#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৪
তোঁষা’র মাথাটা কোলে তুলে আরহাম শান্ত হয়ে বসে আছে। বাইরে থেকে ঝাপ্টা একটা বাতাসে শীতলতা অনুভব করলো আরহাম। ঝাপ্সা চোখে তাকালো তোঁষা’র পানে। একটু আগের করা তোঁষা’র ছটফটানি এখনও ওর চোখে ভেসে বেড়াচ্ছে। আরহাম জানে তোঁষা’কে দেয়া মেডিসিনগুলো রিএক্ট করবে। সাইড ইফেক্ট আছে তাই বলে এমন কোন কিছু যে আজ হবে তা আরহামে’র জানার বাইরে। ব্রেইন কন্ট্রোল করা আরহাম জানে। পটুত্ব যতটা দরকার তার অনেকটাই আরহামে’র আয়ত্ত্বে। দেশের বাইরে চিকিৎসা শিক্ষা উন্নত বেশ। সেখানে যদি প্রশ্ন আসে সাইকোলজি নিয়ে তাহলে উন্নয়নের শীর্ষে রয়েছে কিছু রাষ্ট্র। আরহাম যথেষ্ট মেধাসম্পন্ন ছেলে। যেমন ভাবে তার একদিক দিয়ে মানুষিক কিছু সমস্যা রয়েছে ঠিক তেমন ভাবেই তার মেধা তুখোড় এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ইন্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে হুট করে মেডিক্যাল সেক্টরে যাওয়াটা কারো জন্যই সহজ বিষয় নয় কিন্তু সেখানেও নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে নিজেকে বিস্তর ভাবে প্রামাণ করেছে আরহাম। বাবা’র নজরে সে তোঁষা’র জন্য নিজেকে পারফেক্ট করতে চেয়েছিলো। করেছেও। তারা যদি একটা বার মেনে নিতো তাহলে হয়তো আজ আরহামে’র এতটা কঠোর হতে হতো না। তোঁষা’কে এতটা কষ্টদায়ক ভাবে ট্রিট করতে হতো না।
তখন যখন আরহাম ফিরে তাকালো তখন বিছানা থেকে নিচে পড়েছে তোঁষা। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে নিজের মাথা নিজেই দেয়ালে বারি মে’রেছে। আরহাম’কে ধরার বা কিছু করার সুযোগ সে দেয়নি। মুহুর্তটা ভুলতে পারছে না আরহাম। বহু কষ্টে ইনজেক্ট করেছে তোঁষা’কে। এরপর এইতো মাত্র ঘুমালো। কপালটা ফুলে আছে। ডান সাইডে খুবই আলতো হাত বুলালো আরহাম। সাইড থেকে মলমটা নিয়ে খুবই যত্ন করে লাগিয়ে দিলো কপালে। কিছুটা চুল তোঁষা’র মুখে চোখে আসছে দেখে আরহাম চুলগুলো একত্রে করার চেষ্টা করছে। বেশ হিমশিম খেতে হলো আরহাম’কে। এত বড় চুলগুলো কিছুতেই আয়ত্ত্বে রাখা যায় না। তুঁষ’টা নিজেও ঝামেলায় পরে যায় চুল নিয়ে।
দৃষ্টি নিবদ্ধ তোঁষা’র মুখে। ফুলা ফুলা গাল দুটো আরহামে’র অনেক প্রিয়। যখন তুঁষ’টা জেদ ধরে বা রাগ করে তখন লাল একটা আভা ছড়ায় এখানে। লজ্জা তেমন একটা পায় না ওর তুঁষ। তাই আরহাম বুঝতে পারলো না তার তোঁষা’র মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়? জানা নেই।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আরহাম ভাবনায় পরলো। ডোজটা সে নিজেই বাড়িয়েছে তোঁষা’র। আরেকটু স্টাডি করা দরকার এটা নিয়ে। তোঁষা’র এতটা মাথা ব্যাথা কেন উঠলো? চিন্তায় আরহামে’র কপালে ভাজ পড়লো। এমন হওয়াটা আজ স্বাভাবিক ঠেকল না ওর নিকট।
_________________
রাফি’কে ডেকে পাঠালো তুষা’র। রাফি শুকনো ঢোক গিলে দরজায় নক করলো। তুষা’র গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— কাম।
— স্যার!
— কাম হেয়ার রাফি।
— সরি স্যার।
— আই সেইড ইউ টু কাম।
তুষা’রের কথা শুনা মাত্র রাফি’র ঘাম ছুটে গেলো। স্যার তাকে কেন ডেকেছে তা জানা নেই রাফি’র। ভয়ে ভয়ে আগেই সরি বলে কেটে পরতে চাইলো কিন্তু তুষারের মুখভঙ্গি দেখে কিছুই ঠাওর করতে পারলো না। তুষার বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললো,
— বসো।
সামনের চেয়ারটা ইশারায় দেখাতেই রাফি জড়সড় হয়ে সেখানে বসলো। তুষা’র আরাম করে বসে আছে। বেশ ঠান্ডা গলায় সে বলে উঠলো,
— এখানে কেন এসেছো?
ডেকে এনে জিজ্ঞেস করছে কেন এসেছো? রাফি শুকনো গলায় বললো,
— আপনি ডেকেছেন তাই।
— আই আস্কড হোয়াই ডিড ইউ জয়েন্ড বাংলাদেশ আর্মি?
— ইটস মাই লাভ ফর মাই কান্ট্রি স্যার।
— ভুল। কোথায় দেশ প্রেম? আমি তো রাজশাহী শহর জুড়ে তোমার নারী প্রেম দেখছি।
তুষার প্রচুর চতুর মানুষ। মুখের ভাষায় মা’রতে হয় কিভাবে তা জানা আছে তার। যা বুঝার তা সে বুঝে গেলো ততক্ষণে। বেশ তারাহুরোয় বলে উঠলো,
— স্যার আই কেন এক্সপ্লেইন।
— প্রয়োজন নেই তার। ইউ মে গো।
রাফি মাথা নিচু করে চলে গেল। যাওয়ার আগে আরেকবার সরি বলতেও ভুললো না সে।
রাফি যেতেই তুষারের ফোনটা বেজে উঠে। তারাতাড়ি ফোন তুললো তুষার। ব্যাস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— কোন ইনফরমেশন?
অপর পাশ থেকে কিছু বললো যা শুনে ভ্রু কুঁচকায় তুষা’র। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রাখলো বা পাশের টেবিলে। তোঁষা’টাকে খুঁজতে খুঁজতে এই মাস খানিক সময়ে হাঁপিয়ে উঠছে তুষার। অতি গোপনে আরহামে’র খোঁজ চালাচ্ছে সে। আপাতত এতটুকু শিওর আরহাম ঢাকাতেই আছে। এই পর্যন্ত দুই বার তাকে দেখা গিয়েছে তবে কেউ ই নিশ্চিত না যেহেতু আরহামে’র মুখ ঢাকা থাকে। মাক্সের দরুন চেহারা বুঝা না গেলেও কিছুটা টের পাওয়া যায়। ম্যাসেজে পাঠানো ছবিটা দেখে থমকে গেলো তুষার। হ্যাঁ এটাই আরহাম। এরমানে আরহাম তোঁষা’কেও ঢাকাতেই রেখেছে। মাথা কাজ করছে না তুষা’রের। আরহাম নিজেকে হাজার কন্ট্রোলে রাখুক না কেন দিন শেষে সে বদ্ধ পাগল হয়ে যায়। তখন কাউকে পরোয়া করে না। কতবার এর সাক্ষী স্বয়ং তুষার ছিলো। যে নিজেকে আঘাত করতে দ্বিতীয়বার ভাবে না সে তোঁষা’কে হাজার ভালোবাসা দিক দিনশেষে সেই ভালোবাসাটা ও তো উন্মাদনায় ভরপুর থাকবে। সেই প্রণয়ের ফুলকিতে ঝলসে না যায় তুষা’রের নরম বোনটা। ছোট সেই প্রাণটা।
__________________
— ক্ষুধা লেগেছে।
— হু? হ্যাঁ। খাবি তো প্রাণ। ইনসুলিন টা আগে দিয়ে নেই।
— সাথে ওটা ও দিও নাহলে আমার মাথা ভালো লাগে না।
ঢোক গিললো আরহাম। শুষ্ক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— ওটা মানে?
— জানি না। কিছু একটা। তুমি দাও তো। সেটাই। ওটা না দিলে আমার মাথা ভার ভার লাগে। দেয়ার পর ভালোলাগে।
— আমি কিছু দেই না তুঁষ। শুধু তোর ভালোর জন্য..
— উম। খাব এখন।
— হ্..হ্যাঁ প্রাণ যাচ্ছি এখনই।
সবে মাত্র ঘুম ভেঙেছে তোঁষার। রাত এখন আড়াইটা। আরহাম ইনসুলিন পুশ করে বিশ মিনিট পরই খাবার হাতে ঢুকলো। তোঁষা’র আচরণ স্বাভাবিক। তবে খেতে খেতে জানালো তার মাথা ব্যাথা করছে। আরহাম ব্যাস্ত হতেই তোঁষা পুণরায় বললো,
— কপালে করছে ব্যাথা।
— চলে যাবে প্রাণ। হা কর।
বড় করে মুখ খুললো তোঁষা। আজকের তোঁষা’র খাওয়াটা স্বাভাবিক ঠেকলো না আরহামে’র নিকট। এমন করে ও ওর তুঁষ খায় না। খেতে খেতে কয়েকবার গালে জমিয়ে রেখেছে। আরহাম ওকে পানি খায়িয়ে যেই না নিজে খাবে ওমনিই দেখলো খাবারে আজ লবন হয় নি। হয়নি বলতে হয়তো দেয়া ই হয় নি। তাহলে তোঁষা কেন বুঝলো না?
স্বাদকুড়িতে তো সমস্যা হওয়ার কথা না। তাহলে?
খাওয়া শেষ করে আরহাম তোঁষা’র কাছে এসে ওর কপালে হাত রাখলো। অল্প গরম শরীরটা। আজ তোঁষা’র সপ্তাহিক ইনজেকশন দেয়ার কথা। তবে দিবে কি না আরহাম বুঝতে পারছে না। ওটা দিলেই তো হাতপা ছুঁড়ে কাঁদে তোঁষা। ব্যাথা জনক ইনজেকশনটা। আকাশগুড়ুম ভাবতে ভাবতে তোঁষাই বলে উঠলো,
— আজ রাতে সুই দিবে না?
চমকালো আরহাম। বেশি তো না। এই তো টানা তিন সপ্তাহ ধরে দিচ্ছে তাহলে তোঁষা কিভাবে বুঝলো? আরহাম কিছু বলার আগেই বিছানার মাঝখানে বসে গলগল করে বমি করে দিলো তোঁষা।
#চলবে……
#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৫
তোঁষা’কে বমি করতে দেখেই চমকায় আরহাম। অস্থির হয়ে ওকে চেপে ধরে। মুহুর্তেই নিজের শরীর সহ বিছানা মেখেঝুকে ফেলে তোঁষা। একদিকে যেমন বমি করছে অন্যদিকে কান্না করছে। আরহাম কিছুটা বেকায়দায় পড়ে। তবুও তোঁষা’কে বুকে নিয়ে পুরোটা বমি করায়। বমি করার সময় তা আটকে রাখতে নেই বা মুখে চেপে রাখতে নেই। এই বমি আটকে রেখে ওয়াসরুমে যেতে যেতে কিছুদিন আগে এক বাচ্চা মা’রা গেলো।
তোঁষা’র বমি থেমে যেতেই ও আরহামে’র বুকের দিকে মুখ মুছলো। আরহাম নিজের দিকে তাকালো। আশ্চর্য একটা বারের মতো ওর নাক কুঁচকালো না। তোঁষা’র পিঠে এতক্ষণ বুলানো হাতটা এবার মাথায় বুলিয়ে বললো,
— আরো বমি করবি?
— উহু।
— আয়।
বলেই টেনেটুনে তোঁষা’কে কোলে তুললো। তোঁষা শরীর ছেড়ে আছে। আরহাম কোনমতে ওকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। পরপর পরণে থাকা কাপড়ে লেপ্টে যাওয়া সব পানি দিয়ে ধুয়ে এরপর তোঁষা’কে গোসল করতে সাহায্য করলো। নিজের গায়ে থাকা টিশার্ট’টা খুলে পাশে রেখে তোঁষা’কে নিয়ে বের হলো। তোঁষা’কে পাশে থাকা কাউচে বসিয়ে কিছুটা দৌড়ে ওর পোশাক বের করে আরহাম। তোঁষা’র সামনে দিতেই তোঁষা মুখ ঘুরিয়ে বললো,
— পড়ব না এখন।
— কেন?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আরহাম।
— ঘুমাব।
তোঁষা’র সরল জবাব। আরহাম জোর করেই তোঁষা’কে পড়াতে চাইলো। তোঁষা ও পরবে না। বাথরোবটা গায়ে জড়িয়েই বসা থেকে কাউচে শুয়ে পরলো ও। আরহাম হার মানলো তবে ওকে অবাক করে ওকে কাছে টানলো তোঁষা। হতবুদ্ধ হয়ে গেলো আরহাম। তোঁষা’কে পরিষ্কার করালেও আরহাম পরিষ্কার হতে পারে নি। তারমাধ্যে বিছানা নষ্ট হয়ে আছে। আরহাম বাঁধা দিতে চাইলেও পারছে না। তোঁষা ওকে আঁকড়ে ধরেছে। আরহাম অসহায়ত্ব বোধ করলো। তোঁষা’কে ফেরানোর সাধ্য ওর নেই। না কোনদিন ছিলো। এদিকে তোঁষা ও ছাড়ার নাম নিচ্ছে। আরহাম ফাঁকা ঢোক গিলে তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। অসহায় গলায় বললো,
— ত..তুঁষ এখন না।
— এখনই।
— প্রাণ আমার আমি নোংরা হয়ে আছি।
— কিছু হবে না।
— বুঝার চেষ্টা কর। সব পরিষ্কার করতে হবে।
— আগে আমি।
— হ্যাঁ আগে তুই। একটু সময় দে। আধ ঘন্টা লাগবে।
— উহু। আগে আমি।
তোঁষা থামলো না। আরহাম উশখুশ করতে লাগলো। এভাবে সম্ভব না। অলরেডি টকটক গন্ধে রুম ভরে যাচ্ছে। তোঁষা’র আঁকড়ে ধরা হাতটা ছাড়িয়ে দীর্ঘসময় ওকে চুম্বন করে আরহাম। এতে তোঁষা ছাড়লো তো না ই উল্টো আহ্লাদী হয়ে উঠলো। আরহাম পরলো বিপাকে। এবার জোর করেই তোঁষা’কে ছাড়ালো ও। উঠে বসতে নিলেই রেগে গেলো তোঁষা। আরহামে’র হাত খামচে ধরে তাকালো ওর পানে। জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে বলতে লাগলো,
— ডেকেছি না আমি? কেন আসো না?
আরহাম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তুঁষটা ও এমন না। হাতের খামচিটা তীব্র হতেই “আহ” শব্দ করে আরহাম। তোঁষা’র গালে হাত দিয়ে বললো,
— একটু সময় দে।
— না।
— প্রাণ…..
— যাহ।
আরহাম বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো। তোঁষা’র আচরণ বুঝতে পারছে না ও৷ তোঁষা’কে ধরতে নিলেই ও ঝাড়া দিয়ে বললো,
— ধরবেন না।
বলেই উল্টো হয়ে শুয়ে পরলো। কি যে বিরবির করছে বুঝে না আরহাম। আপাতত সে ঘর গোছাতে ব্যাস্ত হলো। বিছানার চাদর থেকে নিয়ে বাকিসব ধুঁয়ে শুকাতে দেয় আরহাম। নতুন একটা বেড শিট বিছিয়ে স্যাভলন দিয়ে ফ্লোরটাও মুছলো যদিও এর দরকার ছিলো না তবে খুঁতখুঁত স্বভাবটা এখনও যায় নি ওর। একপলক তোঁষার পানে তাকাতেই দেখলো ও শুয়ে শুয়ে ফুঁসছে। এরমানে ঘুমায় নি? আরহাম তো ভাবলো হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিছু না বলে নিজের একটা শর্ট প্যান্ট নিয়ে গোসল করতে চলে গেল আরহাম। প্রায় বিশ মিনিট পর গোসল শেষ করে বের হয় আরহাম।
খালি বুকে বিন্দু বিন্দু তার পানির ছিটা। হাত দিয়ে চুলগুলো ঝাড়া দিয়ে তোঁষা’র পানে তাকালো। কাউচের বাইরে তোঁষা’র চুলগুলো। এগিয়ে এসে নিজের টাওয়াল দিয়ে ই তোঁষা’র চুলগুলো মুছে দিলো। তোঁষা কথা বললো না। আরহাম এবার ডাকলো,
— তুঁষ?
তোঁষা কথা বললো না। বলবে না সে কথা। কেন বলবে? রাগ হয়েছে তার। আরহাম বুঝে। অল্প হেসে ফ্লোরে বসে পা মুড়ে। তোঁষা’র পিঠে হাত রাখতেই তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। আরহাম ব্যাস্ত হলো। হাত রাখলো ওর প্রাণে’র গালে। ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ব্যাথা হচ্ছে? খারাপ লাগছে তুঁষ? কথা বল। কেন কাঁদছিস?
— কথা নেই আপনার সাথে। ভালোবাসেন না আপনি আমাকে।
— কে বলেছে? তোকে না বলেছি এসব কথা না বলতে। আমার কাছে আয়।
বলেই কোলে তুলে বিছানায় নিলো তোঁষা’কে। যেই না আরহাম ওর কাছে এলো ওমনিই তোঁষা তাকে ফিরিয়ে দিলো। আরহাম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে?
— ভালো লাগছে না। কিছু দাও তো আমাকে।
— ক..কি দিব?
— কিছু দাও। ভালো লাগছে না। মাথা কেমন করছে।
এবার ঘাবড়ে যায় আরহাম। তোঁষা ধীরে ধীরে উত্তেজিত হওয়ার আগেই আরহাম ইনজেকশন নিয়ে আসলো। তোঁষা নিজেই হাত বের করে দিয়ে বললো,
— তারাতাড়ি দিন। আমার ভালো লাগছে না। মাথা কেমন করছে।
আরহাম দ্রুত হাতে পুশ করলো। গুঙিয়ে কেঁদে যাচ্ছে তোঁষা তবে বেশিক্ষণ না। মিনিট দুই যেতেই তীব্র ব্যাথায় শব্দ করে কাঁদে তোঁষা। আরহাম বহু কষ্টে বুকে ঝাপ্টে ধরে লাভ হয় না। হাত পা দাপিয়ে মিনিট পাঁচ কাঁদলো তোঁষা। অতঃপর শান্ত। একদম ঠান্ডা। আরহামে’র বুকের মাঝে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো আরহামে’র প্রাণ।
তোঁষা’র ব্যাথায় জর্জরিত মুখটাতে চুমু খায় আরহাম। গলায় মুখ গুজে শুয়ে পরে ওকে নিয়ে। অভিযোগ জানায় কানে কানে,
— এমন কেন হচ্ছে প্রাণ? এমন তো হওয়ার কথা না। তুই আজ বমি কেন করলি? কষ্ট হচ্ছে অনেক? তোর আরহাম ভাই তোকে কষ্ট দিবে না। বিশ্বাস কর আর কষ্ট দিবে না। আর কিছুটা দিন। ধীরে ধীরে সবটা ভুলে যাবি তুই। শেখ বাড়ীর কাউকে মনে থাকবে না তোর। তুই জুড়ে আমি থাকব প্রাণ। শুধু আমি। তোর শরীরে যারা এত আঘাত দিয়েছে। কষ্ট দিয়েছে। ধোঁকা দিয়েছে। এদের সকল থেকে তোকে দূরে রাখব আমি। ভিসায় ঝামেলা হচ্ছে। ওটা মিটে গেলেই আমরা দেশ ছেড়ে দিব। সব ছেড়ে তুই আর আমি সংসার করব। আমি তোকে আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসি প্রাণ। আমৃত্যু এই আরহাম তোকে ভালোবেসে যাবে। আমি পা*গল না। বিশ্বাস কর আমি পা*গল না৷ আম্মু বলেছে আমি আমি পা*গল না। অথচ দেখ আম্মু আর তুই বাদে সবাই পা*গল ভাবে আমাকে। আমি চিকিৎসা নিয়েছিলাম প্রাণ। তোর জন্য সবটা করেছি। কিন্তু তোকে যে কারো জন্য ছাড়তে পারব না। আমার আরো কিছু ট্রিটমেন্ট সেশন বাকি। তোকে নিয়ে গিয়ে বাকিগুলো করব। কিন্তু আমি আবারও বলছি আমি পা*গল না প্রাণ।
তুই শুধু আমাকে মনে রাখ। ধোঁকা দেয়া সকল মানুষদের ভুলে যা। আমি তোকে অনেক আদর করব। প্রচণ্ড ভালোবাসা দিব।
ঘুমন্ত তোঁষা’র কানে কানে সব বললো আরহাম অথচ আরহাম জানলোই না অনিশ্চিত তাদের ভবিষ্যতের কথা। কিছু না বলা সত্য। কিছু না জানা তিক্ততা।
______________
— স্যার!
কর্নেল তাহের হাসলেন তুষারকে দেখে। ইশারায় বসতে বললেই তুষার বসলো সটান হয়ে। যতক্ষণ না স্যার কিছু বলছে ততক্ষণ তুষার ও কিছু বলতে পারছে না। অবশেষে প্রস্তাব দিলো কর্নেল তাহের,
— ইউ নো তুষার সোজা কথা বলতে পছন্দ করি আমি।
— ইয়েস স্যার।
— আমি তোমাকে আজ অনেক বছর ধরে চিনি। তোমার স্বভাব চরিত্র আমার জানা। আমার মেয়ের জন্য তোমাকে চাইছি। আমি চাই তাকে তোমার হাতে তুলে দিতে।
এতটুকু বলেই থামলেন তিনি। মুখ চিকচিক করছে তার। তুষার কোনদিন তাকে ফেরাবে না এটা জানেন তিনি। তথ্য কিছু কাজে এইদিকে এসেছিলো। এসেই এমন কথা শুনে ওর মাথা ঘুরে উঠলো। এইজন্য ই কি তুষার তাকে পাত্তা দেয় না। যেখানে এতবড় ঘরের প্রস্তাব পেয়েছে সেখানে তথ্য’র মতো কাউকে কেন ই বা গ্রহণ করবে তুষার? কথাটা ভাবতেই গলা ধরে আসলো ওর। চোখটা ঝাপটালো বার কয়েক। কান্না করা এতটাও সহজ না তথ্য’র জন্য। খুব কমই কাঁদে সে। অথচ আজ তথ্য’র চোখে পানি। শক্ত স্বাভাবের তথ্য শুধু মাত্র এই তুষারের জন্য কি ই না করলো। কত বেহায়াপনা করলো। তুষার বুঝি এজন্যই তথ্য’কে কোনদিন দেখেও দেখে নি। বিয়ের কথা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।
কোনমতে কান্না চেপে বেরিয়ে এলো তথ্য। এসেই টেবিল থেকে কাগজ তুলে রিজাইন লেটার লিখে ফেললো। কোনকিছু না ভেবে তা পাঠিয়ে দিলো দায়িত্বরত অফিসারের নিকট।
থাকবে না এখানে তথ্য। কিছুতেই না।
_________________
তোঁষা’কে আজ সকাল থেকে বেশ ফুরফুরা দেখালো। আরহাম তাতে সস্তি পেলো। ভোরে তোঁষা নিজে ধরা দিলো আরহাম’কে। সকল ক্লান্তি, চিন্তা অবসাদ যেন তাতেই কেটে গেলো। ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে আরহাম। আজ আসার সময় তোঁষা হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছে তাকে। আরহাম অল্প চিন্তায় পরলেও তোঁষা যখন গলায় ঝুলে তাকে মিষ্টি আদর করলো তখন আরহাম চিন্তামুক্ত হয়ে বেরুলো।
আজ রাতে আরহামে’র জন্মদিন। দিন গুণে গুণে রাখার অভ্যাস তোঁষা’র। তার আরহাম ভাই এর জন্মদিন ও সে গুনেগুনে হিসেব রাখে। আরহাম যেতেই সোজা রান্না ঘরে ঢুকে ও। ফ্রিজ ঘেটেঘুটে ময়দা, ডিম বের করলো। কেক বানাতে পারে না ও। তবুও চাচি’কে যতটুকু দেখেছে তা মনে করেই কাজ আগালো তোঁষা। সকাল থেকে দুপুর অতঃপর বিকেল। আজ সারাটাদিন লাগিয়ে এসব করেছে তোঁষা। আরহাম সবটা ফোনে দেখলো। মনে জোয়ার এলো যেন ওর। তোঁষা’র ভালোবাসা নিখুঁত। তার থেকেই নিখুঁত খোদ তোঁষা।
আজ আরহামে’র ফিরতে লেট হলো কিছুটা। তোঁষা তখন সুন্দর করে একটা শাড়ী পরেছে। সেজেছে হালকা করে। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিলো পিঠ জুড়ে। লাল রঙা ঠোঁটটা বেশ আকর্ষণীয় দেখালো। নিজেকে দেখে হাসলো তোঁষা। লজ্জা পেলো সামান্য। মিনমিন করে বললো,
— দেয়ার মতো গিফট তো নেই। আমিটাকেই আপনাকে দিয়ে দিব প্রাণ।
অতঃপর অপেক্ষা। তোঁষা আধঘন্টা যাবৎ অপেক্ষা করার পর চিন চিন ব্যাথা অনুভব করলো মাথায়।
গাড়িতেও একবার লাস্যময়ী তোঁষা’কে দেখেছে আরহাম। নিজেকে বহু কষ্টে সামাল দিয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো ও।
তোঁষা’র মাথা ব্যাথা চিনচিন থেকে ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। তোঁষা দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো। মুখে ব্যাথাকাতুর শব্দ করে ডেকে উঠলো মা, বাবাকে। চোখের সামনে সবই যেন ঝাপ্সা হয়ে আসছে ক্রমশ। আর সহ্য করতে পারে না তোঁষা। উঠে দৌড়ে যায় আলমারির ড্রয়ারের কাছে। টান দিতেই তা খুলে গেলো। হয়তো আরহাম আজ লক করতে ভুলে গিয়েছে।
তিন চারটা অ্যাম্পুল রাখা সেখানে। তোঁষা বড় সিরিঞ্জ নিলো একটা। মাথা ব্যাথায় জান যায় যায় অবস্থা। তিনটা অ্যাম্পুল হাতে তুলে তোঁষা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ধপ করে আলমারি ঘেঁষে বসলো পরলো। শাড়ীর আঁচলটা অবলীলায় পরে গেলো। তোঁষা সহ্য করতে না পেরে এক সিরিঞ্জ লিকুইড স্যাম্পল নিজের হাতে পুশ করলো। ব্যাথা কমে নি ওর। পরপর আরেক সিরিঞ্জ ভরে জোরে গেঁথে দিলো বাহুতে। শরীর কাঁপছে ওর। ঠিক যেন কোন নেশাগ্রস্ত মানুষ নেশা পেলো। তীব্র বাসনায় দিশেহারা হলো ও।
তৃতীয়টাও বাদ গেলো না। তবে সেটা শরীরে গাঁথলেও অর্ধেকের বেশি পুশ করতে পারলো না তোঁষা। শরীর ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলো ও।
আরহামে’র জন্য করা সাজটা নিমিষেই লেপ্টে গেলো। এদিকে তীব্র আকাঙ্খা আর হাত ভর্তি ফুল নিয়ে রুমে ঢুকলো আরহাম। হাসি মুখে ডেকে যাচ্ছে,
— তুঁষ? তুঁষ? কোথায় তুই প্রাণ?
#চলবে……