#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৪৪
আবিদের হাত থেকে স্রোতের ন্যায় রক্ত পড়ছে। ডানহাতে গভীর ক্ষত হয়েছে, ব্লিডিং দেখে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে। আবিদ তবুও নির্বিকার হয়ে আছে। ইতিমধ্যে পুলিশ তখন ছেলেগুলোকে হাতকড়া পড়িয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। কিছুক্ষণ পরে আবিদের গার্ডরা চলে আসে। আবিদ আহত অবস্থায় গাড়ির লক খুলে দর্শিনী, আদিবাকে বের করে। আদিবা গাড়ি থেকে নেমে ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। দর্শিনীর সুযোগ হয়নি আবিদকে জড়িয়ে ধরার। বেচারী প্রচণ্ড ভয় পেয়ে তখন থেকে নিঃশব্দে কাঁদছে। আবিদ একদিকে বোনের মাথায় হাত রেখে কাঁদতে নিষেধ করে। অন্যদিকে আঘাত পাওয়া হাত দিয়ে দর্শিনীর ডান হাত আঁকড়ে ধরে কান্নাকাটি করতে নিষেধ করে। পুলিশদের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা তাদের কাছে এগিয়ে আসে। আবিদ আদিবাকে ছেড়ে সাইডে দাঁড়াতে বলে। দর্শিনী তখন আবিদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতের পৃষ্ঠে আবিদের রক্ত লেগে আছে। দর্শিনী একহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে অন্যহাত দিয়ে কিছুক্ষণ রক্তটা উঠানোর চেষ্টা করে, কিন্তু রক্তটা উঠেনি! পুলিশের লোকটি সবটা খেয়াল করে আবিদকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ We are really sorry sir! আমরা আরো আগে পৌঁছে যেতাম কিন্তু আজকে যানজট বেশ ছিল। আপনি আঘাত পেয়েছেন আমাদের খারাপ লাগছে স্যার। এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট!’
আবিদ তখন রক্ত বন্ধ করতে হাতে রুমাল চেপে ধরেছে। পুলিশ কর্মকর্তার কথায় হঠাৎ-ই ঠোঁটে চাঞ্চল্যকর সুক্ষ্ম হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
‘ব্যাপার না রফিক সাহেব! আপনি ওদেরকে থানায় নিয়ে যান। আপাতত তাদের থেকে কথা বের করার চেষ্টা করুন। আমি বিকালে থানায় আসবো! ওদেরকে বেশি টর্চার করার দরকার নেই। আমি বিষয়টি দেখবো। আর হ্যাঁ, ধন্যবাদ আপনাকে!’
‘ঠিক আছে স্যার! আমরা তাহলে আসি।’
‘ঠিক আছে, আসুন তবে।’
কিছুক্ষণ পরেই পুলিশগুলো গাড়িতে চড়ে চলে যায়। আবিদ আদিবা দর্শিনীকে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে গার্ডদের সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নেয়। আবিদ গার্ডদের মধ্যে দু’জনকে থাকতে বলে বাকিদের চলে যেতে বলে। পরবর্তীতে গার্ডরা চলে গেলে আবিদ দর্শিনী, আদিবার চাপে পড়ে মেডিপ্যাথের উদ্দ্যেশে রওনা দেয়। তার হাতের ক্ষতটা ছুঁয়ে দর্শিনীকে অনেকক্ষণ কান্না করতে দেখে আবিদ মিষ্টি-মধুর হেসেছে। দর্শিনীর জন্য আবিদ এভাবে হাজারবার আহত হতে রাজি আছে! এই ঘটনার পরে দর্শিনীর সঙ্গে আবিদের তেমন কথা হয়নি। এজন্যই দর্শিনী অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল আবিদের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সামনে দুইজন গার্ড অন্যদিকে আদিবা রয়েছে। এদের মধ্যে আবিদকে একটু আদর করার সুযোগটা নেই। সমস্যাটা মূলত এখানেই! আবিদের এখন দর্শিনীর মতো সেইম অনুভব হচ্ছে!
মেডিপ্যাথে আদিবার নিহালের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এই পাঁচমাসে যেমন সবার জীবনে পরিবর্তন এসেছে। ঠিক তেমনি আদিবা নিহালের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। নাছোড়বান্দা আদিবা নিহালের পিছু ছাড়েনি। সে নিহালকে প্রতিপদে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, নিহালের প্রতি তার সমুদ্র সমপরিমাণ ভালোবাসা। অথচ নিহাল তাকে অনেকবার ফিরিয়ে দিয়েছে! অবশ্য আদিবা কখনো নিহালের সিদ্ধান্ত মানতে চায়নি। তবে এই পাঁচমাসে নিহাল উপলব্দি করে ফেলেছে আদিবার প্রতি তার ভালোলাগা, ভালোবাসা আছে! বয়সের ডিফারেন্স এছাড়া অন্যান্য কম্পলিকেশনকে মোকাবেলা করে দুজনেই এখন রিলেশনশীপে আছে। যদিও এই ব্যাপারে কেউ জানেনা। তবে আদিবার এডমিশন হয়ে গেলে নিহাল তাকে বিয়ে করবে বলে জানিয়েছে। এই কথাটা শোনার পরে প্রথমবার আদিবা লজ্জা পেয়েছিল। আদিবা যখন বারবার নিহালকে ভালোবাসি বলতো তখন এতটা লজ্জা পায়নি যতটা নিহালের বিয়ের প্রস্তাবে পেয়েছিল। বেচারী পুরো একদিন লজ্জায় নিহালের সঙ্গে কথা বলেনি। এদিকে নিহাল টেনশনে পড়ে গেছিলো। হঠাৎ-ই কী হলো তার ছোট্ট প্রেয়সীর? পরবর্তীতে প্রথমবার প্রেমিক হিসাবে আদিবার কলেজের সামনে গিয়ে দেখা করে এসেছে। আদিবা কখনো কল্পনা করেনি সে নিহালের ভালোবাসা পাবে। কিন্তু বাস্তবে যখন এতটা প্রাপ্তি পেলো আনন্দে কেঁদেছিল সারাদিন। আজকে কোচিং থেকে নিহালের চেম্বারে দেখা করার কথা ছিল আদিবার। এজন্যই খুব সুন্দর করে সেজেছিল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তার কোচিংয়ে যাওয়া হয়নি। ভাগ্যক্রমে আবিদ, দর্শিনী, আদিবা সবাই মেডিপ্যাথে এসেছে। এখানেই আদিবার উজ্জ্বল মুখশ্রীতে কান্নাকাটির স্পষ্টত ছাপ পেয়ে নিহাল ভয় পেয়ে যায়। সে চেকআপ করার উসিলায় সবার অগোচরে আদিবাকে জড়িয়ে ধরে জিগ্যেস করে সব ঠিক আছে কী না? পরবর্তীতে আদিবা তাকে সবটা খুলে বলে। সব শুনে নিহাল তাকে সান্ত্বনা দেয়। মন খারাপ করতে নিষেধ করে।
আজকে ডক্টর নিহাল রায়হান আবিদের ড্রেসিং করবে। সে দর্শিনীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে আবিদের হাতের ড্রেসিং করে দেয়। আবিদের হাতের গভীর ক্ষততে তিনটা সেলাই পড়েছে। যখন আবিদকে ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছিলো তখন দর্শিনী চোখ বন্ধ করে আবিদের অন্যহাত শক্ত করে আঁকড়ে ছিল। হাতের কাটা জায়গাতে সেলাই করার সময় আবিদ নিশ্চুপ নির্বাক হয়ে ব্যাথা সহ্য করে নেয়। কিন্তু দর্শিনী আবিদকে ব্যাথা পেতে দেখে চোখ খিঁচে বন্ধ করে রাখে। মনে হচ্ছিলো আবিদ নয় আঘাতটা দর্শিনী পেয়েছে। বিষয়টি এমন ছিল যে সেলাই আবিদের হচ্ছে, কষ্টটা দর্শিনী পাচ্ছে। আবিদ দর্শিনীর এতো কেয়ার দেখে আপ্লুত ছিল! দর্শিনী সেলাইয়ের সময় আবিদকে ডিসট্র্যাক করতে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এদিকে সবটা লক্ষ্য করেছে নিহাল! সে মৃদু হেসেছে দর্শিনীর পজেসিভ নেস দেখে। দর্শিনীকে নিহাল এখনো মনে রেখেছে তবে পছন্দনীয় হিসাবে নয়, সম্মানীয় একজন হিসাবে! সে আবিদ দর্শিনী দুজনকেই রেসপেক্ট করে। তাছাড়া আবিদ দর্শিনীর ভালোবাসা তার কাছে ভিষণ স্নিগ্ধ মনে হয়। ইতিমধ্যে নিহাল বাকি সবার মতো আর্বিশিনীর প্রেম থেকে ভালোবাসা সব ঘটনা শুনেছে। আদিবা তাকে নিজে থেকে বলেছে। নিহাল তাই দুজনের ভালোবাসাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে।
নিহাল যেহেতু আজকের ঘটনা সম্পূর্ণ আদিবার কাছে শুনেছে। এজন্য দ্বিতীয়বার ঐ বিষয়ে কথা তোলেনি। আবিদের চিকিৎসা শেষে তাকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়। যাওয়ার আগে আবিদের নিহাল সম্পর্কে সমস্ত ধারণা পাল্টে যায়। নিহাল যেহেতু দর্শিনীকে ভুলে গ্রো-আপ করেছে, তাই বৃথা অসন্তোষ পুষে রাখা ঠিক হবেনা। তাছাড়া আবিদ জানে নিহাল অত্যন্ত ভালো ছেলে। শুধু দর্শিনীকে নিয়ে সমস্যা ছিল আবিদের। তারা সবাই নিহালকে বিদায় বলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে নিহাল আদিবাকে বলে,
‘বাসায় পৌঁছে জানাবে!’
‘ঠিক আছে! আই উইল মিস ইউ, বাই।’
‘বাই সুইটহার্ট!’
.
চৌধুরী ভিলাতে গার্ডসহ আবিদ উপস্থিত হয়। সবাই আবিদের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে আতঙ্কিত হয়ে ব্যাপারটা জিগ্যেস করে। আবিদ তখন সোফায় গা এলিয়ে দেয়। আদিবা, দর্শিনী পুরো ঘটনাটা খুলে বলে। আজকে একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই আবিদের প্রাণ চলে যাওয়ার সম্ভবণা ছিল! প্রচণ্ড তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পূর্ণ হওয়ার দরুণ আবিদ প্রাণে বেঁচে গেছে। ধারালো অস্ত্রসহিত ছেলেগুলোকে সামলানো ভিষণ জটিল ছিল! সবটা শুনে পরিবারের সবাই হতবিহ্বল। হঠাৎ -ই অনুসা বেগম হুহু করে কেঁদে উঠেন। তিনি ব্যাতিব্যস্ত হয়ে আবিদকে এসে জড়িয়ে ধরেন। দীর্ঘ অনেক বছর পরে ছেলেকে এভাবে জড়িয়ে ধরছেন অনুসা বেগম! আগেবার যখন আবিদের এক্সিডেন্ট হয়েছিল। দর্শিনী, অনুসা বেগম, পরিবারের সবাই আবিদের শোকে ভিষণ কাতর ছিল। সেই শোক কেটে গেছে অনেকদিন। এখন আবার নতুন বিপদ দেখে তিনি নিজেকে সামলাতে পারেনি। আবিদ অস্বস্তিতে বুদ হলেও মায়ের মাথায় হাত রেখে কাঁদতে নিষেধ করেন। একে একে সবাই এসে আবিদকে জড়িয়ে আবেগপূর্ণ হয়ে যায়। এদিকে নিচে কান্নাকাটির আওয়াজ পেয়ে শবনম চৌধুরী লিভিং রুমে চলে আসেন। তিনি নিচে নামতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। আবিদকে ঘিরে জটলা দেখে সব জিগ্যেস করেন। পরবর্তীতে সবার থেকে সবটা শোনার পর তিনি কেঁদে উঠেন। আবিদ পড়ে যায় বিপাকে। সে কাকে সামলাবে এখন ফুপিআম্মুকে নাকি নিজের মাকে? অবশেষে সবটা সামলে নেয় আবিদ। দর্শিনী এক্ষেত্রে সাহায্য করে তাকে। আবিদের রেস্ট প্রয়োজন বলে উপরে নিয়ে যায় দর্শিনী। যাওয়ার আগে বাসার সবাইকে টেনশন করতে নিষেধ করে। অতঃপর সবাইকে নিজেদের রুমে যেতে বলে। আবিদের দুজন গার্ডস ইতিমধ্যে চলে গেছে। পরিবারের সবাই তখন আদিব দর্শিনীর মতো নিজেদের রুমে চলে যায়।
রুমে পৌঁছে দর্শিনী শান্তির একটা নিঃশ্বাস নেয়। আবিদ তার দিকে তাকিয়ে সুন্দর একটা হাসি উপহার দেয়। দর্শিনী আবিদের হাতে চুমু খেয়ে মনে মনে বলে,
‘আমার সুদর্শন স্বামী! আল্লাহ তুমি সবসময় আমার স্বামীকে হেফাজত করিও, আমিন।’
আবিদ দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘সবাই এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করছে যেন, আমি সত্যি ম’রে গেছি! সামান্য একটা আঘাত ছিল, সিরিয়াস ইস্যু ছিলনা।’
আবিদের মুখে ম’রে যাওয়ার কথা শুনে দর্শিনী তার মুখ চেপে ধরে। সে আবিদের উপর মৃদু রাগ করে বলে,
‘আপনি কখনো এসব কথা বলবেন না। আল্লাহ আমার সব হায়াত আপনাকে দান করুক, আমিন।’
আবিদ সুক্ষ্ম হেসে দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আচ্ছা বলবো না।’
দর্শিনী আবেশে চোখ বন্ধ করে। আবিদ দর্শিনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হার্টবিট অনুভব করতে থাকে। দর্শিনী সেই বিভৎস ঘটনার সময় থেকে চাইছিল, আবিদকে জড়িয়ে ধরতে! কিন্তু তখন সম্ভব হয়ে উঠেনি। সে হঠাৎ-ই মাথা তুলে বলে,
‘ছেলেগুলো কী বলছিল আপনাকে? আমার জন্য এসব হয়েছে ঠিকনা? আমি আপনার অপরাধী? আপনি সবাইকে বললেন না কেনো, আবিদ?’
দর্শিনীর চোখে পানি চলে আসে। আবিদ আলতো হাতে পানি মুছিয়ে দেয়। সহসা আবিদ তার ঠোঁট দিয়ে দর্শিনীর নরম ঠোঁট আঁকড়ে ধরে দারুণ অনুভূতিতে মত্ত হয়। দর্শিনী আবিদের সুট খামচে ধরে। আবেশে দুজনেই চোখ বন্ধ করে চুম্বন ক্রিয়ায় মত্ত! দর্শিনীর চোখের কোণ বেয়ে এখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে। আবিদ চুমুটা দীর্ঘ করে। দর্শিনী শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করে উঠলে, আবিদ তাকে ছেড়ে দেয়! দুজনে ঐভাবে একে অন্যকে জড়িয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। দর্শিনী লজ্জায় আড়ষ্ঠ! তাকে লজ্জা পেতে দেখে আবিদের ঠোঁটে হাসি দেখা যায়।
আবিদ বলে,
‘নিজেকে দোষী ভেবোনা দর্শিনী! সবকিছু হওয়ারই ছিল। তাছাড়া ছেলেগুলোর কথার উপর বেস করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবেনা। আমাদের প্রমাণ প্রয়োজন। আগে থানায় যায়, তখন সবটা জানতে পারবো! তুমি দুশ্চিন্তা করোনা।’
পরক্ষণে আবিদ দর্শিনীকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। বিকালে থানায় যেতে হবে তার। এখন আপাতত ঘুম প্রয়োজন। আবিদ শোয়ার সময় হাতে ব্যাথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠে। দর্শিনী আবিদের কঁকিয়ে উঠা দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আবিদ তখন রুম কাঁপিয়ে হুহা করে হেসে উঠে। দর্শিনী বুঝতে পারে আবিদ অভিনয় করছিল। শেষে মুখ গোমড়া করে সে অন্যদিকে তাকায়। আবিদ দর্শিনীকে বুকে জড়িয়ে বলে,
‘মজা করছিলাম, আমার সুদর্শিনী বউ!’
#চলবে
[ সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ ]