#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৪৯
ইরা মেয়েটি অত্যাধিক–অসভ্য–বর্বর–বাজে মেয়ে! দর্শিনীর সঙ্গে সেদিন নিকৃষ্ট ব্যবহারের পরে আবিদ তাকে দারুণ শিক্ষা দিয়েছিল। ইমান আবদুল্লাহ এবং সুফিয়া বেগম নিজেদের মেয়ের কুকীর্তি জানার পরে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন! পরবর্তীতে ইরাকে দর্শিনীর পা–ধরে মাফ চাইতে বলেন। আবিদ তার ছাত্রত্ব বাতিল করতে চেয়েছিল! কিন্তু ইমান চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবে থেমে যায়। তবে মেয়েটি যথেষ্ট পরিমাণে অসম্মানিত হয়েছে! বরং—পরিমাণটা বেশি ছিল! মাত্র অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে, ভার্সিটির সবাই জেনে গেছিল ইরার মিথ্যাচার। সে টপ–বিজনেস ম্যানের মেয়ে নয়। একজন প্রতারক! যে—গরিব বাবা-মার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। এমন মেয়ে কতোটা নিকৃষ্ট ভার্সিটির সবাই উপলব্ধি করেছিল সেদিন। সবটা প্রকাশ হওয়ার পরে ইরাকে মিথ্যা পরিচয়ের জন্য প্রচুর ধিক্কার জনক কথা, অপমান সহ্য করতে হয়েছে! অবশেষে সকলের চাপে পড়ে ইরা দর্শিনীর পা–ধরে ক্ষমা চায়। দর্শিনী ভেতর থেকে বিরক্তবোধ করলেও, তাকে মাফ করে দিয়েছিল! সেদিন ইরার চোখে দর্শিনীর জন্য মৃদুমন্দ আক্রোশ ছিল। পরর্বতিতে ইরা কিছুদিন গায়েব ছিল! এখন স্বাভাবিক ভাবেই ভার্সিটি যায়, সব ক্লাস করে, সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে! কিছুদিন আগে অবশ্য ইরা সুসাইড করতে চেয়েছিল! কারণ হিসাবে নিত্যদিন সহপাঠীদের বাজে কথা, অপমানে ডিপ্রেসড ছিল। সবার সমস্যা ছিল ইরার আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়াতে। ইরা বখাটে বড়লোক বন্ধুদের উসিলায় যত আরাম আয়েস করেছে সবটা লোক দেখানো ছিল! তাই সুযোগ পেলে সবাই তাকে কথা শোনাতো, অপমান করতো! সবার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলে প্রতারণা করেছিল বলেই‚ মেয়েটা আজ সবার কাছে অপমানিত হচ্ছে। তাই ইরা প্রতিজ্ঞা করেছে তাদের আর্থিক অবস্থা সফলতা দিয়ে বদলে ফেলবে! এজন্যই ভার্সিটিতে সহস্রবার অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরার অদ্ভূত কর্মকান্ডের জন্য ইমান আবদুল্লাহ আর সুফিয়া বেগম মেয়েকে মাফ করেনি। তবে মেয়ের পরিবর্তনে নরম হয়েছেন কিছুটা। অতঃপর সেদিন থেকে ইরার সঙ্গে দর্শিনীর দ্বিতীয়বার কখনো দেখা হয়নি!
____________
দর্শিনীর প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে আশরাফ মুহতাসিম‚ প্রিয়মা বেগম খুবই খুশি হয়েছেন। তাছাড়া আহমেদ মুহতাসিম তো আছেন। তিনি সুখবর পাওয়া মাত্রই প্রিয় নাতনিকে দেখতে চেয়েছেন। দর্শিনীর বিয়ের পরে, দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ বোধ করছেন তিনি। এজন্যই আশরাফ সাহেব বাবাকে নিজের কাছে রেখে—আদর-যত্ন করছেন! প্রয়োজন মতো ডাক্তার দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রজ্জ্বলিনী সন্তান সহ বাবার বাড়িতে থাকার সুবাদে সেদিন আলাদা করে জানানো হয়নি। বোনের প্রেগন্যান্সির খবরে আনন্দিত প্রজ্জ্বলিনী! তবে দর্শিনীর এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া দেখে কিছুটা চিন্তিত ছিল। আবিদ, দর্শিনী দুজনেই স্বহাস্যে—আত্মীয়স্বজনকে সুখবরটা দিয়েছে। সবাই খুশি ছিল তাদের অনাগত সন্তানের জন্য! আসফি খবরটা শুনে খুশি হয়েছে। ঈষদুষ্ণ কষ্টও পেয়েছে বটে! বেচারী সত্যিই আবিদ, দর্শিনীর ভালো চায়! কিন্তু কেনো জানি প্রিয়দর্শিনী নামক সুক্ষ্ম ব্যথাটা মাঝেমধ্যেই তীব্র হয়ে উঠে। তাই সেটা নির্মল করতে লাইফটাইম কানাডায় থাকার সিদ্ধান্ত। তবে এতবড় সত্যিটা কেউ জানেনা। জানবেও না!
আজকে আবিদ‚ দর্শিনীকে নিয়ে মুহতাসিম ভিলায় যাবে। আহমেদ মুহতাসিম বারবার করে আবিদকে বলে দিয়েছেন। উনার কথা রাখতে আবিদ আজকের জন্য যাবতীয় কাজ থেকে ইস্তেফা নিয়েছে! দর্শিনী আজকে বাবা-মার সঙ্গে খুশির সংবাদ ভাগ করে নিতে পারবে বলে অনেকটা এক্সাইটেড ছিল! দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে আবিদ দর্শিনী দুজনেই রেডী হয়ে যায়। দর্শিনী খয়েরী-কালো সংমিশ্রণে একটা শাড়ি পড়েছে। গলায় আবিদের দেওয়া স্বর্ণের চিকন চেইন। কানে ছোট্ট দুল! মাথায় মসৃণ চুলগুলো ছেড়ে রাখা। ব্যস! দর্শিনী রেডী হয়ে গেলে, আবিদ তখন রুমে আসে। সে দর্শিনীর সামনে দ্রুত শার্ট চেন্জ করতে থাকে। দর্শিনী হতভম্ব হয় আবিদের কাণ্ডে! তৎক্ষণাৎ চোখ ঢেকে অন্যদিকে ফিরে যায়। সে আবিদকে ওয়াশরুমে গিয়ে—চেন্জ করতে বলে। আবিদ তার কোমড় আঁকড়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
‘বাবুর আম্মু বানিয়ে দিলাম তবুও এতো লজ্জা আসছে কোথা থেকে? হুউমম? আমার তেজস্বিনী কী আমাকে প্রথমবার এভাবে দেখেছে? বিনাবস্ত্রে আমাকে তো অনেকবার দেখেছে! এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো কীভাবে? আমার শরীরে এইযে নখের আঁচড়গুলো এখানো আছে‚ ম্যাম।’
আবিদের শেইমলেস কথায় দর্শিনী লজ্জা পেয়ে আবিদের ঠোঁটে হাত রেখে বলে,
‘ইশশ! আপনি চরম অসভ্য আবিদ!’
আবিদ দর্শিনীর দিকে একটু ঝুঁকে বাঁকা হেসে বলে,
‘সব পুরুষই নিজের বউয়ের কাছে বন্য, চূড়ান্ত অসভ্য হয়!’
দর্শিনী আবিদের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। আবিদ তার চুলের ফাঁকে হাত ডুবিয়ে, অন্যহাত আলতো করে গালে রেখে পুরুষালি ঠোঁট দিয়ে দর্শিনীর ঠোঁটে শব্দ করে চুমু খায়। দর্শিনীর যেন আচমকা নিঃশ্বাস আঁটকে যাওয়ার মতো অনুভব হলো। পরবর্তীতে আবিদ তাকে ছেড়ে বাঁকা হেসে ওয়াশরুমে ব্লেজার, প্যান্ট নিয়ে চলে যায়। এদিকে দর্শিনী বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়। তার দৃষ্টি তখনও ওয়াশরুমের দরজাতে নিবদ্ধ। দর্শিনী মনে মনে বলে,
‘আশ্চর্য্য, আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী আপনি স্বামী হিসেবে সত্যি আশ্চর্য্য!’
আবিদ‚ দর্শিনী রেডী হয়ে গাড়িতে উঠে বসে। অনুসা বেগম, শাহরিয়ার চৌধুরী দুজনকে গাড়িতে উঠিয়ে দেন। শাহরিয়ার চৌধুরী গাড়ির স্পীড কমিয়ে রাখতে বলেন। আবিদ সুন্দর ভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। তারা রওনা হয়, মুহতাসিম ভিলার উদ্দেশ্যে। দর্শিনীদের বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করতেই—কয়েকজন অনাথ পথশিশু দুজনকে ঘিরে ধরে। শরীরে তাদের জরাজীর্ণ ময়লা পোশাক! শিশুগুলোর শুকনো, ক্ষুদার্থ চেহারা দেখে দর্শিনীর ভিষণ খারাপ লাগলো। তারা দর্শিনীর শাড়ির আঁচল ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,
‘আপা আমগোরে কিছু খাওন দিবেন? আজ তিনদিন আমরা পানি ছাড়া কিছুই খাইনি। জানেন কেউ আমগোরে কোন কাজ দেয়না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। পেটের দায়ে পড়ে ভিক্ষা করছি।’
দর্শিনীর ভেতরের কমল মনটা কেমন যেন শিউরে কেঁপে উঠল। আজ তিনদিন ধরে বাচ্চাগুলো পানি খেয়ে আছে! আশ্চর্য্য‚ কেউ কী তাদের খেতে দেওয়ার মতো সামর্থ্যবান ছিল না? নিষ্ঠুর এই সমাজে মানুষের মনোভাব নিকৃষ্ট কেনো? মানুষ ক্ষুদার্ত থাকলে অনুভব করতে পারে, কতটা কষ্ট হয়! সেখানে পথশিশুরা দীর্ঘদিন না খেয়ে পার করে। তাদের কষ্ট অনুভব করে দর্শিনীর চোখে পানি জমল। তৎক্ষণাৎ সে আবিদের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল! আবিদ তার প্রিয়দর্শিনী কী চাইছে, মুহূর্তেই বুঝে গেছে! দর্শিনীর কমল, পবিত্র মনটা সর্বদা মুগ্ধ করে আবিদকে! সে ভাগ্যবান স্বামী কারণ দর্শিনী তার মনের মতো। আবিদ বাচ্চাগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘চলো আমাদের সাথে! বয়স কতো তোমাদের?’
একজন বলল পাঁচ বছর‚ একজন বলল তিন বছর‚ একজন ছয় বছর এভাবে সবাই নিজেদের বয়স বলল। পরবর্তিতে নাম জিগ্যেস করা হলে—সবাই নিজেদের নাম বলে মলিন হাসলো। তারা সবাই অনাথ! দর্শিনী ওদের পেছন পেছন হেঁটে আসছে। তাদের কথাবার্তা সবকিছু কর্ণগোচর হলো দর্শিনীর। মুহূর্তে মনে মনে বিস্তর পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলল‚ এতিম পথশিশুদের নিয়ে! তাদের সবার জন্য কিছু করার উদ্যোগ নিবে দর্শিনী। সে ঠিক করলো আবিদকে জানাবে তার একান্ত পরিকল্পনা! এদের থাকার জন্য এতিমখানা তৈরির ব্যাপারে।
আমাদের দেশে প্রায় সহস্রাধিক পথশিশু ভাগ্যের পরিহাসে এভাবেই অনাহারে‚ আনাদরে রাস্তাঘাটে মৃত্যুবরণ করছে! তাদের পর্যাপ্ত খাবার পানি, বস্ত্রসমূহ, শিক্ষা, চিকিৎসার অভাব! সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ তাদের জন্য এগিয়ে আসেনা। অথচ এটা প্রত্যেকটি ব্যক্তি, নাগরিকের কর্তব্য! সমাজের তথাকথিত ধনী–সম্প্রদায় সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে—এভাবে ফুলগুলো অকালে ঝরে পরতো না! দর্শিনী পথভ্রষ্ট সমাজের চিন্তাচেতনা তো বদলাতে পারবে না। কিন্তু চেষ্টা তো করতেই পারে! হয়তো চেষ্টার ফলে অনেকের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে। ধীরে ধীরে মানুষ ভালো-মন্দ বুঝতে শিখবে।
কলিং বেল বাজতেই প্রিয়মা বেগম দরজা খুলে দেন। দরজা খোলার পরমুহূর্তেই, এতোগুলো বাচ্চাকে দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে আবিদের দিকে তাকালেন। বাচ্চাগুলো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে! আবিদ দর্শিনী তাদের পিছনে হাসিমুখে রয়েছে। অনাথ বাচ্চাগুলোর মলিন চেহারায়; নূরের মতো হাসি দেখে প্রিয়মা বেগমের হৃদয় জুড়িয়ে গেলো। আবিদ স্বহাস্যে শাশুড়িকে সালাম দেয়,
‘আম্মা তারা অনাথ পথশিশু! আজকের দিনটা আমাদের সঙ্গে থাকবে! কোন সমস্যা হবে না তো?’
প্রিয়মা বেগম নরম মনের মানুষ। তাছাড়া দর্শিনীর পরিবারের সবার মানসিকতা ভিষণ সুন্দর। এই বাচ্চাগুলোর জন্য তাদের অসুবিধা হবে তিনি এটা ভাবতেই পারলেন না। বাচ্চারা ফেরেস্তা সমতূল্য! তারা বাড়িতে সৌভাগ্য বয়ে আনে। প্রিয়মা বেগমের সবাইকে দেখে মায়া হলো। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন অভুক্ত রয়েছে সবাই! তিনি হাসিমুখে বলল,
‘কোন সমস্যা নেই বাবা! তোমরা সবাই ভেতরে আসো।’
আবিদ বাচ্চাগুলোকে ইশারা করে। সবাই শৃঙ্খলভাবে লিভিং রুমে প্রবেশ করে। আশরাফ সাহেব অনাথ পথশিশুদের সঙ্গে মেয়ে জামাইকে দেখে এগিয়ে আসলেন। আবিদ তখন ফোনে কাউকে কিছু আনতে বলছিল। সে শ্বশুরকে দেখে ফোন রেখে সালাম দেয়। দর্শিনী বাবা–মার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। আশরাফ সাহেব, প্রিয়মা বেগম দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেন! দর্শিনী বাবা–মাকে অনাথ বাচ্চাগুলোর অসহায়ত্ব সম্পর্কে বলে। এসব ভেবেই তার মন খারাপ ছিল। আশরাফ সাহেব বললেন, যতদিন পর্যন্ত এদের ব্যবস্থা না হবে তিনি সবাইকে বাড়িতে রাখবেন। আশরাফ সাহেবের কথায় সবাই খুশি হয়ে যায়। আবিদ খুশি হয় দর্শিনীকে খুশি হতে দেখে! কালকেই সবাইকে এতিমখানায় নিয়ে যাবে আবিদ। নিচে হৈ-হুল্লোর শব্দ শুনে প্রজ্জ্বলিনী প্রহরকে নিয়ে লিভিং রুমে চলে আসে। দর্শিনী বোনকে দেখে এগিয়ে যায়। প্রহরকে কোলে নিয়ে আদর করে দেয়। প্রজ্জ্বলিনী বাচ্চাগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকায়, দর্শিনী বোনকে সবটা খুলে বলে। প্রজ্জ্বলিনী ওদের জন্য ব্যথিত হয়! ততক্ষণে আবিদের লোকজন বসের শ্বশুরবাড়িতে বড় বাস্কেট ভর্তি বাজার, মাছ-মাংস নিয়ে এসেছে! তাছাড়া বাচ্চাগুলোর জন্য বেশকিছু কেনাকাটা করেছে। তাদের পরিধানের কাপড়সমূহ! আবিদের পরামর্শ অনুযায়ী লোকটা বাজারের ঝুঁড়িগুলো রান্নাঘরে সাজিয়ে রাখে। এতোসব দেখে আশরাফ সাহেব বলেন,
‘এসব কী আবিদ? এতো কিছু কেনো এনেছো? তুমি একদম ঠিক করোনি আবিদ!’
প্রজ্জ্বলিনী‚ দর্শিনী‚ প্রিয়মা বেগম অনেকদিন পরে একসঙ্গে হয়েছে। তারা আহমেদ মুহতাসিমের রুমে ছিল! তাই এতসব দেখেনি। আবিদ মৃদু হেসে শ্বশুরকে বলে,
‘আমি আপনার মেয়ে জামাই! এটা আমার কর্তব্য ছিল বাবা! তাছাড়া দাদুভাইয়ের কথা ভেবে অন্তত গ্রহণ করুন।’
আশরাফ সাহেব আর কথা বলতে পারলেন না। আবিদ লোক দুটোকে চলে যেতে নির্দেশ করে। পরবর্তীতে বাচ্চাদেরকে গোসল করিয়ে পরিপাটি করাতে, আবিদ আশরাফ সাহেবকে সাহায্য করে। অবশেষে মেয়েরা ডাইনিং টেবিলে খাবার রেডী করতে থাকে! সবাই ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে এসেছে। সবশেষে উজান আসে সরাসরি অফিস থেকে। তারপর আহমেদ মুহতাসিমকে ধরে-ধরে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে আসে আবিদ, দর্শিনী! অতঃপর সবাই খেতে বসেছে। বাচ্চাগুলো যেন পেট পুরে খেলো! আজকে, কালকে সারাদিন তারা এখানে থাকবে। আগামীকাল আবিদের তত্ত্বাবধায়ণে এতিমখানায় শিফট করা হবে তাদের। বাচ্চাগুলোকে রাতে গেস্টরুমে শুতে দেওয়া হয়েছে। তারা সামান্য যত্ন পেয়ে কেমন কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে মাথানত করে রাখছিল। এমন শিশুদের প্রতি সমাজের তথাকথিত ভদ্রমানুষ রূপি অমানুষদের মায়া হওয়া উচিত। কিন্তু তারা এমন নয়! আবিদ, দর্শিনী দুজনই দাদুর সঙ্গে কথা বলে নিজেদের রুমে ফিরে আসে। দর্শিনী রুমে ফিরেই আবিদকে জড়িয়ে ধরে জিগ্যেস করে,
‘আপনার তত্ত্বাবধায়ণে কয়টি এতিমখানা চলে? কেউ জানেনা কেনো? আমি আজকে আপনার কথা না শুনলে, জানতেও পারতাম না আবিদ! আপনি আমার থেকে কথা লুকিয়ে অন্যায় করেছেন।’
আবিদ দর্শিনীর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
‘আমি এটা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম দর্শিনী। ভালো কাজ সবাইকে বলে করতে হয়না। তোমার অনাথ শিশুদের প্রতি দূর্বলতা দেখে বলতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তুমি আগেই জেনে ফেলেছো। মানেটা পরিস্কার! আল্লাহ্‚ চাননি আমি স্ত্রীর কাছে বিষয়টি গোপন করি।’
‘আপনার টাকাই এতিমখানা চলে? এক্সাক্ট কয়টি?’
‘পাঁচ-ছয়টা! ভবিষ্যতে সংখ্যা বাড়বে। চিন্তা করোনা সমাজে অবহেলিত অনাথ শিশুদের নিয়ে ভালো চিন্তাভাবনা করেছি। তাছাড়া সরকার তাদের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। সবাইকে সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া হবে। ইনশাআল্লাহ!’
‘আমাকে নিয়ে যাবেন প্লীজ? আমি তাদেরকে দেখতে চাই!’
‘এতিমখানায় বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বড়সড় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। তখন সবাইকে এলাউ করে! তাছাড়া কালকে আমি ওদেরকে পৌঁছে দিতে যাবো। তখন আমার সঙ্গে যাবে সমস্যা নেই।’
‘আমি বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কেমন অনুষ্ঠান হয় দেখতে আগ্রহী!
‘সবার জন্য বড়সড় খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বছর শেষে! তাছাড়া সবাইকে কম্বল‚ চকলেট-মিষ্টি‚ নানান উপহার সামগ্রী দেওয়া হয় এটাই।’
‘বাহ সুন্দর তো!’
‘ঠিক আছে! এবার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান হলে তোমাকে নিয়ে যাবো। এখন কথা নয় শুয়ে পড়ো!’
__________
পরেরদিন সময় মতো বাচ্চাগুলোকে এতিমখানাতে পৌঁছে দেয় আবিদ। দর্শিনী তার সঙ্গেই ছিল। বাগানের মধ্যে সুন্দর পরিবেশে এতিমখানা অবস্থিত! সেখানে উপস্থিত প্রতিটা বাচ্চা আবিদকে দেখে অনেক খুশি হয়। বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর জন্য টিচার, দেখাশোনা করার জন্য কেরানি গার্ডস ছিল! আবিদ আসার সময় সবার জন্য চকলেট নিয়ে এসেছিল। বাচ্চাগুলো দর্শিনীর সঙ্গে পরিচিত হয়! অনাথ শিশুদের দেখে দর্শিনীর কষ্ট হয়। সে তাদেরকে অবজার্ব করতে থাকে। তারা সবাই ভিষণ ট্যালেন্টেড। দর্শিনী অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিল। ভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্ন ছিল তাই হয়তো আবিদের মাধ্যমে স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হচ্ছে! আবিদ‚ দর্শিনী পুরো বিকেলটা এতিমখানায় কাটিয়ে দেয়। তারা পাঁচটি এতিমখানাতেই গেছিল। আরেকটি নতুন তৈরি হচ্ছে! কনসট্রাকশনের কাজ চলছে! প্রায় শেষের পথে! দর্শিনী আজকে অনেক খুশি কারণ হাফ পার্সেন্ট অনাথ বাচ্চাদের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তারা এখন ভালো থাকবে। তাদের আর কখনো না খেয়ে কষ্ট পেতে হবে না। এতিমখানা ঘোরাঘুরি শেষে আবিদ‚ দর্শিনী দুজনেই চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আজকে দর্শিনীদের মতো প্রজ্জ্বলিনী আর উজান তাদের নিজেদের বাড়িতে রওনা দিয়েছে। প্রহরের জন্মের পরে প্রজ্জ্বলিনী অনেকদিন বাবা-মার সঙ্গেই ছিল। ফলে উজানকে এখানে আসতে হয়েছে! মাঝেসাঝে উজান অফিসে যাওয়ার পথে প্রজ্জ্বলিনী আর প্রহরকে রেখে আসতো। আবার বাসায় নিয়ে যেতো। আপাতত মুহতাসিম ভিলায় আশরাফ সাহেব‚ প্রিয়মা বেগম‚ আহমেদ মুহতাসিম এবং একটি মেইড আছে! মেইডকে আহমেদ মুহতাসিমের দেখাশোনা করার জন্য রাখা হয়েছে।
#চলবে
[ পরবর্তী পর্বে সমাপ্তি থাকবে! সমস্যা নেই স্যাড এন্ডিং দিবোনা। সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ ]