প্রিয় বাবা – Sumaiya Afrin

0
1068

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রিয় বাবা,

হাজারো বিষণ্নতার বেড়াজাল ছিন্ন করে বলতে হচ্ছে তোমার সাথে দীর্ঘপথ হাঁটার সুযোগ হয়ে ওঠেনি ।
“তাই ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না ।” তবুও, যেটুকু মনে আছে সেটুকুর স্মৃতিচারণ করেই আজকের তোমার তরে চিঠি লেখা । লেখার সময়ে এক অদ্ভূত অনুভূতি পুরো শরীর-মন জুড়ে বসে আছে। জানি না ! কেমন সেই অনুভূতি । তবে এতটুকু জানি সেই অনুভূতি প্রকাশ করার মতোন শব্দ চয়ণ আমার পক্ষে সম্ভব হবে না । তাই সেই ব্যর্থ প্রচেষ্টা নাই বা করলাম । কারণ আমি মনে করি, “অনুভূতি নামে মাত্র কোনো শব্দ নয় এর ভিতরে লুকিয়ে আছে অনুভবের গভীরতা । যা মাঝে মাঝে প্রকাশ না করে রেখে দিতে হয় নিজস্ব মন কুঠুরিতে । আবার কখনো বা এই জাগ্রত অনুভূতিই পুড়ে যায় কষ্টের তাপে, ধুয়ে যায় বৃষ্টির জলস্রোতে ।”

রাগ, শাসন আর রাশভারী চেহারার আবডালে যে মানুষটির কোমল হৃদয় ছিল, তুমি আমার সেই বাবা । জন্মের পর মায়ের পরেই তুমি তোমার নি:স্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতার শৃঙ্খলা বেঁধে আমার জীবনকে নিরাপদ ও সুন্দর রাখতে চেয়েছো । “বাবা” আমার জীবনে তুমি ছিলে নির্ভরতার আকাশ, একরাশ নিরাপত্তার শক্ত কোনো প্রাচীর, নিদাঘ সূর্যের নিচে অমল-শীতল কোনো ছায়া।

জীবন পরিক্রমায় এসে আজ বুঝতে পারছি বাবাহীন জীবন ছোট্ট ডিঙ্গি নিয়ে উত্থাল সাগর পারি দেওয়ার দুঃসাহসিক চেষ্টার নাম । যার ‘বাবা’ নামক বটবৃক্ষের নিবিড় ছায়া নেই,সেই বুঝে ‘বাবা’ নামক শব্দের গভীরতা ঠিক কতটা ।
আজ আমার মনের দরজায় যেনো সবসময়ে কড়া নাড়তে থাকে, “অনন্ত পথ বাবাহীন চলতে হবে একা, জানি ভেঙে দিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা ।” কারণ সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতা কিংবা বিরূপ বিশ্বের অজানা বিপদের হাতছানি থেকে পরম আবেশে আগলে রেখেই স্বনির্ভরসম্পন্ন মানুষ করার স্বপ্ন সাধনাই যে ছিল তোমার জীবনের ব্রত, সেই তুমি আর আমার জীবনে নেই । আর নেই বলেই আজ একরাশ চাপা কষ্ট নিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে হচ্ছে এই বিরূপ বিশ্বে । যেখানে নানা রকম অজানা আশংকায় আমায় চলতে হয়, প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় সৈনিকের বেশে । শুধু একটু ভালো থাকার প্রচেষ্টায় ।

জানো বাবা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বর্তমানের তুমিহীনা জীবন কতটা আগোছালো সেটা তুমি থাকাকালীন সেই গোছালো অতীত খুব করে জানান দিয়ে যায় । আজকে তুমি নেই বলেই দুঃখের সাগরে পতিত হলেও কারো বুকে এসে একটু তীরের সন্ধান খুঁজে দেখা হয় না ; হয়ে ওঠে না ‘বাবা’ ডাকের সেই মিষ্টি ডাকটা ডাকতে পেরে তৃষ্ণা মেটানো হৃদয়ের অনুভূতির পূর্ণতা । চরম হতাশা কিংবা বিপদগ্রস্ত হলে কেউ এখন মাথায় হাত বুলিয়ে বলে না, “আমি তো আছি ‘মা’, চিন্তা বা ভয়ের কোনো অবকাশ নেই ।” আর কোনোদিন হয়তো তোমায় ‘বাবা’ বলে শান্তির পরশ মিশিয়ে আবেগের চাদর বিছিয়ে জড়িয়ে ধরে আলতো করে চুমু এঁকে দেওয়া হবে না । কারণ আমার যে সেই তুমিটা নেই ! আল্লাহ্‌ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে অবশেষে চলে গেলে না ফেরার দেশে ।”
তবুও তোমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কিছু একটা লিখি কিন্তু লিখতে গিয়েও সেটা এর আগে কখনো হয়ে ওঠেনি । যেহেতু গল্প পোকা একটা সুবর্ণ সুযোগ করে দিলো তাই আজকে তোমাকে নিয়ে সেই অনুভূতির জানান দিব নিজের লেখা চিঠির দ্বারাই । যেটা এতদিন নিজের মনে স্মৃতির পাতায় লিখে রেখেছিলাম খুব যত্ন করে । যদিও জানি আজও সেই অনুভূতি লেখার পরেও তুমি অবধি সেটা পৌঁছাবে না । কিন্তু

“বাবা ! তোমাকে আর পাব না,
সে কথা জেনেও খুব যত্ন করে
সঙ্গপোনে অশ্রু ঝরাই হৃদয় কোণে ।”
মনপাঁজরে রক্ত ঝরে-
ডুকরে ডুকরে ভেতর কাঁদে ।
তুমি না-ই বা সেটা দেখলে ।
বাবা কেন জানি না তোমার মেয়ে যখন নিজের চোখের সামনে অন্য কাউকে তার বাবার সাথে খুনশুটিতে মেতে উঠতে দেখে, তখন এক রাশ কালো মেঘের ছায়া এসে ভর করে তার হৃদয় কোণে যেখানে তখন দীপ্তি জ্বেলে এক মুঠো রোদ ওঠার কথা ছিল । সেখানে আজ রোদ ওঠে না বরং আনন্দের রাশি বিরাজ না করেই মুখে থাকে ম্লান হাসি যা আমার চঞ্চলতাকে দমিয়ে দিয়ে করে ফেলে গৃহবন্দি । বুক ফেটে বেরিয়ে আসে না পাওয়ার, না ডাকতে পারার এক অতৃপ্ত আর্তনাদ । কিন্তু ওই যে আমাদের মতো বাবাহীনদের বুক চিঁরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস কিন্তু বুক যতোই ফেটে যাক ; মুখ তো ফেটে যাওয়ার নয় তাই লোকসমাজে আমি হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই চলে বেড়াচ্ছি দিনের পর দিন নিজের গড়া কোনো এক ছন্দে । কারণে অকারণে নিজের তৈরি করা নিয়মের মাঝে আজ নিজে থেকেই যেনো নিজেকে করেছি এক দুর্বোধ্য কঠিন বেড়াজালে বন্দি । কারন কষ্টের সাথেই যে প্রতিনিয়ত করে চলেছি সন্ধি।যখন কোনো কিছু চোখের সামনে দেখলেও হাজারো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কিনতে না পারার ব্যর্থতা অনুভব করি, তখন বুঝি তুমি নামক বটবৃক্ষের অবদান আমার জীবনে কতখানি । নিজের ইচ্ছেগুলো সব সময়ে হয়তো পূরণ করা হয়ে উঠে না তখন ইচ্ছেশক্তিগুলো নিজের মন কুঠুরিতে রেখে দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না সামলিয়ে এগিয়ে যেতে হয় পরবর্তী সময়ে কি করব সেটা ভেবেই ।
বাবা তুমি যখন আমায় ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলে । তখন আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে জানান দিয়েছিল ঠিকই তুমি আর নেই । কিন্তু বুঝতে পারিনি সেদিন তুমি না থাকা কথাটার গভীরতা কতটা বিশাল ছিল । আজকে সেটা বুঝতে পারি কারণ সমাজে চলার পথে কতটা বাঁধা-বিপত্তির পাশ কাটিয়ে কোনোরকম সাপোর্ট ছাড়াই এগিয়ে যেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত । জানি সামনের দিনগুলোতেও অন্য সবার বাবার মতোন ভরসার হাত বাড়িয়ে দিবার মতোন কাউকে পাবো না কারণ সেটা যে আর কোনোদিন সম্ভব হবার নয় । মাঝে মাঝে নিজের কাছেই প্রশ্ন জুড়ে দেই, “বাবা থাকলে আমার জীবনটা ঠিক কেমন হত ?” কোনোদিন এই প্রশ্নের উত্তর পাই না । নিজের মনকে তখন নিজেরই সান্ত্বনা দিতে হয় যাতে পুরো পরিস্থিতি সামলে নিতে পারি । কিন্তু ভাবনার জগত জুড়ে কিছু প্রশ্নের রেশ থেকেই যায় হয়তো খুব বেশি ভালো হতে পারতো ; মাথার উপরে থাকতো এক প্রাচীর ঘেরা ছায়া ।

বাবা তুমি থাকাকালীন হয়তো কোনোদিন সেইভাবে বলতে পারিনি তোমায় কতটা ভালোবাসি । কারণ ভালোবাসার অনুভূতিটুকু ছিল সুপ্ত যার প্রকাশ করার সুযোগ হয়নি তবে আজকে বলছি এই চিঠির দ্বারা বলেছি , “বাবা, ভালোবাসি ! তোমায় ভীষণ ভালোবাসি ।”

আজ এখানেই শেষ করছি । কিন্তু মনের ভিতর যেন অজানা এক বাজনা বাজে । আর সেই বাজনাই যেন জানান দেয় শেষ হয়েও হলো না শেষ । কারণ তোমায় নিয়ে আমার সব অব্যক্ত কথামালা একটা চিঠিতে ব্যক্ত করা সম্ভব নয় । কিন্তু চিঠির যে ইতি টানতেই হবে একটু আগে কিংবা পরে । তাই আমার কথার ইতি না টেনে বরং চিঠির ইতি এখানেই টেনে দিলাম ।

ইতি,
তোমার ছোট্ট মেয়ে
সুমাইয়া আফরীন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে