প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০৯

0
533

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৯
,
দুই ছেলের কাছে এমন উত্তর পেয়ে শাহানার এবার ভীষণ রাগ হলো। তার বড় ছেলে তো সরাসরি না করে দিলো তিনি এতে কিছুই মনে করেননি। কারণ সে তার বড় ছেলেকে চেনে ওর কাছ থেকে কোনো আশা করাটাই বৃথা। কিন্তু মেজো ছেলের থেকেও যে একই জবাব আসবে তিনি ভাবতেও পারেনি। কিছুক্ষণ আগে যখন তিনি শশীকে বিয়ে করার কথা বলল তখন রোদ্র রাজি হলেও রোদ্রের পরে কথাটা শুনে পুরাই অবাক বনে গেছে।

মা তুমি যেটা চাইছো সেটাই হবে আমি বিয়েটা করবো তবে এখন নয় এক বছর পর। তুমিই বলো আমি এখন ওর দায়িত্ব কীভাবে নিবো আমি এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তোমাকে বলেছিলাম এখানে আশার আগে আমি আমার আঁকা কিছু ছবি বাইরের দেশের একটা প্রতিষ্ঠানে মেইল করেছিলাম। ওরা কালকে তার জবাব দিয়েছে এই জন্যই কালকে সারাদিন আমি বাইরে ছিলাম। ওখানে অনেক বড় একটা প্রদর্শনই হবে সেখানে আমি আমার আঁকা ছবিগুলো প্রদর্শন করার সুযোগ পেয়েছি। আমি কালকেই ভাইয়ার সাথে ঢাকা চলে যেতাম কিন্তু এই সম্যসার জন্য যেতে পারিনি। তবে আজকে কিংবা কালকে চলে যাবো এই সপ্তাহের মধ্যেই আমাকে চলে যেতে হবে। সামনের সপ্তাহে ওখানে অনুষ্ঠান।

কথাগুলো বলে রোদ্র একটু থামলো তারপর ওর মায়ের হাতদুটো শক্ত করে ধরে অনুনয় করে বলল, জানোত মা আমি প্রথম দেখাতেই শশীর পুরো ছবি মনের ক্যানভাসে এঁকে ফেলেছি। আমার বলতে কোনো দ্বিধা নেই আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমি এখন ওর যোগ্য নয় আমি এখনো ওর দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য নয়। আমি প্রতিষ্ঠিত হবো তারজন্য আমার সময় চাই। মাগো আমি তোমার কাছে শশীকে চাইছি তুমি আমায় কথা দাও তুমি এই একটা বছর ওকে আগলে রাখবে। আমি যে ওকে ভালোবাসি সেটা ও জানেনা ও আমাকে ওর অনেক ভালো বন্ধু ভাবে। তুমি ওকে কখনোই জানাবে না আমি এসে নিজে মুখে ওকে জানাবো তুমি শুধু আমায় কথা দাও এই একটা বছর ওকে দেখে রাখবে।

ছেলের কথা শুনে প্রথমে যতটা রাগ হয়েছিলো এখন রোদ্রের পুরো কথাশুনে সেই রাগটা আর নেই। সত্যিতো একজন বাবা কখনোই বেকার কোনো ছেলের হাতে তার মেয়েকে তুলে দিবে নাহ। যত কিছু হোকনা কেনো সেখানে শশীতো ফুলের মতো পবিত্র। শাহানারা ভেবেছিলো তার বড় ছেলের বউ করে সবার সামনে দিয়ে মাথা উঁচু করে শশীকে নিয়ে যাবে কিন্তু সেটা তো আর হলো নাহ। কিন্তু সে তার মেজো ছেলেকে কথা দিবে নিশ্চয়ই শশীকে সে ছেলের বউ করবে তবে বড় ছেলের নয় মেজো ছেলের। শাহানারা মুচকি হেসে রোদ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

অবশ্যই আমি আমার ছেলের আমানত এর কোনো খেয়ানত করবো নাহ। তুই নিশ্চিন্তে থাক আর মন দিয়ে সবটা করবি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবি বাবা ভাইয়ের মতো দশ জন এর একজন হবি তবেই কিন্তু শশীকে পাবি নয়ত আমি আমার মেয়েকে তোর সাথে দেবো নাহ।

মায়ের কথা শুনে রোদ্র হেসে মায়ের হাতের উপর চুমু খেয়ে বলল, আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো মা।
,,,,,,,,,,
শশীর শরীল খুবি দুর্বল দুই হাতের ছিলে যাওয়া স্থানে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। এতোক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছিলো জোনাকির কাছে সালিশের সবটা শুনে শোয়া থেকে উঠে বসল। দুর্বল শরীলে ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো। পুরো দোতলা ফাঁকা কেউ কোথাও নেই কি আশ্চর্য বাড়ির সবাই গেলো কই। সিঁড়ি বেয়ে নেমে নিচে আসতেই দেখলো সবাই বসার ঘরে। শশী দেখলো ওর আব্বা চৌকির উপর মাথা নিচু করে বসে আছে। মেঝেতে ওর মা আর কাকীরা ছোটো কাকা আর মেজো কাকা আব্বার থেকে একটু দূরে চেয়ার পেতে বসে আছে। শশী আস্তে আস্তে ওর আব্বার দিকে এগিয়ে গেলো তারপর ওর আব্বার পায়ের কাছে বসে মুখের দিকে তাকিয়ে ওর আব্বার হাতের উপর হাত রেখে বলল,

আব্বা বিশ্বাস করেন সমুদ্র ভাইয়া কিছুই করেননি ওনিতো আমায় বাঁচিয়েছে। ওইদিন আমি বই নিয়ে আসার সময় ওই শাহিন আমার মুখ চেপে ধরে ওই ক্লাবঘরে নিয়ে যায়। তারপর আমার হাত মুখ বেঁধে বলে ও নাকি আপনার সম্মান নষ্ট করে দেবে। আমাকে সারারাত এই ঘরে বন্ধ করে রাখবে তারপর সবার কাছে বলবে আমি খারাপ। আব্বা বিশ্বাস করেন আমি আপনার সম্মান নষ্ট হবে এমন কোনো কাজ করি নাই।

মেয়ের কথাশুনে জামশেদ মাস্টার মাথা তুলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কৈফত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই আম্মা আমি আপনারে বিশ্বাস করি।

বাবার মুখে কথাটা শুনতেই শশী ছোট বাচ্চার মতো বাবার হাত জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। তখনি শাহানা ঘরের মধ্যে এসে বলল, জামশেদ ভাই আমার একটা আবদার আছে আপনার কাছে।

কি আবদার আপা।

আমি শশীকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই আমার মেয়ের পরিচয়ে। আমার অনেক সাধ ছিলো আমার একটা মেয়ে হবে যাকে আমি পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবো। কিন্তু সেটাতো আর হলো নাহ তাই আমার অনুরোধ শশীকে আমায় দিয়ে দিন। নয়ত এই গ্রামের মানুষ ওর জীবনটা শেষ করে দেবে ওই খারাপ ছেলেটার সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি শশীকে নিয়ে যাবো পরিক্ষার সময় ও এসে পরিক্ষা দিয়ে যাবে। শহরের নাম করা কলেজে আমি ওকে ভর্তি করাবো ওকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবো ও নিজের পরিচয়ে বাঁচবে। আজকে ও মুখ লুকিয়ে এই গ্রাম থেকে যাচ্ছে কিন্তু একদিন সেই ওই মাথা উঁচু করে এই গ্রামে পা রাখবে কথা দিচ্ছি আপনাকে।

কিন্তু আপা আমি কোন পরিচয়ে আপনার সাথে ওকে পাঠাবো। গ্রামের মানুষ এসব বুঝবে নাহ আপনার ঘরে জোয়ান দুটো ছেলে এভাবে কেউই মানবে না আপা।

শশী মাথা তুলে বলল, আমি কোথাও যাবো নাহ আমি এখানেই থাকবো। এই গ্রামের বাইরে কিছুতেই যাবো নাহ।

শাহানারা এগিয়ে এসে শশীর মাথায় হাত রেখে ওকে বোঝানোর সূরে বলল, মারে বড় কিছু পেতে হলে এমন ছোট ছোট অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। আমিতো তোর মায়ের মতোই কথা দিচ্ছি আমার কাছে তুই কষ্টে থাকবি নাহ।

তারপর জামশেদ মাস্টার এর দিকে তাকিয়ে বলল, বিকেলে আপনি সবাইকে বলে দিবেন শশী আমার বড় ছেলের বউ এর পরিচয়ে আমার বাড়ি যাচ্ছে।

কিন্তু আপা সমুদ্র?

ওর কথা ভাববেন নাহ আমি সবটা দেখে নেবো।

শাহানারার কথায় সবাই রাজি হলো কেননা মেয়েকে বাঁচাতে তাদের এটা করতেই হবে। নয়ত গ্রামের মানুষ শশীকে শাহিন এর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে আর বাবা হিসাবে এটা কিছুতেই সয্য করবেন নাহ।
,,,,,,,,,,,
বিকেলের সালিশে এই কথাই জামশেদ মাস্টার সবাইকে বলে দিলো। শাহিন এর মুখটা রেগে লাল হয়ে আছে। তার করা প্ল্যান যে এভাবে নষ্ট হবে ও ভাবতেও পারেনি। সন্ধ্যার একটু আগেই বৈঠক ভেঙেছে। রাতেই সমুদ্ররা রওনা হবে। শশী কান্না করতে করতে দুইবার অঙ্গান হয়েছে। ও শুধু একটা কথায় বলছে ও কোথাও যাবে নাহ। জোনাকিও বোনকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কান্না করছে। শশীর ছোট কাকি ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে রেখেছে সমুদ্র হাজারও বিরক্তি নিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। আর বার বার শুধু ঘড়ি দেখছে একটু পরেই মাগরিবের আযান দিবে এখনো কেউ বাড়ির মধ্যে থেকে বের হয়নি। প্রায় অনেকটা সময় পর সবাই শশীকে ধরাধরি করে আনলো আগে শাহানারা গাড়িতে উঠলো তারপর শশীকে পাশে বসায়ে বুকের মধ্যে আগলে নিলো। জোনাকি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলো জয় ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল।

তুমি চাইলেই আমাদের ওখানে যেতে পারবে শুধু শুধু কান্না করো নাহ। যদিও তুমি আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছো তবুও আমি সবটা ভুলে গিয়েছি। যদিওবা তুমি আমাকে সরি বলোনি তবে ব্যাপার না। তোমার যখন তোমার আপুকে দেখতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলো আমি গাড়ি নিয়ে এসে তোমায় নিয়ে যাবো।

জোনাকি কিছু বললো নাহ শুধু ছলছল চোখে জয় এর দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনলো। জয় কথাগুলো বলে গাড়ির দরজা খুলে মায়ের অন্যপাশে বসে পড়ল। রোদ্র সমুদ্রের পাশের সিটে বসে পড়ল। সমুদ্র চোখে সানগ্লাস পড়ে গাড়ি স্টার্ট করতে গেলে রোদ্র থামিয়ে দিয়ে বলল।

ভাই দাঁড়াও এখনো হয়নি আর একটু।

সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে সামনে থাকা আয়নার দিকে তাকালো যেখানে শশীর কান্না ভেজা মুখটা ফুঁটে উঠেছে। সমুদ্র বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলো কেনো জানি মেয়েটাকে এই অবস্থায় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। কী আজব ব্যাপার কান্না করলেও কাউকে এমন সুন্দর লাগে?

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে