প্রিয়ানুভব পর্ব-১৩

0
569

#প্রিয়ানুভব [১৩]
লেখা: প্রভা আফরিন

খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি কথাটার যথার্থতা দিগন্ত খুঁজে পেল মাথার ওপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানটা দেখে। বাতাস যতটা না ধীর শব্দ ততটাই উচ্চ। তবে ফ্যানের চেয়েও দিগন্ত ওরফে হালুমের কৌতুহল বন্ধু অনুভবের দিকে। বাড়ি ছাড়া হয়ে, ভার্সিটির হলে এসে ছেলেটার লাইফস্টাইল একদম বদলে গেছে। মেয়েদের নজরবিলাসী অনুভব এখন দিনরাত চাকরির পড়া পড়ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে নিশ্চিত করার ভাবনায় তার অবস্থাটা এমন হয়েছে যে দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে সুন্দর মুখটা চেনা যাচ্ছে না। পরিশ্রম তার চোখেমুখে উপচে পড়ছে। ওদের ফাইনাল সেমিস্টার শেষ হয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো আড্ডাবাজি, ঘোরাঘুরি হয় না। সবাই এখন ভবিষ্যত গুছিয়ে নিতে তৎপর। ওরা বুঝতে পারছে জীবনটা ক্রমশ স্বস্তির গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে। নির্ঝঞ্ঝাট, নির্ভাবনার জীবনটা বাস্তবতার বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে ক্রমশ। দিগন্তের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।

মেহগনি গাছের ফাঁক গলে বিকেলের কোমল ছঁটা এসে উঁকি দিচ্ছে জানালায়। দিগন্ত পা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে অনুভবের বিছানায়। অনুভব তার পাশেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই সত্যিই ইউএস চলে যাবি?”

দিগন্ত বিরস গলায় উত্তর দেয়,
“একদমই যেতে চাই না, দোস্ত।”

“সুযোগ আছে, যাবি না কেন?”

“তুইও চল। আমি একলা বনবাসে যাব কেন? তোকে নিয়ে যাই।”

অনুভব হেসে ফেলল,
“আমার সুযোগও নেই, ইচ্ছেও নেই। কারণ আমার পিছুটান আছে। শুধু একটা চাকরি দরকার। তাহলেই পত্নীনিষ্ঠ সংসারী হয়ে যাব। কিন্তু তোর সুযোগ আছে। পিছুটানও নেই। বোকামো করে কেন হারাবি?”

দিগন্ত উঠে বসে অনুভবের হাঁটুতে ঘু’ষি দেয়।
“এখনই পর করে দিয়েছিস? তোরা আমার পিছুটান নয়?”

অনুভব ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। দিগন্তের বাহুতে পাল্টা আঘা’ত করে বলে,
“হা’রা’মী হালুম, এটা পিছুটানের নমুনা ছিল?”

“বেশ করেছি। তুই আছিস পড়ায় ডুবে, ইকরির কোনো খবর নেই। টুকটুকি বোকাটার কথা তো বাদই দিলাম। আমার মনে হচ্ছে সবাই এক সমুদ্র দূরে দূরে অবস্থান করছি। আমি চলে গেলে তোরা কেউ মনে রাখবি না।”

দিগন্তকে দেখাচ্ছে গাল ফোলানো বাচ্চাদের মতো। ছেলেটির মাঝে সরলতার গাঢ় প্রলেপ আছে বলেই বালকের ন্যায় নিষ্পাপ দেখায় চোখদুটি৷ অনুভব হেসে ওর গালে টেনে দিয়ে বলল,
“তুই কিন্তু ন্যাকা হয়ে যাচ্ছিস, হালুম। কার সঙ্গে মিশতেছিস আল্লাহ মালুম।”

দিগন্ত ওর হাত সরিয়ে দিয়ে সন্দেহি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“তুই কি কোনো কারণে আপসেট?”

অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার হৃদয়ের রানী আবারো তাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকদিন হলো তাদের ঠিকঠাক যোগাযোগ নেই। না টিউশনিতে গেলে দেখা হয়, আর না তার এলাকায় গেলে। নিজের দোষটা কোথায় অনুভব খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা যে জটিল তা নিয়ে সংশয় নেই। উদাসী গলায় বলল,

“প্রেমানল বুঝিস, বন্ধু? তুষের আ’গুনের চেয়েও জ্বা’লাময়ী যার শিখা। অন্তর পু’ড়ে খাঁক করে দেওয়ার বিনিময়েও এক আনা প্রেম মেলে না।”

দিগন্ত বিজ্ঞের ন্যায় ঘাড় হেলিয়ে বলল, “হুম, বুঝলাম।”

“কী বুঝলি?”

“বন্ধু আমার দেবদাস হয়ে গেছে। তোর হাসু আবার টাইট দিয়েছে?”

অনুভব প্রলম্বিত শ্বাসখানি কণ্ঠে চেপে বলে, “মেয়ে মানেই প্যারা। কোনোদিন কোনো মেয়ের মায়ায় পড়বি না।”
________________

আলো যখন আঁধারিয়া অম্বরের দ্বারপ্রান্তে অনুভব প্রিয়ার এলাকায় গিয়ে হাজির হলো। প্রিয়ার বাড়িটা কোথায় নির্দিষ্টভাবে সে জানে না। কাজেই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে কল করল ওকে। প্রথমবার বেজে বেজে কেটে গেল। অনুভব ধৈর্য ধরে আরো দুবার কল করল। প্রতিটা রিং হওয়ার সাথে সাথে ওর মাথা দপদপ করছিল রাগে৷ কত্ত বড়ো সাহস! সেদিনের মেয়ে তাকে ইগনোর করা শেখায়! প্রেমে পড়ে একটু পাত্তা দিচ্ছে বলে কী তার দাপট কমে গেছে ভেবেছে! তৃতীয়বার বেজে বেজে কেটে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কল তুলল প্রিয়া। অনুভব কিছু জিজ্ঞেস করল না, কুশল বিনিময়ের ধারও ধারল না। রোষাগ্নি স্বরে বলল,
“এক্ষুণি যদি গলির মাথায় না আসো আমি তোমার বাড়ি ঢুকে যাব। এরপর যা হবে দেখা যাবে।”

অনুভব উত্তরের অপেক্ষা না করেই কল কাটে। প্রিয়া এলো ঠিক পাঁচ মিনিট পর। মাথায় ওড়না জড়িয়ে জুবুথুবু চলনে সে হাঁটছে। একটি দর্শনেই অনুভবের চৈত্রদগ্ধ হৃদয়ের আঙিনা দক্ষিণা হাওয়ায় দুলে উঠল। কিন্তু অভিব্যক্তিতে গোপন রাখল। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ফিরবে। প্রিয়া কাছাকাছি এসে সাবধানী গলায় বলল,
“সন্ধ্যাবেলা এখানে কেন আসতে গেলেন?”

“তোমায় কিডন্যাপ করতে।”

প্রিয়া কথাটা বুঝে ওঠার আগেই অনুভব ওর হাত চেপে ধরে রিকশায় তুলে নিল।
________________

রাতের সঙ্গী আঁধার। আর সেই আঁধারের অঘোষিত নিয়ম নিঝুম নিস্তব্ধতা। রাতের দুটো নিয়মই ভেঙে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে চোখ ধাধানো কৃত্রিম আলো। কোলাহলে মুখোরিত চারপাশ। তেমনই এক আলোকোজ্জ্বল শব্দমুখর স্থানে মুখোমুখি বসে আছে অনুভব ও প্রিয়া। গুমোট অনুভূতি চক্রাকারে পাক দিচ্ছে উভয়কে। মুখে নেই কোনো শব্দ। অনুভবের চোখে বেদনা, প্রশ্ন, রাগ। প্রিয়া নির্লিপ্ত। নিরবতা ভেঙে বলল,

“এখানে কেন এনেছেন?”

“রেস্টুরেন্টে মানুষ কেন আসে? নিশ্চয়ই সিনেমা দেখতে নয়।”

“আমি খাব না।”

“ফাইন, আমার খাওয়া দেখো।”

“আপনার খাওয়া বুঝি এতটাই দর্শনীয় কিছু?”

“তোমার উপেক্ষাও বুঝি এতটাই সহনীয় কিছু?”

অনুভব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির নত মুখশ্রীতে। পালটা জবাবে ধরাশায়ী প্রিয়া। ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয়,
“আমার কাজ আছে, ফিরতে হবে।”

অনুভব সবল হাতে প্রিয়ার হাত চেপে ধরে। রাগ চেপে খাটো সুরে বলে,
“ড্যাম! সমস্যা কী তোমার? দুদিনের মেয়ে আমাকে ভাব দেখাও।”

প্রিয়া ঝারা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। নিজেকে শান্ত রেখে শক্ত গলায় বলে,
“আপনি দেখতে কেন আসছেন?”

“হাসু… নাও ইউ আর রিয়েলি হার্টিং মি। আমি কী এতটা ডিজার্ভ করি?”

প্রিয়া দুহাতে মুখ ঢাকল। অস্থির লাগছে। কী ধরনের আচরণ করা উচিত আসলেই বুঝতে পারছে না। অনুভব বোধহয় মেয়েটির মনের অবস্থা টের পেল। ওর মুখ থেকে জোর করে হাত সরিয়ে আশ্বাসের সাথে আঁকড়ে ধরল। রুক্ষতাকে ভেঙে কোমল গলায় বলল,
“আমাকে একটুও ভরসা করো না তুমি? আমি এতটাই অবিশ্বাসের মানুষ?”

প্রিয়া চোখ তুলে তাকায়। বলে,
“বিশ্বাস করি তো।”

“তাহলে কি মনের কথা শোনার মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি? আমি তাহলে সব দিক দিয়েই ব্যর্থ বলো? না পাচ্ছি ভালো একটা চাকরি, না হতে পারছি কারো মনের মানুষ। আই এম টোটালি আ লুজার।”

কী বলবে প্রিয়া? এই লোকটা তার জন্য ন্যায় চাইতে গিয়ে পরিবার হারিয়েছে। আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাস হারিয়েছে। কতগুলো মাস ক্রমাগত স্ট্রাগল করে চলেছে জীবনের সঙ্গে। প্রিয়ার জীবনের জটিলতা কেন তাকে শুনিয়ে উদ্বিগ্ন করবে? বরং মানুষটাকে দেখলে প্রিয়ার অন্তরে খারাপ লাগা বাড়ে। নিজেকে সর্বদা সেরা হিসেবে উপস্থাপন করা নিখুঁত মানুষটার দিকে তাকানো যায় না। সুদর্শন মুখটায় মলিনতার ছাপ। চোখের নিচে ক্লান্তিকর সন্ধ্যার মতো লেপ্টে আছে কালি। দাড়ি-গোঁফে মুখ ঢেকে গেছে। মাথার চুলগুলোও বোধহয় কাটেনি মাসকয়েক। কপালে অবিন্যস্ত পড়ে আছে তা। কী বেহাল দশা! প্রিয়ার বুকটা হু হু করে ওঠে। শক্ত করে ধরে অনুভবের হাত। বলে,
“আমার জন্য নিজেকে কেন ভুল বুঝছেন?”

অনুভব ক্ষণকাল বিলম্ব না করে উত্তর দেয়,
“কারণ দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রার মাঝে আমার বিশ্রাম তুমি। সকল দুঃখের মাঝে এক চিলতে স্বস্তি তুমি। অথচ আমি স্বস্তি হতে বঞ্চিত।”

প্রিয়ার অন্তরে শীতল বাতাস বয়। দীর্ঘদিন কান্না, অভিযোগ, ধিক্কার, পরিহাস শোনা কান যেন ব্যতিক্রম কিছু শুনতে পেয়ে আরামবোধ করছে। অনুভব বলল,
“আমার দোষটা কোথায়? এই অবহেলার কারণ? এটা নিশ্চয়ই বলবে না যে আমার মনের কথা তুমি বোঝো না।”

“বুঝি, বুঝি বলেই ভয় করে।”

“নির্ভয়ে একবার মনের কথাগুলো বলা যায় না? নিজেকে যতটা গুটিয়ে রাখবে ততটাই কষ্ট পাবে। মনের ওপর এত চাপ দেওয়ার কোনো দরকার আছে? কাউকে বলো, নিজেকে হালকা করো একটু। এই বয়সে আমি বন্ধুদের সঙ্গে হেসে খেলে বেড়িয়েছি। জীবন সম্বন্ধে কোনো ভাবনাই ছিল না। আর তুমি কতটা মানসিক য’ন্ত্র’ণা বয়ে বেড়াও। এমন করে থাকলে পাগল হয়ে যাবে একদিন। একজন সৎ পরামর্শদাতা হিসেবে তো তোমার কথাগুলো শুনতেই পারি। পারি না?”

প্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর দিল না। অনুভব ওর হাত ছেড়ে দিয়ে খাবার অর্ডার করল দুজনের জন্য। অনেকটা সময় পর প্রিয়া কথা বলল,
“জানেন, জীবনেরও যে একটা ভার আছে সেটা কখনো উপলব্ধি করিনি। গত একটা বছরে বুঝেছি জীবনের চেয়ে ভারী বস্তু পৃথিবীতে কিছু নেই। অর্থ-সম্পদ যত কমে জীবনের ভার তত বাড়ে। আমার জীবনটা এখন টিকে থাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। দিনরাত মা-বোনকে নিয়ে চিন্তা। মাকে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে রাখতে পারলে অবস্থার উন্নতি হতো। তা সম্ভব নয়। দিয়া বড়ো হচ্ছে। এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। আমি তো সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারি না। মাও পারে না। আশেপাশে বহু মুখোশ পরা মানুষ দেখি আজকাল। আমাদের দুর্বলতা বুঝে গেলেই তাদের নোংরা মুখোশ খসে যাবে। সুরক্ষা নিশ্চিত করাটা এখন আমার এক ও প্রধান লক্ষ্য। তারওপর অন্যান্য ঝামেলা তো আছেই।”

“যেমন?”

প্রিয়া ছোটো করে শ্বাস ফেলে বলল,
“বাড়ি ভাড়া জমে গেছে। বাড়িওয়ালা বলে দিয়েছেন এই মাসে ভাড়া না দিতে পারলে যেন বাড়ি ছেড়ে দেই। আমার টিউশনিতে তিন জনের খাওয়ার খরচই কুলোচ্ছে না। সঙ্গে দিয়ার পড়াশোনার খরচ বাড়ছে। আমি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারব না। ভাবছি ফুলটাইম কোনো জবে ঢুকব। কিন্তু সেটাও খুঁজে পেতে সময় লাগবে। টিউশনির বাইরে যতটা সময় পাই, সে সময়টায় এখন কাপড়ে হ্যান্ড পেইন্টের কাজ করি। আমাদের বস্তিতে এক আপা কাজগুলো এনে দেয়। সামান্যই অর্থ। তবুও কিছু প্রয়োজন মেটানো যায়। এই দুর্দিনে এক বেলার খাবারটাই বা কে দেয়!”

প্রিয়ার চোখ ছলছল করছে। কণ্ঠস্বর কাঁপে। ঢোক গিলে পুনরায় বলে,
“আচ্ছা… আপনি আমায় একটা সোনার চেইন বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? বাইশ ক্যারেট আছে, মাত্র পাঁচ আনা। ওটা দিয়ে ভাড়াসহ খরচটা একটু গুছিয়ে নিতে পারতাম।”

অনুভব বেদনাহত চোখে চেয়ে থাকে। অনেকক্ষণ কোনো উত্তর দিতে পারল না। প্রিয়ার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও। পরে কথা বলি।”

প্রিয়া নিঃশব্দে খেতে শুরু করে। সত্যিই ক্ষুদাতুর ছিল সে। দুজন খাওয়া-দাওয়া শেষে রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। অনুভব প্রিয়ার আঙুলের ভাজে আঙুল ডোবায়। প্রিয়া কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। রাতের আকাশে অগণিত তারকারাজি ফুটে আছে। কাস্তের মতো সরু একফালি চাঁদ বুঝি ওদের দেখে মিটিমিটি হাসছে। অনুভব নির্জন স্থানে প্রিয়ার হাত টেনে ধরে পায়ের গতি রোধ করে। প্রিয়া প্রশ্নোক্ত চোখে তাকাতেই দুর্বোধ্য হেসে অতি নিকটে চলে আসে। প্রিয়া ভড়কে যায়। পিছিয়ে যেতে চাইলে অনুভব সরু চোখে চায়। যেন দৃষ্টি দিয়ে বোঝাতে চাইল,
“আমাকে ভয়!”

প্রিয়া অজান্তেই থেমে গেল। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল অনুভবের সম্মোহিত চোখে। অনুভব গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। চন্দ্রালোকিত আকাশ ও গোপনীয়তা রক্ষাকারী রাতকে সাক্ষী রেখে প্রিয়তমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,
“ম্যারি মি, হাসু।”

প্রিয়া ঝটকায় দূরে সরে গেল। বিস্ময়বিমূঢ় চোখে চেয়ে দেখল সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় অনুভবের মুখের পেশি দৃঢ়। কৌতুকের হাসি সেখানে অনুপস্থিত। প্রিয়া কম্পিত গলায় বলল,
“মজা করছেন?”

“আমি মজা করার মুডে নেই।”

“এ হয় না।”

“কেন? আমাকে তোমার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে আপত্তি? এতটা অযোগ্য ভেবো না। বাচ্চা তো পেট থেকে পড়েই হাঁটা শেখে না। প্রথম বসা শেখে, এরপর হামাগুড়ি। তারপর আধো আধো হাঁটতে গিয়ে আছার খাওয়া৷ পরে না দৌড়াতে জানা। আমিও স্বামীর দায়িত্ব-কর্তব্য শিখে নেব।”

“তা নয়, আমাকে আমার মা-বোনদের জন্য বাঁচতে হবে। ওদের আমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারি না।”

অনুভব ওর দুই কাঁধে হাত রেখে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
“সবদিক চিন্তা করেই বলছি আমি। মা আর দিয়াকে বাদ দিয়ে তো ভাবছি না। তুমি একটু আগে যা বললে এখন তোমার সেফটি নিয়েই আমার চিন্তা হচ্ছে। ছোটো বোনের সুরক্ষা নিয়েও তো ভাববে। ওই পরিবেশটা থেকে বেরিয়ে এসে একটা সেইফ বাড়ি দরকার। আমরা বিয়ে করে একটা ভালো দেখে বাড়ি ভাড়া করে নেব। চাকরি না হওয়া অবধি আরো দুটো টিউশন বাড়িয়ে নেব। একটু কষ্ট হলেও আমাদের চলে যাবে। কিন্তু তোমাদের সেফটি নিয়ে আমি কোনো দ্বিধা রাখব না। আমাকে আর যন্ত্রণা দিয়ো না, পাষাণী।”

প্রিয়া বোঝে লোকটার কথা। কিন্তু তার আত্মসম্মানবোধ ঝুকতে রাজি নয়। ভালোবাসার বিনিময়ে অনুভবকে সে ব্যবহার করতে চায় না। দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চায় না৷ বলল,
“তা হয় না। আমার মা-বোনের দায়িত্ব আমারই। আপনি নিজেই কত স্ট্রাগল করছেন। আমার বাড়তি বোঝা চাপানোর কথা ভাবতেও পারি না।”

অনুভব অসহায় কণ্ঠে বলে,
“আমার মা গত হয়েছেন আজ প্রায় আট বছর। বাবাও তার একবছর বাদে ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর আর কেউ স্নেহের হাত রাখেনি মাথায়। আমারও একটা মা প্রয়োজন, হাসু। একটা ফ্যামিলি প্রয়োজন। আমি ফ্যামিলি পারসোন। ব্যাচেলর লাইফ আমার কাছে অসহনীয়। হলের প্রতিটা রাত কী দুঃসহ কাটে তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। একাকিত্ব গলা টিপে ধরে৷ আমি বুঝতে পারছি তোমার অসুবিধা। তোমাকে টিউশনি কিংবা পড়াশোনা কিছুই ছাড়তে হবে না। আমরা নাহয় মিলেমিশে ঘর বাঁধব। দুইজন আলাদা আলাদা বোঝা টানার চেয়ে হালালভাবে একসঙ্গে থেকে একটা বোঝা ভাগ করে নেব। ভার কম লাগবে। পারবে না এই নিঃস্ব মানুষটার হাত ধরতে? একটা শূন্য সংসারকে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করতে? প্লিইজ!”

অনুভব হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রিয়া শূন্য দৃষ্টিতে সেই হাতের দিকে চেয়ে থাকে। শক্ত খোলসের ভারে ন্যুব্জ আবেগী মনটা কেঁদে বলে, রেখেই দেখ না হাতটা। দিনশেষে প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্যও কম কী? কীসের আশায় মানুষের ছুটে চলা? সুখের জন্যই তো। অনুভব ওকে সুখ ভেবে আঁকড়ে ধরতে চায়৷ প্রিয়ার সুখটাও তো অবিচ্ছেদ্য নয়৷

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে