#প্রিয়ানুভব [১১]
প্রভা আফরিন
চাকরি যাওয়ার পর প্রায় দিন পনেরো বেকার ছিল প্রিয়া। এরপর অনুভবের মারফতেই মাসখানেক হলো ওর টিউশনি জুটেছে ঝিগাতলায়। মাস গেলে ছয় হাজার টাকা বেতন। দুই ঘন্টা পড়াতে হয়। প্রিয়া রোজ বিকেলে পড়িয়ে আসে। স্টুডেন্ট-এর বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। মা হাউজ ওয়াইফ। প্রিয়াকে কোনো নাশতা দেন না তারা। ভাড়া বাঁচাতে রোজ হেঁটে হেঁটে পড়াতে গিয়ে প্রিয়া বেশ ক্লান্ত হয়ে যায়। প্রথম দুদিন চেয়ে নিয়ে পানি খেয়েছিল। পরে চক্ষুলজ্জায় সেটুকুও হয়ে ওঠেনি বলে ব্যাগে করে পানি নিয়ে যায়।
আজ একটা বিপত্তি ঘটে গেল। ফেরার পথে জুতোর তলি ছুটে গেছে। ফেলে দিয়ে চলে যেতে চাইল না ও। এমনিতেই টাকার সংকট। ছয় হাজারে বাড়ি ভাড়া দিয়ে খাওয়ার টাকাই মিলবে না। নতুন জুতো সেখানে অলীক কল্পনা। বরং অল্প টাকায় সেলাই করে পরা যাবে আরো কিছুদিন। প্রিয়া আরেকটা টিউশনি খুঁজছে। নয়তো খেয়ে-পরে বাঁচা কষ্টের হয়ে যাবে। অনুভবও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। বিপদে ছেলেটি এভাবে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে সাহায্য করে চলেছে বলেই কিনা প্রিয়া তার প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞ। এদিকে অনুভবের নিজেরই টিউশনি করিয়ে চলতে হবে চাকরি না পাওয়া অবধি। তবে সে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং অভিজ্ঞ হওয়ায় টাকার অংকটা একটু বেশি। সেই হিসেবে প্রিয়ার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দুই-ই কম। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে পা ঘষটে হাঁটছিল প্রিয়া। হুট করে কেউ বাহু ধরে টান দিল। প্রিয়া আকস্মিক ভড়কে গেলেও বিপরীত ব্যক্তির দেহ নির্গত নিজস্ব গন্ধটা পরিচিত ঠেকল। কানে বাজল এক ঝগড়ুটে পুরুষের কর্কশ সুর,
“এই মেয়ে, চোখ কি পকেটে নিয়ে ঘোরো? রাস্তায় হাঁটার সময় সামনে-পেছনে গাড়ি আছে কিনা খেয়াল করবে না?”
প্রিয়া নিজের ভারসাম্য সামলে তড়িৎ সরে দাঁড়ায়। একে তো হেঁটে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া, তারওপর জুতো ছিঁড়ে সকলের সামনে ছ্যাঁচড়ে হাঁটা। প্রিয়ার মনটা এমনিতেই খারাপ ছিল। অনুভবের ধমক শুনে ওর রাগ হলো। ইদানীং তার অল্পতেই রাগ হচ্ছে। বলল,
“খেয়াল করলে কি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার বকা শুনি?”
“আমি তোমাকে বকেছি?”
“তো কী রাস্তা ভর্তি লোকের সামনে আদর করছেন?”
মুখ ফসকে বলে প্রিয়া ঠোঁট টিপে থেমে যায়। রাগটা উবে গিয়ে ধরা দেয় সংকোচ। অনুভব চোখ ছোটো করে তাকায়। উচ্চতায় প্রিয়া তার কাঁধসম। একটু ঝুঁকে এসে দুষ্টু হেসে বলে উঠল,
“তুমি কি রাস্তা ভর্তি লোকের সামনে তাই চাইছিলে, হাসু?”
প্রিয়া সেই দৃষ্টির প্রগাঢ়তার সামনে বিমূঢ় হয়ে যায়। যেন জ্ব’লন্ত আ’গুনে পানি পড়েছে এমন ভাবে চুপসে যায়। অনুভব চুলে আঙুল চালিয়ে বলে,
“অবশ্য হ্যান্ডসাম ছেলেদের থেকে মেয়েরা শাসন আশা করে না। তার বদলে একটু আকটু আদর, আশকারা, যত্নই কামনা করে। বুঝি আমি।”
“কচু বোঝেন।”
প্রিয়ার অতিশয় অপ্রতিভ। এ ধরনের কথা তার সংকোচ বাড়িয়ে দেয়। স্বাচ্ছন্দ্য পায় না। অনুভব তা খেয়াল করে ঠোঁটের কোণের উষ্ণ হাসিটা আরেকটু চওড়া করে। ক্ষীণ স্বরে বলে,
“লজ্জা পাচ্ছো কেন?”
প্রিয়া ত্যক্ত স্বরে বলল,
“ধুর, আপনি ভালো না।”
অনুভব অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,
“দুষ্টুমি তোমার মনে আর আমি ভালো না?”
প্রিয়া উত্তর না দিয়ে পাশ কাটাতে চাইল। অনুভব মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কানের কাছে ঝুঁকে এসে আবেগমথিত স্বরে বলল,
“তুমি চাইলে কিন্তু রাস্তার মাঝে সেটাও পারব।”
ব্যস্ত রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে একের পর যান। গাড়ির হর্ন, হকারদের ডাক, রিক্সার ক্রিং ক্রিং কিংবা পথচারীদের হইচই কোনোটাই প্রিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। একটু আগের গাঢ় স্বরের শব্দতরঙ্গ প্রিয়ার সর্বাঙ্গে শিহরণের ঢল নামিয়েছে। গা ঘেঁষে দাঁড়ানো স্বঘোষিত সুন্দর পুরুষটির স্পৃহা জাগানো দৃষ্টিতে চোখ রেখে প্রিয়ার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। অষ্টাদশী হৃদয়ে ছড়ায় অচেনা বার্তা। ব্যস্ত রাস্তার বিরক্তিকর পরিবেশে মুখোমুখি, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে যা হওয়ার কথা ছিল না, যা কল্পনাতেও ঠাঁই পায়নি ঠিক তাই হয়ে গেছে। ধুলো ওড়ানো গরম, অস্বস্তিকর, কোলাহলময় পরিবেশে সবচেয়ে সুন্দরতম দৃষ্টিবদল ঘটে গেছে। পরিবারের চিন্তা, অর্থের ভাবনা, সম্মান বাঁচিয়ে চলা তটস্থ মস্তিষ্কের এক ফাঁকে উঁকি দিয়েছে সাতরঙা কিরণ। যাতে লেগে আছে নতুন অনুভূতির আবেশ। সেই প্রথম প্রিয়ার উপলব্ধি হলো পুরুষের অনুরাগ আক্রান্ত দৃষ্টি ছু’রির চেয়েও ধা’রালো হয়। যা হৃদয়কে এফোঁ’ড়’ওফোঁ’ড় করে দিতে সক্ষম। এটাকে যে অনুরাগ আক্রান্ত দৃষ্টি বলে তা ওকে কেউ বলে দেয়নি, শিখিয়ে দেয়নি। তবুও প্রিয়ার মন বুঝে গেল। কী অবাক করা কান্ড! তার অগোচরেই মনটা সব শিখে যাচ্ছে! প্রিয়া চোখ নামিয়ে নেয়। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে কণ্ঠে শব্দ জুগিয়ে বলে,
“পথ ছাড়ুন।”
প্রিয়ার কাজ করে খসখসে হয়ে যাওয়া সরু আঙুলগুলো তখন অনুভবের বলশালী আঙুলের ভাজে বন্দী হয়েছে। মেয়েটির হাত অস্বাভাবিক ঘামছে। ছাড়িয়ে নিতে চাইছে। অনুভব হাত ছাড়ল না। বরং শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আগের মতোই গাঢ় ও তীব্র স্বরে বলল,
“ছাড়ার জন্য ধরেছি নাকি!”
হুট করে একজন রিকশাওয়ালা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তেরছা স্বরে বলে উঠল,
“রাস্তাও আজকাল পার্ক হইয়া গেছে!”
প্রিয়া লজ্জায় মুখ লুকানোর স্থান খোঁজে। সরে যেতে চায়। কিন্তু পুরুষালি হাতের ভাজ থেকে নিস্তার মেলে না। অনুভব রিকশাওয়ালার কথাটা লুফে নিয়ে সহাস্য উত্তর দিল,
“শোনেন মামা, প্রেম যু’দ্ধক্ষেত্রকেও নন্দনকানন বানাতে পারে। আর এটা তো সামান্য রাস্তা। প্রেমিকের চোখে গুলিস্তানও গুলশান।”
উচ্চস্বরের রসিকতার ফলেই আশেপাশের উৎসুক মানুষ নজর ঘুরিয়ে দেখল ওদের। কেউ ঠোঁট টিপে হাসল, কেউ বিরক্ত হলো যুব সমাজের অবক্ষয়ে, কারো আবার কিছুই এলো গেল না। এতক্ষণে অনুভবের খেয়াল হলো ওর পায়ের দিকে। ঘন সুন্দর দুটি ভ্রুর মাঝে ভাজ ফেলে বলল,
“আচ্ছা, এই কারণে পা ছ্যাঁচড়ে হাঁটছিলে!”
প্রিয়া ইতস্তত করে বলল,
“হুট করে ছুটে গেল। আপনি এখানে হঠাৎ?” কথা ঘোরানোর চেষ্টা।
অনুভব বলল,
“সাইন্সল্যাব এসেছিলাম। এই সময় তোমার টিউশন শেষ হওয়ার কথা তাই ভাবলাম দেখা করে যাই। এসে দেখি গাড়ির নিচে চাপা পড়তে মহানন্দে রাস্তা ধরে হাঁটছো। মানে দুনিয়ার সমস্ত দুশ্চিন্তা রাস্তায় বের হলেই কেন করতে হবে? বাসায় একটু ফেলে আসা যায় না?”
প্রিয়া ধমক খেয়ে গোমড়া মুখে বলল, “দুশ্চিন্তা যদি ধরার মতো কিংবা ছাড়ানোর মতো বস্তু হতো তাহলে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসতাম।”
অনুভব হেসে ফেলল, “ধরা, ছোঁড়া না গেলেও কন্ট্রোল করা যায়। ইউ নিড সামথিং স্পেশাল ফর থিংক।”
“মানে?”
অনুভব জাদরেল হাসিটা ঠোঁটে এঁটে নিচু গলায় বলল,
“নতুন কিছু ভাবো, নতুন অনুভূতিকে ভাবো। সবচেয়ে সুন্দর পুরুষকে মনে ঢুকতে দাও। দেখবে সুন্দর পুরুষটা মন থেকে সব দুশ্চিন্তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে।”
প্রিয়া মুখ কুচকে ফেলল, “ফালতু কথা।”
“আরে একবার এপ্লাই তো করে দেখো। কার্যকর না হলে সুন্দর পুরুষটাকে তুমিও ঝেটিয়ে বিদায় করবে। যে অনুরাগী তার অনুরাগিনীর মন দখল করতে পারে না তার কোনো অধিকার নেই সেই মনে থাকার।”
প্রিয়া থুতনিতে হাত রাখে। ঠোঁট উলটে ভাবুক স্বরে বলে, “এখন সুন্দর পুরুষ কোথায় পাই?”
অনুভবের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল সে কথায়। ভীষণ রেগে গমগমে স্বরে বলল, “ফকফকা আলোতে দাঁড়িয়ে তুমি সুন্দর পুরুষ দেখতে পাও না? চোখটা গেছে, চশমা লাগবে মনে হচ্ছে।”
“আলোও ফকফকা, আমার চোখও ঠিক আছে।”
“তাহলে কি বলতে চাও আমি সুন্দর নই তোমার চোখে?” অনুভব একই সঙ্গে আহত ও বিস্মিত হয়।
“ওহহ আচ্ছা, আপনি তাহলে এতক্ষণ নিজের জন্য বলছিলেন?”
প্রিয়ার ঠোঁটে চাপা হাসি। অনুভব চোখ ছোটো করে তাকায়। কতটা বদ এই মেয়ে! মুখ থেকে কথা স্বীকার করিয়ে নিল! অনুভব ওর কপালে ঠুকে দিয়ে হতাশ গলায় বলল,
“বুঝেছি, আমাকেই নতি স্বীকার করতে হবে। সারাজীবন মেয়েরা আমাকে পটাতে ছুটেছে, আর এখন আমাকেই কিনা এইটুকুনি মেয়ের চোখ রাঙানি দেখতে হচ্ছে! কী অধঃপতন আমার! এ জন্যই বলে সব ভালো, প্রেম ভালো না।”
প্রিয়া অসহিষ্ণু হয়। প্রেম, ভালোবাসা কিংবা এ ধরনের হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক নিয়ে সে কখনোই বিশেষ ভাবেনি। আর এখন তো ভাবতে ইচ্ছেও করে না। কিন্তু এই পাগল গোছের লোকের পাল্লায় পড়ে আজকাল মনের ভেতর কিছু বুদবুদ সৃষ্টি হয়। প্রিয়া তা দমিয়ে রাখতে চায়। তার জীবনটা এখন আর আবেগের পাল্লায় ভেসে বেড়ানোর নয়। না শাড়ি, চুড়ি, সাজগোজ কিংবা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে মেতে থাকার। পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই তার উদ্দেশ্য। অনুভবের জীবনে কেউ নেই, তাই সে দায়িত্বের গুরুত্ব হয়তো তেমন বোঝেও না। না ভেবেই দুমদাম কথা বলে ফেলে, কাজ করে ফেলে। পাগলের পাল্লায় পড়ে প্রিয়ারও পাগল হলে চলবে না। সে বিরক্ত হয়ে বলল,
“এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না আমার।”
“তা লাগবে কেন? আস্ত রসকষহীন মেয়ে। এখন এই স্লিপার ফেলে দাও। চলো নতুন কিনি।”
প্রিয়া এবার নিজের স্বভাবসুলভ গম্ভীরতায় ফিরে গেল। এই ভয়টাই করছিল এতক্ষণ। স্পষ্ট গলায় বলল,
“নতুন কেনার ইচ্ছে নেই। এটাকে সেলাই করে নেব। আপনি যদি একান্তই সাহায্য করতে চান তাহলে আমাকে মুচি মামার কাছে নিয়ে চলুন।”
ইচ্ছে নেই কথাটার অর্থ যে কেনার অপারগতা অনুভবের বুঝতে অসুবিধা হয় না। জোর করে কিনে দেওয়া যায়, তবে এতে আত্মসম্মানী প্রিয়া তার সামনে সংকুচিত হয়ে পড়বে। সমস্যার কথা খুলে বলতে পারবে না। তার চেয়ে প্রিয়ার মতো এগোলে মেয়েটা সহজ হবে। অনুভব ওর কথা মেনে মুচির খোঁজে এগোয়।
অবশ্য আরেকটা গোপন সত্যি হলো ভাইয়ার সাহায্য থেকে বেরিয়ে আসার পর অনুভবের পকেটের অবস্থাও আহামরি ভালো নয়। ভাবীর মাকে অপমান করার দায়ে ভাবী তার ওপর নারাজ হয়েছে। পিতা-মাতাহীন বখে যাওয়া সন্তান রূপে তাকে চরম ভর্ৎসনা করা হয়েছে। ভাইয়া সামনাসামনি কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু অনুভবের কেন জানি রুচি হয়নি। সে টের পেয়েছে ভাইয়ার কণ্ঠেও অসন্তোষের ছায়া। অনুভবকে বোঝানোর সময় ভাইয়া বারংবার মনে করাতে ভোলে না ছোটো ভাইকে সব ভরনপোষণ দিচ্ছে, কতটা পরিশ্রম আছে সেই ভরনপোষণ জোগাড়ে। তাই ছোটো ভাইয়ের উচিত কৃতজ্ঞ থাকা।
অকৃতজ্ঞ অনুভব হয়নি। ভাইয়া-ভাবীর সংসারে মাথা নত করে থেকে তাদের মন জুগিয়ে চলে, বাড়ির কাজ যতটা সম্ভব কমিয়ে নিজের তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সে কার্পণ্য করেনি। অথচ একটা ঘটনায় পারিবারিক, সাংসারিক ছেলেটা এক লহমায় বখে গেল! কারণ অ’প’রাধীর মেয়ের জন্য ভাবীর মাকে খোঁটা দিয়ে উচিত কথা শুনিয়েছে।
অনুভব বুঝে গেছে, অনেক তো হলো অন্যের ছায়ায় বাঁচা। এবার নিজের জন্য ছায়া তৈরি করতে হবে। পথ মসৃণ নয়। কিন্তু হাল ছাড়া যাবে বা। ছায়া তৈরি হোক বা না হোক অনুভব তার ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে কখনোই ভুলবে না। সত্যিই তো বাবা-মায়ের পরলোক গমনের পর ভাই না দেখলে সে ভেসে যেত। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা তার আত্মার কাছে দায়বদ্ধতা। ভবিষ্যতে তাদের কোনো সাহায্যে লাগতে পারলে অনুভব হাসিমুখেই তা করবে।
ভাইয়ার ছায়া থেকে বেরিয়ে অনুভব যে শুধু নিজের ছায়া গড়তে চাইছে বিষয়টা একমাত্র তাই নয়। সে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে অধিকার নিয়ে আরেকজনের ছায়াও হতে হবে, অভিভাবক হতে হবে। সেটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল। কী অদ্ভুত! দু-মাস আগের অনুভবও কী এভাবে দায়িত্বের কথা ভাবত! কিন্তু এখন তাই ভাবছে। পরিস্থিতি তাকে ধীরে ধীরে বাস্তবতা চেনাচ্ছে। খামখেয়ালিপনা, নির্ভার চলাফেরা হ্রাস পেয়ে দুষ্টু ছেলেটির মাঝে একটি দায়িত্বশীল পুরুষের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রিয়ার সব হারিয়ে তার বাড়িতে চাকরি নিতে আসা, বিশ্রী পরিস্থিতিতে পড়ে আবার সেই চাকরিটা চলে যাওয়া এক অর্থে অনুভবের জীবনকেও প্রভাবিত করেছে। কী অদ্ভুতভাবে দুটো অচেনা, অজানা মানুষের পথ এক গলিতে এসে মিলেছে! ওরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছিল। নিরবতা ভেঙে অনুভব বলল,
“তুমি আমার জীবনের গতিপথ বদলের নিমিত্ত। সুতরাং অদূর, অচেনা ভবিষ্যতের অক্লান্ত যাত্রায় তোমাকে আমি ছাড়ছি না। যতবার হোঁচট খেয়ে পড়ব, তুমি সেবা করবে।”
প্রিয়া জবাব দিল রয়েসয়ে। স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ত স্বরেই বলল,
“এই নীতি মানলে আপনার বাড়িতে আমি যার নিমিত্তে চাকরি পেয়েছি তাকে গিয়ে ধরুন। কারণ সে চাকরির হদিস না দিলে আমি যেতাম না, আপনিও অনিশ্চিত জীবনে পড়তেন না।”
একটা আবেগঘন কথার বিপরীতে এহেন জবাবে অনুভব মর্মাহত। কটমট করে বলল,
“তাহলে তো যে তোমাকে বাড়ি ছাড়া করেছে তাকে আগে ধরা উচিত। না সে তোমায় বাড়ি ছাড়া করত, না তুমি কাজের খোঁজ করতে, আর না আমাদের বাড়িতে এসে আমার মনে সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুতে।”
“গুড আইডিয়া, আপনি প্লিজ আমার চাচিকে গিয়ে ধরুন। আপনি যে মানুষ, আমার বিশ্বাস চাচি দুইদিনেই পাগল হয়ে যাবে।”
অনুভব ফোঁস ফোঁস করে ওঠে। তার মতো মোস্ট ডিজায়ার এক পুরুষকে এভাবে অপমান! নারী জাতি শুনলে ওর মান থাকবে! অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “হাঁসের বাচ্চা হাসু, তুমি একদিন আমার হাতে মা র্ডা র হয়ে যাবে শিওর। পারব না মুচি খুঁজে দিতে। নিজে খুঁজে নাও গিয়ে, বদ মেয়ে।”
প্রিয়া বাধ্য মেয়ের মতো চলে যাচ্ছিল। অনুভব তা দেখে আরো ক্ষেপল,
“আজব! এরপরেও আমায় সরি বলবে না?”
“সত্যি কথা বললে সরি বলতে হয় বুঝি?” প্রিয়া পাত্তা না দেওয়ার সুরে বলে।
অনুভব মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে, “তুমি সরি বলবে কেন? দোষ তো আমার। আমিই সরি। তোমার পাশে থাকতে চাওয়ায় সরি, তোমাকে ভালোবাসতে চাওয়ায় সরি, তোমাকে পাশে পাওয়ার বাসনা করায় সরি। আর কিছুর জন্য সরি বলা বাদ পড়ল, মাননীয়া?”
“হু, এই ওভারএক্টিংয়ের জন্য আরেকটা সরি।”
“হাসুরে…”
প্রিয়া হাসি চেপে জুতো হাতে নিয়ে ছুট দিল। বাড়ি ফিরে সে কল করল অনুভবের ফোনে। অনুভব রিসিভ করে গম্ভীর গলায় বলল,
“কী? সরি বলবে?”
“বলছিলাম যে, আমি সরি বলতে না পারলেও ধন্যবাদ দিতে জানি৷ আপনাকে ধন্যবাদ আমার পাশে থাকার জন্য। কঠিন দিনগুলো একটু সহজ হতে সাহায্য করার জন্য।”
চলবে…