প্রিয় নয়নতারা পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
666

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_অন্তিম[প্রথমাংশ]

“অতিরিক্ত শব্দটাই বিষাক্ত! অতিরিক্ত ভালোবাসা মানুষকে সর্বোচ্চ নিচে নামিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত কোনো কিছু মানেই অধঃপতন।”
নয়নের কথাটা ফাহিমের কানে যেতেই ফাহিম ওর হাতে থাকা ফুলদানিটা দিয়ে, নিজের মাথায় আঘা’ত করতে করতে বলতে লাগল,
“আমার তারাকেই চাই। তারাকেই চাই আমার।”
রিমা বেগমকে ছেলের এই করুণ অবস্থা মেনে নিতে পারছেন না। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বার বার। রুবিনা বেগম তাকে শান্ত করায় ব্যস্ত আছেন। তারা নয়নকে ভয়ার্ত স্বরে বলল,
“কিছু একটা করো, প্লিজ। উনি তো ম’রে যাবে।”
রিমা বেগম দৌড়ে নয়নের কাছে এসে, নয়নের হাত জোড়া আকঁড়ে ধরলেন। আকুতিভরা কণ্ঠে বললেন,
“আমার ছেলেটাকে বাঁচা, বাবা৷ আমার ছেলেটার এই কষ্ট যে আমি সহ্য করতে পারছি না। কিছু একটা কর।”
নয়ন এই মুহুর্তে খুঁজে পাচ্ছে না কি করে ফাহিমকে সামলাবে? তারার দিকে একবার অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করল। তারা ইশারায় ভরসা দিলো খানিকটা। নয়ন রিমা বেগমের হাত দুটো ধরে অভয়বাণীতে শুধালো,
“চিন্তা করো না, মামি।”
বলেই নয়ন ফাহিমের দিকে এগিয়ে গেলো। ফাহিমকে গিয়ে দুইহাতে শক্ত করে ধরল। চিৎকার করে বলতে লাগল,
“কি করছিস তুই? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? যে ভাগ্যে থাকেনা তাকে হাজার চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়না। এই সহজ সত্যি কথাটা মানতে শিখ। তারা এখন আমার বউ। তুই হাজার চেষ্টা করলেও এখন আর তারাকে পাবিনা। তারাকে যদি সত্যিই ভালোবাসিস, তাহলে ওকে ভালো থাকতে দে। তুই এমন করলে তারা ভালো থাকবে না। অপরাধবোধে ধুঁকে ধুঁকে ম’রে যাবে। সেটা কি তুই চাস?”
ফাহিম এতক্ষণের শান্ত হয়ে গেছে। কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনল। যখনি নয়ন প্রশ্ন করল, তখন অসহায় চোখে তাকাল নয়নের দিকে। উত্তর দিলো না। নয়নের মায়া হলো খুব। যতই হোক ভাই বলে কথা। ফাহিমের কপাল দিয়ে গড়িয়ে র’ক্ত পড়ছে। হাতে অজস্র দাগ হয়ে আছে। গালের এক সাইডে কে’টে আছে। ফাহিমকে চুপ করে থাকতে দেখে, নয়ন শান্ত স্বরে আবার প্রশ্ন করল,
“বল, তারা অপরাধবোধে ম’রে যাক সেটা কি চাস তুই?”
ফাহিম দুইদিকে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ ‘না’। নয়ন উত্তর পেয়ে বলল,
“তাহলে এসব বন্ধ কর, ভাই। নিজের জীবনটা নতুন করে শুরু কর। অন্তত মামির দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নে। দেখ, ওই মানুষটা কেমন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তুই ছাড়া তার আর কেউ নেই। প্লিজ ভাই, নিজেকে সামলে নে।”
ফাহিম একবার নিজের মায়ের মুখপানে তাকাল। রিমা বেগম পাগলের মতো আহাজারি করছেন। ফাহিম কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।।পরক্ষণেই ঢলে পড়ে যেতে লাগল। কিন্তু তার পূর্বেই সবাই মিলে ও’কে ধরে ফেলল। নয়ন সবার সাহায্য নিয়ে ফাহিমকে রুমে নিয়ে গেলো। ইমারজেন্সি ডাক্তারকে কল করল। এদিকে রিমা বেগম অস্থির হয়ে কাঁদছেন। নয়ন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিচ্ছে।
“কান্না কইরো না, মামি। সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার দেখছে তো, ফাহিম ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ও’কে একটা ভালো সাইকোলজিস্ট দেখাব৷ দেখবে ও একদম সুস্থ হয়ে যাবে।”
ডাক্তার জানিয়ে গেলো। ফাহিম অতিরিক্ত মানসিক চা’পে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। একটা ভয়ানক ট্রোমাতে আটকে গেছে। যতদ্রুত সম্ভব ভালো সাইকোলজিস্ট দেখাতে।



রাত ১২টা বেজে ১০মিনিট। পুরো বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। যেই বাড়িটা সবসময় হাসি, আড্ডায় মেতে থাকতো, আজ সেই বাড়িটাই শূন্যতায় ভরপুর। সবার উপর দিয়ে অনেক বড় ধকল গেছে। আহসান সাহেব পুরো ঘটনাটায় অনেক ভেঙে পড়েছেন। তনয়া শশুড় বাড়ি ফিরে গেছে। রিমা বেগম ছেলের রুমে অপেক্ষা করছেন ছেলের জ্ঞান কখন ফিরবে, সেই আশায়। তারা আর নয়নের বিয়েটা কি করে হয়েছে সেটাও সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওদের বিয়েটা সামাজিক ভাবে দেওয়া হবে। তারা সারাদিনের ধকল সেরে গোসল করেছে কিছুক্ষণ আগেই। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। ভেজা চুল দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। তারা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু ভাবছিল। জীবন কখন কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে। কেউ বলতে পারবে না। হুট করে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। অতি চেনা, অতি আপন মানুষটার ছোঁয়া পেতেই তারার শরীরের সব অশান্তি, অস্বস্তি কেটে গেলো। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। শরীর ভালোবাসার শিহরণ বয়ে গেলো। শরীর বুঝি এই ছোঁয়ার অপেক্ষায় ছিলো এতক্ষণ। তারা চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইল আগের ন্যায়। নড়াচড়া করল না। খুব করে মানুষটাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা জমেছে মস্তিষ্কে। ইচ্ছাগুলো শিরায় শিরায় ছড়িয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ গতিতে। তারা নয়নের হাত দুটো নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখল। নয়নের হাতের উপর নিজের হাত দিয়ে চেপে রাখল। নয়ন হাতটা সরিয়ে নিলো মুহূর্তেই। তারা তা দেখে খানিকটা অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“সরালে কেন? ভালো লাগছিল এভাবেই।”
নয়ন উত্তর দিলো না। তারার জামার ভেতর দিয়ে হাত ঢুকাল। তারার অনাবৃত পেটে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গে তারা কেঁপে উঠল। এই প্রথম নয়ন তারাকে এত গভীর ভাবে ছুঁয়েছে। এবার নয়ন তারার ঘাড়ে মুখ ডুবাল। সেভাবেই বলল,
“তোর শরীরের ঘ্রাণটা আমাকে মাতাল করে দেয় রে, তারু।”
তারা আবেশে চোখ বন্ধ করে আছে। উত্তর দিলো না কোনো। নয়ন তারার ঘাড়ে গভীর ভাবে চুমু এঁকে দিলো। পেটের উপর থাকা হাতের বাঁধনটা আরো শক্ত হলো। তারাকে এবার নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। রেলিং এর সাথে তারার পিঠ ঠেকলো। নয়ন তারার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল বেশকিছু সময়। বেলকনিতে থাকা লাইটের আবছা আলোয় তারার মুখটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। তারার হালকা গোলাপি রঙের ঠোঁট জোড়া নয়নকে মারাত্নক ভাবে টানছে। তারার দিকে খানিকটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
“তোর ঠোঁট দুটো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে রে, তারু।”
তারা ফট করে চোখ খুলল। চোখ, মুখ কুঁচকে বলে উঠল,
“নির্লজ্জ! তুমি এত নির্লজ্জ হয়ে গেছো?”
নয়ন ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,
“অন্য মেয়েকে বলছি নাকি? আমার বউকে বলেছি। আমার বউ তুই। আমি যা খুশি বলতে পারি। আবার করতেও পারি।”
শেষের কথাটা বলে ঠোঁট চেপে হাসল। তারা সেই হাসির দিকে চেয়ে লজ্জা পেলো বেশ। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। নয়ন হাত তারার অনাবৃত পেট ও কোমড় জুড়ে বিচরণ করছে। ক্ষণে ক্ষণে তারা কেঁপে উঠছে। নয়ন তারার কপালে আলতো করে চুমু খেলো। তারার দুই গালে হাত রেখে নরম স্বরে বলতে লাগল,
“অনেক ঝড়ঝাপটা চলে গেছে আমাদের উপর দিয়ে। উপরওয়ালার অশেষ রহমতে তুই এখন আমার বউ। আমি তোকে হারিয়ে ছন্নছাড়া, দিশেহারা হয়ে যেতাম রে। দ্বিতীয় বার আর কাউকে ভালোবাসতে পারতাম না। আর কাউকে ভালোবাসা, বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। ভালোবাসার উপর আমার এক আকাশসম অভিযোগ জমে গিয়েছিল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তবুও শক্ত ছিলাম। আমার মায়ের তো আমি ছাড়া কেউ নেই।”
নয়নের গলা আটকে আসছে। তারা চেয়ে আছে নয়নের দিকে। নয়ন পুনরায় বলতে লাগল,
“তুই যখন ফাহিমকে ভালোবাসার কথা স্বীকার করলি। তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি ভেতর থেকে মা’রা যাচ্ছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার সময় মনে হচ্ছিলো ফুরিয়ে আসছে। আ…।”
আর কিছু বলার আগেই তারা নয়নের মুখ চে’পে ধরল। আঁতকে উঠে বলল,
“এসব আর বলো না। এতদিন যা হয়েছে সেসব আমাদের অতীত ছিলো৷ অতীত ভেবে কেন ভবিষ্যৎকে নষ্ট করছো? ভেবো না। সব ভুলে যাও। আমি ভুলিয়ে দিবো। আমি আছি তো। তোমাকে আগলে রাখব। কখনো ভেঙে পড়তে দিবো না। কখনো না। তুমি চিন্তা করো না। তোমার তারু যতদিন নিঃশ্বাস নিবে, ততদিন তোমারই থাকবে। নয়নের প্রিয় তারা হয়েই নয়নের আকাশে বিচরণ করব অন্তকাল অব্দি।”
নয়নের ঠোঁটে হাসি ফুটল। তারাকে আলতো করে নিজের বুকের মাঝে আগলে নিলো। তারাও শক্ত করে ধরল নয়নকে। এই বুকের বা পাশেই তারার শান্তি। এই সময়টা এখানেই থেকে যাক। দুটি অশান্ত হৃদয় মিলেমিশে একাকার হয়ে শান্ত হচ্ছে….

#চলবে

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_অন্তিম[শেষাংশ]

ভালোবাসা শব্দটা হয়তো সহজ। কিন্তু কাউকে ভালোবেসে তার সব পরিস্থিতিতে তার পাশে থেকে, ভরসা, সাহস দিয়ে তাকে আগলে রাখা কঠিন। ভালোবাসার মানুষটার হাত শক্ত করে ধরে রাখা কঠিন। সবাই এই কঠিন কাজটা করতে পারেনা। আর যে এই অসাধ্যসাধন করতে পারে সেই প্রেমিক পুরুষ। নয়ন পেরেছে সেই অসাধ্যসাধন করতে। পেরেছে ভালোবাসার মানুষটাকে কঠিন পরিস্থিতিতে আগলে রাখতে। সময় বহমান। নিজের স্রোতে বয়ে চলে। সেদিনের পর কেটে গেছে বেশকিছু দিন, সময়, মুহূর্ত। আধার কাটিয়ে সবার জীবন আলোকিত হয়েছে৷ আজ নয়ন আর তারার বিয়ে। খুব ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো বাড়ি আলোকসজ্জায় ঝিকমিক করছে। সবার মুখে হাসি বিরাজমান। ফাহিম এখন বেশ সুস্থ, শান্ত। নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরে বেশ কয়েকবার ক্ষমা চেয়েছে সবার কাছে। নয়ন আর তারা মিলে ফাহিমকে সুযোগ দিয়েছে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার। যদি কোনো মানুষ ভুল করার পর নিজেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারে, অনুতপ্ত হয়৷ তাহলে তাকে শেষ বার একটা সুযোগ দেওয়া অবশ্যই উচিত। ফাহিমও নিজের জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর সুযোগ পেয়েছে। এটা সে কিছুতেই নষ্ট হতে দিবেনা। তার মায়ের জন্য হলেও তাকে সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বাঁচতে হবে। নিজের জীবনের সাথে সাথে মায়ের জীবনটাকে রঙিন করে সাজিয়ে তুলবে। নয়ন আর তারার বিয়ের আয়োজন ফাহিম একা হাতে করেছে৷ সবদিকে তার সে কী খেয়াল! তারার ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করছে সে৷ বলতে বলতে সেই খুশির লগ্ন চলে এলো। নয়ন বর সেজে অপেক্ষা করছে তার প্রিয় তারার জন্য। নয়নের পাশেই ওর বন্ধুরা মিলে মজা নিচ্ছে। হুট করে চোখ সামনের দিকে যেতেই নয়নের মুখটা হা হয়ে যায়। বউ সেজে এগিয়ে আসছে তারা। পাশেই তনয়া হাসতে হাসতে ইশারায় জিজ্ঞেস করছে,
“কেমন লাগছে?”
নয়ন বুকে হাত দিয়ে সুরে সুরে বলে উঠল,
“জ্ঞান হারাবো, ম’রেই যাবো। বাঁচাতে পারবে না কেউ।”
বলেই পেছনে ঢুলে পড়তেই ওর সব বন্ধুরা মিলে ও’কে ধরে ফেলল। মুহূর্তেই খিলখিল হাসিতে পুরো বাড়ি মেতে উঠল। তারা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ঢং দেখে আর বাঁচি না, বাপু।”
তারাকে কেউ বসতে বলার আগেই তারা নয়নের পাশে বসে পড়ল। নয়নের বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। তা দেখে তনয়া মজা করে বলল,
“তোর কি লজ্জা শরম নেই রে, তারা? এতগুলো মানুষের সামনে হাত ধরে বসে আছিস।”
তারা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তনয়ার দিকে। ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,
“ও মা! লজ্জা থাকবে কেন? আমি কি পরপুরুষ কে ধরেছে? আমি আমার জামাইকে ধরছি৷ শুধু হাত কেন আরো অনেক কিছুই ধরতে পারি। দেখাবো?”
তারার মুখে এমন কথা শুনে নয়নের বন্ধুরা সবাই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে। আর তনয়া বেশ লজ্জা পেলো। আমতা আমতা করে অন্যদিকে পা বাড়ালো। সেদিকে চেয়ে তারা ঠোঁট চে’পে হাসল। নয়ন তব্দা খেয়ে বসে আছে। পাশ থেক্ব কোনোরকম সাড়া শব্দ না পেয়ে তারা নয়নকে ধাক্কা মে’রে বলে উঠল,
“তোমার আবার কী হলো? তব্দা খেয়ে আছো কেন?”
নয়ন অবিশ্বাস্য সুরে বলল,
“তুই কি ইদানীং বেশিই নির্লজ্জ হয়ে গেছিস?”
তারা বিরক্ত হলো বেশ। নয়নের পাঞ্জাবির কলার চে’পে ধরে নয়নের বেশ ঝুকল। দুজনের নাকে নাক ঘষার উপক্রম। দুজনের ঠোঁটের মাঝে অল্প বিস্তর ফাঁকা। নয়ন বেশ ঘাবড়ে গেলো। তারা এবার নয়নের চোখে চোখ রেখে রাগ নিয়ে বলল,
“তোমার জন্য শুধু নির্লজ্জ কেন? সব হতে রাজি। আর একবার যদি আমাকে নির্লজ্জ বলো, তাহলে প্রাকটিকাল দেখিয়ে দিব নির্লজ্জ কাকে বলে? তাও সবার সামনে। বুঝেছো?”
বলেই নয়নকে হালকা ধাক্কা মে’রে ছেড়ে দিলো। নয়নের অবস্থা দেখে ওর বন্ধুরা বেশ মজা নিচ্ছে। সাথে তারাও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সবাই বিয়ের আসরে উপস্থিত হতেই আহসান সাহেব কাজিকে হুকুম করলেন, বিয়ে শুরু করার জন্য। ঠিক তখনি নয়ন সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,
“ এই মুহূর্তে বিয়েটা হবে না। ”
নয়নের মুখে একথা শুনে তারার বুকটা কেঁপে উঠল। বিস্ময়ের চোটে আঁখি জোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বাড়ির সবাই অবাক দৃষ্টিতে নয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহিমও বেশ অবাক। সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপে। হুট করে এমন কথা কানে যেতেই অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো সবাই। জাহানারা বেগম গর্জে উঠে প্রশ্ন করলেন,
“কী বলছিস তুই?”
নয়ন সবার দৃষ্টি পরখ করে হেসে ফেলল। বলল,
“আরে, আরে শান্ত হও! আমার কথাটা শেষ করতে দাও। আমি বলেছি এই মুহূর্তে বিয়েটা হবে না৷ কয়েক মুহূর্ত পরে হবে৷ কারণ আমার সবাইকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার আছে৷”
এবার যেন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তারা তো সহ্য করতে না পেরে ধুম করে কিল বসিয়ে দিলো নয়নের পিঠে। রেগেমেগে বলে উঠল,
“একেবারে সব কথা বলতে পারো না৷ থেমে থেমে কথা বলো কেন, হাম্বার মতো। বলদ পোলাপাইন। অসভ্য একটা।”
তারার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। নয়ন সেই মুহূর্তে তারার কানে ফিসফিস করে বলল,
“এভাবে রেগে যেও না, বউ। রাগলে তোমাকে দারুন লাগে! লাল টমেটো। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করেছে এক্ষুনি। কিন্তু আমি তো এখন খাব না। রাতে খাব।”
তারার নয়নের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই নয়ন আমতা আমতা করে বলল,
“আই মিন, আদর খাব।”
পরমুহূর্তে দুজনেই হেসে উঠল। নয়ন এবার বলে উঠল,
“সবাই এক মিনিট অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
বলেই বাইরে বেড়িয়ে গেলো। মিনিটের মাথায় সাথে মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। নয়নের সাথে সবাই মোস্তফা সাহেবকে দেখে অবাক হলো বেশ খানিকা। আহসান সাহেব রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“ও এখানে কেন?”
মোস্তফা সাহেব নয়নের দিকে একবার অসহায় চোখে তাকালেন। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে ফেললেন। নয়ন আহসান সাহেবের সামনে এসে বলতে শুরু করল,
“দেখো মামু, প্রত্যেকটা আসামীর একটা করে ভালো হওয়ার সুযোগ পাওয়া উচিত। ফাহিমকে তো আমরা সবাই ক্ষমা করে দিয়ে, বুকে জড়িয়ে নিয়েছি। তাহলে ছোট মামুকে কেন, আলাদা করে দিব? তারা দুজনেই কিন্তু সমান অপরাধী। ফাহিম যেমন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে, ঠিক তেমনি ছোট মামুও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তার অপরাধের জন্য যথেষ্ট শাস্তিও পেয়েছে। আর শাস্তি তার প্রাপ্য নয়। তাকে ক্ষমা করে দাও। আমরা সবাই আবার একসাথে বাঁচব। আবার আগের মতো এবাড়িতে হৈ-হুল্লোড় হবে। হাসি, আনন্দে মেতে থাকবে। আমি জানি তুমি নিজেও ভালো নেই। আদরের ভাইকে কারাগারে বন্দি দশায় দেখে তোমার সবথেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে৷ তাই বলছি ক্ষমা করে দাও, মামু৷ বুকে জড়িয়ে নাও তোমার আদরের ভাইকে। আবার আমরা সব ভুলে নতুন করে বাঁচি, চলো?”
নয়নের কথা শেষ হতেই মোস্তফা সাহেব এসে আহসান সাহেবের পায়ে পড়ে গেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ভাইজান, আমারে একটা সুযোগ দাও। আমারে ক্ষমা করে দাও। শেষবারের মতো আমারে একবার বিশ্বাস করো। আমারে মাফ করে দাও, ভাইজান।”
আহসান সাহেবের চোখের কোনে পানি। সত্যিই তো মোস্তফা সাহেবকে তিনি ছোট থেকে কত আদর, স্নেহ দিয়ে ভালোবেসে বড় করেছেন। সেই ভাইকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। উঠিয়ে দাঁড় করালেন। কান্নারত স্বরে বললেন,
“যতই হোক তুই তো আমার রক্তের ভাই। তোর থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকি কিভাবে? আয় ভাই বুকে আয়।”
বলেই তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন ভাইকে। দুই ভাইয়ের মাঝে সব অভিমান, রাগ ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গেলেন। আহসান সাহেব এবার ফাহিমকেও ডাকলেন। ফাহিম এসে উনাদের দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরল। পরিবারের সবার মুখে আজ খুশির বিচরণ। সবার চোখে আনন্দ অশ্রু। কিছুক্ষণ পর ফাহিম উনাদের ছেড়ে গিয়ে নয়নের সামনে দাঁড়াল। নয়নের হাত দুটো ধরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করিস, ভাই। তোকে আর তারাকে অনেক আঘাত দিয়েছি। অপমান করেছি। অনেক অন্যায় করেছি তোদের সাথে। জানি আমার ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। তবুও বলছি পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
নয়ন শুধু হাসিমুখে বলল,
“আমার ছোট ভাই তো তুই। ছোট ভাই যদি কোনো ভুল করে ভাই হিসেবে আমার উচিত সেটা সংশোধন করে দেওয়া। ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়ে বুকে টেনে নেওয়া।”
বলেই ফাহিমকে জড়িয়ে ধরলেন। ফাহিম যেন আজ কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেলো। রিমা বেগমের বুকের থেকে একটা বড় পাথর সরে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সবাই। বাড়িটাকে আবার আগের মতো হাস্যজ্বল দেখে তারার বড্ড আনন্দ লাগছে। সবার চোখে পানি দেখে তারা এবার চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“আমার বিয়েটা কি তোমরা আর দিবে না? আমার তো আর তর সইছে না। আমি বিয়ে করব। তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও আমার।”
তারার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। তনয়ার স্বামী আকাশ হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলল,
“আরে বাহঃ! আমার শালিকার দেখি বিয়ে পাগলী হয়ে গেলো। কী ব্যাপার হ্যাঁ?”
প্রতিউত্তরে তারা লজ্জামাখা হাসি উপহার দিলো। আকাশ পুনরাহ ফিসফিস করে বলল,
“বুঝি, বুঝি সব বুঝি আমি। শালাবাবুকে কাছে পাওয়ার জন্য মন উন্মাদ হয়ে আছে, তাইনা?”
তারা কোমরে হাত দিয়ে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তা দেখে আকাশ হেসে নয়নের উদ্দেশ্যে বলল,
“তাড়াতাড়ি বিয়েতে বসো, শালাবাবু। তোমার বউয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।”
আকাশের কথা শেষ হতেই সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল৷ নয়ন আর তারা আবার পাশাপাশি বসল। কাজি পড়ানো শুরু করল। কবুল বলার সময় তারা একদমে তিনবার কবুল বলে ফেলল। বিয়েটা সম্পূর্ণ হতেই নয়ন তারার কানে কানে বলল,
“তোমাকে কাছে পাওয়ার নেশা জাগছে খুব।”
তারা মুচকি হাসল। ঠোঁট চে’পে হেসে বলল,
“রেডি থাকো, জান। তোমার কাছে পাওয়ার নেশা কাটিয়ে দিব।”
বলেই চোখ টিপ মা’রল। সামনেই বাড়ির সবাই নাচানাচি করছিল৷ এবার তারাও গিয়ে যোগ দিলো সেখানে। ‘মুঝে সাজান ক্যা ঘার যানা হ্যায়’ গানে খুব সুন্দর করে নাচল। অনুষ্ঠানের পর্যায় শেষ হতে হতে রাত হয়ে গেলো। সবাই মিলে তারা আর নয়নের জন্য বাসর সাজিয়ে রেখেছিল। পারিবারিক বন্ধনটা আবার আগের মতো শক্ত সুতোয় বাঁধা পড়ল।



ঘড়ির কাটা টিকটিক শব্দ করে চলছে। তারা বসে অপেক্ষা করছিল নয়নের জন্য৷ সবাই চলে যেতেই কয়েক মিনিটের মাথায় নয়ন ভেতরে ঢুকল। নয়নকে দেখেই তারা খাটের থেকে নেমেই, রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“এই আসার সময় হলো তোমার?”
নয়ন হেসে বলল,
“আমাকে কাছে পাওয়ার নেশা দমিয়ে রাখতে পারছো না, জান?”
তারা হাসল। নয়নের গলায় দুই হাত ঝুলিয়ে বলল,
“একদম না।”
নয়ন হেসেই তারার কোমরে হাত দিলো৷ নিজের সাথে তারাকে মিশিয়ে নিলো। তারার নাকে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
“তাহলে চলো, তোমার নেশা কাটিয়ে দিই।”
তারা উত্তর দিলো না। কোনো এক সুখের আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। নয়ন তারার কপালে চু’মু এঁকে বলল,
“আমাদের জীবনের সব তিক্ততা ভুলে চলো হারিয়ে যাই সুখের অতলে। যাবে আমার সাথে, প্রিয় নয়নতারা?”
তারা চোখ বন্ধ করেই রইল। ঠোঁটে কোনের হাসিটা বিস্তর ছড়িয়ে গেলো। দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নয়নকে। মুহূর্তা শুধুই ভালোবাসার। দুটি হৃদয়ের পূর্ণতার মুহূর্তগুলো সবথেকে দারুন! নয়ন তারাকে এবার কোলে তুলে নিলো। বিছানায় উপর রেখে তারার ঠোঁটে গভীর ভাবে চু’মু খেলো। তারার হাত দুটো নয়নের পাঞ্জাবী শক্ত করে ধরে আছে। নয়ন এক এক করে তারার গহনা গুলো খুলে ফেলল। শাড়ির থেকে সেফটিপিন গুলো খুলে রাখল। তারপর নিজের গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলেই মুখ ডুবালো তারার গলায়। হারিয়ে গেলো দুজন সুখের অতল গভীরে। যেখানে শুধুই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নতুন করে। ভালোবাসার পূর্ণতায় দুটো হৃদয়, মন মিশে একাকার হয়ে গেছে। সব বাধা পেরিয়ে আজ তারা জয়ী। নিজেদের ভালোবাসা দিয়ে সব যুদ্ধ জয় করেছে। সময়টা এখানেই থেমে যাক। ভালোবাসার ছোঁয়ায় দুটি মন উন্মাদ হয়ে আছে আজ। দুনিয়ার কোনো কিছুতেই তাদের মন নেই। তারা আজ সুখের নেশায় ব্যস্ত। তাদের এই সুখ অন্তকাল অব্দি থাকুক এই প্রার্থনা। পরিশেষে ভালোবাসা সুন্দর সঠিক মানুষকে পেলে।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে