#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব___২০
অপরাহ্ণের শেষ সময়। আবিদ ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে দর্শিনী নিশ্চুপ। দর্শিনী নির্বিঘ্নে আবিদের দিকে দৃষ্টিপাত করছে। যখনই আবিদ দর্শিনীর দিকে তাকায় দর্শিনী নজর সরিয়ে নেয়। আবিদের চোখে মুখে দু’ষ্টু হাসি। আবিদ মনোমুগ্ধকর হেসে দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে,
‘জানেন আমি অনেক আগে নিজস্ব ডায়রীতে হৃদয়ের গহীনে শব্দচয়ন খুঁজে দুলাইন কবিতা লিখেছিলাম। আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার জন্য। অনেক আগের ঘটনা এটা তখন আপনি আমার জীবনে ছিলেন না। আর অবিশ্বাস্য ঘটনা কী জানেন? আমার স্বপ্নে দেখা মেয়েটি আপনিই ছিলেন, কিন্তু আবছা। অবিশ্বাস্য হলেও আমি যেমন রাজকন্যা কল্পনা করেছিলাম আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে গেছে। তারপর আপনাকে যখন বাস্তবে দেখলাম একটু অবাক হয়েছিলাম। অনেক আশ্চর্যের বিষয় ছিল আমার কাছে। কাউকে বাস্তবে দেখার আগে স্বপ্নে কল্পনা করা বিরল ঘটনা। এটা আমার সঙ্গে ঘটেছে। কেনো কিসের জন্য আমি কিছু জানিনা। তখন থেকে আমি আপনাকে নিয়ে ভাবতাম। আপনাকে সবসময় মনে পড়তো। আমি আপনাতে মত্ত থাকতাম। তখন থেকে আপনাকে নিজের করতে চাইতাম। আপনি অনেক আগে থেকে আমার হৃদয়ে ছিলেন। দর্শিনী! আপনি কী শুনতে চান সেই কবিতা?’
দর্শিনী আঁখিদ্বয়ের বিস্ময়কর চাহনী আবিদকে পরোক্ষ করছে। আবিদ সেই বিস্মিত চাহনী দেখে হাসে। দর্শিনী আবিদের দিকে উৎসাহ নিয়ে তাকায়। অনেক আগ্রহী সে।চোখেমুখে তার বিস্ময়কর অবস্থা ফুঁটে উঠেছে। আবিদ দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
‘তুমি সকালের মিষ্টি রোদ হয়ে দৃশ্যমান হও, আমি তোমাকে শরীরে মাখিয়ে প্রাণচ্ছল হাসতে থাকবো। তুমি শ্রাবণের বারী ধারার মতো ছুঁয়ে যাও, আমি তোমার মাঝেই শীতলতা খুঁজে নিবো। তুমি বৃষ্টি শেষে রংধনুর সাত রঙে দৃশ্যমান হও, আমি তোমাতেই আমার স্বপ্ন সাজাবো। আমি তেমন কিছু চাইনা আমার একটা তুমি চাই। যাকে হৃদয়ে সযত্নে লুকিয়ে রাখবো।’ ______আবিদ বুকের বাঁপাশে হাত রেখে আবারো বলে,
‘আমার সেই সুদর্শিনী রাজকন্যা আপনি ম্যাম। যে এখন আমার কাছে সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। দর্শিনী আপনি আমার অন্যতম অসুখ। যে অসুখ থেকে আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী কখনো সুস্থ হতে চায়না। কারণ সুস্থ হলেই যে নৃ’সংশ মৃ’ত্যু অবধারিত। আমি আপনাকে তুমি করে বলার অপেক্ষায় রয়েছি। আর কয়েকটাদিন তারপর আপনি আমার হবেন।’
দর্শিনী আবিদের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে। আবিদ মনোমুগ্ধকর হাসছে। দর্শিনী মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সবটা শুনছে কিন্তু প্রতিত্তর করতে পারেনি। সে কী প্রতিত্তর করবে? দর্শিনী আবিদের অনুভূতিকে প্রতিত্তর করে পরিমাপ করতে চায়না। আবিদের তার দর্শিনীর জন্য অনুভূতি অশেষ। দর্শিনী নিজেও তো স্বপ্ন পুরুষকে চায়। তার স্বপ্ন পুরুষ আর কেউনা স্বয়ং আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী। এটা ভেবেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে দর্শিনীর।
–
মুহতাসিম ভিলা,
ড্রয়িং রুমে পিনপতন অবস্থা। প্রিয়মা বেগমের চাচাতো বোন রেহানা বেগম পুত্রের জেদের কাছে হার মেনে দর্শিনীকে চেয়েছেন। সবকিছু জানা সত্ত্বেও। আশরাফ মুহতাসিম থমথমে মুখে বসে রয়েছেন। প্রজ্জ্বলিনী ছাড়া বাকি সবাই হতাশ এমন প্রস্তাবে। দর্শিনীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। রাত পেরুলেই যেখানে বাগদান সম্পূর্ণ হবে। বিয়ের জন্য ডেট ফিক্সড করা হবে। সেখানে আজকে এমন প্রস্তাব অযৌক্তিক। আশরাফ মুহতাসিম চৌধুরী পরিবারকে কথা দিয়েছেন। কথা খেলাফ করার মতো মানুষ তিনি নন। তাই যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে তিনি রেহানা বেগমকে বুঝিয়ে নাকচ করে দেন। রেহানা বেগমের আর কিছু বলার বাকি নেই। নিহাল যেমনটা আশা করেছিল তেমন কিছুই হয়নি বরং নিরাশ হতে হয়েছে। বয়স্ক আহমেদ মুহতাসিম নিহালের পাশে বসে বেশ ভালো করে বুঝিয়েছেন। রেহানা বেগম, প্রিয়মা বেগম ও নিহালকে ভালো করে বোঝালেন। সবার অগোচরে নিহালের দু’চোখে অশ্রু জমা হয়। হয়তো কারো চোখে দৃশ্যমান হয়নি। ছেলেদের চোখের পানি এতো সহজে গড়িয়ে পড়ে না। নিহাল বুঝতে পারছে সে বড্ড দেরী করে ফেলেছে। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর আগে কেনো সে আসেনি দর্শিনীর জীবনে? তাহলে হয়তো এতটা খারাপ লাগতো না। নিজের ইচ্ছে চাওয়া সবটা বুঝতে দেরী হয়ে গেছে। দর্শিনী এখন তার হবেনা। প্রজ্জ্বলিনী নিহালের জন্য কষ্ট পায়। সে বাবার কাছে সুপারিশ করেছিলো নিহালের জন্য কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আশরাফ সাহেব স্পষ্টত জানিয়েছে আবিদ দর্শিনীকে ভালোবাসে। আবিদ কিছুতেই এমনটা হতে দিবেনা। আশরাফ সাহেব নিজেও এমনটা চায়না। ওয়াদা ভ’ঙ্গ করতে কোন সুস্থ মানুষ অন্তত পারেনা। রেহানা বেগম শুরু থেকে ছেলের পক্ষে ছিলেন কারণ তিনি ছেলের ভালো চাইতেন। এখন সবটা জানার পর নিজেই ছেলেকে ওয়াদা করিয়েছেন কোন রকম ঝামেলা যেন না করে। নিহাল তীব্র মনোঃকষ্টে মুহতাসিম ভিলা থেকে বেড়িয়ে যায়। রেহানা বেগম ছেলের এমন অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেন। স্বামীহারা জীবনে ছেলেই একমাত্র সম্বল তার। নিহাল যদি প্রথমেই তাকে জানাতো তবে ছোটতেই দর্শিনীর সঙ্গে বাগদান করিয়ে রাখতো। কিন্তু এখন কিছু করা সম্ভব নয়। এই প্রথম ছেলের কোন চাওয়া অপূর্ণ রাখলেন তিনি। প্রিয়মা বেগম বোনকে শান্ত্বনা দিলেন। রেহানা বেগম সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাইরে আসেন। নিহাল বাহিরে গাড়িতে বসে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রিয়মা বেগম আর আশরাফ মুহতাসিম রেহানা বেগমের সঙ্গে বাহির পযর্ন্ত আসলেন। আশরাফ মুহতাসিম তাদের থাকতে বলেন কিন্তু নিহাল থাকতে রাজি হয়নি। তার ভিতর বিশ্রীভাবে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এখানে থাকলে দর্শিনীকে দেখলে আরো কষ্ট পাবে তাই ব্যাস্ততা দেখিয়ে ফিরে যায়। ওদের গাড়ি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবিদের গাড়ি গেটে প্রবেশ করে। বাহিরে বাবা মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দর্শিনী অবাক হয়। আবিদ গাড়ি থেকে নেমে দর্শিনীর পাশের দরজা খুলে দেয়। আবিদ শপিং ব্যাগ, ফলমূল গুলো বের করতে থাকে।একজন দাড়োয়ান আবিদকে সাহায্য করে। আশরাফ মুহতাসিম আবিদকে ভিতরে যেতে বলেছিল। কিন্তু আবিদ ব্যাস্ততার জন্য বাহির থেকেই চলে যায়। দর্শিনী আবিদকে বিদায় জানিয়ে বাবা মার সঙ্গে ভিতরে চলে আসে। বাড়িতে সবাইকে গম্ভীর দেখে দর্শিনী কারণ জিগ্যেস করলে কেউ তাকে কিছু বলেনি। আশরাফ সাহেব তাকে আজকের ঘটনা আর নিহালের ব্যাপারে জানাতে চায়নি। বিষয়টি খুবই সেন্সিটিভ ছিল। দর্শিনী জানতে পারলে দুঃখ পাবে। তাছাড়া এমনিতে প্রজ্জ্বলিনী আর দর্শিনী নিহালকে সারাজীবন ভাইয়ের চোখে দেখে এসেছে। এখন এসব জানলে বাজে ভাবে ইফেক্ট করবে দর্শিনীর। তাই তিনি সবাইকে নিষেধ করে দেন দর্শিনীকে জানাতে।
বাবার সিদ্ধান্তে প্রজ্জ্বলিনী একদম নাখুশ।প্রজ্জ্বলিনী ভাই হিসাবে নিহালকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে। হ্যাঁ প্রথমে নিহালের দর্শিনীকে পছন্দ করার ব্যাপারটায় প্রচন্ড অবাক হয়। তবুও প্রস্তাব তো খারাপ ছিলনা। সরকারী মেডিকেলের ডাক্তার তার উপর পরিচিত ভাই। নিহালের সঙ্গে দর্শিনীর বিয়ে হলে মেয়েটা সুখী হতো। তার ধারণা অন্তত আবিদের মতো ধুরন্ধর লোকের হাত থেকে বেঁচে যেতো। হয়তো চৌধুরী পরিবারকে কথা দেওয়া ছিল কিন্তু বাগদান তো হয়নি। তাদেরকে একবার জানালেই পারতো আশরাফ মুহতাসিম।
দর্শিনীর অগোচরে এতোকিছু ঘটে গেছে দর্শিনী টেরও পায়না। সে ফুরফুরে মেজাজে নিজের রুমে চলে যায়। আশরাফ মুহতাসিম আর প্রিয়মা বেগম সব ভুলে কালকের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। উজান প্রজ্জ্বলিনীকে ঘরে রেখে শ্বশুরকে সঙ্গ দেয়। কাল সকাল থেকে কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে তারা। এখন কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ফেললে কালকের জন্য সহজ হবে। এদিকে প্রজ্জ্বলিনী সুযোগের অপেক্ষায় আছে। সুযোগ পেলেই দর্শিনীকে নিহালের ব্যাপারে জানাবে। দর্শিনীকে নিহালের ব্যাপারে জানাতে পারলে কিছুটা সুবিধাই হবে বলে তার ধারণা।
_
দর্শিনী শাওয়ার নিয়ে সবেমাত্র বের হয়েছে। চুল মুছতে মুছতে বেলকনিতে গিয়ে নিশ্চিন্তে বসে। হুট করে তার আবিদের কথা মনে পড়ে। আবিদের সব দুষ্টুমি, তার জন্য লেখা কবিতা সবকিছু মনে পড়ে।দর্শিনী রুমে গিয়ে আবিদের নাম্বারে টেক্সট করে পৌঁছে গেছে কিনা। অনেকক্ষণ পর আবিদ তাকে ফোন দেয়। এভাবে বেশকিছুক্ষণ কথা বলার পর আবিদ তাকে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে বলে ফোন রেখে দেয়। দর্শিনী ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। আজকের দিনটা দর্শিনীর জীবন অন্যতম একটা দিন ছিল।সারাদিন যা হয়েছে দর্শিনীর এক এক করে সব মনে পড়ছে। ঘুম কিছুতেই আসছে না। আবিদের সঙ্গে কাটানো মুহুর্ত গুলো বারবার মনে পড়ছে। মানুষটা তার জন্য কতোটা পাগল উপলব্দি করতে পারছে। দর্শিনী নিজেও আবিদের উপর ভিষণ ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যাস কালকে বাগদান হবে তারপর বিয়ে। বাগদান বলতে অর্ধেক বিয়ে ধরা হয়। আর কিছুদিন পর দর্শিনী স্বপ্নের নায়ককে স্বামী রূপে পেয়ে যাবে। ভাবনার মাঝেই ম্যাসেজের শব্দ পেয়ে দর্শিনী তৎক্ষণাৎ ফোনটা হাতে নেয়। আবিদ টেক্সট করেছে তাকে।
‘কোন কথা ছাড়া তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য সারাজীবন সময় পাবেন দর্শিনী। একদম রাত জাগবেন না। উপদেশ নয় আদেশ করছি। কালকে আপনি খুব সুন্দর করে সাজবেন। আর আমি আপনাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকবো।’____
শুধু এটাই লিখেছে আবিদ। দর্শিনী মিষ্টি করে হেসে চোখ বন্ধ করে নেয়। আবিদ তাকে না দেখেই কতো ভালো বুঝতে পারে। অন্যকেউ পারেনা কেনো?আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী দর্শিনীর কাছে রহস্যময় বটে। আবিদের কথা ভাবতে ভাবতে দর্শিনী ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায়।
_
চৌধুরী বাড়িতে,
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু আবিদের রুমে আলো জ্বলছে। আবিদ বেলকনিতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। আবিদ নিহাল সম্পর্কে কিছুক্ষণ আগে জানতে পেরেছে। সে মুহতাসিম ভিলার খোঁজখবর নিতে লোক ঠিক করে রেখেছিল আগে থেকে। দর্শিনীকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সময় দর্শিনীর বাবা মাকে বাহিরে দেখেই আবিদের সন্দেহ হয়েছিল। সেই সন্দেহ আরো গাঢ় হয় নিহালকে মুহতাসিম ভিলা থেকে যেতে দেখে। যখন খবর পেলো নিহাল তার মাকে নিয়ে এসেছিল দর্শিনীকে চাইতে। আর আবিদ দর্শিনীর বিয়েটা ভে’ঙ্গে দিতে। তখন আবিদের মাত্রাতিরিক্ত রাগ হচ্ছিলো। পরে যখন শুনলো আশরাফ মুহতাসিম তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আবিদ নিজেকে কোনরকম শান্ত হয়। আবিদ অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে নির্বিকারভাবে বলে,
‘আপনিতো আমাকে সবদিক দিয়ে পোড়াচ্ছেন সুদর্শিনী। আপনি শুধু সুদর্শিনী নন তেজস্বিনীও বটে। আপনার সরলতা, তেজস্বিনী রূপ সবাইকে দগ্ধ করছে, হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করছে, এটা আমার পছন্দ নয় দর্শিনী। আমার অপছন্দ এমন কাজ বারবার হতে পারেনা আমি সহ্য করিনা। আপনি শুধুমাত্র আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর ব্যাক্তিগত। আপনাতে দগ্ধ হওয়ার অধিকার একমাত্র আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীরই থাকবে। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী ব্যাতিত অন্যকারো না।’
#চলবে
#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব___২১ (প্রথম অংশ)
সকালের স্নিগ্ধ মনোমুগ্ধকর আবহওয়া। সঙ্গে ধোঁয়া উঠা উষ্ণ এককাপ কফিতে কোমল ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে সময়টা উপভোগ করছে দর্শিনী। বেলকনির ফাঁকা জায়গায় চেয়ারে বসে আছে সে। আজকের সকালটা অন্যরকম সুন্দর। মুহতাসিম ভিলায় তোড়জোড় করে আয়োজন শুরু হয়েছে। আজ আবিদ দর্শিনীর এঙ্গেজমেন্ট। আশরাফ মুহতাসিম আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখতে রাজি নয়। বেলকনিতে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দর্শিনী নিচে নামে। বাসার সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত। উজান প্রজ্জ্বলিনীকে জোর করে খাইয়ে দিচ্ছে। প্রজ্জ্বলিনী খাওয়ায় অনিয়ম করে প্রচুর। দর্শিনীকে নিচে নামতে দেখে উজান বলে উঠে,
‘স্নো হোয়াইট! আজকে কেমন বোঁধ করছো?’
দর্শিনী বুঝতে পারছে উজান তাকে নিয়ে মজা করছে। আজকের দিনে উজান দর্শিনীকে টিজ করবেনা এমনটা হতেই পারেনা। দর্শিনী কিছু না বলে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ে। প্রজ্জ্বলিনী সবটাই লক্ষ্য করছে, সে উজানের উপর একটু বিরক্ত হয়। উজানের আবিদের ব্যাপারে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি তার পছন্দ নয়। এরমধ্যেই শাহরিয়ার চৌধুরী আশরাফ মুহতাসিমকে ফোন করে জানিয়ে দেন তারা বিকালে রওনা দিবেন। দর্শিনী খাওয়া-দাওয়া শেষে নিজের রুমে চলে যায়। প্রজ্জ্বলিনী সুযোগ বুঝে দর্শিনীর রুমে আসে। প্রায় নানা গল্পের মাঝে প্রজ্জ্বলিনী দর্শিনীকে কালকের ব্যাপারে বলে। কাল নিহাল আর রেহানা বেগম এসেছিল দর্শিনীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। নিহাল তাকে পছন্দ করে শোনার পর দর্শিনীর ভ্রুকুঁচকে যায়। অদ্ভুত ভাবে তাকায় প্রজ্জ্বলিনীর দিকে। যেন কোন অপ্রাসঙ্গিক কথা শুনল। দর্শিনী বুঝতে পারছে না নিহাল সব জেনে শুনে কেনো এমন প্রস্তাব দিয়েছে। সেদিন আবিদ নিজে থেকে নিহালের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। নিহাল তো তার ভাই। কতো ভদ্র একটা ছেলে। দর্শিনীর ভাইয়ের প্রতি এমন ভ্রান্ত ধারণা কখনো ছিলোনা। দর্শিনী প্রজ্জ্বলিনীর উদ্দেশ্যে বলে,
‘নিহাল ভাইয়াকে আমি সবসময় ভাইয়ের চোখে দেখেছি আপু। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক আমার পছন্দ নয়। এমন চিন্তা উনি কীভাবে করতে পারেন। কাল ‘বিগ বাজারে’ আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী নিজে পরিচিত হয়েছিল উনার সঙ্গে। তবুও এমন প্রস্তাব দেওয়ার মানে কী? এটা চৌধুরী পরিবারের সবাই জানতে পারলে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে জানো?’___বলেই দর্শিনী প্রচন্ড অসস্থি অনুভব করে।
দর্শিনীর কথায় প্রজ্জ্বলিনীর মুখটা ভারী হয়ে আসে। বোনকে বুঝিয়ে বাগদান ভাঙতে চেয়েছিল সে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে দর্শিনী আবিদের উপর প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পড়েছে। ঠিক যেভাবে একসময় না চাইতেও সে দূর্বল হয়েছিল। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর জন্য চিঠি লিখে কতো পাগলামি করেছিল। প্রজ্জ্বলিনীর আগের কথা ভাবলে প্রচন্ড রাগ হয়। আবিদের প্রত্যাখান তাকে আরো বি’ষিয়ে তুলে। এখন তার আফসোস হয় কেনো সে কিশোরী বয়সে আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর প্রেমে পড়েছিল। প্রজ্জ্বলিনী পুরোনো কথা ভেবে চোখমুখ কুঁচকে নেয়। নিজেকে শান্ত করে দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে,
‘নিহাল ভাই তোকে পছন্দ করে। তার পছন্দের কোন দাম নেই তোর কাছে? নিহাল ভাই একজন ডাক্তার এতো শিক্ষিত। তোর জন্য যোগ্য তুই একটু ভেবে দেখ প্রিয়। নিহাল ভাই কতো কষ্ট পেয়েছে জানিস বাবার প্রত্যাখানে। তুই রাজি থাকলে আবিদ শাহরিয়ারের কিছু করার থাকবে না।’
দর্শিনী বুঝতে পারছেনা প্রজ্জ্বলিনী তাকে আজ এসব কথা কেনো বলছে। মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে দর্শিনী। প্রজ্জ্বলিনীর আবিদ শাহরিয়ারের প্রতি এতো রাগের কারণ জানেনা দর্শিনী। জিগ্যেস করলেও প্রজ্জ্বলিনী স্বীকার বা কিছু বলেনি কোনদিন। এদিকে দর্শিনী আবিদকে ব্যাতিত অন্য কারো সম্পর্কে ভাবতে পারেনা। সেখানে প্রজ্জ্বলিনীর নিহালকে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা ভালো লাগলো না। আবিদ দর্শিনী একে অপরকে ভালোবাসে সেখানে একতরফা ভালোবাসা কতটা যুক্তিযত? আত্মীয়দের মধ্যে সম্পর্ক আশরাফ মুহতাসিম এমনিতেও পছন্দ করেনা। দর্শিনীও ব্যাতিক্রম নয়। দর্শিনী বোনের উদ্দেশ্যে বলে,
‘আমি একা থাকতে চাই আপু। প্লীজ যাও এখন।’
প্রজ্জ্বলিনী রাগ করে উঠে আসে। মেজাজটা তার খারাপ হচ্ছে। ছোট বোনের উপর এই প্রথম বিরক্ত হলো সে। সেটার জন্যও দায়ী আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী। প্রজ্জ্বলিনী ক্রো’ধে বিরক্তিতে বলে উঠে,
‘বাহ্! আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী বাহ্! ভালোই ব্রেইন ওয়াশ করেছো আমার বোনের। অনেক হয়েছে, তুমি যতো চেষ্টা করো তোমাকে আমি সফল হতে দিচ্ছিনা।’
প্রজ্জ্বলিনীর চলে যাওয়ার পর নিহালের বিষয়টি ভেবে দর্শিনীর প্রচন্ড খারাপ লাগছে। হুট করে নিহালকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। নিহাল আর যাইহোক দর্শিনীকে পাওয়ার জন্য অনৈতিক পথের আশ্রয় নেবে না। সে যথেষ্ট ওয়েল ম্যাচিয়্যুর পার্সন। কিন্তু কালকের সেই অপ্রীতিকর ঘটনায় নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। দর্শিনী পরবর্তীতে নিহালের সঙ্গে কথা বলে মিটমাট করে নিবে বলে ঠিক করল। নিহাল যেন তাকে ভুলে মুভ অন করে সে ব্যাপারে বোঝাবে দরকার হলে।
_
চৌধুরী বাড়িতে,
সবাই তৈরি হয়ে গেছে একটুপর মুহতাসিম ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। আবিদ মেরুন রঙের কাজ করা পান্জাবী সঙ্গে সাদা পাজামা পড়েছে। চুলগুলো সুন্দর করে জেল দিয়ে সেট করা। হাতে রোলেক্স ব্যান্ডের ঘড়ি। গমরঙা ত্বকে বলিষ্ঠ সুন্দর শরীরে মেরুন রঙ সুন্দর ভাবে ফুঁটে উঠেছে। শাহরিয়ার চৌধুরী কোট প্যান্ট পড়ে তৈরি। অনুসা বেগম আর পুস্পিতা একই ডিজাইনের ভিন্ন কালারের শাড়ি পড়েছে। আরহান শার্ট প্যান্ট পড়ে তৈরি। আদিবা মিষ্টি কালারের কাজ করা থ্রি-পিচ পড়েছে। আসফি গম্ভীর মুখে পান্জাবী পড়ে রেডী হয়ে আসে। যদিও যাওয়ার ইচ্ছে ছিলনা। প্রিয়দর্শিনীকে সে ভাইয়ের সঙ্গে দেখতে পারবেনা বলে। কিন্তু শাহরিয়ার চৌধুরী স্পষ্ট জানিয়েছেন যেতে হবে।
মোট দুইটা গাড়ি যাবে মুহতাসিম ভিলার উদ্দেশ্যে। একটায় আবিদ, আদিবা, অনুসা বেগম, শাহরিয়ার চৌধুরী। অন্যটায় আসফি, আরহান, পুস্পিতা যাচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা পৌঁছে যায়। আশরাফ মুহতাসিম আর উজান, চৌধুরী পরিবারের সবাইকে ভিতরে নিয়ে যায়। চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে আরো দু’জন কাজের লোক ছিল। ফলমূল, মিষ্টান্ন দ্রব্য সবকিছু নিয়ে আসতে সাহায্য করার জন্য। চৌধুরী পরিবারের সবাইকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সামনে ট্রি-টেবিল ভর্তি ভিন্ন রকমের স্ন্যাকস্। সবাই হালকা নাস্তা করে নেয়। আবিদ এদিকে দর্শিনীকে দেখার জন্য প্রচন্ড উদগ্রীব হয়ে আছে। আদিবা সব লক্ষ্য করে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঠাট্টা করে। আবিদ কিছু না বলে চোখ রাঙায়। আদিবা পাত্তা দেয়নি।
আহমেদ মুহতাসিম, আশরাফ মুহতাহিম, শাহরিয়ার চৌধুরী বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পরে দর্শিনীকে ডেকে আনার জন্য বলেন। প্রজ্জ্বলিনীর এই অবস্থায় বারবার উঠা নামা নিষেধ এজন্য প্রিয়মা বেগম হৃদিকে বলেন। হৃদি দর্শিনীর কথায় সেই দুপুরেই চলে এসেছিল। দু’বান্ধবী একে অপরকে সব শেয়ার করে। হৃদি নিহালের ব্যাপারটা নিয়ে মন খারাপ করতে নিষেধ করে। অন্যদিকে দর্শিনীর মুখে আবিদ সম্পর্কে সবটা শোনার পর অবাক হয়েছিল। যে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে এতোকিছু সেই ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দর্শিনীর বিয়ে। অবশ্য হৃদি আগে থেকে জানতো দর্শিনী ম্যাজিস্ট্রেট আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর উপর মা’রাত্মক ক্রাশড্। এজন্য সে অনেকটাই খুশি। হৃদি দর্শিনীকে সিঁড়ি বেয়ে নামাচ্ছিল।
এদিকে আবিদ একদৃষ্টিতে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসছিল। দর্শিনীর ফর্সা শরীরে মেরুন জামদানি, গহনা হালকা সাজে দারুণ লাগছে। দর্শিনীর এই মা’রাত্মক আবেদনময়ী রূপে আবিদ ঘায়েল হয় প্রতিবার। কিন্তু দর্শিনীর মুখে সেই প্রাণোচ্ছল হাসিটা আজ আর নেই। আবিদের কিছু একটা ভেবে সন্দেহ হয়। যতক্ষণ না সে দর্শিনীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবে আবিদ সস্থি পাবেনা। আবিদ উপর উপর হাসিখুশি দেখালেও ভেতর থেকে দর্শিনীর জন্য দুশ্চিন্তা করছে।
#চলবে
#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব___২১(বর্ধিতাংশ)
মুহতাসিম ভিলায় আনন্দমুখর পরিবেশ। দর্শিনী আবিদকে সোফায় পাশাপাশি বসানো হয়েছে। দুই পরিবারের সবাই আবিদ দর্শিনীকে ঘিরে রয়েছে। দর্শিনী নিহালের ব্যাপারটায় কিছুটা মন খারাপ করেছিল কিন্তু আবিদের সংস্পর্শে সবটা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেছে। আবিদ পাশে থাকলে মনখারাপ দর্শিনীকে ছুঁতে পারেনা। আদিবা, আবিদ দর্শিনী দুজনের পাশাপাশি ছবি তুলছে। এদিকে আবিদ মুগ্ধ হয়ে তার দর্শিনীকে দেখছে। দর্শিনীও আবিদের দিকে তাকায়। যতটা প্রেমপূর্ণ মুগ্ধ নজরে দর্শিনী আবিদকে দেখছে। ততটা ক্রোধের সঙ্গে প্রজ্জ্বলিনী, আসফি আবিদকে পরোক্ষ করে। প্রতিটা ভালোবাসার গল্পে একজন খলনায়ক থাকে। এখানে আবিদ দর্শিনীর ভালোবাসায় খলনায়ক আসফি আর প্রজ্জ্বলিনী। তারা দুজনই চায়না আবিদ দর্শিনীর মিলন হোক। দুজনের এমন হিংসাত্মক মনোভাব কারো নজরে না পড়লেও আবিদের নজরে ঠিক পড়েছে। দুজনের চাইল্ডিশ আচরণে সবার অগোচরে আবিদ তাচ্ছিল্যপূর্ণ বাঁকা হাসে। অনুসা বেগম দর্শিনীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘মাশআল্লাহ্! আমার ছেলের হবু বউকে জামদানি শাড়িতে দেখতে ভারী সুন্দর লাগছে। ঠিক যেন স্নিগ্ধ পরী। একটাই ইচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি চৌধুরী বাড়িতে লক্ষ্মী হয়ে এসো।’
দর্শিনী মিষ্টি মধুর হাসলো। অনুসা বেগম দর্শিনীর গলায় ডাইমন্ডের নেকলেসটা পড়িয়ে দিলেন। পুস্পিতা ডাইমন্ডের আংটিটা আবিদের হাতে দেয়। আবিদ মিষ্টি মধুর হেসে দর্শিনীর মুখোমুখি হয়ে বসে। সে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বাম হাত বাড়াতে ইশারা করে। আবিদ দর্শিনীর বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে ডায়মন্ডের আংটিটা পড়িয়ে দেয়। সবাই উচ্চস্বরে আলহামদুলিল্লাহ্ পড়ে। সবশেষে আশরাফ মুহতাসিম দামী প্লাটিনামের পুরুষালী আংটিটা দর্শিনীর হাতে দেয়। দর্শিনী সেটা আবিদের বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে পড়িয়ে দেয়। দুইপক্ষ আনন্দে উচ্ছসিত হয়। অবশেষে আবিদ দর্শিনীর বাগদান সম্পূর্ণ হয়।শাহরিয়ার চৌধুরী আশরাফ মুহতাসিম একে অপরের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। তারা আনন্দে হাত মেলবন্ধন করে। একে অপরকে জড়িয়ে মিষ্টি মুখ করায়। অনুসা বেগম, প্রিয়মা বেগম সবার মতো একে অপরকে মিষ্টি মুখ করায়। উজানও আরহানের সঙ্গে হাত মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তারা এভাবে মিষ্টি মুখ করে আনন্দটুকু একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়।
এসব দেখে প্রজ্জ্বলিনীর স্বাভাবিক ভাবে বিরক্ত লাগে। তাইজন্য সে উঠে চলে যায় নিজের রুমে। সবাই অতো গুরুত্ব দেয়নি। তবে আসফি বেশ কয়েকবার প্রজ্জ্বলিনীকে খেয়াল করেছে। সে আবিদের প্রতি প্রজ্জ্বলিনীর চোখেমুখে অদ্ভুত বিতৃষ্ণা দেখতে পেয়েছে। যথাসম্ভব আবিদকে প্রজ্জ্বলিনী ঘৃণার চোখে দেখে। তারা কী আগে থেকে পূর্বপরিচিত শত্রু ছিল? প্রজ্জ্বলিনীর কী এই বিয়েতে মত নেই? যদি তার সন্দেহ সত্যি হয়, তবে আবিদ দর্শিনীকে আলাদা করা তার জন্য সহজ হবে। আসফি আবিদ দর্শিনীকে আলাদা করতে প্রজ্জ্বলিনীর সাহায্য নিতে পারবে। সবাই যখন মিষ্টি মুখ করতে ব্যাস্ত আবিদ অগোচরে শাহরিয়ার চৌধুরীকে বলে,
‘বাবা! আমি চাই বিয়েটা পরের শুক্রবারে হোক। তুমি রাজি করাবে আশরাফ আঙ্কেলকে। মনে করো তোমার ম্যাজিস্ট্রেট ছেলে তোমাকে অগোচরে চ্যালেন্জ ছুড়ে দিয়েছে। আমি জানিনা কীভাবে করাবে কিন্তু তোমাকে রাজি করাতেই হবে।’
শাহরিয়ার চৌধুরী ভ্রুকুঁচকে ছেলের দিকে তাকায়। তার ছেলে অবাস্তবিক আবদার কেনো করছে? বিয়ে এক দু’দিনের বিষয় না। আয়োজন করতেও সময় লাগে। শাহরিয়ার চৌধুরী ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,
‘এতো তাড়াহুড়োর কী খুব প্রয়োজন?ধীরে সুস্থে বিয়েটা হলে ভালো হতো না? আশরাফ মুহতাসিম আহমেদ মুহতাসিমকে কীভাবে জানাবো? তারা এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য রাজি হবেন কী?’
আবিদ ভাবলেশহীন। সে জানে শাহরিয়ার চৌধুরী চাইলে সব সম্ভব। আবিদ বাবার উদ্দেশ্যে নির্বিকারভাবে বলে,
‘সেটা তুমি ভালো জানো। আমার কাছে হার মানতে পারো না তুমি, বাবা। টাকা পয়সা খরচ করলে দ্রুত বিয়ের আয়োজন অসম্ভব নয়। তোমাকে সবাইকে রাজি করাতেই হবে। আই বিলিভ ইউ, যাস্ট ডু ইট।’
শাহরিয়ার চৌধুরী চিন্তিত হয়ে ছেলেকে সমর্থন করে। আবিদ অগোচরে বাঁকা হাসে। সে দর্শিনীর দিকে একবার তাকিয়ে আশরাফ মুহতাসিমের উদ্দেশ্য বলে,
‘আমি দর্শিনীর সঙ্গে কথা বলতে চাই আঙ্কেল। আপনার কোন আপত্তি না থাকলে আমি কী কথা বলতে পারি?’
আশরাফ মুহতাসিম মনোমুগ্ধকর হাসে। আবিদের ছোট ছোট বিষয় যেমন, আচার-আচরণ কথাবার্তায় তিনি মুগ্ধ হোন। তিনি আবিদের দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘অবশ্যই! আমি ও চাইছিলাম বিয়ের ডেট ঠিক করার আগে তোমরা দুজনে আলাদা কথা বলে নেও। এতে তোমাদের মতামত নিয়ে আমরা এগোতে পারবো। বিয়ের ডেট ফিক্সড্ করতে আমাদের সুবিধা হবে।’
আশরাফ মুহতাসিম দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলেন,
‘মামনি! আবিদকে নিয়ে রুমে যাও। কথা বলে আসো তোমরা।’
দর্শিনী বাবার কথায় উঠে দাঁড়ায়। আবিদকে তার সঙ্গে যেতে বলে। হৃদি দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে অগোচরে দু’ষ্টু ইশারা করে। দর্শিনী হৃদির দিকে বিস্মিত চোখে তাকায়। আবিদ দর্শিনী পাশাপাশি রুমের দিকে হেঁটে যায়। আসফি সব দেখেও কিছু করতে না পারার জন্য আফসোস করে। একপর্যায়ে ধৈর্য্য ধরে নিজের রাগ দমন করে নেয়।
আবিদ দর্শিনী দু’জনে রুমের উদ্দেশ্যে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ কী ভেবে আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
‘দর্শিনী! ছাদে যাবো রুমে না।’
দর্শিনী প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ফিরে তাকায়। আবিদ দুষ্টুমি করে বলে,
‘কালকের মতো আপনাকে লজ্জায় ফেলতে চাইনা এজন্যই ছাদে যেতে চাইছি। আজকের দিনে বদ্ধরুমে আপনাকে একা পেয়ে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে ব্যার্থ হলে বিষয়টি ভালো দেখাবে না। তাই আরকি ছাদে চলুন।’ ____বলে আবিদ অমায়িক হাসে।
দর্শিনী আবিদের কথা মতো ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। আবিদ দর্শিনীর পিছু পিছু যেতে থাকে। সে দর্শিনীকে লজ্জা পেতে দেখে বলে উঠে,
‘হতে পারে কোনো রাস্তায়, কোনো হুড তোলা এক রিক্সায়! আমি নীল ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে, তুমি অদ্ভুত এক খেয়ালে, আর আমি তোমাতেই, আমি সেইজন দর্শিনী! লোকে পাগল বলুক মাতাল বলুক আমি তোমার পিছু ছাড়বো না।’
দর্শিনী আবিদের কথায় মনোমুগ্ধকর হাসে। আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে আবারো বলে,
‘আমার নিজেকে সত্যি পাগল মনে হচ্ছে দর্শিনী। আমি টিনএজার প্রেমিকদের মতো আচরণ করছি। সব দোষ আপনার। আপনি আমাকে এমন অসুস্থ করে দিয়েছেন। আমি আপনি নামক অসুখে আক্রান্ত।’
দর্শিনী ছাদে পৌঁছে আবিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? কীভাবে আপনাকে আমি নামক অসুখ থেকে সুস্থ করবো আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী?’
উপরে বিস্তর নীল আকাশ, সুন্দর প্রাণোচ্ছল বিকেল। ছাদের চারপাশে ফুল ফলমূলের গাছ লাগানো। আবিদের হঠাৎ ফুপির কথা মনে পড়ে। তার ফুপি বাগান খুব পছন্দ করতো। দর্শিনী উত্তরের আশায় আবিদের দিকে চেয়ে আছে। আবিদ দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমি আপনি নামক অসুখ থেকে সুস্থ হতে চাইনা দর্শিনী। বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে আমার প্রয়োজন। অক্সিজেন আপনি আমার। প্লীজ যা কিছু হয়ে যাক আমাকে ছেড়ে কখনো যাবেন না দর্শিনী। আমি বাঁচতে পারবো না তাহলে।’
দর্শিনী আবিদের কথায় বুকের বাঁপাশে ব্যাথা অনুভব করে। আচমকা সে আবিদকে জড়িয়ে ধরে। আবিদ মনোমুগ্ধকর হাসে। দর্শিনীকে বুকের মধ্যে শক্ত করে মিশিয়ে নেয়। একসময় অনুভব করে পান্জাবী অশ্রুতে সিক্ত হচ্ছে। তারমানে দর্শিনী কী কাঁদছে? আবিদ বিচলিত হয়ে দু’হাতে দর্শিনীর মুখটা আজলা করে ধরে। দর্শিনীর চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তৎক্ষনাৎ। আবিদ জিগ্যেস করে,
‘আপনি আবারো কাঁদছেন? আপনাকে নিয়ে আমি কী করবো দর্শিনী? আমার কিছু হয়নি, হবেও না ভয় নেই। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী এতো সহজে আপনার পিছু ছাড়বে না দর্শিনী।’
দর্শিনী আবারো আবিদকে জড়িয়ে ধরে। শাড়ি পরিহিত স্নিগ্ধ রমনীকে বুকে জড়িয়ে আবিদের অন্যরকম অনুভব হয়। মনের মধ্যে দর্শিনীকে তীব্র ভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনুভূত হয়। কিন্তু আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী হেল্পলেস। আবিদ দর্শিনীর গলাই মুখ গুজে দেয়। দর্শিনীর পিঠে আলতো করে হাত রাখে। অনুভূতিতে আবিদ দর্শিনীর শরীর ঝিমঝিম করে উঠে। দর্শিনী ঐভাবে বলতে শুরু করে,
‘আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী আমি আপনাকে ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি। আপনি ব্যাতিত কাউকে কল্পনা করতে পারিনা। সেই প্রথম দেখার দিন থেকে বর্তমান, আমৃত্যু পযর্ন্ত আপনাকে ভালোবাসবো।কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববো না, কোনদিন না।’
আবিদ দর্শিনীকে আলতো করে ছাড়িয়ে আশেপাশের সৌন্দর্য দেখতে থাকে। হঠাৎ নজর পড়ে, টবে লাগানো লাল টকটকে গোলাপ গাছটার দিকে। গুনে গুনে ছয় সাতটা ফুল ফুঁটে আছে। সেখান থেকে একটা ফুল তুললে নিশ্চয়ই ক্ষতি হবে না। আবিদ লাল গোলাপের গাছ থেকে একটা ছোট্ট গোলাপ ফুল তুলে নেয়। এরজন্য অবশ্য গোলাপ গাছের কাঁটার আঘাত পায়। সাথে সাথে হাতের আঙ্গুলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। আবিদ তোয়াক্কা না করে লাল গোলাপটা দর্শিনীর কানের পাশে গুজে দেয়। মসৃণ ছেড়ে রাখা বাদামী চুল, সঙ্গে কানে উপর ছোট্ট লাল গোলাপটা দারুন লাগছে আবিদের। এই লাল গোলাপের থেকে তার ব্যাক্তিগত গোলাপ আরো বেশী সুন্দর। আবিদ দর্শিনীকে লক্ষ্য করে মনোমুগ্ধকর ভাবে হাসে। দর্শিনীও আবিদকে হাসতে দেখে মুগ্ধ হয়। দর্শিনীর হঠাৎ আবিদের হাতের দিকে চোখ পড়ে। আবিদ গোলাপ গাছের কাঁটার আঘাত পেয়েছে। দর্শিনী ব্যতিব্যাস্ত হয়ে উঠে। যেন আঘাতটা তার লেগেছে। যদিও অল্প আঘাত। দর্শিনী আবিদের ডান হাতের আঘাত পাওয়া আঙ্গুলে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। একফোঁটা রক্ত দর্শিনীর ঠোঁটে লেগে যায়। দর্শিনীর রক্ত ন্যায় লাল ঠোঁটে আবিদের একফোঁটা রক্ত লেগে আছে। আবিদের ইচ্ছে করছে দর্শিনীর ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে সবটা শুষে নিতে। সে নিজেকে মনে মনে শা’ষায়। আবিদ হাত দিয়েই ঠোঁটের উপর রক্তের ফোঁটা মুছে দেয়। তারা একে অপরের দিকে বেশকিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকে। আবিদের হঠাৎ নিহালের ব্যাপারটা মনে পড়ে যায়।
#চলবে
#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব___২২
‘দর্শিনী, একটা প্রশ্নের উত্তর দিন কাল ডক্টর নিহাল রায়হান কী বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো আশরাফ আঙ্কেলের কাছে?’
দর্শিনী আবিদের কথায় বিস্মিত হয়,যেন অবাকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে সে। দর্শিনী বুঝতে পারছে না, এতকিছু আবিদ কীভাবে জানলো? আবিদ দর্শিনীর দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। দর্শিনীর হঠাৎ দুশ্চিন্তা হচ্ছে আবিদ তাকে ভুল বুঝছে নাতো? অদ্ভুত হলেও সত্যি আবিদ সবটা মানুষ লাগিয়ে আগেই জেনেছে। কিন্তু দর্শিনীর ভিতরে কী চলছে ব্যাপারটা তার জানা দরকার। এজন্য দর্শিনীকে ইচ্ছেকৃত প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দর্শিনী আবিদের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সবটা খুলে বলবে। এদিকে দর্শিনীর যেন অসস্থি না হয় এজন্য আবিদ তাকে সহজ সাবলীলভাবে জিগ্যেস করে,
‘দর্শিনী! আম ড্যাম শিয়র আপনার কাজিন আপনাকে পছন্দ করে, ইজেন্ট হি?’
দর্শিনী চমকায়, বিস্মিত হয়। আবিদের উদ্দেশ্যে নির্বিঘ্নে বলে,
‘আপনি নিহাল ভাইয়ার ব্যাপারটা কীভাবে জানেন? প্লীজ বিশ্বাস করুন আমি বিন্দুমাত্র টের পাইনি নিহাল ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে। রেহানা আন্টি সবকিছু জানার সত্ত্বেও কাল বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন বাবার কাছে। এসব আমি জানতাম না। আমি নিজেই মা’রাত্মক শকড হয়ে গেছিলাম সব জানার পর। আমাকে প্রথমে কেউ কিছু বলেনি। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লীজ।’
দর্শিনীর কথায় আবিদ হাসলো। তাকে এখন অনেকটা ডেস্পারেট দেখাচ্ছে। সেটাও আবিদ যেন তাকে ভুল না বোঝে সেজন্য। আবিদ দর্শিনীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি আপনাকে ভুল বুঝছি? বা আপনার উপর আমি রাগ করবো?একদম না দর্শিনী। আমি জানি সবকিছু আপনার অজান্তেই ঘটেছে। আমি এটাও জানি আপনার সবটা জুরে আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর অস্তিত্ব রয়েছে।’
আবিদ কপালে আঙ্গুল ঘোষে অনেকটা ভাবুক হয়ে বলে,
‘তবে আমি জানতে চাই, শুধু এজন্যই কী আপনার মন খারাপ? আজকে এতো আনন্দের দিন তবুও আপনার মধ্যে কোন একটা ব্যাপার মিসিং মনে হচ্ছে?’
দর্শিনীর হাসি পায় আবিদের অঙ্গভঙ্গিতে। সে আবিদের কথায় ভ্রু কুঁচকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে,
‘আমার মন খারাপ নয়। আমার মধ্যে কোন ব্যাপারটা মিসিং মনে হচ্ছে আপনার?’
‘এইযে আপনার মধ্যে প্রাণোচ্ছল মনোভাবটা পাচ্ছিনা দর্শিনী।’
আবিদ একদৃষ্টে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। দর্শিনী আবিদের উদ্দেশ্যে অকপটে বলে,
‘আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। বাগদানের একদিন আগে এমন একটা খবর শুনে আপনারা কী রিঅ্যাক্ট করতেন? হয়তো আমাদের ভুল বুঝতেন এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো।’
‘ভয় নেই দর্শিনী। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী, সবসময় আপনার পাশে থাকবে আমৃত্যু পর্যন্ত। আপনাকে আমি আপনার চেয়ে বেটার চিনি ভুল বোঝার প্রশ্নই আসেনা।’____আবিদ মিষ্টি মধুর হেসে বলে।
আবিদ হঠাৎ দর্শিনীর অনামিকা আঙ্গুলের আংটির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আজ আমাদের এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে, আগামী শুক্রবার আমাদের বিয়েটা হলে কেমন হয়? আমি চাইছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা মিটে যাক। বাবাকে বলেছি আশরাফ আঙ্কেলকে দ্রুত রাজি করাতে। দর্শিনী! এতে আপনার কোনো সমস্যা নেইতো?’
দর্শিনী অগোচরে স্মিত হাসে। তার তো আপত্তি থাকার কথা নয়। তার স্বপ্নের নায়ক নিজে তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য উদগ্রীব। তারা খুব দ্রুত হালাল সম্পর্কে আবদ্ধ হবে। দর্শিনী তো ভিষণ আনন্দিত। আবিদ চাতক পাখির ন্যায় দর্শিনীর দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
‘মৌনতা কী সম্মতির লক্ষণ?’
‘জানিনা।’___বলে দর্শিনী মিষ্টি হেসে ছাদ থেকে নিচে নামতে থাকে।
সময়টা অপরাহ্ণের মাঝামাঝি। গৌধুলীর লগ্ন শুরু হয়েছে কেবল। নীল আকাশটা লালচে হতে শুরু করেছে। আবিদ হেসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। আবিদ নিচে নামার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। হঠাৎ ছাদের দরজার কাছে প্রজ্জ্বলিনীকে দেখে আবিদ ভ্রু কুঁচকে ফেলে। প্রজ্জ্বলিনী সাবধানে হেঁটে আবিদের মুখোমুখি দাঁড়ায়। আবিদ স্বাভাবিক ভাবে পাশ কাটিয়ে যেতে উদ্ধত হয়। প্রজ্জ্বলিনী আবিদকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠে,
‘আমার বোনের সঙ্গে এসব ভালোবাসা, বিয়ের নাটক বন্ধ করুন মিস্টার আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী। প্রিয়কে যেভাবে ব্রেইন ওয়াশ করে রেখেছেন। আমার সহজ সরল বোনের কিছু হলে আমি আপনাকে ছাড়বো না বলে দিলাম। আমি চাইনা আমার বোন আপনার মতো কারো সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোক।’ ____প্রজ্জ্বলিনীর সহজ সাবলীল স্বীকারোক্তি।
তৎক্ষণাৎ আবিদের পা থেমে যায়। প্রজ্জ্বলিনীর দিকে ফিরে তাকায়। যেভাবে ছিল সেভাবে অবস্থান করে বলে,
‘নাটক? সেটাও দর্শিনীর সঙ্গে? নিজের ভালোবাসার সঙ্গে নাটক করার মতো মেন্টালিটি আমার নয়। যথেষ্ট কারণ বশত আমার থেকে রিজেকশন পেয়েছেন বলে, আমার প্রতি ক্রো’ধ হিংসা জাহের করা বন্ধ করুন। আমি আপনার বোনকে ভালোবাসি। দর্শিনী যদি কারো হয়, সেটা আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর হবে মাইন্ড ইট। আর হ্যাঁ, এই বিয়েতে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। এতে ফল ভালো হবে না। সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো বোকা নিশ্চয়ই আপনি নন প্রজ্জ্বলিনী। নিজের পরিবার, স্বামী, সন্তান নিয়ে ভালো থাকুন। এটাই আপনার জন্য কল্যাণকর হবে।’ ____বলেই আবিদ চলে যায়।
প্রজ্জ্বলিনী অপমানিত বোধ করে। একটু ক্রু’দ্ধ হয়। আবিদ তাকে খোঁচা মারল তার কিশোরী বয়সে প্রেমে পড়া, রিজেকশন নিয়ে। প্রজ্জ্বলিনী এসেছিল আবিদকে কথা শোনাতে সেখানে আবিদ তাকে কথা শুনিয়ে চ্যালেন্জ ছুড়ে দিয়ে গেছে। প্রজ্জ্বলিনী তাচ্ছিল্যতার সঙ্গে বলে,
‘দেখা যাক মিস্টার আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী! সিংহ বিপদে পড়লে কারো সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে কী না? আপনি অষ্টাদশী প্রজ্জ্বলিনীর জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিলেন। আমি এখন অনুভব করতে পারি। আমার নিষ্পাপ বোনকে সেই ভুলের সঙ্গে জড়াতে দেই কীভাবে? আপনাকে আমি এতো সহজে ক্ষমা করব না।’
****
প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নেমেছে। ড্রয়িংরুমে দুই পরিবারের সবাই মিলে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। শাহরিয়ার চৌধুরীর ইচ্ছে অনুযায়ী পরবর্তী শুক্রবার বিয়ের ডেট ঠিক করা হয়। দর্শিনী, আবিদকে পাশাপাশি বসিয়ে তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আবিদ দর্শিনীকে জিগ্যেস করা হলে আবিদ তাতে সম্মতি দেয়। অন্যদিকে দর্শিনী নিরাবতা পালন করে। তার নিরাবতাকে সম্মতি হিসাবে গ্রহণ করেন আহমেদ মুহতাসিম এবং আশরাফ মুহতাসিম। শাহরিয়ার চৌধুরীর কথায় বিয়েটা আগামী শুক্রবারে হবে। প্রথমে আশরাফ মুহতাসিম এতো তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করেছিলো কিন্তু শাহরিয়ার চৌধুরী এবং অনুসা বেগম তাকে মানিয়ে নিয়েছে। আবিদ সবার অগোচরে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলো। এদিকে শাহরিয়ার চৌধুরী তার ম্যাজিস্ট্রেট ছেলের চ্যালেন্জ রাখতে পেরেছেন বলে মনে মনে ভিষণ গর্ববোধ করলেন। ব্যাপারটা আসফির নজরে পড়েছে। বেচারির তো করুণ অবস্থা। বাগদান তো আটঁকাতে পারেনি। কিন্তু বিয়ের ডেট এতদ্রুত ঠিক হবে আশা করেনি একদম। যদি বিয়েটা বাগদানের মতো আটঁকাতে না পারে, আসফি কীভাবে সহ্য করবে আবিদ দর্শিনীকে? এসব ভেবে আসফির ভেতরে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। যেন তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। প্রচন্ড অসস্থি হচ্ছে আবিদ দর্শিনীকে পাশাপাশি একে অপরের হাত আঁকড়ে ধরে থাকতে দেখে। তার সবার সামনে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে প্রিয়দর্শিনী আমার। তোমরা তাকে আমার থেকে কেড়ে নিও না। কিন্তু ভিতর থেকে এমন দুঃসাধ্য কাজটা করার সাহস পাচ্ছেনা আসফি। একজন সাবলম্বী ছেলের জন্য এরচেয়ে লজ্জাজনক কিছু নেই। আসফির এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। নিজেকে নিজের ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করছে।
আনন্দমুখর পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। হঠাৎ আশেপাশ থেকে আযানের সুমধুর ধ্বনি শোনা যায়। দুই পরিবারের সব ছেলেরা একসঙ্গে নামাজ পড়ার জন্য রওনা দেয়। মুহতাসিম ভিলা থেকে একটু দূরেই সুন্দর একটা মসজিদ আছে। শুধু বয়স্ক আহমেদ মুহতাসিম বাদে সবাই গেছে। কারণ আহমেদ মুহতাসিমের জন্য সেখানে হেঁটে যাওয়া কষ্টসাধ্য। এজন্য তিনি নিজের ঘরেই নামাজ পড়বেন। এদিকে নামাজের পর সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবে। প্রিয়মা বেগম কাজের লোকজনের সহযোগিতায় খাওয়া-দাওয়ার পর্বের জন্য সব রেডি করে ডাইনিং টেবিলে রাখেন। আজকে মেহমানদের জন্য অনেক ধরনের পদ রান্না হয়েছে। দর্শিনী আর হৃদি, পুস্পিতা অনুসা বেগম আদিবার নামাজ পড়ার জন্য ড্রয়িং রুমেই জায়নামাজ বিছিয়ে দেয়। এদিকে ওরা দুজন নামাজ শেষ করে প্রিয়মা বেগমকে যথেষ্ট সাহায্য করে। অন্যদিকে পুস্পিতা, আদিবা, অনুসা বেগম সবাই নামাজ শেষে ড্রয়িং রুমে বসে আছে। প্রজ্জ্বলিনীও সেখানে উপস্থিত ছিল। অনুসা বেগম প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে ভালো মন্দ দু’চার কথা জিগ্যেস করে। প্রজ্জ্বলিনী ভদ্রতার খাতিরে সব উত্তর দেয়। ছেলেরা নামাজ শেষে প্রফুল্ল হয়ে একসঙ্গে ফিরে আসেন। তারপর সবাই এক এক করে ড্রাইনিং টেবিলে বসে পড়ে। আশরাফ সাহেব প্রিয়মা বেগম, চৌধুরী পরিবারের যত্নে কোন ত্রুটি রাখেনি। তাদের আন্তরিকতা বরাবরের মতো সুন্দর ছিলো। চৌধুরী পরিবার পুরোপুরি মুগ্ধ। শাহরিয়ার চৌধুরী দর্শিনীকে তার পাশে বসায়। এদিকে তার ঠিক উল্টোদিকে আবিদ আশরাফ মুহতাসিমের পাশে। দর্শিনী আবিদ মাঝেমধ্যে একে অপরের দিকে তাকায়। আবিদের চোখে মুখে সু’ক্ষ্ম হাসি থাকলেও দর্শিনী সবার মাঝে নিশ্চুপ থাকে। চৌধুরী পরিবারের সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রিয়মা বেগমের রান্নার প্রশংসা করলেন। সবাই তৃপ্তি নিয়ে খেলেও আসফি সেভাবে কিছুই খায়নি। মূলত তার গলা দিয়ে খাবার নামেনি। সবার অগোচরে বিষণ্ন মন নিয়ে বসেছিল।
–
এদিকে সবকিছু ঠিকঠাক মিটে গেলে চৌধুরী পরিবারের সবাই বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। উজান আর আশরাফ মুহতাসিম সৌজন্যতা বজায় রাখতে চৌধুরী পরিবারের সবাইকে বাহির পযর্ন্ত এগিয়ে দিতে আসেন। দর্শিনী প্রজ্জ্বলিনী আর প্রিয়মা বেগমের সঙ্গে ভেতরে থেকে যায়। অবশ্য যাওয়ার আগে আবিদ দর্শিনীকে কিছু ইশারা করে যায়। চৌধুরী পরিবারের সবাই গাড়িতে চড়ে বিদায় নেয়। দুটো গাড়ি গেট পার করে রওনা দিলে, উজান আর আশরাফ মুহতাসিম নিশ্চিন্ত হয়। কিছুক্ষণ পর তারা বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করতে করতে ভিতরে চলে আসে।
এদিকে প্রিয়মা বেগম রাত হয়ে যাওয়ায় হৃদিকে দর্শিনীর সঙ্গে থেকে যেতে বলেন। তিনি নিজ দায়িত্বে ফোন করে হৃদির পরিবারের থেকে পারমিশন নিয়ে নেন। রাতে দুজন কাজের লোক অর্ধেক কাজ সেরে খাবার দাবার নিয়ে বাড়িতে ফিরে যায়। অন্যদিকে দর্শিনী আর প্রিয়মা বেগম নিজ দায়িত্বে বাকি কাজ সেরে নিজেদের রুমে ফিরে আসে। রুমে এসেই দর্শিনী দ্রুত চেন্জ করে নেয়। হৃদিকে সারা ঘরে খুঁজে না পেয়ে, বেলকনিতে উঁকি দিয়ে দেখে হৃদি ফিসফিস করে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। দর্শিনীর হৃদির দিকে ভ্রুকুঁচকে তাকায়। হৃদি তো কথা বলতেই ব্যাস্ত দর্শিনীর দিকে তার খেয়াল নেই।
#চলবে