প্রিয়া চন্দ্রিমা পর্ব-০৩

0
513

#প্রিয়া_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#৩য়_পর্ব

ভাইয়া আব্বু ডাকছে। আমার সাথে এসো। – পিছনে কারো কন্ঠ শুনে দ্রুত চোখ মুছে নিলাম।
– কিছু বললে তুমি!
– তুমি কান্না করছো?
– আমি কেন কান্না করবো বলো! কি বলছিলে তুমি?
– আব্বু ডাকছে তোমায়।
– আচ্ছা চলো।

রুমের মাঝে একজন বয়স্ক পুরুষ খাটের উপর বসে আছে আমি ঠিক তার কিছু দূর দাঁড়িয়ে আছি। খুব সম্ভবত উনিই আমার জন্মদাতা।
– অবন্তী তুমি বাইরে যাও।
– আচ্ছা আব্বু।
অবন্তী চলে গেলো যাওয়ার সময় শুধু একটুকু বললো- খাওয়ার সময় ভাইয়াকে সাথে নিয়ে আসবে।

– দাঁড়িয়ে আছো কেন! বসো।
– আমি এভাবেই ঠিক আছি।
– তোমার আম্মু কেমন আছে!
– প্রায় ছয় মাস হলো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।
কথাগুলো বলার সময় খুব কষ্টে নিজের চোখে বাঁধ বাঁধিয়ে রাখলাম। কিন্তু আমার সামনে বসা ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমা খুলে চোখ জোড়া মুছে নিলো।
– এতো বছরে যে মানুষটার একটা বার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি তার মৃত্যুতে আপনার চোখে পানি আদৌও কি শোভা পায়!
– কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা অসহায় হয়ে পড়ি বাবা, যেটা না আমরা কাউকে বলতে পারি আর না নিজে সহ্য করতে পারি।
সামনের ভদ্রলোককে কেমন যেন অসহ্য লাগছে। এই লোকটা আমার ফুলের মতো মা’কে বেঁচে থাকতেই মৃত্যু যন্ত্রণায় প্রতিটি মুহুর্ত পুড়িয়েছে। তবে এখানে আসার আগেই শুধু তাকে এক নজর দেখার প্রবল ইচ্ছে মনের মাঝে প্রতিনিয়ত জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছিলো।
– আমায় এখানে ডাকার কারণ কি ছিলো?
– অবন্তী যখন থেকে জেনেছে তার একজন ভাই আছে তখন থেকে প্রায় বাহানা করতো ভাইয়ার কাছে যাবে বড় মা এর কাছে যাবে। কিন্তু ওর মা’য়ের জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। বাসায় প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে তাই ভাবলাম এটাই সুযোগ অবন্তীকে ওর ইচ্ছে পূর্ণ করানোর। তোমাকে চিঠিটা ঐ লিখেছে আমি তো শুধু ঠিকানা বলেছিলাম।
– আমি তাহলে এখানে অবন্তীর ইচ্ছায় এসেছি! ঠিক আছে, ওর সাথে আমার দেখা হয়ে গেছে আমি আগামী কাল চলে যাবো।
লোকটার প্রতি অসহ্য অনুভূতি ক্রমশ বাড়ছে।
– বিয়েতে থেকো।
– বিয়ে তো হচ্ছে না।
– বিয়ে হবে। সবাইকে ইনভাইটেশন দেওয়া শেষ হয়ে গেছে। এখন পরিবারের সম্মানের কথা, বিয়ে হতেই হবে। এই কয়দিন বোনটাকে একটু সময় দাও। তবে ওর মা যদি তোমায় কিছু বলে তবে কিছু মনে করবে না। ও তোমাদের কথা সহ্য করতে পারে না।

খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে। একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো, দাদু, মেজো চাচ্চু, ছোট চাচ্চু, বড় ফুপি, ছোট ফুপি, চাচীরা, বড় ফুপির মেয়ে অধরা, মেজো চাচ্চুর মেয়ে রাদিয়া এবং রাফছি, ছোট চাচ্চুর একটা পিচ্চি আছে সেটা কেবল হাঁটতে শিখছে।
সবাই খাবার শুরু করলো। এর কিছু সময় পরই একজন মহিলা আসলো। উনাকে দেখিয়ে বড় ফুপি বললো- সুমন উনি তোমার ছোট মা।
কথাটা শেষ হতে না হতেই কর্কশ শব্দে উনি বললো- আমি কারো ছোট মা নই। আমার একটাই মেয়ে। বাসায় যে কোনো অতিথি আসলেই কি আমি সবার মা হয়ে যাবো নাকি!
আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলো যাতে উনার কথায় আমি কিছু মনে না করি। উনার মাথায় সমস্যা আছে।
আব্বুর ইশারা দেখে আমি আর অবন্তী ফিক করে হেঁসে দিলাম।
আমাদের হাসিটা ছোট মা’র দৃষ্টির আড়াল হয়নি- খেতে বসে এভাবে হাসছো কেন অবন্তী! এসব কি এই কয়েক ঘন্টায় শিখে ফেললে নাকি?

কথাটা যে আমায় কটাক্ষ করে বললো সেটুকু তো বুঝতে পারলাম। কিন্তু তবুও চুপচাপ খেতে লাগলাম।
– বিয়ে তো হচ্ছে না। বাইরে থেকে যে গেষ্ট আসছে তারা যেন কালকেই চলে যায়। নাকি পারমানেন্ট থাকার ইচ্ছে আছে!
এটা কথাও উনি আমাকেই বললো তাই এবার আর চুপ থাকলাম না – দেখুন আমাকে আপনার অসহ্য লাগতেই পারে, কিন্তু আমি তো এর আগে কখনো এখানে আসিনি বা আপনার কোনো ক্ষতি ও করিনি। একটু সুন্দর করে কথা তো বলতে পারেন! মেনে নিলাম আপনার গর্ভে আমার জন্ম হয়নি কিন্তু সম্পর্কে তো আপনি আমার মা’ই।লাগেন। সেদিক থেকে একটু সুন্দর করে কথা বললে খুব বেশি অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আমি এখানে থাকতে আসিনি এটা নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। আমি শুধু এতটুকু দেখতে আসছি আমার পরিবারটা কেমন। যেখানে থাকাটা হয়তো আমার অধিকারে থাকলেও ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি।
আমার চোখে পনি টলমল করছে। এখানে আর কিছু সময় থাকলে সবার সামনেই হয়তো দুই এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়বে। সেখানে থেকে দ্রুত প্রস্থান করলাম।
যখন আমাদের আকাশ সমান এক্সপেক্টেশন একবারে মাটির সাথে গুড়িয়ে যায় তখন চোখের বাঁধ যতোই মজবুত হোক না কেন ভেঙে যায়। এতোদিন পরিবার ছিলো না তাই নিজেকে পাষাণ হৃদয়ের মানুষ বলেই জানতাম কিন্তু আজ পরিবারকে এতো কাছে পেয়ে তাদের বলা প্রতিটি কঠিন শব্দ আমার চোখে টলমল সৃষ্টির কারণ হয়ে যাচ্ছে ।

গেষ্ট রুমে নিজের মাথার চুল ধরে টানছি। তখন দরজায় নক পড়লো। অবন্তী হাতে একটা প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– কিছু বলবা!
– তুমি তো কিছুই খেলে না তাই বড় ফুপি খাবার পাঠিয়ে দিলো।
– আমি খাবো না। তুমি নিয়ে যাও।
অবন্তী আমার পাশে এসে বসে বললো- ভাইয়া আমি তোমায় খাইয়ে দেই! আমার অনেক দিনের শক আমি তোমায় খাইয়ে দিবো।
অবন্তীর এমন করুন আর্জি না করতে পারলাম না।
– তুমি আম্মুর কথায় কিছু মনে করবে না ভাইয়া। এখানে কেউ তোমায় ভালো না বাসলেও আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তুমি শুধু আমার জন্য হলেও কিছু দিন থেকে যেও!
– আচ্ছা আপু।
– ভাই বোনের ইমোশনাল সিন শেষ হলে আমাকে একটু সুযোগ দিলে ভালো হয়।
দুজনেই দরজার দিকে তাকালাম। বড় ফুপির মেয়ে অধরা দাঁড়িয়ে আছে।
অবন্তী জিজ্ঞেস করলো- তুমি এখানে কি করছো?
– তোমার ভাইয়া কিছু খায়নি তখন তাই খাবার নিয়ে আসলাম।
– আমি আমার ভাইয়ার যত্ন নিতে পারি তোমায় লাগবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
অবন্তীর কথা চেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা ভয়ে চলে গেলো। কিন্তু তখন বুঝতে পারি নি দরজার পিছনে ছোট মা দাঁড়িয়ে ছিলো।

To be continue…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে