#প্রিয়_বালিকা |২১|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
সকাল সকাল বাড়ির সকলের তোড়জোড় হুড়োহুড়ি দেখে পা থেমে গেল রৌদ্রের।সকালের নাস্তার জন্য নিচে নেমে সে সকলকে কোনো একটি বিশেষ অতিথির জন্য বিভিন্ন আয়োজন করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে।অভয়ের বিয়ের প্রায় পনেরো দিন কেটে গেল।সে এখনো অস্ট্রেলিয়া ফেরেনি।কিসের টানে সে এখনো এখানে পড়ে আছে তা সম্পর্কে সে অবগত।এর মধ্যে অনেকবারই চেষ্টা করেছে আভাকে তার মনে কথা বলতে কিন্তু যতবারই চেষ্টা করেছে ততবারই তার গলা আঁটকে গিয়েছে অজানা আতংকে।রৌদ্রকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রেমা আইরিনকে বললেন,
– আইরিন রৌদ্রকে খেতে দে।
রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– আব্বু খেতে এসো।
রৌদ্র কপালে ভাঁজ রেখেই খাওয়ার টেবিলে বসে।প্রেমাকে জিজ্ঞেস করে,
– আন্টি কেউ আসবে?স্পেশাল কেউ?
প্রেমা মিষ্টি হেসে উত্তর করে,
– হ্যাঁ।আভাকে দেখতে আসবে।গত পরশু ফোন করে বললো।
মাথায় যেন বাজ পড়ল রৌদ্রের।পাথরের মুর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে গেল সে।আভাকে দেখতে আসবে মানে?কয়েক মিনিট নিরবতা পালন করে হুঁশ এলো তার।চট করে বলে উঠলো,
– আভাকে দেখতে আসবে?আভা তো এখনো অনেক ছোট।লেখাপড়াও এখনো শেষ হয়নি।এখনই বিয়ে?
প্রেমা ঠোঁট মেলে বলেন,
– দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হবে যাচ্ছে না।দেখাশোনা হবে কথাবার্তা হবে তারপর বিয়ে।বিয়ে তো আর হুট করে হয়ে যায় না।হাজার কথা না বললে বিয়ে হয় না।আর তারা যদি আমার মেয়েকে লেখাপড়া না করাই তাহলে আমরা ওখানে বিয়ে দেব না।
প্রেমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়না রৌদ্র।নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে এক দু লোকমা খেয়ে উঠে চলে আসে সে।
আভার ঘরের দরজার সামনে থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে রৌদ্র।তার একটা বিষয়ই দেখবার আছে আর তা হলো আভা এ বিয়েতে রাজি কিনা।কিন্তু সে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে।সে ঘরে প্রবেশ করার আগেই আভাকে বাহিরে বের হতে দেখা গেল।সে সুন্দর একটি নীল জামদানী শাড়ি পরে হালকা পাতলা সেজেছে।আভাকে এসে গুঁজে পটের বিবি হয়ে ঘুরতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল রৌদ্র।চোখ বেরিয়ে তাকিয়ে আছে সে আভার দিকে।আভা নির্বিকার।রৌদ্রকে দেখেও যেন দেখছে না।শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে চিকন সুরে গান গেয়ে ওঠে সে,”মে তো রাস্তে সে যা রাহা থা, মে তো ভেলপুরি খা রাহা থা।তুসকো মিরচি লাগি তো মে কেয়া কারু?লা লা লা..”
আভার গান শুনে রৌদ্রের মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেল।মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে।হাতের শিরাগুলো জেগে উঠে দৃঢ়ভাবে।এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত কামড়ে আভাকে জিজ্ঞেস করে,
– এসব কি তামাশা লাগিয়ে রেখেছ?
আভা একপলক রৌদ্রের মুখের দিকে চেয়ে আবারো নিজেকে দেখতে দেখতে বলে,
– দেখুন তো এই শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে?
রৌদ্র চোখ বন্ধ করে একটি শ্বাস নিলো।আগের মতো ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আভার দিকে।রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
– বিচুটি পাতার মতো লাগছে।এই দেখো আমার হাত চুলকাতে শুরু করেছে।
রৌদ্র নিজের ডান হাত এগিয়ে দিলো আভার সামনে।আভা রৌদ্রের রাগের কারণ বুঝতে পেরে চাপা হাসি দেয়।নির্লিপ্ত স্বরে বলে,
– তা আপনার হাত চুলকাক বা সারা শরীর চুকলাতে চুলকাতে ছাল চামড়া খসে পড়ুক তাতে আমার কি?আমার হবু স্বামীর কাছে আমি একদম ঔষধি লতা।সরুন আমার হবু স্বামী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
রৌদ্র চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইলো আভার দিকে।আভা একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে রৌদ্রকে সরিয়ে দিয়ে চলে গেল।রৌদ্র আভার যাওয়ার দিক তাকিয়ে আভাকে ব্যঙ্গ করে বলে,”এহ্ হবু স্বামী..!আসার সময় যেন রাস্তায় মরে।যত্তসব!”
সোফায় মুখোমুখি বসে আছে আভা এবং তার হবু স্বামী আকিব ইমরান।তার পাশেই তার পরিবার বসা।আভার সাথে তারা বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করছে।আভা হেসে হেসে সকলের সাথে কথা বলছে।এদিকে দূরে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য হজম করে চলেছে রৌদ্র।মাথার ঘিলু টগবগ করে ফুটছে তার।সে আর নিতে পারছে না এদের এসব মেলোড্রামা।দাঁতে দাঁত পিষে আভার দিকে তাকিয়ে আছে সে।চোখের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরা উপশিরাগুলো লাল রং ধারণ করেছে। খুব বেশি ভয়ংকর দেখাচ্ছে তার শিকারী চোখ দু’টো।পারিবারিক কথাবার্তা শেষে পালা আসে আভা এবং সীমান্তের নিজেদের মধ্যে আলাদা কথা বলার।সীমান্ত নিজে থেকেই সকলের কাছে এ প্রস্তাব রাখে।সকলের অনুমতিতে তারা বসার ঘর ছেড়ে একান্তে কথা বলার জন্য বাড়ির বাইরে বাগানে চলে যায়।রৌদ্রও পা পিঠে পিঠে তাদের পিছন পিছন যায়।আভা না তাকিয়েও বুঝতে পারে রৌদ্রের উপস্থিতি।সে ঠোঁট চেপে হাসে।আভা সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপনি কি করেন যেন বললেন?
সীমান্ত মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে অতি ভদ্রতার সহিত জবাব দেয়,
– পুলিশ।
আভা এবং সীমান্তকে হেসে কথা বলতে দেখে রাগে শরীর কাঁপতে থাকে রৌদ্রের।শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে ঘামতে শুরু করে সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিজের হাত কামড়ে ধরে সে।এতোটাই জোরে কামড়ে ধরে যে মুহুর্তেই সেখানে রক্তের কণিকারা এসে জমাট বাঁধতে থাকে।মুখ থেকে হাত নামিয়ে পাশের দেয়ালে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করে।সঙ্গে সঙ্গে হাত থেঁতলে যায় তার।গটগট করে হেঁটে নিজের ঘরে চলে আসে।ওয়াশরুমে ঢুকে বালতিতে পানি ভর্তি দেখে বালতি উঠিয়ে সবটুকু পানি নিজের মাথায় ঢেলে দিলো।যাক এবার একটু শান্তি লাগছে!
সীমান্তের জবাবে আভা কোনোকিছু না ভেবেই বলে উঠলো,
– ও আচ্ছা তাহলে চোর ছুটানো আপনার কাজ?
সীমান্ত রাগি দৃষ্টিতে তাকাল আভার দিকে।তবে আভা সে দৃষ্টি দেখতে পেল না।সে সামনে তাকিয়ে আছে।সীমান্ত গম্ভীর স্বরে বলল,
– চলুন ভিতরে যাই।
– চলুন।
সীমান্তের মায়ের আভাকে খুব পছন্দ হয়েছে।তবে সে বার বার একটি কথা বলেছেন তা হলো মেয়ের গায়ের রং চাপা।তিনি যতবার এ কথা বলেছেন প্রেমাসহ বাড়ির সকলে ততবারই অপমানিত হয়েছেন।আভার সাথে একা কথা বলার পর থেকে সীমান্ত গম্ভীর মুখে বসে ছিলো।একটা টু শব্দও করেনি সে।
আভার কেন যেন সীমান্তকে দেখে মনে হয়েছিল সে তাকে পছন্দ করেনি।আভা কপাল কুঁচকে সীমান্তকে দীর্ঘক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে বুঝেছিল সীমান্ত বাড়ি গিয়ে এই বিয়েতে অমত করবে।হলোও তেমনটা।তারা বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পরই আভাদের বাড়িতে কল আসে।তারা জানান আভার ভদ্রতা জ্ঞান বলতে কিছু নেই।থাকলে একজন পুলিশ অফিসারের পেশা বা কাজ নিয়ে এভাবে কথা বলতো না।আর যে মেয়ে হবু স্বামীর কাজ নিয়ে ব্যঙ্গ করে কথা বলে তাকে সীমান্ত বিয়ে করবে না।আভা নির্বাক হয়ে সবটা দাঁড়িয়ে থেকে শোনে।প্রেমার বকাঝকাও শোনে।প্রেমা বকেছে বিয়ে ভেঙে গিয়েছে সে জন্য নয় বরং এভাবে ব্যঙ্গ করে কথা বলার জন্য।আইরিন রাগি কন্ঠে বলে,
– ভাবি উনিও তো বার বার বলছিলেন আমাদের মেয়ের গায়ের রং চাপা।এই সেই।তাহলে তো ওনাদেরও ভদ্রতা জ্ঞান বলতে কিছু নেই।আমাদের মেয়েটা শুধু মজা করেছে তাই মেয়েটাকে কতকিছু বলল।
প্রেমা শক্ত কন্ঠে বলে,
– উনি বলেছেন বলেছেন কিন্তু এখানে প্রশ্নটা আমার শিক্ষা নিয়ে। আমি আমার মেয়েকে কেমন শিক্ষা দিয়েছি যে সে একটি পেশা নিয়ে এভাবে ব্যঙ্গ করে কথা বলে?ভার্সিটিতে গিয়ে অ’সভ্য হয়ে এসেছ।
আভা রাগে ক্ষোভে গটগট করে চলে এলো বসারঘর থেকে।আড়াল থেকে সবটা শুনে একজনের ঠোঁটে দেখা গেল বাঁকা হাসি।
রাত একটা কি দেড়টা।পানি খেতে ঢুলুঢুলু পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে আভা।ঘুমে চোখ ভেঙে যাচ্ছে তার।আবার পিপাসায় গলা বুক শুঁকিয়ে আছে।তাই চোখ বন্ধ করেই ঘুমের মধ্যে আন্দাজ করে করে এগিয়ে যাচ্ছে সে।মাঝে মাঝে পিটপিট করে তাকিয়ে নিজের অবস্থান দেখে নিচ্ছে।আচমকা তার কোমর ছুঁয়ে কেউ নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।সুঘ্রাণ নাকে আসতেই আভা ঠাওর করতে পারল ব্যক্তিটি কে।ব্যক্তিটির বুকের সাথে আভার পিঠ স্পর্শ করে আছে।সে ধীরে ধীরে নিজের মুখ নামিয়ে আভার কানের কাছে নিয়ে এলো।হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
– আই লাভ ইউ টু রৌদ্রাভা।
ঠোঁট মেলে গেল আভার।ঘুম কেটে গিয়েছে অনেক আগেই।তবু চোখ খুলল না আভা।হেসে বলল,
– আজকে হঠাৎ কি মনে করে?
সে পূর্বের মতো হিসহিসিয়ে বলে,
– আজকে একটা বিষয় খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি।
– কি?
সে এবার কন্ঠস্বর আরো নামিয়ে জবাব দিলো,
– তোমাকে এই জীবনে অন্যকারো সাথে দেখার মতো সহ্য শক্তি আমার নেই।
আভা হাসে।হৃদয় জুড়ে শীতল বাতাস বয়ে যায় তার।এই প্রথম রৌদ্র তার এতোটা কাছে।শ্বাস প্রশ্বাস ধীর হয়ে চলেছে তার।শুঁকানো ঢোক গিলে আভা।রৌদ্র আভার আরো সান্নিধ্যে চলে আসে।আভার কানে ঠোঁট ছুঁয়ে আভার কোমর ছেড়ে দেয় সে।কানে রৌদ্রের অধরের স্পর্শ পেতেই কেঁপে ওঠে আভা।মাথা ঘুরতে শুরু করে তার।কিছুক্ষণ নিঃশব্দে অতিবাহিত হতেই ধপ করে নিচে পড়ে যায় আভা।সেদিকে তাকিয়ে সামান্য শব্দে হাসে রৌদ্র।যত্নের সাথে আভার দেহটাকে নিজের বাহুতে তুলে নেয় সে।আভার খাটে শুইয়ে কপালে অধরের স্পর্শ স্থির রাখে বেশ খানিকক্ষণ।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় সে।
সকালে উঠে সারাবাড়ি চিরুনি তল্লাশি করেও রৌদ্রকে খুঁজে পায়না আভা।চোখটা জ্বলে যাচ্ছে লোকটাকে একপলক দেখার জন্য।কিন্তু সে কোথায়?তার তো টিকিটাও নিখোঁজ।আভাকে এভাবে ছুটোছুটি করতে দেখে ভ্রুকুটি করে অভয়।জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে তুই এমন পাগলের মতো একবার এদিকে তো একবার ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছিস কেন?
আভা এতোটাই জলদির মধ্যে ছিল যে সে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অভয়কে জিজ্ঞেস করতে বসে রৌদ্র কোথায়?তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন?অভয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে।আভাকে অভয়কে জিজ্ঞেস করবে তার আগেই অভয়ের ফোন বেজে ওঠে।অভয় কল রিসিভ করে বলে,
– হ্যাঁ রৌদ্র পৌঁছেছিস?
অপরপাশ থেকে বোধ সম্মতিসূচক উত্তর এলো।অভয় বলে,
– আচ্ছা ফ্রী হয়ে কল দিস।
আভা থমকে যায়।রৌদ্র অস্ট্রেলিয়া ফিরে গিয়েছে? তাকে একবার জানাল না?তাহলে কি কালরাতে যা কিছু হয়ে সব তার স্বপ্ন?সব তার ভ্রম?কিন্তু সে তো রৌদ্রের শরীরের মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিল কাল।তাহলে?
চলবে…
#প্রিয়_বালিকা |২২|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
পাহাড়ি রাস্তার মতো উঁচু নিচু রাস্তা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাব।
এসে থামল একটি সাদা প্রাচীর ঘেরাও বাড়ির সামনে।বিশাল বড় একতলা বাড়ি।যার প্রায় অধিকাংশ কাঁচে আবৃত।প্রধান ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই বাড়ির সামনে ডানপাশে দেখা গেল একটি সাড়ে তিনফুট গভীর নীল পানির সুইমিং পুল।চারপাশে বিদেশি গাছপালা নিখুঁতভাবে নকশা করে কাঁটা।ছয়টা সিঁড়ি পাড় করে গৃহমধ্যস্থে প্রবেশের জন্য কাঠের দরজা।কলিং বেল বাজাতেই খুলে দিল প্যান্ট শার্ট পরিহিত এক মধ্যে বয়সী নারী।অবাক স্বরে বলে উঠলো,
– রৌদ্র?!
রৌদ্র চোখের কালো সানগ্লাস খুলে হেসে বলল,
– হেই মম!
ভিতর থেকে অবাক দৃষ্টিতে বেরিয়ে এলেন মহিলার সমবয়সী একজন পুরুষ।তাকে দেখে রৌদ্র বলে,
– হাই ড্যাড!
লোকটি হেসে রৌদ্রকে আলিঙ্গন করে।মহিলাটিকেও জরিয়ে ধরে রৌদ্র।সে এখনো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র মায়ের কপালে চুমু খেয়ে মাকে আগলে রেখেই বলে,
– কেমন আছো?
রৌদ্রের মা অবাক স্বরে উত্তর দিলো,
– আ’ম ফাইন।হোয়াট এবাউট ইউ?বাংলাদেশ ট্যুর কেমন হলো?
– আমেজিং।ড্যাড তুমি কেমন আছো?
রৌদ্রের বাবা উত্তর দিলেন,
– নট ব্যাড।তোমাকে দেখে আরো ভালো লাগছে।কতদিন পর এলে।বেলারাত যাওয়ার পর আর দেখা হয়নি।থাকবে নাকি চলে যাবো।
– আজ লাঞ্চ একসাথে করবো।তাছাড়া আমার তোমাদেরকে কিছু বলারও আছে।
রৌদ্রের মা তাকে তাড়া দিয়ে বলে,
– ওকে।আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করে নাও।তারপর আমরা একসাথে বসে কথা বলবো।ডিনারে তোমার ফেবারিট কন্টিনেন্টাল ডিস রাখছি।
– সাউন্ডস গুড।বাট আই থিংক বাংলাদেশি ডিস ইজ টেস্টিয়ার দেন কন্টিনেন্টাল।
রৌদ্রের মা রোদেলা দুই ঠোঁট ফাঁক করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে।রৌদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে সুটকেস দুটি দিয়ে নিজের বিশাল বড় কামরায় চলে গেল।তার ঘরের এক অংশ শুধু কাঁচে আবৃত।সেখান থেকে সূর্যের আলো প্রবেশ করে সারাঘর ঝলমলে করে রেখেছে।আরামদায়ক ফোমের খাটটি বেশি উচ্চতায় নয়। মাথার কাছের দেয়ালটিতে বড় একটি এনিমে ক্যারেক্টর সাটোরু গোজোর ছবি। তার নিচেই পাঁচটি সাদাকালো স্কেটিং বোর্ড।ঘরের বামদিকের কাঠের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই বিশাল বড় ওয়াশরুম এবং ব্লকরুম।যেখানের বিভিন্ন কাবার্ডে রৌদ্রের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস।রৌদ্র ঘাড়ের কালো ব্যাগটি বিছানায় ছুঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।ঠান্ডা পানিতে শীতল করল নিজের দেহ।শাওয়ারের বিন্দু বিন্দু পানি চোখে মুখে পড়তেই চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।চোখের সামনে ভেসে উঠল আভার হাসোজ্জল চেহারা।তার ঠোঁটও প্রসারিত হলো।লম্বা লম্বা চুলগুলো ডানহাতে পিছনে ঠেলে দিলো।ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি দীর্ঘশ্বাস।
দরজায় ঠেস দিয়ে বসে ফোঁস ফোঁস করছে আভা।তখন থেকে রৌদ্রকে কল করে যাচ্ছে সে।প্রতমবার কল কেটে দেওয়া হয়েছিল।তারপর থেকে ফোনে কল ঢুকছেই না।আভা বুকটা ভারি হয়ে আছে।গলার কাছে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে কন্ঠনালিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে।রৌদ্র কেন তাকে না বলে চলে গেল?আর চলেই যখন গেল তখন কেন সে রাতে তাকে ভালোবাসার কথাটা বলল?দু’হাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদে আভা।পরমুহূর্তেই চোখ মুছে সটান শিরদাঁড়া সোজা করে ফেলে।নাক ফুলিয়ে নিজে নিজেই বলে,”আমি আর কাঁদবো না।মটেও কাঁদবো না।বাজে ফালতু লোকটার জন্য মটেও কাঁদবো না।”
আভা উঠে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে।নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আবারো ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে তার।তবু সে নিজেকে সংযত করে চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিচে চলে যায় খাবার খেতে।
টেবিলে সকলকে দেখা গেল।অভয় নেই।তার ছুটি শেষ তাই কাজের তাগিদে তাকে শহরে ফিরতে হয়েছে।নতুন বউটাকে এভাবে রেখে যেতে একদম মন টিকেনি তার।তবু কি আর করা।আভা একটি চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে পড়ে।আভাকে এতো গম্ভীর চুপচাপ দেখে সকলে নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।আরাভ সাহেব মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– তোমার ভার্সিটি খুলবে কবে?
আভা খাবারের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
– আগামী সপ্তাহে শনিবার।
– যাবে কবে?
– শুক্রবার।
– আচ্ছা আমি ট্রেনের টিকেট বুক করে রাখবো।
আভা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।আরাভ সাহেব নিচের ঠোঁট বের করে প্রেমার দিকে চায়লেন।হঠাৎ মেয়েটা এতো চুপচাপ আর গম্ভীর হয়ে গেল কেন?আভার এমন অদ্ভুত আচারণে তারা একে-অপরের পানে চেয়ে ঘার সংকুচিত করেন।
খাবার ঘরে চামচ এবং ছু’রির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না।রোদেলা এবং তার স্বামী হামিদ কিছুক্ষণ পরপ রৌদ্রের দিকে তাকাচ্ছে।রৌদ্র মনোযোগ সহকারে নিজের খাবার খাচ্ছে।হামিদ শশার ছোট টুকরো মুখে দিয়ে বললেন,
– বাংলাদেশ কেমন লাগল বললে না তো?
রৌদ্র বাবার দিকে তাকাল।চোখে মুখে ভিড় হলো একঝাঁক মুগ্ধতা।আনমনা স্বরে বলে উঠলো,
– অপরূপ সুন্দর সে দেশ।মানুষগুলো যেমন কোমল হৃদয়ের দেশটাও তেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।সেখানে আমি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি।সে আমার দেশ।সে আমার শিকড়।যদিও আমি সেখানে জন্মায়নি তবে সেখানে আমি আমার শিকড় খুঁজে পেয়েছি।নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।তাই আমি ঠিক করেছি আমি বাংলাদেশে সেটেল্ড হবো।
এতোক্ষণ রোদেলা এবং হামিদের মুখে হাসি থাকলে রৌদ্রের শেষের বাক্যে হাসও মিলিয়ে গেল তাদের।রোদেলা তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন।রৌদ্র বাবা মায়ের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারল তারা তার বলা কথায় সন্তুষ্ট নন।সে আবারও বলে,
– হ্যাঁ মম আমি বাংলাদেশে থাকতে চাই।বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চাই।
রোদেলার চোখেমুখে দেখা গেল রাগের ছাপ।সে কঠিন স্বরে বলেন,
– পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি রৌদ্র?তোমার লাইফস্টাইলের সাথে তুমি ওখানে কিছুতেই খাপখাওয়াতে পারবেনা।
– কিন্তু মম আমি তো এতোদিন ছিলাম ওখানে।তাছাড়া তোমরা আমাকে যতটা সাহেব মনে করো আমি তেমন নই।আমি খাপখাওয়াতে জানি।আমি সবখানেই খাপ খাওয়াতে পারি।
রোদেলার রাগ বেড়ে গেল।সে আগের মতোই রাগি স্বরে বলেন,
– রৌদ্র দেখ,তোমার উন্নত জীবনের জন্য আমরা অস্ট্রেলিয়া এসেছি।কোথায় অস্ট্রেলিয়া আর কোথায় বাংলাদেশ?আমি তো বুঝতেই পারছিনা তুমি এখানে এমন লাক্সারিয়াস লাইফ রেখে কেন বাংলাদেশের মতো দেশে যেতে চায়ছ?
রৌদ্র তাচ্ছিল্য হাসে।মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে,
– আমার উন্নত জীবন?নাকি তোমাদের উন্নত জীবন?কারণ তোমরা যখন এসেছিলে তখন আমি পৃথিবীতে আসিনি।আর বাংলাদেশের মতো দেশ বলতে তুমি কি বুঝাতে চায়ছ?বাংলাদেশে কি মানুষ বাস করে না?তারা আমাদের থেকে ভালো আছে মানসিকভাবে।তাদের মধ্যে ইমোশন নামক শব্দটা এগজিস্ট করে।তারা আমাদের মতো ইমোশনলেস নয়।
হামিদ ছেলেকে বলেন,
– রৌদ্র তুমি মমকে ভুল বুঝছ।আমি জানি তুমি এখন এডাল্ট তুমি নিজের ডিসিশন নিজে নিতে পারো।কিন্তু তোমার মম যা বলছে তোমার ভালোর জন্য বলছে।
– ড্যাড আমি জানি মম আমার ভালোর জন্য বলছে।কিন্তু আমাকে তো বাংলাদেশ যেতেই হবে।আর সেটা আমার ভালোর জন্যই।
রৌদ্র শব্দহীনভাবে কাঁটা চামচটি প্লেটের পাশে রাখে।চেয়ার ছেড়ে উঠে বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– লাঞ্চ ভালো ছিল।ধন্যবাদ।
রোদেলা বিস্মিত হয়ে হামিদের দিকে তাকালেন।বলেন,
– ধন্যবাদ বলছে ও?ও কি পাগল হয়ে গিয়েছে?ও কি করছে এসব?ওর কোন ধারণা আছে বাংলাদেশ সম্পর্কে? ও কেন যেতে চায়ছে ওখানে?
গভীর ঘুমে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আভার।তবে ঘোর কাটেনি এখনো।ফোন তুলে কানে নিয়ে ঘুম ঘুম স্বরে বলে,
– হ্যালো..
– আমি নেই আর তুমি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছ?কোথায় ভাবলাম আমি না বলে চলে আসায় কেঁদেকেটে চোখে জোয়ার তুলবে তা না আরামসে ঘুম দিচ্ছ?কতটা নির্দয় তুমি আভা।
তেঁ তেঁ উঠল আভা।কন্ঠ স্বরটা শুনেই বুঝতে পেরেছিল এটা কে।আভা রাগে কটমট করে বলে,
– কেন ফোন করেছেন আপনি?আর নির্দয় আমি নই আপনি মি.আফসিন রৌদ্র।
রৌদ্র অবুঝ স্বরে বলে,
– ওমা কেন?আমি আবার কি করলাম?
– কি করলাম মানে?আপনি এভাবে চলে গিয়েছেন কেন?
চলবে…
#প্রিয়_বালিকা |২৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
– তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে তাই তোমাকে বলতে পারিনি।আর আসাটাও জরুরি ছিল।
– রাতে বলতে পারতেন।না বলে এভাবে চলে গেলেন কেন?
– বললাম তো জরুরি ছিল।
– কি জরুরি?না বলে কেন চলে গেলেন?
রৌদ্র এবার বিরক্ত হলো।আভাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠলো,
– বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?বলছি তো জরুরি ছিল তাই আসতে হয়েছে।তখন থেকে বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছ।
আভাও রাগি স্বরে বলে,
– এই মাঝরাতে আমাকে বকাবকি করতে ফোন দিয়েছেন?তাহলে শুনে রাখুন ঘুম হারাম করে আপনার বকা শোনার মতো সময় আমার নেই।গুড নাইট।
আভা ফোন কাটতে যাবে তখন রৌদ্র বলে,
– হ্যাঁ ঘুমাও যত্তসব!
ফোন কেটে দিলো আভা।আপাতত এসব রৌদ্র টৌদ্র বাদ।এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঘুম।আভা ফোনে সময় দেখে নিলো।সাড়ে চারটার কিছু বেশি বেজেছে।মনে মনে ভাবল এখন অস্ট্রেলিয়ায় কত সময় হতে পারে?পরমুহূর্তেই মাথা থেকে সব ঝেড়ে শুয়ে পড়ে সে।কিছুক্ষণ যেতেই আবারও ফোনটা বিকট শব্দে বেজে ওঠে।মাত্রই ঘুম এসেছিল আভার চোখে ফোনের শব্দে আবার ঘুম কেটে গেল তার।এবার সে বড়ই বিরক্ত রৌদ্রের উপর।মানে লোকটা কি ঠিক করেছে তাকে ঘুমাতে দিবে না?আভা ফোন ধরে বিরক্তির সুরে বলে,
– আবার কি হয়েছে?
অপর প্রান্ত থেকে রৌদ্রের রাগি স্বর ভেসে এলো,
– তোমার তো সাহস আছে।তুমি এই টোনে কথা বলো আমার সাথে?
আভা এবার উঠে বসলো।বাঁকা হেসে মশকরা করে বলল,
– আরো বলবো।কিই বা করে নিবেন আপনি?হুহ্!
রৌদ্র কন্ঠ খাদে নামিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
– দূরত্বের সুযোগ নিচ্ছো?
আভা মৃদু হাসে।বলে,
– কিছুটা।
রৌদ্র পূর্বের স্বরেই বলে,
– দাঁড়াও একবার দুরত্বটা ঘুচিয়ে ফেলি তখন দেখবে সুযোগ নেওয়া কাকে বলে।
আভার গাল দুটো গরম হয়ে গেল।ঠোঁট চেপে লাজুক হাসে সে।গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে বলে,
– এতো রাত হয়েছে ঘুমাননি কেন এখনো?
রৌদ্র শব্দ করে হাসে।সে অসম্ভব সুন্দর শব্দ আভার কানে পৌঁছাতেই শিউরে ওঠে সে।চোখ বন্ধ করে অনুভব করে নিজের অস্বাভাবিক গতির হৃৎস্পন্দন।রৌদ্র হাসি থামিয়ে বলে,
– ও ম্যাডাম আমি বাংলাদেশে নেই।এখানে মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে।আচ্ছা তুমি ঘুমাচ্ছিলে ঘুমাও।আর নিজের যত্ন নিবে।যতদিন না আমি আসি।আমি চলে আসলে আমি নিজ দায়িত্বে তোমাকে দেখে রাখবো কেমন?গড নাইট হানি।
“হানি” শব্দটি শুনে আভার শ্বাস বৃদ্ধি পেল।ঠোঁটের লাজুক হাসিও প্রসারিত হলো।গাল দু’টো অস্বাভাবিকভাবে গরম হয়ে যাচ্ছে।সে করুণ স্বরে বলে,
– সাড়ে বারোটা আপনার কাছে মাত্র? আচ্ছা বাদ দেন আগে বলেন কবে আসবেন?
রৌদ্রের ঠোঁটের দেখা যায় তৃপ্তির হাসি।প্রিয় মানুষের চোখে, মুখে,কন্ঠে নিজের জন্য উদ্বেগ দেখাটা বোধ হয় পৃথিবীর সব থেকে প্রশান্তিময় দৃশ্য।রৌদ্র কোমল স্বরে জবাব দেয়,
– চলে আসবো।খুব শীঘ্রই। এসে তোমাকে অর্ধাঙ্গিনী করবো।তোমাকে খুব ভালোবাসবো।
আভার ভারি হয়ে গেল।গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
– আচ্ছা তাহলে এখন ঘুমাই?
রৌদ্র আদুরে স্বরে সায় দিলো,
– ঘুমাও।
আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে আভা।থাকবে না কেন?কাল রাতে যে তার প্রমিকের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে।আজ বেশ ফড়িং এর মতো এদিক সেদিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সে।আর মাত্র চারদিন আছে সে বাড়িতে এটা ভাবলে আবার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আভার।শুক্রবারই তাকে আবার মেসে যেতে হবে।সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু শনিবার থেকে।খাবার টেবিলে বেশ সতেজ ভঙ্গিতে খাবার খাচ্ছে আভা।অহনা আভার প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে বলে,
– কি ব্যাপার আভাকে আজকে অনেক খুশি খুশি লাগছে।
আভা বিগলিত হেসে ভাবির দিকে চায়ল।অহনা ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে?”।আভার উত্তর না দিয়ে ঠোঁট মেলে তাকিয়ে থাকে ভাবির দিকে।অহনা ভ্রু কুঁচকে আভার পাশের চেয়ার টেনে বসে।চারিদিকে সতর্কতার চাহনি দিয়ে স্বর নিচু করে বলে,
– কি ব্যাপার আভামনি?মনে হচ্ছে কোনো সুপুরুষের প্রেমে পড়েছ?
আভা মাথা নত করে লাজুক হেসে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।অহনা চোখ বেরিয়ে এলো বিস্ময়ে।মুক দিয়ে বেরিয়ে এলো অবিশ্বাস্য সুর।সে কন্ঠ স্বরে আরো সতর্কতা এনে বলে,
– কে সে?দেখতে কেমন?
আভা ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়ালো।নিচু হয়ে অহনার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
– সে সোনার নাগর দেখতে চান্দের সমান!
এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না আভা।অহনা ঠোঁট আলগা করে বড় বড় চোখে আভার যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে।
অন্ধকার ঘরে কম্পিউটারের মনিটারের তীব্র আলো ঠেকাতে চোখে সানগ্লাস পরে কীবোর্ড আঙুল চালাচ্ছে রৌদ্র।কীবোর্ডেও লাল-নীল আলো জ্বলছে।খুব মনোযোগ সহকারে
ওয়েব ডেভলপমেন্টের একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে সে। গ্রাজুয়েশনের পর থেকে সে ওয়েব ডেভলপমেন্টের কাজ করছে।এতোদিনে অনেকগুলো প্রজেক্ট জমা হয়েছে।তবে সম্প্রতি নতুন পাওয়া প্রজেক্টির কাজ সে গ্রহণ করেছে।কারণ তার এখন কিছু ডলারের প্রয়োজন। কপালে সূক্ষ্ম একটি ভাঁজ দেখা গেল রৌদ্রের।পরণে কালো টি-শার্ট এবং হাঁটুর নিচ অবধি কালো প্যান্ট।কীবোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে পাশে থাকা কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানে ছোট একটি চুমুক দিলো।রৌদ্রের ঘরের দরজায় দু’বার কড়া নেড়ে কোনো সাড়া পেল না রোদেলা।সংকোচ নিয়ে ধীরগতিতে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে সে।সারাঘর অন্ধকার।শুধু মাত্র খাটের সাথে সেট করা পারপেল আলো আর এক কোণায় রৌদ্রের কম্পিউটারের আলো দেখা যাচ্ছে। কম্পিউটারের সামনে সানগ্লাস চোখে বসে আছে রৌদ্র। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি।এগিয়ে গিয়ে হাতের কফিটি কীবোর্ডের পাশে ফাঁকা জায়গাতে রাখেন। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন রৌদ্রের পাশে।মনিটারে একপলক চোখ রেখে রৌদ্রের দিকে তাকান তিনি।রৌদ্রের কোনো নড়চড় নেই।সে ভাবলেশহীন ভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। রোদেলা নিরবতা ভেঙে রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করেন,
– পিএইচডি নিয়ে কিছু ভেবেছ?
রৌদ্র মনিটরে চোখ রেখে উত্তর করে,
– আপাতত পিএইচডির কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি।
আবারও একটি তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো রোদেলার ভিতর থেকে।সে হতাশ কন্ঠে বলল,
– আর সেই কাজটা?
– কিসের কথা বলছো?
– একটা কোম্পানিতে আইটি এন্ড ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে অফারটা পেয়েছিলে সেটা নিয়ে কি কিছু ভেবেছ?
রৌদ্র বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে,
– এতো ছোট কোম্পানিতে আমি কাজ করবো না।
রোদেলা এবার নিজের রাগ ধরে রাখতে পারলেন না।ক্ষিপ্র স্বরে বলেন,
– তুমি এসব কি করছ রৌদ্র?তোমার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে তুমি সেটাকে এভাবে নষ্ট করছ অবহেলা করছ?আর ওটা কোনো ছোট খাটো কোম্পানি নয় সিডনির খুব ভালো কোম্পানি। তুমি কেন এমন খামখেয়ালি করছ?
রৌদ্র এতোক্ষণে নিজের মায়ের দিকে তাকায়।কীবোর্ডের পাশে থাকা রিমোট চেপে ঘরের লাইট জ্বালায়।চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে,
– মম আমি জানি আমি কি করছি।আমি বাংলাদেশে যেতে চাই আর এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।
রোদেলা আগের স্বরে বলেন,
– কেন যেতে চাও তুমি ওখানে?কি এমন আছে ওখানে?কি এমন পেয়েছ তুমি সেখানে যে তুমি তোমার সুন্দর জীবনটাকে এভাবে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছো?
রৌদ্র কোনো উত্তর করে না।আবারও কীবোর্ড আঙুল চালায় সে।রোদেলা সন্দিহান দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।রৌদ্রকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলে,
– তোমার কি কোনো বাঙালি মেয়েকে পছন্দ হয়েছে?হলে আমাকে বলো আমি তাদের সাথে কথা বলবো।বিয়ের পর তাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে এসো।তাই বলে এতো বড় ভুল করো না।ভবিষ্যতে তোমাকে এর জন্য পস্তাতে হবে।তাছাড়া তুমি সেখানে সেটেল্ড হতে চাইছো তোমার তো সিটিজেনশিপ নেই।
– অ্যাপলিকেশন করেছি।কিছুদিনের মধ্যে চলে আসবে।তোমার এবং ড্যাডের আছে সো আমাকে তেমন কষ্ট করতে হয়নি।
রোদেলা করুণ স্বরে বলে,
– রৌদ্র তুমি ভুল করছো।
রৌদ্র আবারও তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– মম তুমি কি যেন বলছিলে?তুমি আমার প্রেমিকার পরিবারের সাথে কথা বলবে?সত্যি বলবে?বললে খুব উপকার হবে।
রোদেলা ভ্রুকুটি করে বলেন,
– তারমানে তুমি সত্যিই কোনো বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
রৌদ্রের দায় সাড়া জবাব,
– হ্যাঁ।
– কে সে?
রৌদ্র খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে দিলো,
– অভয়ের বোন আভা।
রোদেলা গম্ভীর স্বরে বলে,
– আচ্ছা ওর মা বা বাবার নম্বরটা দাও আমাকে।
রৌদ্র নম্বর দিয়ে দিলো।বলল,
– ফোন করে বলবে আমি তাদের মেয়েকে বিয়ে করতে চাই আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই বিয়ের পর আমি বাংলাদেশেই থাকবো।সো তার মেয়ে তাদের কাছেই থাকবে।
রোদেলা কোনো উত্তর দেয় না।নম্বর নিয়ে গম্ভীরমুখে বেরিয়ে আছে রৌদ্রের ঘর থেকে।রৌদ্র রিমোট চেপে ঘরের দরজা লক করে দিলো।তারপর চোখে সানগ্লাস দিয়ে ঘরের আলোও বন্ধ করে দিলো।নিজের কাজে মনোযোগ দিলো পুনরায়।
চলবে…
#প্রিয়_বালিকা |২৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
প্রেমা কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করছে এবং স্বামীর খাবারের থালায় খাবার তুলে দিচ্ছে।সকলে সকালের খাবার খেতে খাওয়ার টেবিলে এক হয়েছে।সেখানেই প্রেমা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তখন থেকে হাঁসফাঁস করে চলেছে।আরাভ সাহেব খাওয়া থামিয়ে স্ত্রী দিকে তাকিয়ে বলেন,
– কিছু বলতে চাও?
প্রেমা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।আমতা আমতা করে।কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মিনমিন করে বলে,
– রৌদ্রের মা কাল ফোন করেছিল।
রৌদ্রের নাম শুনে আভা একপলক মায়ের দিকে দেখে।আরাভ স্ত্রীর মুখ পানে চেয়ে বলে,
– রৌদ্রের মা?তা কি বলল?কি হয়েছে?রৌদ্র কেমন আছে?
প্রেমা মেয়ের দিকে আঁড়চোখে দেখে পূর্বের ন্যায় মিনমিন করে বলে,
– বলল রৌদ্র নাকি আভাকে বিয়ে করতে চায়।
মায়ের মুখে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য শুনে ভীমড়ি খায় আভা।অনবরত কাশতে শুরু করে সে।চোখ বড় বড় করে একবার মাকে দেখে তো একবার বাবাকে।বাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকে পড়তেই নিজেকে সামলে নেয় সে।মনে মনে ভাবে,”রৌদ্র এতো তাড়াতাড়ি সবাইকে কথাটা ফাঁস করে দিলো?কোথায় ভাবল কয়েকদিন লুকিয়ে লুকিয়ে মাখো মাখো প্রেম করবে তা না রৌদ্র স্পয়লারটা এভাবে মেরে দিলো?” আভার চোখে মুখ আফসোস আর হতাশায় নিমজ্জিত হয়।আরাভ সাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে থাকেন।তারপর হঠাৎই বিগলিত হেসে বলেন,
– রৌদ্র তো ভালো ছেলে।আমরা ওকে অনেক কাছ থেকেও দেখেছি।চেনা জানা ভালো,ভদ্র ছেলে সে।তাহলে তুমি এমন মুখ ভার করে খবরটা কেন দিচ্ছ?
প্রেমা নিচু স্বরে বলে,
– বিয়ের পর ও আভাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চায়।
আরাভ মুন্সির মুখে নেমে আসে আঁধার কালো মেঘ।একমাত্র মেয়ে তার এতো দূরে একা থাকবে নতুন পরিবেশে?আভার বুকটাও কেঁপে ওঠে মায়ের শেষ কথা শুনে।রৌদ্র তাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চায়?কই সে তো তাকে এমন কিছু বলেনি।কিন্তু সে তো তার বাবা-মাকে ছেড়ে এতো দুরে যেতে চায় না।
আরাভ মুন্সি গম্ভীর মুখে বসে আছেন।প্রেমা কটুণ দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে চেয়ে।হয়তো এবার সে রৌদ্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।অহনা আমতা আমতা করে বলে,
– বাবা জানি আপনাদের মধ্যে কথা বলা ঠিক হবে না তবু আমার কিছু বলার আছে।
সকলের দৃষ্টি এখন অহনার দিকে।আরাভ মাথা নাড়িয়ে বলার অনুমতি দেয়।অহনা আভার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি যতটুকু জানি আভা কাউকে পছন্দ করে।তাই ওর বিয়ের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ওর মতামতটাও নিয়ে নেওয়া উচিত।
আভা চমকে ওঠে।যাক এটারই বাকি ছিল।এখন ষোল কলা পূর্ণ হলো।আরাভ অবাক চোখে আভার দিকে তাকিয়ে বলে,
– তোমার পছন্দের কেউ আছে?
পরমুহূর্তেই স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,
– তাহলে তো রৌদ্রের প্রস্তাব গ্রহণের কোনো প্রশ্নই উঠছে না যেখানে আমার মেয়ের অন্য পছন্দ আছে।নিশ্চয়ই সে আমার মেয়ের যোগ্য তাই আমার মেয়ের তাকে পছন্দ হয়েছে।গ্রাজুয়েশন শেষ করে তুমি তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিও আভা।আর প্রেমা তুমি রৌদ্রের মাকে ফোন করে সব বুঝিয়ে বলে দিও কেমন?এখন আমি উঠি অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে।
– কিন্তু বাবা…!
আভা কিছু বলার আগেই আরাভ মুন্সি উঠে বেরিয়ে গেলেন।প্রেমা প্লেট গুছিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে যাচ্ছে।অহনাও শাশুড়ীর হাতে হাতে সবকিছু এগিয়ে দিচ্ছে।আভা সেখানেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।কতদিক দিয়ে জট লেগেছে ভাবতেই তার মস্তিষ্ক জট পেকে গেল।ঘরে চলে গেল সে।একা একা নানা গবেষণা চালাল নিজের মনে, “রৌদ্র আমাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চায়?আমাকে তো আগে বলেনি।আমি বাবা-মাকে এখানে একা রেখে যেতে চাইনা।বাবা মায়ের আমি আর ভাইয়া ছাড়া কেউ নেই।আমি দূরে চলে গেলে মা বাবার কি হবে?”
আভা নানা কিছু চিন্তাভাবনা করে রৌদ্রকে কল করে।রৌদ্র সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে।আভা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি বলে,
– তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করেন।আপনার নম্বরে অনেক বেশি টাকা কাটে।
রৌদ্র হতভম্ব হয়ে ফোনের স্ক্রিনে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে কল ব্যাক করে।আভা প্রথমে ধীরে সুস্থে রৌদ্রকে সালাম দেয়।রৌদ্রও সালামের উত্তর দিয়ে জানতে চায়,
– কি অবস্থা?সবকিছু ঠিকঠাক?ভার্সিটিতে গিয়েছ?
আভা গম্ভীর স্বরে বলে,
– আপনি আমাদের ব্যাপারে আপনার মাকে জানিয়েছেন?
রৌদ্র ভ্রু কুঞ্চন করে বলে,
– মম ফোন করেছিল?
পূর্বের স্বরে বলে,
– হ্যাঁ।
রৌদ্র সন্দিহান স্বরে বলে,
– কি বলেছে?
– বলেছে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান।
রৌদ্র স্বস্তির শ্বাস ফেলে বিগলিত হাসে।জোরে একটি শ্বাস নিয়ে বলে,
– যাক মম তাহলে একটা কাজের কাজ করল।তো বলেন ম্যাডাম আপনার সারপ্রাইজটা কেমন লাগল?
আভার সোজা জবাব,
– ভালো না।
কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হয় রৌদ্রের।আভা শক্ত কন্ঠে বলে,
– আপনি বলেছেন আপনি বিয়ের পর আমাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চান?দেখুন আপনার সিদ্ধান্ত যদি এটা হয় তবে আপনার সাথে আমার পথচলা এখানেই শেষ করতে হবে।আমি আমার বাবা মাকে একা ফেলে এতো দূরে যাবো না।আমার বাবা মা আমার কাছে সবচেয়ে দামি।আল্লাহ না করুক বাবা মায়ের কোনো সুবিধা অসুবিধা হলে আমি বাবা মায়ের কাছে থাকতে পারবো না।
রৌদ্র বিস্মিত কন্ঠে বলে,
– কিন্তু আমি তো এমন কিছুই বলিনি।আমি তো আরো বললাম যে…!
কলটা কেটে দিলো আভা।রৌদ্র চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।ফোনটা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে।ফোনে কতগুলো দাগ সৃষ্টি হয়।রাগে সারা শরীর ঘামতে শুরু করে তার।ঘর থেকে বের হয়ে হুংকার ছাড়ে,
– মম! মম!ড্যাড!মম!
রোদেলা বা হামিদ কাউকেই আশেপাশে দেখা যায় না।মিনি স্কার্ট পরিহিত গৃহকর্মী এগিয়ে এসে বিনয়ী স্বরে বলেন,
– সরি স্যার।ম্যাম ইজ নট এট হোম।
– ডু ইউ নো হোয়ার ইজ শী?
-নিউ বার ওপেনড ইন টাউন টুডে।স্যার এন্ড ম্যাম ওয়েন্ট দেয়ার ফর লেট নাইট পার্টি।
– ওকে।ইউ মে গো নাও।
– স্যার ডু ইউ নিড কফি?
– নো থ্যাংকস।
তার চারটা বেজে পাঁচ মিনিট।রৌদ্র তার কম্পিউটারে নিজের প্রজেক্টে ফাইনাল টাচ দিচ্ছে।একঘন্টা পরই ক্লায়েন্টকে এটি সাবমিট করবে।বিনিময়ে তার একাউন্টে বেশ বড় অংকের মার্কিন ডলার যুক্ত হবে।মেইন দরজা খুলতেই মৃদু শব্দের একটি এলার্ম বেজে ওঠে।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে রৌদ্র।ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে পায় তার বাবা মা বাড়িতে প্রবেশ করছে।বাবার কাঁধে মা নিজের মাথা রেখে আছে।শরীরের ভরটাও বাবার উপর।হামিদ ছেলেকে দেখে চমকে উঠলো।রোদেলা চোখ পিটপিট করে ছেলেকে দেখে দাঁত বেরিয়ে হাসে।ঢুলতে ঢুলতে ছেলের সামনে এসে নেশাল স্বরে বলে,
– রৌদ্র মাই সন তোমাকে আমি বাংলাদেশে যেতে দিবো না।
রৌদ্র শক্ত কন্ঠে বলে,
– আভার মাকে কি বলেছ তুমি?তোমাকে আমি বলতে বলেছি আমি বাংলাদেশে সেটেল্ড হবো।তুমি কেন বলেছ আমি আভাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসবো?
রোদেলা ঢুলে পড়ে যাওয়ার আগেই রৌদ্র ধরে ফেলল মাকে।নাক মুখ কুঁচকে বলে,
– নিতে পারো না যখন তখন এতো ড্রিংক করো কেন?ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছ না।
রোদেলা রৌদ্রকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বলে,
– তুমি মেয়ের জন্য বাংলাদেশ যেতে চায়ছ না?তাহলে শোনো তোমাকে একটা সিক্রেট বলি।
রোদেলা রৌদ্রের মাথা ধরে নিচে নামিয়ে আসে।কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
– ঐ মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে না। ও অন্য কাউকে পছন্দ করে।হ্যাঁ…!তাই তো ওর মা আমাকে ফোন করে বলল তার মেয়ে অন্য কাউকে পছন্দ করে তাই তারা আমাদের প্রস্তাব গ্রহন করতে পারবে না।তুমি ঐ মেয়েকে ভুলে যাও।কাল তোমার জন্য আমি একটা ব্লাইন্ড ডেট ফিক্সড করেছি।
ঠোঁট ভেঙে ফুপিয়ে রোদেলা ছেলের কপালে চুমু খায়।ছেলে দুহাতে আগলে নিয়ে বলে,
– প্লিজ তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না রৌদ্র।মম ড্যাড তোমাকে অনেক ভালোবাসে।তুমি কেন তোমার মম ড্যাড থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকো?একই শহরে থেকেও তুমি আলাদা থাকো।কেন বাবা।মম তোমাকে খুব ভালোবাসে।মমকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ।
হামিদও স্ত্রীর সাথে সায় দিয়ে আবেগি স্বরে বলে,
– মম ঠিক বলেছে বাবা।তুমি প্লিজ আমাদের সাথে থাকো।
রৌদ্র তপ্ত শ্বাস ফেলে মায়ের কপালে উষ্ণ ছোঁয়া দেয়।বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– মমকে ঘরে নিয়ে যাও।আর তোমাদের কতবার করে বলি এসব ক’কটেইল ম’কটেইল আর খেও না।বয়স হয়েছে তোমাদের।
হামিদ স্ত্রীকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।রৌদ্র তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,
– হায় রে উন্নত জীবন!
কাউকে ফোন করে বলে কাল সকালের এমার্জেন্সি ফ্লাইটের একটি টিকেট বুক করতে।বারবার ভাবে তার মা কি বলল?আভা অন্যকাউকে পছন্দ করে?কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?
তখন থেকে পাসপোর্ট খুজে চলেছে রৌদ্র।কোথাও পাচ্ছে নার পাসপোর্টটা।একটু পরেই তার ফ্লাইট এখন পাসপোর্টাই উধাও। রাগে শরীর জ্বলছে তার।বার বার মনে হচ্ছে ফ্লাইটটা আজ সে মিস করবে।কিন্তু সে কিছুতেই ফ্লাইট মিস করতে চায় না।এবার বাংলাদেশ যাওয়ার পিছনে তার অন্য একটি কারণ আছে।সে বিশাল বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ যাচ্ছে এবার।কিন্তু পাসপোর্ট?সেটাই তো নিখোঁজ।
চলবে..