চলো আমরা বিয়ে করে দুইজন কেটে পড়ি এরা এদের কোন্দল নিয়ে থাক।এখন বেশি কথা না বলে চলো বিয়ে করবো রাত হয়ে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে বাসর রাত মিস হয়ে যাবে।চলো চলো।

রৌদ্র আবারো এগিয়ে এসে আভার হাত ধরতে চায়লে আভা সরে দাঁড়ালো।অবাক স্বরে বলে উঠলো,
– মানেহ্!পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি?আমি এভাবে বিয়ে করবো না।আমার ফ্যামিলি আমার কাছে সবচেয়ে দামি।আমি এভাবে পালিয়ে বিয়ে করলে আমার বাবা মা অনেক কষ্ট পাবে।

রৌদ্র কোনো কিছু বোঝার অবস্থায় নেই।সে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে সে আজ এখনই বিয়ে করবে ব্যস এটাই তার শেষ কথা।সে থুতনিতে তর্জনি ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– শোনো প্রথমে তো একটু কষ্ট পাবেই।কিন্তু যখন একবছর পর দুইটা কোলে ধরিয়ে দিবো না তখন এমনিতেই সব ভুলে যাবে।এখন তুমি প্যাকপ্যাক করে সময় নষ্ট না করে চলো তাড়াতাড়ি।

আভা হা হয়ে বলে উঠলো,
– এক বছরে দুইটা?

রৌদ্র দাঁত বেরিয়ে হেসে বলে,
– হ্যাঁ আমাদের তো জমজ হবে তিন্নি মিন্নির মতো।

– হু আপনাকে বলেছে!

– সত্যি দেখে নিও তুমি।আচ্ছা বেবি প্লানিং নিয়ে ঝগড়া বরং আমরা কবুল বলার পর বাসর রাতে করবো এখন চলো তাড়াতাড়ি লেট হয়ে যাচ্ছে।

আভা চোখ বন্ধ করে একটি বড় শ্বাস নিয়ে ছাতা বন্ধ করে।দীর গতিতে রৌদ্রের কাছে এগিয়ে আসে।শান্ত স্বরে বলে,
– দেখুন রৌদ্র এমন ঝোঁকের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।আমরা দুই জন ফ্যামিলিকে বোঝানোর চেষ্টা করি অবশ্যই তারা বুঝবে।আমার বাবা মাকে ছেড়ে অতদূরে থাকতে কষ্ট হবে তবে আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো।

রৌদ্র দু’হাতে আভার গাল আগলে নেয়।নরম সুরে বলে,
– কিন্তু আভা আমি তো বাংলাদেশেই সেটেল্ড হতে চাই।

আভা চোখ মুখ চক চক করে ওঠে।পুলকিত স্বরে বলে,
– সত্যি?

– হ্যাঁ।তাহলে এখন চলো বিয়ে করবো।

আভার চোখমুখ আবারো কালো হয়ে যায়।দৃষ্টি নত করে গোমড়া মুখে বলে,
– রৌদ্র কি শুরু করেছেন আপনি বলেন তো?মানে বার বার ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ে কেন বলছেন আপনি?

রৌদ্র কপাল কুঁচকে হেসে বলে,
– হোয়াট ছেমড়ি?আই লাইক দিস ওয়ার্ড।তাহলে এখন থেকে তোমাকে আমি ছেমড়ি বলেই ডাকবো।আর শোনো ছেমড়ি আমি না তোমার সাথে মোটেই মজা করছিনা।আমি সত্যিই আজকে তোমাকে বিয়ে করবো।অভয় আর ভাবি ওয়েট করছে আমাদের জন্য।তুমি জানো তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমাকে অভয়ের শক্ত হাতের একটা ঘুষিও খেতে হয়েছে।এই দেখো ঠোঁট ফুলে গিয়েছে।

রৌদ্র তার নিচের ঠোঁট বেরিয়ে দেখায়।সত্যি ঠোঁটটা কেটে গিয়েছে বাজেভাবে।আভা অবাক হয়ে তাকিয়ে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র অভয়কেও সব বলে দিয়েছে?আভা তবু এভাবে বিয়ে করতে চায় না।সে সেখানেই মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে আভাকে পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করে।আভার বুকের উপর থাকা জরজেট ওড়নাটি সহসা টান দিয়ে নিজের হাতে পেঁচিয়ে ফেলে।আচমকা এমন ঘটনাই চমকে ওঠে আভা।দুই হাত আড়াআড়িভাবে বুকের উপর দেয়।চোখ কোটর থেকে খুলে পড়ে যায় যায়।চিৎকার করে ওঠে সে,
– রৌদ্র কি করছেন আপনি এসব?আপনি কিন্তু এবার আপনার সীমা লঙ্ঘন করছেন।আমি বিয়ে করতে রাজি হইনি বলে আপনি আমার সাথে এটা করতে পারেন না।

রৌদ্র বিরক্তি চাহনিতে ওড়নায় প্যাচ দিতে দিতে আভাকে দেখছে।পাশের একটা বড় গাছের নিচে চলে গেল সে।আভা এদিক ওদিকে ছুটোছুটি করছে।রৌদ্রকে গাছের নিচে আরাম করে বসে ব্যাগ থেকে খাতা কলম বেরিয়ে কিছু লিখতে দেখে থেমে গেল সে।ভ্রু কুঁচকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে রৌদ্রের কাছে।রৌদ্র খুব উদাসীন ভঙ্গিতে ছোট একটি কাগজে কিছু লিখছে।আভা উঁকি দিতে দেখতে পেল রৌদ্র গোটা গোটা বাংলা বর্ণে লিখছে,
“প্রিয় বালিকা,
তোমার মাথার স্ক্রু ঢিলা থাকার শর্তেও আমি তোমাকে অনেক ভালোবেসেছি।ভেবেছি বিয়ের পর আমি আর আমার বাচ্চা মিলে স্ক্রু-ড্রাইভার হয়ে তোমার মাথার স্ক্রুগুলো টাইট দিবো।কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে তোমার মাথার স্ক্রু টাইট দেওয়ার সৌভাগ্য আমার নেই।তার আগেই আমি পৃথিবী থেকে নিজেকে বিলীন করে দিচ্ছি।আমি মরে যাচ্ছি তাতে আমার একটুও কষ্ট নেই বিশ্বাস করো।আমার হৃদয় ভাঙা কষ্ট শুধু এটা ভেবে যে তোমার মাথার স্ক্রু ঢিলা রেখেই আমি মরে যাচ্ছি।না জানি কখন ওগুলো খুলে মাটিতে পড়ে যায়।তখন তোমার কি হবে?স্ক্রু ছাড়া তুমি চলবে কিভাবে?এই চিন্তা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। দয়া করে স্ক্রুগুলো সামলে রেখো।

ইতি
তোমার না হওয়া স্ক্রু-ড্রাইভার”

লেখা শেষ করে বড় একটি শ্বাস ফেলে উদাসীন মুখে কাগজটি আভার হাতে ধরিয়ে দিলো রৌদ্র।আভা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে রৌদ্র আরো একটি ছোট কাগজে লেখা শুরু করে,” আমি আফসিন রৌদ্র কবুল করছি যে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী আমার হবু বউ আভা বিনতে আরাভ।আমার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় আমি গলা’য় দ’ড়ি দিয়ে আত্ম’হত্যা করছি।আপনারা তাকে কঠিন থেকে কঠিন শা’স্তি দিবেন।চায়লে তাকেও ফাঁ’সি দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন আমার কোনো আপত্তি নেই।বরং এতে আমি খুশিই হবো।ভু’ত পে’ত্নী দু’জনে মিলে সুখের সংসার গড়বো।সবকথার এক কথা এই ছেমড়ির শাস্তি হওয়া চাই-ই চাই।”
রৌদ্র এবারের কাগজটি ভাঁজ করে আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– এটা পুলিশ আসলে দিবে।

এবার সে লাফিয়ে ওড়নাটা গাছের নিচু ডালের একপাশ থেকে ঘুরিয়ে অন্যপাশে নিয়ে প্যাচ দিয়ে ফেলে।ডালটা এতোটাই চিকন আর নিচু যে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির আভাও সেটার নাগাল পাবে বিনা দ্বিধায়।আভা হা হয়ে তাকে লেখা চিঠিটি সম্পূর্ণ পড়ে।পড়তে পড়তে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার।আবার রৌদ্রের মরার কথা পড়তেই ভয়ে গলা শুঁকিয়ে যায় তার।সে তার হাতের কাগজটি ফেলে ভাঁজ করা কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করে।চোয়াল ঝুলে যায় আভার।রৌদ্র এতোক্ষণে গলার মধ্যে ওড়নার প্যাচ ঢুকিয়ে ফেলেছে।আভাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে চিঠি পড়তে দেখে বিরক্ত হলো সে।ভ্রু কুঁচকে আভা ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
– এখন কি শুধু চিঠিই পড়তে থাকবে নাকি আমাকে বাঁচাবেও?সু’ইসাইড করতে যাচ্ছি আমি।আমাকে না বাঁচিয়ে তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়ছো?মানবতার ফেরিওয়ালা আজ কোথায়?

শেষের কথাটি বেশ করুণ স্বরে বলে রৌদ্র।আভা মুখ তুলে রৌদ্রের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলো। রৌদ্রের গ’লায় ওড়না যা গাছের একটি ডালের সাথে বাঁধা।রৌদ্র এ অবস্থায় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না আভা।হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
– রৌদ্র কি করছেন আপনি এসব?কেন এসব পাগলামো করছেন?প্লিজ সরে আসুন ওখান থেকে।প্লিজ গলা থেকে ওটা খুলে ফেলুন।

রৌদ্র বাঁকা হাসে।গলা’র বাঁধন টাইট দিয়ে বলে,
– না না এতো সহজে তো আসবো না।যে মিশন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি সেই মিশন পূরণ করবো তারপর শ্বাস নিবো না হলে এখনই গ’লায় দ’ড়ি দিবো।বলো দিবো দিবো?তোমার জন্য এতোদূর কিভাবে এসছি তা শুধু আমি জানি।মম পাসপোর্ট লুকিয়ে রেখেছিল।অনেক খুঁজে ওনার জুতার বাক্সে পেয়েছি।পাসপোর্ট না পেয়ে তো আমার হার্টঅ্যাটাক হয়ে গিয়েছিল।এতো স্ট্রাগল করে এখানে এসে যদি মিশন কমপ্লিট না হয় তাহলে এ জীবন রেখে কি লাভ?তাই এখন আমি গ’লায় দ’ড়ি দিবো।বিদায় পৃথিবীবাসি আর আমাকে মনে করো না আমি আর ফিরবোনা।

বলে রৌদ্র পা দু’টো ভাঁজ করে ঝুলে পড়ে।শ্বাস আঁটকে আসতেই কাশতে শুরু করে চোখ চোখ বড় করে ফেলে।আবারো মাটিতে পা রাখে।আভা এতোটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে যে সে খেয়ালই করেনি রৌদ্র মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে।আভা কাঁদতে শুরু করে।কান্না ভেঁজা কন্ঠে বলে,
– রৌদ্র না প্লিজ এমন করবেন না প্লিজ।আমাকে এভাবে একা ফেলে যাবেন না।

রৌদ্র তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
– তাহলে বলো বিয়ে করবে?না হলে এখনই গ’লায় দ’ড়ি দিবো।দিবো?দিবো?

আভা কাঁদতে কাঁদতে তড়িঘড়ি বলে,
– না না প্লিজ।হ্যাঁ বিয়ে করবো।চলুন বিয়ে করবো।প্লিজ এমন করেন না।

রৌদ্র বাঁকা হেসে গলা থেকে ওড়ানাটা খুলে ফেলে।ডাল থেকেও ওড়ানাটা খুলে এগিয়ে এসে আভার গায়ে জড়িয়ে দেয়।আভা কাঁদতে কাঁদতে দু’হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ে।আসলে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে।জীবনের প্রথম সে এমন কোনো পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।রৌদ্রের খারাপ লাগে।সে হাঁটু গেড়ে আভার সামনে বসে।মুখ থেকে আভার হাত সরিয়ে আদুরে স্বরে বলে,
– আভা দেখো আমার কিছু হয়নি।এইতো আমি।আভা দেখো।

আচমকা আভা শক্ত করে রৌদ্রের গলা জরিয়ে ধরে।রৌদ্রের কাঁধে মুখ ডুবিয়ে অঝোরে কাঁদে সে।রৌদ্রের কাঁধটা মুহুর্তেই ভিজে যায়।এই প্রথম আভার তার এতো কাছে।ভাবতেই সারা শরীর হিম শীতল হয়ে যায় তার।একহাতে আভার কোমর জড়িয়ে অন্য হাতে আভার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দেয় সে।নরম সুরে বলে,
– সরি ভয় দেখানোর জন্য।এবার কান্না বন্ধ করো আমার কষ্ট হচ্ছে। দেখো গলা ব্যাথা করছে।

আভার কান্নার বেগ কিছুটা কমে আসে।তবু কেঁপে কেঁপে ওঠে সে।নাক টেনে আচমকা আক্রমণ করে রৌদ্রের উপর।মুখে, গলায়,কাঁধে বড় বড় নখের খামচি বসাতে থাকে আভা।রৌদ্র চিৎকার করে আভাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়
– আহ আভা কি করছ ব্যাথা পাচ্ছি। ওমা কাঁধের চামড়া তুলে ফেলল।আহ্ খুব জ্বলছে।

আভা ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
– শয়’তান ছেলে আর কোনোদিন এমন করবি বল?

– আরে তুমি আগে ঢালটা তো দেখো।কত নিচু আর চিকন দেখো।ওটাতে কখনো ঝোলা সম্ভব?ডাল ভেঙে পড়বো না!

আভা এবার খেয়াল করে দেখে।এবার তো তার রাগ আরো বেড়ে যায়।রাগে ক্ষোভে কিছু বলবে তার আগেই রৌদ্র সতর্ক করে তাকে,
– এখন আর একটা কথাও না তুমি বলেছ তুমি আজই আমাকে বিয়ে করবে।তুমি যদি বিয়ে করো তাহলে আমি কিন্তু এবার সত্যি সত্যি..

চট করে আভা বলে ওঠে,
– আমি কি বলেছি বিয়ে করবো না?

– চলো তাহলে এবার।

রৌদ্র মাটি থেকে চিঠি দু’টো নিয়ে ব্যাগ ঢুকিয়ে ফেলে।ব্যাগ কাঁধে এক হাতে আভার হাত চেপে ধরে।এগিয়ে যায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ সম্পূর্ণ করতে।আভাও গোমড়া মুখে তার পিছন পিছন ধীর কদমে এগিয়ে যায়।

কাজী অফিসে পাশাপাশি বসে অপেক্ষা করছে অভয় এবং অহনা।কাজী সাহেব নেই নামাজ পড়তে গিয়েছেন।অভয় অনেকদিন পর বউকে দেখে যেন বাচ্চা হয়ে গিয়েছে।তখন থেকে বউকে বিরক্ত করে যাচ্ছে।কখনো বউয়ের হিজাব ধরে টানছে তো কখনো চুড়ি নিয়ে টানটানি করছে অহনা এবার বিরক্ত হয়ে হাত ঝাড়া দেয়।মোটা মোটা চোখ করে তাকায় অভয়ের দিকে।অভয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসে।অহনার হাতে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে,
– কেমন আছো বউ?

অহনা আবারো চোখ মোটা করে চায় অভয়ের দিকে।অভয় এবার শার্ট ঠিক করে সোজা হয়ে বসে।কাজী অফিসে প্রবেশ করে আভা এবং রৌদ্র।দু’জনে হাত ধরে আছে।সেদিকে তাকিয়ে চোখ চোখ বন্ধ করে ফেলে অভয়।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজে নিজে বিড়বিড়িয়ে বলে,”কন্ট্রোল অভয় কন্ট্রোল।ও তোর বোনের জামাই।”

অহনা রৌদ্র আভাকে দেখে বিগলিত হেসে বলে,
– তোমরা চলে এসেছ?কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্য।সরি আভা না জেনেই বাবাকে তোমার পছন্দের কথা বলে ফেলেছিলাম।রৌদ্র বলল তোমরা রিলেশনে আছো তখন বুঝলাম সেদিন তুমি রৌদ্রের কথাই বলেছিলে।সরি আভা।

আভা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগি কন্ঠে বলে,
– ভাইয়া তুমি ওনার গায়ে হাত তুলেছ?তুমি ওনার ঠোঁট কেটে দিয়েছ?

অভয় মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে চোরা দৃষ্টিতে আভাকে দেখে।রৌদ্র আর অহনা ঠোঁট চেপে হাসে।রৌদ্র বলে,
– বাদ দাও না।আচ্ছা আভা বউয়ের ভাইকে যেন কি বলে?

– শা’লা

– হ্যাঁ।শা’লা আমার ঝটকাটা সামলে উঠতে পারিনি।তাই একটা ঘু’ষি নাহয় মেরে দিয়েছে।ব্যাপার না।চলো এবার বিয়ে করি।

সকলে এগিয়ে গেল কাজী সাহেবের দিকে।চেয়ার টেনে বসবে ঠিক তখন গম্ভীর মুখে হাজির হয় আরাভ সাহেব।অভয় মৃদু স্বরে বলে,
– বাবা!

সকলে চমকে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।আভার ধুকপুকানির গতি বৃদ্ধি পায়।ভয়ে কেঁদে দিবে বলে।রৌদ্রও কিছুটা ঘাবড়ে যায়।আভাকে একহাতে আগলে তাকিয়ে থাকে আরাভ সাহেবের দিকে।তিনি গম্ভীরমুখে রৌদ্রের দিকে এগিয়ে আসেন।অভয়ও ভীত চোখে তার সাথে সাথে আসেন।তিনি রৌদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে একনজর দেখে গম্ভীর স্বরে বলেন,
– রৌদ্র।

রৌদ্র কোনো শব্দ করে না।তিনি পুনরায় বলেন,
– অভয় আমাকে সবটা বলেছে।তুমি অস্ট্রেলিয়া যাবেনা বলেই কিন্তু আমি শান্ত আছি এ কথার যেন কোনো নড়চড় না হয়।সেদিকে খেয়াল রাখবে।

সকলের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল।সকলের ঠোঁটে ভেসে ওঠে এক চিলতে হাসি।রৌদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে ঝড়ের গতিতে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।আরাভ সাহেবও মৃদু হেসে রৌদ্রের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলেন,
– ছেলে হিসেবে তোমাকে খারাপ বলার মতো এতোটা জা’হিল আমি না।

আরাভ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন হাসেন।রৌদ্র আভা পাশাপাশি চেয়ারে বসে।নেই কোনো আয়োজন, কোনো জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী।শুধু গোটা পাঁচেক মানুষের উপস্থিতি।পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে আভাকে স্ত্রী হিসেবে কবুল করে রৌদ্র।আভাকে কবুল বলতে বললে বারবার থমকে যায় সে।সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে তার কাছে।মাকে খুব বেশি মনে পড়ছে তার।মাথায় কারো স্নেহের স্পর্শ এবং হাতে কারো ভালোবাসা আর ভরসার স্পর্শ পেয়ে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে আভার।মাথায় হাত রেখে তার বাবা তাকে কবুল বলতে আশ্বাস দিচ্ছেন।হাতে হাত রেখে নিজেকে ভরসা ও বিশ্বাস করতে আশ্বাস দিচ্ছে রৌদ্র।আভা টলমল চোখে ঠোঁট মেলে হাসে।নিচু স্বরে তিনবার “কবুল” বলে রৌদ্রকে স্বামী হিসেবে শিকার করে।রৌদ্রের হৃদয় জুড়ে প্রজাপতি ডানা ঝাপটায়।অবশেষে সে তার ডান পাঁজরে হাড়টি খুঁজে পেল।রৌদ্রের চোখেও জমা হয় নোনাজল।প্রাপ্তি সুখ বোধহয় এমনই হয়।না সহ্য করা যায় না দূরে ঠেলা যায়।রৌদ্র-আভা টলমল চোখে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।সবকিছু যেন একটা সুন্দর স্বপ্ন মনে হচ্ছে দুজনের কাছে।অভয় এবং আরাভ সাহেবের চোখেও দেখা গেল জল।আরাভ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
– নাও এখন চলো।আর বাড়িতে গিয়ে কি বলবে ঠিক করে নাও।আমি কিন্তু কাউকে বাঁচাতে পারবোনা।

দুজনে উঠে দাঁড়ায়। অভয় রৌদ্রের সামনে এসে রৌদ্রকে জরিয়ে ধরে।আবেগি স্বরে বলে,
– সরি রৌদ্র তোকে তখন না বুঝেই ঘুষি মেরে দিয়েছি।তোর থেকে ভালো ছেলে আর দু’টো পাবো কিনা জানিনা।তবে আমার বোন তোর সাথে অনেক ভালো থাকবে জানি।

রৌদ্র মুচকি হেসে অভয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।অভয় রৌদ্রকে ছেড়ে বলে,
– যতোই তুই আমার বোনের জামাই হোস না কেন তুই কিন্তু সবার আগে আমার বেস্টফ্রেন্ড বুঝেছিস?

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে বলে,
– হুম।

বাড়ির জন্য রওনা হয় তারা।শহরের একটি কাজী অফিসে এসেছিল তারা।বাড়ি পৌঁছাতে এখনো দেড় ঘন্টার মতো সময় লাগবে।রাত দশটা বাজবে ত্রিশমিনিট বাকি।বাড়ির সকলের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে এখন সেটাই দেখার বিষয়।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |২৭|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

মুন্সিবাড়ির সকলে মোটামুটি মুখ ভার করে আছে।এখন বাজে রাত সাড়ে বারোটা।এতোক্ষণ ধরে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে সকলের মাঝে।প্রেমার ক্ষোভের কাছে টিকতে না পেরে ঘর ছেড়েছেন আরাভ সাহেব।আজ বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাবেন তিনি।বাড়িতে আসলেই বউয়ের খিটমিট মেজাজ তার হজম হবে না।তখন এক কথা দুই কথায় বড়সড় একটা ঝামেলার সৃষ্টি হবে।বুড়ো বয়সে বউয়ের সাথে কোনো রকম ঝামেলা সে চায়না।তাই চুপচাপ সরে যাওয়ায় শ্রেয় মনে করেছেন তিনি।বসার ঘরে সোফায় চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে অভয়,অহনা,রৌদ্র,আভা।প্রেমা দূরে দাঁড়িয়ে নানা ধরনের প্রলাপ বকে চলেছেন।
প্রেমা অভয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
– তুই আমার পেটে হয়ে আমার সাথে এমন বেইমানি কিভাবে করতে পারলি?আমি ভাবতাম সকলে আমার বিপক্ষে থাকলেও তুই আমার ছেলে আমার সাথে থাকবে আর সেই তুই কিনা তোর বাপের সাথে মিলে এই বেইমানিটা করলি!

অভয় কাচুমাচু মুখে বলে,
– আম্মু বেইমানি কিভাবে করলাম?বিয়ে তো হবে অনেক বড় করে।এখন ফর্মালিটিস গুলো সেরে রেখেছি যাতে সামনে কোনো ঝামেলা না হয়।

– চপ একটা কথাও বলবিনা তুই। আমি কে?আমি তো দাসি বান্দি পথে বসে কান্দি!আমার মতামতের কি তো প্রয়োজন আছে?আমারে তোর বাপ এনেছে রান্না করে খাওয়ানোর জন্য।আরে আমি কি কোনো জালিমের ঘরের মেয়ে যে রৌদ্রকে মেয়ে জামাই হিসেবে মেনে নেব না?তোর বাপ এই গাদ্দারিটা কিভাবে করতে পারল?

অভয় হাত ঘড়িতে সময় দেখে রৌদ্র এবং আভার দিকে তাকায়।দু’জনে অপরাধী মুখে চুপচাপ বসে আছে।অভয় মিনমিন করে বলে,
– আম্মু এবার তো থামো।দেখ সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে।নবদম্পতিকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত সোফায় এভাবে বসিয়ে রেখে এমন সিন ক্রিয়েট করার কি কোনো মানে আছে?

প্রেমা এবার কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলেন,
– হ্যাঁ আমি বললেই তো সিন ক্রিয়েট।দেখো না হাঁটছে কোথায় রাত দুপুরে।যখন থাকবো না তখন বুঝবি মায়ের কি মূল্য।রৌদ্র আব্বু খেতে এসো।

এতোক্ষণে রৌদ্রের ঠোঁটে হাসি দেখা গেল।প্রেমা কথা শেষ করার সাথে সাথে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে যায় রৌদ্র।তার খুব খিদে পেয়েছে।তাকে দাঁড়াতে দেখে সকলে তার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে পড়ে।রৌদ্র সামান্য বিব্রত হয়ে বলে,
– কি এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?আম্মু খেতে ডাকছে চল খাবো।

রৌদ্রের মুখে “আম্মু” ডাক শুনে প্রেমার এতোক্ষণের সকল রাগ অভিমান এক নিমিষেই গলে জল হয়ে গেল।সে তৃপ্তির হাসি হেসে চোখের কোণে জমা জলটুকু মুছে টেবিলে একেক করে সকল খাবার এনে রাখলেন।হাতে হাতে সাহায্য করে অহনা এবং আইরিন।তিন্নি মিন্নি বাড়িতে নেই নানু বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে।
খাবার টেবিলে অভয় এবং রৌদ্র পাশাপাশি বসেছে।আভার রৌদ্রের মুখোমুখি। রৌদ্র বেশ বিরক্ত সে তার বউয়ের জন্য জায়গা রেখেছিল হঠাৎ কোথা থেকে এই অভয় এসে বসে পড়েছে।রৌদ্র কাটা চামচ দিয়ে খাবার মুখে দিতে দিতে বলে,
– শহরে তুই যেখানে তার আশেপাশেই একটা ভালো খোলামেলা ফ্লাট দেখিস।

অভয় অবাক হয়।খাওয়া থামিয়ে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুই শহরে থাকবি?

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।খাবার মুখে তুলতে গিয়েও থেমে যায় কিছু একটা ভেবে থেমে যায়।বলে,
– আমার পি.সি. ও সেট-আপ করতে হবে।সিপিইউ এনে দিস বাকিগুলো আমি কিনে নিবো।

– আচ্ছা।কিন্তু আমার মনে হয় আভার ভার্সিটির আসেপাশে থাকলে ভালো হবে।

রৌদ্র এবার চোখ তুলে তাকিয়ে আভাকে একপলক দেখে।আভা অভয় এবং তার দিকেই তাকিয়ে আছে।রৌদ্রও সম্মতি দিয়ে বলে,
– আচ্ছা তাহলে আভার ভার্সিটির আশেপাশেই দেখ।আর আমার সিপিইউ এর কথা যেন মনে থাকে।অনেকগুলো প্রজেক্ট কিন্তু আঁটকে আছে।

– আচ্ছা আচ্ছা মনে থাকবে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় দুইটার কাছাকাছি বেজে গেল।রৌদ্রকে আভার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।তবে সেখানে আভাকে এখনো পাঠানো হয়নি।যেহেতু বিয়েটা তেমন কোনো আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি মেনে হয়নি তাই বাসর ঘরে টাকার জন্য কেউ দাঁড়ায়নি। দাঁড়াবেও বা কে?ছোটরা তো আর কেউ নেই।অভয় তো বড় ভাই তাই তার টাকা চায়তেও বিবেকে বাঁধে।তাই সে চুপচাপই রইলো।অহনা আভাকে হালকা পাতলা সাজিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে।অভয় সুন্দর একটি রাণী গোলাপি রঙের শাড়ি গিফট করেছে আভাকে।সে এটা কাজি অফিসে যাওয়ার আগেই কিনেছিল আভার জন্য।সেটা পরানো হলো আভাকে।সাথে মুখে হালকা পাতলা নু’ড মেকআপ। আভার বিশেষ কোনো অনুভূতি জাগছেনা মনে।তবে সে কিছুটা ভীত।শ্বাসটা ঘন হচ্ছে ধীরে ধীরে।বুকের ভিতরো তেমন ঢিপঢিপ করছে।তবে এগুলো তেমন একটা কাবু করতে পারছে না আভা।হয়তো কাবু করত যদি সে লোকটাকে না চিনতো।সে তো রৌদ্রকে চেনে খুব আগে থেকেই চিনে তাই তেমন একটাও ভয় লাগছে না তার।রাত তিনটার কাছাকাছি আভাকে একগ্লাস দুধ হাতে পাঠানো হলো তার ঘরে।দরজা খুলতেই সহসা কাঁপতে শুরু করে সে।বুকের ভিতর থাকা হৃৎপিণ্ড নামক বস্তুটা অসম্ভব গতিতে ওঠানামা করে চলেছে।দরজা খোলার শব্দ পেয়ে রৌদ্র ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে।তিন বেজে পাঁচ মিনিট।রৌদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– আর আসার দরকার ছিল কি একবারে সকলে আসতে।

রৌদ্রের অভিমানী স্বরে বলা বাক্যে আভার ভয় উড়ে যায়।ঠোঁটে দেখা যায় চাপা হাসি।ধীর পায়ে এগিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়।ঘরের আলো জ্বলে উঠতেই চোখে ঘোর লেগে যায় রৌদ্রের।পলকহীন তাকিয়ে থাকে তার সামনে হেঁটে চলে বেড়ানো রাণী গোলাপি শাড়িতে থাকা তার বউয়ের দিকে।আভা হাতের গ্লাসটি খাটের পাশে থাকা বেড সাইড টেবিলে রাখে।রৌদ্র খাটে পা ঝুলিয়ে বসে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আভা তার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে সাদা পাঞ্জাবির কলার টেনে মুখ ঘুরিয়ে এদিকে ওদিকে করে গলা ঝেড়ে বলে,
– ত তুমি এতো সেজেছ কেন স্ট্রেঞ্জ!

আভার মুখে আবারো সেই চাপা হাসি ভেসে ওঠে।সে খাটের অন্যপাশে যেতে যেতে বলে,
– ঘুমাবো তাই।

রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে দেখতে দেখতে বলে,
– তো ঘুমানোর জন্য কি তোমাকে এক কেজি আটা ময়দা মুখে মাখতে হয়?স্বপ্নে কি ব্লাইন্ড ডেটে যাবে?নাকি সিরিয়ালের শুটিং হচ্ছে এখানে?

আভা খাটে বসে পড়ে রৌদ্রের চোখে চোখ রেখে বলে,
– যেতোও পারি ব্লাইন্ড ডেটে তাতে আপনার কি?আপনি ঐটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন অলরেডি তিনটা বেজে গিয়েছে একটু পরেই ভোর হয়ে যাবে।

আভার দৃষ্টি রৌদ্রের চোখে স্থির হতেই আবারো ঘোরে চলে যায় রৌদ্র।মস্তিষ্ক জুড়ে নেমে আসে হাজারো অসভ্য চিন্তা ভাবনা।এই মেয়েটাকে দেখলেই যত বাজে,খারাপ,নোংরা চিন্তা ভাবনার শুরু হয় রৌদ্রের।মেয়েটা একদমই সুবিধার নয়।রৌদ্র ধীরে ধীরে আভার সান্নিধ্যে চলে আসে।আরেকটু কাছে আসার চেষ্টা করতেই আভা এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় রৌদ্রের দিকে।সহসা বলে ওঠে,
– কি যেন বলেছিলেন?আমার মাথার স্ক্রু ঢিলা?

রৌদ্র আভার সহসা এমন কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।মাথা পিছনে নিয়ে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আভার দিকে।হঠাৎ মেয়েটা এমন কড়া কথা বলছে কেন বুঝতে পারে রৌদ্র।রৌদ্র আভার কথায় না দিকে আভার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে মুখ এগিয়ে নিয়ে যেতেই আভা উঠে খাট থেকে লাফ দেয়।ভ্রু কুঁচকে ফেলে রৌদ্র।রাগি স্বরে বলে,
– এসব কি হচ্ছে আভা?

আভা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে বলে,
– কোনো বাসর টাসর হবেনা।এই বিয়ে আমি আমি না আপনি আমাকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে করছে।

রৌদ্রও খাট থেকে উঠে দাঁড়ায়।আভার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
– কোন সিরিয়ালের ডায়ালগ দিচ্ছ?ব্লাকমেইল করে বিয়ে করি আর যেভাবেই বিয়ে করি বিয়ে করছি মানে বাসর হবে।

আভা দ্বিমত করে বলে,
– না হবে না।

রৌদ্র আভার দিকে এগিয়ে যেতে বলে,
– হবে।

– হবে না।

– হবে।

এমন তর্কাতর্কির মাঝে আভাকে নিজের বাহুতে আঁটকে ফেলে রৌদ্র।ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– এবার?এতো সুন্দর করে আমার জন্য সেজেগুজে এসেছ এখন এই সাজ যদি নষ্ট না করি তাহলে শান্তি পাবো বলো?

আভা সাপের মতো মুচড়ামুচড়ি করতে করতে বলে,
– আমি একদম আপনার জন্য সাজিনি।আমিকে তো ভাবি জোর করে সাজিয়ে দিয়েছে।

– ভাবি আমার জন্যই সাজিয়েছে।

আভা এবার বুকে সাহস জুগিয়ে বলে,
– রৌদ্র ছাড়ুন আমাকে।আমি কিন্তু কুস্তি জানি। আপনি আমার সাথে এভাবে জবরদস্তি করতে পারেন না।নাহলে কিন্তু আমি কুংফু করে দিবো।

রৌদ্র শব্দ করে হাসে।আভাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে।বুজে হাত গুঁজে বলে,
– এতো সুন্দর ডায়ালগ দাও তুমি আভা।তোমাকে আসলে ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রিতে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত।তাহলে জীবনে শাইন করতে পারবে।কই শুরু করো দেখি তোমার কুংফু।

আভা চোয়াল শক্ত করে মুখের সামনে আড়াআড়িভাবে দু-হাত তোলে।পা তুলে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে। মুখ দিয়ে, “হাই, হুই,হুহ্” শব্দ করে।রৌদ্র পেট ধরে শরীর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করে।হাসতে হাসতে তার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। আভা কপাল কুঁচকে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।রৌদ্র হাসি থামিয়ে ঝড়ের গতিতে আভার দুইহাত ধরে ঘুরিয়ে পিছন থেকে চেপে ধরে নিজের সাথে।চমকে ওঠে আভা।ঘটনা এতো দ্রুততার সাথে হয় যে তার কিছুই ঠাওর করতে পারে না আভা।দু’জনের শ্বাস ক্রমেই বৃদ্ধি পায়।দু’জনে শরীরের তাপমাত্রা হু হু করে বেড়ে যায়।রৌদ্র ধীরে ধীরে আভার কাঁধের কাছে নেমে আসে।আভার কানে হিসহিসিয়ে বলে,
– ড্রামা কুইন।

কথাটি শেষ করে নিজের মুখমণ্ডল রাখে আভার কাঁধের এক অংশে।চোখের পাতা এক করে শুঁকনো ঢোক গিলে আভা।রৌদ্রের একহাতে নিজের দুইহাত আঁটকে থাকায় চায়লেও কিছু করার ক্ষমতা পায় না আভা।চোখ বন্ধ করে রৌদ্রে টুকরো টুকরো স্পর্শে কেঁপে ওঠে সে।রৌদ্রের হাত আলগা হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় সে।এক মুহুর্ত কালবিলম্ব না করে রৌদ্রকে জোরে ধাক্কা দেয়।এতোটাই জোরে ধাক্কা দেয় যে রৌদ্র ছিটকে পড়ে মেঝেতে।কোমরের প্রচন্ড ব্যাথাতে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে সে।আভা দৌড়ে খাটের উপর উঠে দুই হাত কুংফু ভঙ্গিতে মুখের সামনে আড়াআড়িভাবে রাখে আবারো।রৌদ্র কোমরে হাত দিয়ে রাগে কটমট করে বলে,
– ইউ…!

আভা দাঁত বের করে হেসে ঘাড় কাঁত করে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
– কেসা লাগা মেরা মাজাক?এতো সহজে তো আমি ধরা দিচ্ছি না স্বামী। আমি কি আর আপনার সেই রেন্টেড গার্লফ্রেন্ড?স্ত্রী আমি আপনার।স্ত্রীকে পাওয়ার জন্য তো একটু কাঠখড় পোড়াতে হবেই।তার উপরে আপনি আমাকে মাথার স্ক্রু ঢিলা বলেছেন।এখন এসেছেন সোহাগ করতে?ব্লাকমেইল করে বিয়ে করেছেন না?বিয়ের অনেক শখ না আপনার?

রৌদ্র চোখ মুখ খিঁচে কোমর ডলছে আর রাগে কটমট করছে।আভা চট করে কাঁথা মুড়ি দিকে শুয়ে পড়ে।রৌদ্রের উদ্দেশ্যে বলে,
– গুড নাইট বস।সি ইউ ইন দ্য মর্নিং।

রৌদ্র চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তর দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে রইলো।মনে মনে ভাবল মেয়েটা কিরকম ব্রিটিশ সেই তিনচার বছর আগের রেন্টে নেওয়া গার্লফ্রেন্ডের কথা নিয়ে এখন খোঁটা দিচ্ছে।মৃদুস্বরে শোনা গেল আযান।রৌদ্র আযান শুনে আভার দিকে তাকিয়ে বলে,
– নামাজ পড়বে না?আযান দেয়।

আভা কাঁথার নিচ থেকে উত্তর দেয়,
– আমার ছুটি চলে।

রৌদ্র থমকে যায় এবার।অপরাধ ভোগে ভুগতে থাকে সে।মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বলে,”আচ্ছা এজন্য তাকে কাছে আসতে দেওয়ায় এতো আপত্তি?”এমনিতেও সে তেমন কিছুই করত না।রৌদ্র ঠোঁটে হাসি রেখেই কোমর চেপে উঠে দাঁড়ায়।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজা খুলে মাথা বের করে দেখে বাইরে কেউ আছে কিনা।আবারো ধীরে ধীরে দরজা লাগিয়ে বের হয় সে।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খাবার ঘরে থাকা বড় ফ্রিজ থেকে আইস ব্যাগে বরফ নিয়ে কোমরে চেপে ধরে।চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছুক্ষণ আগের আভা এবং তার ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে দৃশ্য।ভাবতেই ঠোঁট জুড়ে ছেয়ে যায় এক সুন্দর মোলায়েম হাসি।
হঠাৎ কেউ বলে উঠলো,
– কিরে রৌদ্র বোনটা আমার বাসররাতেই লা’থি মেরে তোর কোমর ভেঙে দিলো নাকি?হা হা।ফাইনালি তাহলে তোর বউয়ের লা’থি খাওয়ার সৌভাগ্য হলো।কেমন সুখ সুখ লাগছে না বল?দেখেছিস বলেছিলাম না বউয়ের লা’থি খাওয়ার মধ্যেও একটা রোম্যান্টিক ব্যাপার আছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে