প্রিয়দর্শিনী পর্ব-২৭+২৮

0
998

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__২৭

দর্শিনী হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে অকস্মাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখে আসফি দাঁড়িয়ে আছে। দর্শিনী বিস্মিত হয়ে আসফির দিকে তাকিয়ে রইল। আসফি তার রুমে কী উদ্দেশ্যে এসেছে?এমনিতে লোকটার চাহনী ভালো নয়। দর্শিনী অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে। আসফি দর্শিনীর দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দেখে। দর্শিনীকে ভয় পেতে দেখে আসফি ধীরে ধীরে দিকে এগোতে থাকে। দর্শিনী কাঁপাকাঁপা কন্ঠে আসফিকে সাবধান করে বলে,

‘আপনি এখানে কী করছেন? দরজা থেকে সরে দাঁড়ান আমি বাহিরে যাবো।’

…..

‘সামনে এগোচ্ছেন কেনো? এগোবেন না আমি সম্পর্কে আপনার বড় ভাবী সমতূল‍্য। এমন আস্পর্ধা দেখাবেন না।’

…….

‘আসফি শাহরিয়ার চৌধুরী দরজা খুল……!’

দর্শিনী বাক‍্য শেষ করবে তার আগেই আসফি ক্লোরোফম মেশানো রুমালটা দর্শিনীর মুখে চেপে ধরে। দর্শিনী সেন্সলেস হয়ে আসফির উপরে ঢলে পড়ে। পরক্ষণে আসফির ইশারা পেয়ে প্রজ্জ্বলিনী এগিয়ে আসে। প্রজ্জ্বলিনী দর্শিনীকে ধরে রাখে আসফি তার হাতটা বেঁধে দেয়। প্রজ্জ্বলিনীর ভিতরে ভয় কাজ করছে যদি পরিবারের কেউ কোনভাবে জেনে যায় মেরে ফেলবে তাকে। সে আসফির উদ্দেশ্যে বলে,

‘এটা কী ঠিক হচ্ছে? প্রিয়কে বুঝিয়ে আমরা রাজি করাতে পারতাম।’

আসফি প্রজ্জ্বলিনীর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দেখুন প্রিয়দর্শিনী ভাইয়ের বিপক্ষে আমাদের কথা শুনে বিশ্বাস করবে এতটা বোকা নয়। যদি এভাবে আটঁকানো সম্ভব হত তাহলে আগেই এমনটা করতাম। আমার ধারণা প্রিয়দর্শিনীকে বুঝিয়ে লাভ হবেনা বিয়েটা আটঁকাতে হলে তাকে দুতিনদিন লুকিয়ে রাখতে হবে।’

‘এতো মানুষের মাঝে প্রিয়কে কীভাবে নিয়ে যাবো। এখন আপনি আমাকে সাহায্য করবেন। আমার শ্বশুরবাড়ি কাছেই! সবার অগোচরে আমাদের সেখানে পৌঁছে দিন।’

আসফি ব‍াঁকা হেসে বলে,

‘আমি ফ্রিতে কোন কাজ করিনা। আপনার বোনকে আমি অনেক পছন্দ করি; বিয়ে করতে চাই। আমাদের বিয়েতে সবরকম সাহায্য করতে হবে আপনার। একবার বিয়ে হয়ে গেলে সবাই মানতে বাধ‍্য হবে। কেউ কিছু বলতে পারবে না পরবর্তীতে। ভাইকে কষ্ট দিতে এরচেয়ে মোক্ষম সুযোগ আর নেই। আপনিও তো তাই চান ঠিক বলছি কী?’

প্রজ্জ্বলিনী জোর করে মেকি হাসে। আসফি প্রজ্জ্বলিনীর ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করে। দুজনেই দুজনের উপর সন্দেহ করছে। প্রজ্জ্বলিনী চেয়েছিল আসফির সহয়তা নিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিতে। দর্শিনীকে তার কাছে কয়েকদিন আটঁকে রাখতে। দর্শিনীকে দিয়ে মিথ্যা বলাতে চেয়েছিল যে প্রিয়দর্শিনী বিয়েটা করবে না। তাহলে আবিদ অনেক অপমানিত হতো। পরবর্তীতে সে দর্শিনীকে বিয়ে করবেনা। অন‍্যদিকে আসফি চেয়েছিল প্রিয়দর্শিনীকে বিয়ে করে নিতে। বিয়ের দুদিন আগে আসফি প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে,প্লান সহ প্রস্তাব দিয়েছিল। কথায় আছে শত্রু শত্রু ভাই ভাই। তাই আসফিকে নিজের দলে পেয়ে প্রজ্জ্বলিনী সেসময় মারাত্মক খুশি হয়। শেষে আসফি যখন দর্শিনীকে বিয়ে করবে বলে শর্ত দেয়। প্রজ্জ্বলিনী ভেতরে হাজার অসন্তুষ্টি নিয়ে আসফিকে মিথ‍্যা আশ্বাস দেয়। প্রজ্জ্বলিনী দুই ভাইয়ের একজনকেও পছন্দ করেনা। আবিদকে প্রজ্জ্বলিনী নির্দিষ্ট কারণে পছন্দ করেনা। কিন্তু আবিদ আসফির মতো অতটা খারাপ নয়। এই চরম সত্যিটা প্রজ্জ্বলিনী ভালোমতো বুঝে গেছে। সে বোনের সঙ্গে আসফির মতো ছেলেকে কখনোই বিয়ে দিতে চায়না। তাই সে আসফিকে মিথ্যা বলে।

প্রজ্জ্বলিনী বলে,

‘অবশ‍্যই বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে; আমি নিজে প্রিয় আর আপনার বিয়ে দিতে সাহায্য করবো। এখন এটা বলেন প্রিয়কে কীভাবে বের করবেন? এতো মানুষ আর আবিদের সিকিউরিটি গার্ডদের ফাঁকি দিয়ে এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব না।’

প্রজ্জ্বিলীর কথায় আসফি সন্তুষ্ট হয়। সে বলে,

‘আপাতত আলাদা একটা রুমে লক করে রাখলেই হবে। সবাই যখন প্রিয়দর্শিনীকে না পেয়ে হুলস্থুল হয়ে খুঁজবে তখন নাহয় সুযোগ বুঝে বের করে নিয়ে যাবো।’

প্রজ্জ্বলিনী সম্মতি দেয়। আসফি দর্শিনীর মুখে কাপড় বেঁধে দেয়। যাতে জ্ঞান ফিরে চিৎকার করতে না পারে। তারপর দুজন মিলে দর্শিনীকে একটা রুমের বিছানায় এনে শুয়ে দেয়। প্রজ্জ্বলিনী এতটুকুতে হাঁপিয়ে গেছে একদম। সে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,

‘প্রিয়র জ্ঞান ফিরবে কখন?’

‘একটু পরেই ফিরবে! ভয় নেই কোন ইফেক্ট হবে না ক্লোরোফমের।’

প্রজ্জ্বলিনী আর আসফি রুম লক করে ফিরে আসে। আসফি বরযাত্রীদের মাঝে মিশে যায়। এদিকে প্রজ্জ্বলিনী ঘেমে নেয় সবার মাঝে উপস্থিত হয়। উজান প্রজ্জ্বলিনীকে লক্ষ‍্য করে এগোতে থাকে। তৎক্ষণাৎ কাছে এসে জিগ্যেস করে,

‘কী ব‍্যাপার এসির মধ‍্যেও ঘেমে গেছো দেখছি। কোথায় ছিলে এতক্ষণ? এখানে বসো।’ বলে টিস‍্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দেয়।

প্রজ্জ্বলিনী জোর করে হাসে। তার হঠাৎ করে ভয় করছে। সবাই কতো আনন্দ করছে বিয়েতে। আশরাফ মুহতাসিম যদি কোনভাবে এই অঘটন টের পায় প্রজ্জ্বলিনীকে মেয়ে হিসাবে পরিচয় দিবেনা কখনো। প্রিয়মা বেগম নিশ্চয়ই তার গায়ে হাত তুলবে। আর উজান! উজান এসব জানতে পারলে প্রজ্জ্বলিনীকে আর ভালোবাসবে না। প্রজ্জ্বলিনী দোটানায় ভোগে। অতিরিক্ত টেনশনে প্রজ্জ্বলিনীর প্রেশার ফল করে। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে উজান তাকে জড়িয়ে ধরে। অনেকে প্রজ্জ্বলিনীকে রুমে রেখে আসতে পরামর্শ দেয়। উজান তাকে ধরে ধরে আলাদা একটা রুমে শুয়ে দেয়।

.

আবিদ অনেকক্ষণ ধরে আসফিকে খুঁজছে। এতোক্ষণ চোখে চোখে রেখেছিল মুহূর্তে কোথায় গেলো। পরক্ষণে আসফিকে অনুসা বেগমের সাথে দেখে আবিদ শান্ত হয়। আবিদের সেট করা চারজন লোক এখনো আসফির উপর নজর রাখছে। হঠাৎই একজন এসে জানায় কিছুক্ষণ আগে আসফি আর প্রজ্জ্বলিনীকে একটা বন্ধ রুমের দরজা খুলতে দেখেছে তারা। আবিদ ভ্রুকুঁচকায়। ব‍্যাপারটা সন্দেহ জনক লাগছে তার। আসফি আর প্রজ্জ্বলিনী এখানকার বদ্ধ রুমে কেনো যাবে? সে বিষয়টি মাথায় রাখল। আবিদ তার লোকজনকে আসফির উপর কড়া নজর রাখতে বলে চলে যায়।

আবিদ সিংহাসনের ন‍্যায় সোফাতে বসে আছে। তার পাশে বন্ধুরা বসে আছে। হঠাৎ আদিবা এসে চিন্তিত হয়ে আবিদের কানে কানে কিছু বলে। আবিদ চোখ মুখ শক্ত করে দ্রুত উঠে পড়ে। বন্ধুরা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালে আবিদ জানায় একটু দরকার আছে। এদিকে দর্শিনীকে রুমে না পেয়ে প্রিয়মা বেগম দুশ্চিন্তা করছিলেন। মেয়েটা তার কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেলো? ঘটনাটা বাহিরে জানাতে চাননা তিনি। লোকজন জানলে উল্টাপাল্টা ভাববে। ভালো মেয়েটার নামে কলঙ্ক লটে ছড়িয়ে দিবে। আদিবা দর্শিনীকে দেখতে এসে খুঁজে পায়নি। প্রিয়মা এতে ভয় পেয়ে যান। আদিবাকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলেন। আদিবা অনেক খুঁজেও দর্শিনীকে না পেয়ে দ্রুত আবিদকে জানায়। আবিদ মুহূর্তেই সেই রূমে এসে প্রিয়মা বেগমকে জিগ্যেস করে,

‘দর্শিনী কোথায় আন্টি?’

‘প্রিয়দর্শিনী নেই বাবা! আমি অনেক খুঁজলাম আমার মেয়েটা এখানে নেই।’

আবিদ আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে। একটুপরেই বিয়ের জন‍্য ডাক পরবে আর এখানে দর্শিনী নেই মানে? নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে দর্শিনীর। নাহলে এমন করার কোন কারণ আছে?

‘আমার মনে হচ্ছে আপনারা ভালো করে খুঁজে দেখেননি। প্লীজ সব জায়গা খুঁজে দেখুন। আমার দর্শিনী এই বিয়ে ছেড়ে; আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে?’

প্রিয়মা বেগমের চোখ ছলছল করছে।

‘আমার মেয়েটা কোথায় গেলো? পালিয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে নয় প্রিয়দর্শিনী। অনেক ভালো মেয়ে আমার! এই বিয়েতে সে খুশি ছিল তবে কোথায় গেলো?’

‘আন্টি আমরা জানি দর্শিনী কেমন। প্লীজ চিন্তা করবেন না। সমস্যা যেমনই হোকনা কেনো আমি ঠিক করে দিবো। আপনি প্লীজ কাউকে জানাবেন না। কেউ যেন এদিকে না আসে এইটা একটু দেখবেন। আমি দেখছি কী করা যায়।’

আবিদ প্রিয়মা বেগমকে টেনশন করতে মানা করে। আর বাহিরে কোন বাহানা দিতে বলে। প্রিয়মা বেগম চলে গেলে আবিদ আদিবাকে বলে,

‘তুমিও বাহিরে যাও। সবার সঙ্গে স্বাভাবিক থাকবে কেউ যেন কিছু টের না পায়। আমার মনে হচ্ছে কোন সমস্যা হয়েছে। আসফি প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোনো সমস্যা ক্রিয়েট করেছে।’

আদিবা জানে আসফি দর্শিনীকে পছন্দ করে এজন‍্য তার ভাই সমস্যা তৈরি করতে পারে অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু প্রজ্জ্বলিনীর ব‍্যাপারটা বুঝল না সে। অগ‍্যতা ভাইয়ের কথা মতো বাহিরে বেরিয়ে যায়। আবিদের টেনশন মাথা ফেটে যাচ্ছে। তখন গার্ডরা আসফি আর প্রজ্জ্বলিনীকে দেখেছে। এরপরেই দর্শিনী নিখোঁজ। তারা নিশ্চয় কিছু করেছে। আবিদের তাদের উপর রাগ হচ্ছে। আবিদ পেশীবহুল হাতটা মুঠো করে সোজা গিয়ে প্রজ্জ্বলিনীর রুমের দরজায় ধাক্কা দেয়। আসফি বাহিরে আছে তাই তাকে প্রজ্জ্বলিনীর কাছেই আসতে হলো। এখানে দর্শিনীর মান সম্মান জড়িয়ে আছে। দরজা ধাক্কানোর শব্দে প্রজ্জ্বলিনী ভয় পেয়ে যায়। এমনিতেই অন‍্যায় করার পর তার পাপ বোঁধ হচ্ছিলো। বোনের সঙ্গে এমন অন‍্যায় করার পর থেকে তার শ্বাসরোধ হয়ে আসছিলো। প্রজ্জ্বলিনী ভাবে এতোক্ষণে সবাই কী জেনে গেলো প্রিয় নিখোঁজ? প্রজ্জ্বলিনী ভয়ে ভয়ে রুমের দরজা খুলে দেয়। সামনেই আবিদকে রাগান্বিত অবস্থায় দেখে কেঁপে উঠে। আবিদ কোন কথা ছাড়ায় সর্ব শক্তি দিয়ে চার পাঁচটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। প্রজ্জ্বলিনীর ফর্সা গালটা জ্বলে যাচ্ছে। ব‍্যাথা আর ভয়ে একদম নিভে গেছে মেয়েটা। পেটের উপর হাত রেখে হঠাৎই শব্দ করে কেঁদে ফেলে। এতো জোরে থাপ্পড় মারবে আবিদ সে কল্পনা করেনি। আবিদের ইচ্ছে করছে প্রজ্জ্বলিনীকে আরো কয়েকটা দিতে। কিন্তু প্রজ্জ্বলিনী প্রেগন‍্যান্ট বলে চুল খামচে নিজের রাগ আয়ত্বে নিয়ে নিলো।

‘দর্শিনী কোথায়? আল্লাহর কসম প্রজ্জ্বলিনী! আপনি যদি চুপ থাকার নিয়ত করে থাকেন আপনাকে আমি মেরে ফেলবো যাস্ট।’

প্রজ্জ্বলিনী গালে হাত দিয়ে কাঁদছে। তার এখন সব স্বীকার করতে মন চাইছে; কিন্তু আবিদের উপর রাগের জন‍্য পারেনা। প্রজ্জ্বলিনী আবিদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আপনি স্বার্থপর! প্রতারক আমার সঙ্গে প্রতারণা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আপনার ইচ্ছে পূরণ হওয়ার আগেই আমার বিয়েটা হয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ সেদিন বিয়েটা হয়েছিল বলে উজানের মতো লাইফ পার্টনার পেয়েছিলাম। এখন আমার আফসোস হয় আবেগে বসে কেনো আমি আপনার জন‍্য পাগলামো করেছিলাম। তিনবছর ধরে আপনাকে আমি একবারের জন‍্য মনে করিনি। তবে আমার নিষ্পাপ বোনের লাইফে কেনো আসলেন? নাটক করতে আসছেন? তার সঙ্গে প্রতারণা করতে? আপনি কী ভেবেছেন আমি আপনার সম্পর্কে জানিনা? আপনি ক্ষমতার বড়াই দেখিয়ে সবাইকে পদতলে পিষে ফেলেন। আপনার সম্পর্কে সব আমার জানা। আমি এমনও শুনেছি বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আপনার উঠাবসা। তাদের সঙ্গে আপনার সখ‍্যতা আছে। এর মানে স্পষ্ট আপনার জীবনে ঝুঁকি রয়েছে। আপনি ভাবলেন কীভাবে আমি আপনার মতো খারাপ লোকের সঙ্গে প্রিয়র বিয়ে হতে দিবো? আপনি অহংকারী, স্বার্থবাদী, প্রতারক আমার তো মনে হয় আপনি নিজেকে বাঁচানোর জন‍্য মানুষ খুন করতেও দ্বিধান্বিত হবেন না। প্রিয়কে আপনি ডিজার্ব করেননা! কখনোই না।’

প্রজ্জ্বলিনী অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে কথা শেষ করলো। আবিদের অলরেডি হাত উঠে গেছে। শক্তিশালী আরেকটা থাপ্পড় খেয়ে প্রজ্জ্বলিনী ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছে। গাল প্রচন্ড জ্বলছে। আবিদ সেইভাবে দাঁড়িয়েই বলে,

‘আপনি যে কতো বড় অজ্ঞ তার পরিচয় দিলেন। এ থাপ্পড় গুলো আপনার প্রাপ‍্য ছিল। আরেই! আপনাকে তো আমি বলেছিলাম আমি আপনাকে ভালোবাসিনা। আমার স্বপ্নকন‍্যা আছে। আপনি যখন আমার জন‍্য চিঠি লিখতেন পাগলামি করতেন আমি কী প্রশ্রয় দিয়েছি? দেখেছেন কোনদিন? আপনি সেই সময় টিনএজ গার্ল ছিলেন। এই বয়সে মেয়েদের আবেগ থাকে। আমি তো আপনাকে স্বাভাবিকভাবে বুঝিয়ে পিছু ছাড়াতে চেয়েছিলাম। আমার অ‍্যাসিস্টেনকে দিয়ে আপনার চিঠির উত্তর পাঠিয়েছিলাম। যাতে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। তারপরেই আপনার বিয়ের খবর শুনি। আপনার বাগদানের পরেরদিন আমিতো বলেছিলাম আপনাকে ভালোবাসিনা তারপরও এতো বিদ্বেষ? এতো বিদ্বেষ কী আমার প্রাপ‍্য ছিল? আমার সেই স্বপ্ন কন‍্যা অন‍্য কেউ না প্রিয়দর্শিনী। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার উদ্ভুত ভাবে। নিজের স্বপ্নকন‍্যাকে যখন বাস্তবে দেখতে পাওয়া যায় কেমন ফিল হয় জানেন? আমিতো মারাত্মক খুশি হয়েছিলাম। সারাজীবন স্বল্পভাষী গম্ভীর ছিলাম। কিন্তু দর্শিনীকে দেখার পর আমার সবকিছু চেন্জ হয়ে গেছিলো। আগের আমিটা এখন প্রাণখুলে হাসতে পারি। দর্শিনীকে আমার সবসময় মনে পড়তো। অশান্তিতে থাকতাম তাকে কল্পনা করে। অবশেষে তার খোঁজ খবর নেই। জানতে পারি আশরাফ আঙ্কেলের ছোট মেয়ে! আপনার ছোট বোন। নিজেকে তবুও আঁটকাতে পারিনি তাকে একবার দেখার জন‍্য বারবার ছুটে যেতাম। মাস্ক লাগিয়ে তাকে অনেক ফলো করেছি। আমার সুদর্শিনী বুঝতেই পারতো না তাকে একবার দেখে কারো বুকে প্রশান্তির ছোঁয়া বয়ে যায়। আরো কী কী বললেন প্রতারক, নাটক? শুনুন! আপনার ঠুনকো আবেগের সঙ্গে অন‍্যকারো ভালোবাসা, প্রশান্তি মেলাবেন না। আমি বরাবরই স্ট্রেইট ফরয়ার্ড কিন্তু অহংকারী নই। আমার কাছে অন‍্যায় এর স্থান নেই। অন‍্যায় করলে শাস্তি পেতে হয়। সেটা আমার কাছে হোক নতুবা অন‍্য কোন মাধ‍্যমে। আপনি ঠিক বলেছেন আমার বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ‍‍্যতা আছে কিন্তু সেটা আমার প্রফেশনের দিক দিয়ে। পার্সোনাল লাইফকে যথাসম্ভব দূরুত্বে বজায় রাখি। আরেকটি কথা কী বললেন আপনি? যে আমি নাকি খুন করতে দ্বিধান্বিত হবো না? একদম ভুল! তবে কেউ যদি আপনাকে আঘাত করে তাকে পাল্টা আঘাত করতে হয়। এটাই যুদ্ধ কৌশলের নিয়ম। আমি জানিনা! যে সত্যিই আমি দর্শিনীকে ডিজার্ব করি নাকি করিনা। তবে মনে রাখবেন সে একান্তই আমার! প্রিয়দর্শিনী শুধুমাত্র আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর।’

প্রজ্জ্বলিনী বিছানায় বসে নিশ্চুপ হয়ে সবটা শুনলো। তার আর কিছু বলার রইল না। আবিদকে সে ভুল বুঝে আসছে এটা তো প্রমাণিত হয়েই গেল। বরং না বুঝে প্রজ্জ্বলিনী আবিদকে প্রতারক, খারাপ, খুনি বাজে লোকেদের সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছে। আগে থেকে প্রজ্জ্বলিনী অপরাধ বোঁধ জেগে উঠেছিল। এখন আবিদের এতো লম্বা অনুরক্তি শুনে তার আরো কান্না পাচ্ছে। গালটা ব‍্যাথা করছে। জোরে কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আবিদ নিশ্চয়ই অনেকদিনের রাগটা ঝাড়তে পেরে খুশি হয়েছে। প্রজ্জ্বলিনী এবার নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিয়ে বলে তুই ডিজার্ব করিস প্রজ্জ্বলিনী। তোর অন‍্যায়ের শাস্তি ছিল এটা। আবিদ বড় সড় শ্বাস ফেলে বলে,

‘প্রজ্জ্বলিনী তোমার শত্রুতা আমার সঙ্গে। শাস্তি দিতে হলে আমাকে দেও। আমার দর্শিনী নিষ্পাপ! আমার জন‍্য কেনো তাকে কষ্ট দিচ্ছো? দর্শিনী আমি একে অপরকে ভিষণ ভালোবাসি। আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করছি আমাকে দর্শিনীর খোঁজ দাও। প্লীজ কোথায় দর্শিনী বলো আমাকে।’

আবিদের দর্শিনীর জন‍্য এমনভাবে অনুরোধ করা দেখে প্রজ্জ্বলিনীর চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নিজের বোন হয়ে অজান্তে বোনের ভালোবাসাকে দূর করে দিতে চেয়েছিল দর্শিনী। নাজানি প্রিয় কতোটা কষ্ট পেয়েছে, হয়তো এখনো পাচ্ছে ভেবে প্রজ্জ্বলিনী ফুঁপিয়ে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে আবিদকে শুরু থেকে সবটা বলে দিলো। আসফি কীভাবে তাকে কথার জালে ফাঁসিয়ে কার্য হাসিল করতে চেয়েছিল। তারা দুজনে মিলে দর্শিনীকে আটঁকে রাখতে চেয়েছিল। আবিদের সঙ্গে বিয়েটা ভেঙ্গে আসফি প্রিয়দর্শিনীকে জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আবিদ সবটা শুনে নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে চাইলো। আবিদের সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে দর্শিনীকে উদ্ধার করা। দ্বিতীয়ত বিয়েটা হয়ে গেলে আসফিকে যোগ্য শাস্তি দেওয়া। প্রজ্জ্বলিনী আবিদকে ইশারা করলো তার সঙ্গে যেতে। আবিদ প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে একটা তালাবদ্ধ রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে দর্শিনীর মৃদু গোঙ্গানোর আওয়াজ আসছে। প্রজ্জ্বলিনী দ্রুত রুমটা খুলে দেয়। আবিদ দর্শিনীকে বিছানায় হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় দেখে স্তব্দ হয়ে যায়। এই দৃশ‍্যটা তার বুকে দহন অনুভব করাচ্ছে। দর্শিনী অনাবরত হাতের বাঁধন মুচড়ে যাচ্ছে। মুখ বাঁধার কারণে শব্দ করতে পারছে না। শুধু উমউম শব্দ করছে। চোখের কোণে অশ্রু বিন্দু চকচক করছে। আবিদ এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দৌঁড়ে দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরে। একে একে হাত মুখের বাঁধন খুলে দেয়। প্রিয়দর্শিনী আবিদকে জড়িয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেলে। দর্শিনী জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এতোক্ষণ হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় ছিল। সে ভেবেছিল হয়তো শ্বাস রোধ হয়ে মারা যাবে। আবিদ দর্শিনীর চোখের পানি মুছে দেয়। মুখে, কপালে, গালে অসংখ্যবার পাগলের মতো চুমু দেয় আবিদ। আবিদ প্রজ্জ্বলিনীর সামনেই দর্শিনীর ঠোঁটে চুমু দেয়। দর্শিনী দরজার কাছে দাড়ানো প্রজ্জ্বলিনীকে খেয়াল করেনি। দর্শিনী তখনো ফুঁপিয়ে কান্না করছে। এদিকে প্রজ্জ্বলিনী বোনকে এভাবে দেখে অশ্রুসিক্ত হয়। ভিতরে ভিতরে বোনের কষ্টে সে ব‍্যাথিত,অনুতপ্ত। দর্শিনী আবিদকে অভিযোগের সুরে বলে,

‘আ..আসফি ভাইয়া আমাকে এখানে আটঁকে রেখেছেন। আমি যখন রুমে একা ছিলাম উনি এসেছিলেন প্রথমে উনাকে দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। তারপর উনি ক্লোরোফম দিয়ে আমাকে অচেতন করে দেয়। আমার আর কিছু মনে নেই। একটু আগে জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে এই রুমে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পাই। আমি প্রচুর ভয় পেয়ে গেছিলাম। চিৎকার করতে চাইছিলাম কিন্তু মুখ বেঁধে রাখার জন‍্য পারিনি। আমার সঙ্গে কী শত্রুতা উনার? কেনো এমন করলো?’ দর্শিনী আবারো কাঁদতে থাকে। আবিদ বলে,

‘আর কাঁদবেন না হুসস। কিচ্ছু হয়নি সব ঠিক আছে আসফিকে আমি শাস্তি দিবো প্রমিস। এভাবে কাঁদলে বিয়ের সাজ নষ্ট হয়ে যাবে। অলরেডি হাফ পার্সেন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। ঐদিকে দেরী হয়ে যাবে। আপনি এখুনি প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে যাবেন। আবার নতুন করে তৈরি হবেন ওকে? দ্রুত যান বেশি সময় নেই। আমি কবুল বলার জন‍্য অপেক্ষায় আছি।’

দর্শিনী আবিদকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তড়িঘড়ি করে প্রজ্জ্বলিনীকে ডেকে নিজের রুমে চলে যায়। এদিকে প্রজ্জ্বলিনী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আবিদের দিকে তাকিয়ে রয়। আবিদ চাইলেই প্রজ্জ্বলিনীর ব‍্যাপারটা বলে দিতে পারতো। কিন্তু আবিদ চায়না দর্শিনী নিজের বোনকে ভুল বুঝুক। তার দর্শিনী এতে কষ্ট পাবে। প্রজ্জ্বলিনী আবিদের উদ্দেশ্যে বলে,

‘আমার অজান্তেই করা সব ভুল ক্ষমা করবেন প্লীজ। আমি না জেনে বুঝে অনেক ভুল করেছি। আপনাকে আজেবাজে কথা শুনিয়েছি। আপনি আমাকে ক্ষমা না করলে শান্তি পাবোনা আমি। প্লীজ ক্ষমা করবেন। আর হ‍্যাঁ প্রিয়র কাছে সবটা গোপন করার জন‍্য কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন। ধন্যবাদ আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী।’

#চলবে

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__২৮
#বিয়ে_স্পেশাল

কারুকাজ করা লাল লেহেঙ্গা পড়ে হ‍াস‍্যজ্জ্বল মুখে দ্বিতীয়বার তৈরি হয়েছে প্রিয়দর্শিনী। খুবই কম সময়ের মধ‍্যে তাকে নতুন করে সাজতে হয়েছে। প্রজ্জ্বলিনী দায়িত্ব নিয়ে তাকে শুরু থেকে সাহায্য করেছে। একটু আগে প্রজ্জ্বলিনী যতটা অসস্থি বোঁধ করছিল এখন সেটা অনেকটাই কমে গেছে। নিজেকে হালকা অনুভব করছে সে। তীব্র অপরাধ বোঁধ থেকেই হঠাৎ তার দায়িত্বজ্ঞান জাগ্রত হয়েছে। আবিদের কয়েকটি থাপ্পড়ে বেচারী ঘাবড়ে গেছিলো সঙ্গে ভয়ও পেয়েছিল। একটু রেস্ট নেওয়া আবশ্যক তার। কিন্তু সেটা না করে; বসে থেকে দর্শিনীকে সাজাতে সাহায্য করেছে। এইমুহূর্তে প্রজ্জ্বলিনীর একটাই চাওয়া আবিদ দর্শিনীর বিয়েটা যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ হয়ে যায়। সে অবচেতন মনে যথেষ্ট গিল্টি ফিল করছে। যেটা কমে যাবে দর্শিনীর আনন্দে।

প্রিয়দর্শিনীর লেহেঙ্গা, মেকআপ সবকিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে এবার ব্রাইডাল মেকআপ নয়; লাইট মেকআপ লুক তার। চুলগুলো সুন্দর করে স্টাইল করে মাথায় লাল টকটকে ভারী ওড়না দেওয়া হয়েছে। লাইট মেকআপ লুকে ফর্সা, স্নিগ্ধ দর্শিনীকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। প্রজ্জ্বলিনীর মনে হচ্ছে সাধারণ মেকআপে দর্শিনী সবার নজর কাড়তে বেশি সক্ষম। আদিবা দর্শিনীকে সাজাতে প্রজ্জ্বলিনীকে সাহায্য করেছে। মূলত আবিদ তাকে পাঠিয়েছিল প্রজ্জ্বলিনীকে সহায়তা করতে। আদিবা ঘটনা কী হয়েছে জানেনা। তবে এটা শিয়র তার ছোট ভাই কোন ঝামেলা করেছিল। দর্শিনী আয়নায় নিজেকে সুসজ্জিত অবস্থায় আরেকবার দেখে নেয়। সে মিষ্টিমধুর হেসে আদিবা আর প্রজ্জ্বলিনীকে ইশারা করে সব ঠিকঠাক আছে বলে। আদিবা প্রজ্জ্বলিনী সবশেষে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে। আধাঘন্টার মধ‍্যে সবকিছু কম্পিলিট হয়েছে। প্রজ্জ্বলিনী দর্শিনীর জোরাজুরিতে পাশের বেডে শুয়ে রেস্ট নিতে থাকে। ঐদিকে আবিদের কিছু কাজিন আসে দর্শিনীকে দেখতে। তারা ক‍্যামেরা দিয়ে অনেক গুলো ছবি তুলে নেয়। পরবর্তীতে আদিবা দর্শিনীকে নিয়ে যায় বিয়ের আসরে।

.

বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। দর্শিনী আর আবিদকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ব‍্যবধান একটা সাদা পর্দা। আবিদ অবশ‍্য সাদা পর্দা দিয়ে স্পষ্টত দর্শিনীকে দেখতে পাচ্ছে। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, ফর্সা ত্বকে লাইট মেকআপ অসাধারণ লাগছে আবিদের। দর্শিনীকে মন ভরে দেখছে আবিদ। সম্পূর্ণ লাল রঙে সেজেছে দর্শিনী। একদম লাল টুকটুকে বধূ। দর্শিনী আবিদের দিকে একবারো তাকায়নি; সে তখন থেকে মাথা নিচু করে আছে। দর্শিনীর অন‍্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। বিয়েটা হয়ে গেলেই তাকে চলে যেতে হবে ভেবে, খারাপ লাগা কাজ করছে। এই দিনটা মেয়েদের জন‍্য স্পেশাল আবার কষ্টের। বাবা মা পরিবার পরিজনদের ছেড়ে অন‍্যের বাড়ি যেতে হয় মেয়েদের। এই বাস্তবতা মেয়েদের জন্য বেশি কষ্টের। আবার স্বপ্নের নায়কের অর্ধাঙ্গিনী হবে ভেবে ভালোলাগাও কাজ করছে। অদ্ভুত অনুভূতি! আবিদ পর্দার ভেতর থেকে তাকে দেখেই যাচ্ছে। সে এভাবে সারাজীবন তাকিয়ে থাকতে পারবে তার সুদর্শিনীর দিকে। আবিদের পাশে তার বন্ধুরা বসে আছে। তারা সবার অগোচরে আবিদকে নিয়ে মজা করে যাচ্ছে। আনন্দমুখর পরিবেশে, পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহর করে কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে। কাজি সাহেব প্রথমে আবিদকে কবুল বলতে বলে। আবিদ একটু সময় নিয়ে তিন কবুল বলে দেয়। সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে। কাজি সাহেব পরবর্তীতে দর্শিনীকে কবুল বলতে বলে। দর্শিনী নিরাবতা পালন করে কিছুক্ষণ। কাজি অনেকবার কবুল বলতে বলেছে কিন্তু দর্শিনী কবুল বলছে না। আশরাফ মুহতাসিম এবং প্রিয়মা বেগম মেয়ের পাশে বসে তাকে কবুল বলতে ইশারা করে। দর্শিনী সবার অগোচরে অশ্রুসিক্ত হয়। আবিদ দর্শিনীর অবস্থা বুঝতে পারছে। এই কঠিন বাস্তবতা মেনেই মেয়েদের চলতে হয়। এইযে তার দর্শিনী কাঁদছে সে তখনও মুগ্ধ হয়ে দেখছে। এজন্যই বলে, যাকে আমরা ভালোবাসি তাকে সবরকম ভাবে আমাদের ভালোলাগে। একরাশ মুগ্ধতা কাজ করছে আবিদের। অবশেষে দর্শিনী সবার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে আবিদের নামে তিন কবুল বলে দেয়। সবাই দ্বিতীয়বার সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ বলে আনন্দে মেতে উঠল। আবিদের বন্ধুরা তাকে কনুই দিয়ে ঠেস মেরে কনগ্রাচুলেট করে। আবিদ সবার সঙ্গে মিষ্টি হেসে আবারো দর্শিনীর দিকে তাকালো। এবার দর্শিনী নিজেও তার দিকে তাকিয়েছিল। আবিদ কিছু একটা ইশারা করতেই দর্শিনী চোখ নামিয়ে নেয়। আবিদকে মনে হলো এতোক্ষণে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। দীর্ঘক্ষণ দর্শিনীকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে অন‍্যজগতে পৌঁছে গেছিলো সে। দর্শিনীর মুখে তার নামে স্বীকারোক্তি মূলক কবুল শুনে প্রফুল্ল লাগছে আবিদের। এখন আবিদ দর্শিনীর মাঝে কোন বাঁধা ব‍্যবধান নেই। তারা ধর্মীয় রীতিতে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। যেটা আল্লাহ প্রদত্ত সম্পূর্ণ হালাল বন্ধন। ইতিমধ্যে দুজনের মাঝে যে পর্দা ছিল সেটা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে তাদের রেজিস্ট্রি হয়। আবিদ সাইন করার পরে দর্শিনীর সময় আসে। দর্শিনীর হাত মৃদু কাঁপছিল। দর্শিনী আবিদের দিকে তাকিয়ে সাইনটা করে দেয়। আইনী পদ্ধতিতেও তাদের বিয়েটা সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ হয়। সবাই মোনাজাত ধরে, আবিদ দর্শিনীর জন‍্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। মোনাজাত শেষে সবাই মিষ্টি মুখ করতে ব‍্যাস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে আবিদ তখন দর্শিনীর হাত শক্ত করে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘এইযে হাত ধরলাম; আর কখনো ছাড়ব না বউ!’

দর্শিনী অকস্মাৎ কেঁপে ওঠে। নিজের সদ‍্য বিয়ে করা বরের মুখে, শীতল কন্ঠের বউ ডাকটা কতোটা ভয়াবহ দর্শিনী উপলব্দি করতে পারছে। যারা সদ‍্য বিয়ে করা বরের কাছে বউ ডাকটা শুনেছে; তারা জানে কেমন অনুভূতি হয়। দর্শিনীর মনে একঝাঁক প্রজাপ্রতিরা উরে বেড়াচ্ছে। দর্শিনী আবিদের উদ্দেশ্যে বলে,

‘হাত ছাড়ুন! এখানে সবাই আছে। কেউ দেখে ফেলবে।’ ___দর্শিনী হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে।

এদিকে আবিদ ভাবলেশহীন। দর্শিনীর হাত ছাড়েনা বরং শক্তিশালী বলিষ্ঠ হাতে আলতো করে চেপে ধরে। ফের দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে,

‘আমার সদ‍্য বিয়ে করা বউ! ছাড়ব না দেখলে দেখুক। আমি কী অন‍্যকারো বউয়ের হাত ধরেছি?’

দর্শিনী হাত ছাড়াতে ব‍্যার্থ হলে হাল ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর আবিদ এমনিতেই ছেড়ে দেয়। দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

‘আমার বউ!’

দর্শিনী মাথা নিচু করে রাখে। একটু আগে তার মনখারাপ ছিল। আবিদ মুহূর্তে সেই মন খারাপ দূর করে দিয়েছে। দর্শিনীকে নির্বিকার দেখে আবিদ দুষ্টুমি করে আবারো বলে,

‘আমার বউ!’

দর্শিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো করে বলে,

‘হুম!’

.
দুপুরে জুম্মার নামাজের সময় সব পুরুষরা পাশের বড় মসজিদে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে চলে যায়। মসজিদে জুম্মার নামাজ, খুতবা শেষে সবাই ফিরে আসে। তারপর শুরু হয় খাওয়া দাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। আশরাফ মুহতাসিম আর উজান সবটা সুন্দরভাবে আয়োজন করেছে। কমিউনিটি সেন্টারের বাহিরে, গরীব দুঃখিদের জন‍্যও খাবারের প‍্যাকেট দেওয়া হয়েছে। মোট কথা বিয়েটা সম্পূর্ণ ত্রুটি ছাড়া শেষ হয়। আসফি প্রয়োজনে একটু বাহিরে গেছিলো আবিদের গার্ডরা তাকে পুরোটা সময় নজরে রেখেছে। সে যখন ফিরে এসেছে; তখন জানতে পারে আবিদ দর্শিনীর বিয়ে হয়ে গেছে। আসফি ভাবতে পারছে না আবিদ প্রিয়দর্শিনীকে কীভাবে উদ্ধার করল? বন্ধ ঘরটার খবর কে দিলো আবিদকে? তার পুরো প্লানটা নষ্ট হয়ে গেছে; প্রিয়দর্শিনীকেও হারিয়ে ফেলেছে। মুহূর্তে আসফির চোখ অশ্রুতে চিকচিক করে উঠে। তার সাজানো প্লানটা নিখুঁত ছিলো; এভাবে আনসাকসেসফুল হয়ে গেলো কীভাবে? আসফির প্রজ্জ্বলিনীর উপর মারাত্মক রাগ হচ্ছে। প্রজ্জ্বলিনী বলেছিলো বিয়েটা আটঁকাবে, তবে এসব কী? তার সঙ্গে নাটক করলো প্রজ্জ্বলিনী? এতোকিছুর পরে আবিদের আনন্দ দেখে আসফির সহ‍্য হচ্ছিলো না। সে কাউকে কিছু না বলে অগোচরে চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে যায়। কেউ তাকে আর দেখেনি; খেয়ালও করেনি।

রৌদ্রতপ্তহীন বিকালে দর্শিনীকে বিদায় দেওয়ার জন‍্য প্রস্তুত আশরাফ মুহতাসিম সহ আত্মীয়স্বজনরা। বিদায় মুহূর্তে দর্শিনী কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ প্রায়। আশরাফ মুহতাসিম, আহমেদ মুহতাসিম, প্রিয়মা বেগম সবার চোখে পানি। দর্শিনীকে, আশরাফ সাহেব আর প্রিয়মা বেগম বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। প্রজ্জ্বলিনীও দর্শিনীর বিদায়ের সময় রুম থেকে বের হয়ে কান্না করছে। প্রিয়মা বেগমের নির্দেশে উজান তাকে থামানোর চেষ্টা করে। আজকে তার উপর অনেক অনেক ধকল গেছে। এমনকি তার মুখে তখনকার থাপ্পড়ের হালকা লাল আভা বোঝা যাচ্ছিলো। উজান ভেবেছে কান্নার জন‍্য এমনটা হয়েছে। সে শুধু নরম গালটায় হাত বুলিয়ে দেয়। উজান প্রজ্জ্বলিনীকে ধরে দূরে নিয়ে গিয়ে বোঝায়,

‘প্রিয়দর্শিনী আবারো আসবে। একেবারের জন‍্য যাচ্ছে না নিদ্রিতা। এভাবে কান্না করোনা বাচ্চার ক্ষতি হবে তো।’

বাচ্চার কথা ভেবে প্রজ্জ্বলিনী চুপ করে যায়। হঠাৎ তার মাথা ঘুরে উঠে। উজান তাকে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের রুমে চলে যায়। প্রিয়দর্শিনী জানলে টেনশন করবে; হয়তো শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইবে না ভেবে কাউকে কিছু বলেনা। এদিকে দর্শিনীর চোখ মুছিয়ে আশরাফ মুহতাসিম আবিদের হাতে তার হাত তুলে দিয়ে বলে,

‘আমার আম্মাকে সম্মানে সঙ্গে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা। তুমি তাকে কখনো কষ্ট পেতে দিওনা। তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমি আজ থেকে তোমাকে দিলাম।’

আবিদ দর্শিনীর হাত ধরে বলে,

‘ইনশাআল্লাহ বাবা! আমি সবসময় আমার স্ত্রীর প্রতি সবরকম দায়িত্ব পালন করবো। তাকে কখনো কষ্ট পেতে দিবোনা সর্বদা রক্ষা করবো।’

ইতিমধ্যে অন‍‍্যান‍্য গাড়িতে সব বরযাত্রী উঠে গেছে। শুধু আবিদ দর্শিনী শাহরিয়ার সাহেব আর অনুসা বেগম এখনো উঠেনি। শাহরিয়ার চৌধুরী আশরাফ মুহতাসিমকে শান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। অনুসা বেগমও দর্শিনী আর প্রিয়মা বেগমকে কাঁদতে নিষেধ করেন। সবশেষে শাহরিয়ার চৌধুরী এবং অনুসা বেগম আলাদা আরেকটি গাড়িতে চড়ে বসেন। এদিকে আবিদ আশরাফ মুহতাসিমের ইশারায় দর্শিনীকে জোর করেই গাড়িতে বসাতে বাধ‍্য হয়। মেয়েটা ননস্টপ কান্না করে যাচ্ছিলো গাড়িতে উঠতে চায়ছিল না। এজন্যই আশরাফ মুহতাসিম আবিদকে গাড়িতে তুলে নিতে ইশারা করে। যাওয়ার আগে দর্শিনী দাদু আহমেদ মুহতাসিমকে নিজের খেয়াল রাখতে বলে যায়। আবিদের বন্ধু গুলো অলরেডী অনুষ্ঠান শেষে চলে গেছে। এজন্য আবিদ দর্শিনী ফুল দিয়ে সাজানো মার্সিডিজ গাড়িতে সম্পূর্ণ একা। সামনে শুধু একজন ড্রাইভার আছে।

[ নোট ~ কালকে অনেকেই বলেছেন প্রজ্জ্বলিনীকে কঠিন শাস্তি দিতে। একজন প্রেগন‍্যান্ট মহিলাকে দু’চারটা থাপ্পড় ছাড়া বাড়াবাড়ি রকমের শাস্তি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তার দোষ ছিল কিন্তু এখানে ভুল বোঝাবুঝি ছিল। আমি ক্লিয়ার করেছিলাম ২৩-২৪ পর্বে আপনারা পর্বগুলো স্কিপ করেছেন। আর হ‍্যাঁ, প্রজ্জ্বলিনী এবং আসফির অন‍্যায়ের কথা সবাইকে জানানোর বিষয়টি আমি সুবিধার্থে স্কিপ করেছি। নাহলে বিয়েতে সমস্যা হতো। দেখা গেলো বিয়েটাই আটঁকে গেছে। দর্শিনী সব জানতে পেরে নিজেই আটঁকে দিয়েছে। আর এটা আপনারা কেউ চাননা। আমিও চাইনা। আমি এভাবেই সাজিয়েছিলাম প্লটগুলো ]

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে