প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১৭+১৮

0
603

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৭)

পাখির কিচিরমিচির শব্দে কান ঝাঁঝিয়ে আসছে প্রিয়তার। রোদের এক ফালি অংশ জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। একে অপরের শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ওরা। কিঞ্চিত দুরত্বও নেই ওদের মাঝে। সুখ নিদ্রায় তলিয়ে আছে প্রহর। প্রিয়তার ঘুম ভেঙেছে। প্রিয়তার উন্মুক্ত দেহের ভাঁজে ভাঁজে প্রহরের দেহের স্পর্শ এখনো অনুভব করছে প্রিয়তা। শ্বাস নেওয়ার কারণে বুক উঠানামা করছে প্রহরের। রোমশপূর্ণ বলিষ্ঠ বুকে জায়গা করে নিয়েছে প্রিয়তা। ঘুমু ঘুমু চোখে প্রহরের পানে নরম ভাবে তাকায় সে। প্রহরের গালে বিচরণ করে প্রিয়তার নরম, মোলায়েম হাত। অতি সুদর্শন লাগে প্রহরকে ঘুমন্ত অবস্থায়। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। স্নিগ্ধ, মুগ্ধকর মুখে অজানা সুখ খুঁজে পায়।

অতি সাবধানে প্রিয়তার স্পর্শে ঘুম ভাঙে প্রহরের। মুচকি হেসে প্রিয়তার স্পর্শকাতর স্থানে হাত বুলায়। চুমু খায় নাকের ডগায়। জড়িয়ে নেয় আরো নিবিড়ভাবে। নেশালো কণ্ঠে বলে,

” ঘুমান।

প্রিয়তা আঁকড়ে ধরে প্রহরের পিঠ। লজ্জায় বশীভূত হয়। বলে ,

” এবার উঠতে হবে। ছাড়ুন।

হাসে প্রহর। ছেড়ে দেয় প্রিয়তাকে। প্রিয়তার অবস্থা নাজুক। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ব্যথা। শিরশির করছে গা। প্রহর মানুষটা গম্ভীর, সহজ আর প্রাণবন্ত হলেও স্ত্রীর নিকট এলে মানুষটা কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। অস্থির, উত্তেজিত দেখায় প্রহরকে। প্রিয়তা গতকাল এক অন্য প্রহরকে দেখেছে। এই প্রহরকে আগে দেখেনি সে। যার মনে-প্রাণে, মস্তিষ্কে প্রিয়তা ব্যতিত অন্য কোনো চিন্তা ছিল না। প্রহরের ভালোবাসার প্রগাঢ়তা প্রিয়তা সহ্য করে নিয়েছে। উপভোগ করেছে ভালোবাসার স্পর্শ গুলো। কালসিটে দাগ পড়েছে প্রিয়তার ঘাড়ে। হাত রাখতেই ব্যথায় টনটন করে উঠল সেথায়। চোখে খিঁচে বন্ধ করে নেয় প্রিয়তা। “উফফ” জাতীয় শব্দ করে। চমকায় প্রহর। চিন্তিত ভঙিতে ভালো করে চোখ মেলে। বলে,

” কি হয়েছে প্রিয়?

প্রিয়তার চোখে অশ্রু। দুঃখের অশ্রু শুকিয়ে গেছে। সুখের অশ্রু গড়াচ্ছে চোখ বেয়ে। প্রহরের চিন্তিত স্বর মোহনীয় লাগে। মুচকি হেসে প্রিয়তা বলে,

” ব্যথা।

প্রহর উঠে বসে। চিন্তিত দেখায় তাকে। প্রেয়সীর আর্তনাদে বক্ষে উন্মাদনা টের পায় প্রহর। জিজ্ঞেস করে,

” শরীর ব্যথা করছে?

” ঘাড়ে বেশি।

প্রহর এগিয়ে আসে প্রিয়তার নিকটে। ঘাড়ে হাত বুলায়। কামড়ের দাগ পড়ে গিয়েছে। কালচে রঙ দেখা গিয়েছে। প্রহর অধরজোড়া চেপে ধরে ঘাড়ে। কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। প্রহর বারংবার অধর চেপে ব্যথিত কণ্ঠে বলে,

” সরি প্রিয়, আমি এক্ষুণি মেডিসিন নিয়ে আসছি।

প্রিয়তা থামায় প্রহরকে। বলে,
” লাগবে না।

প্রহর শোনে না। দ্রুত বিছানা ছাড়ে সে। গোসল ছেড়ে বের হয়। গায়ে নীল রঙের শার্ট জড়াতে জড়াতে প্রিয়তার কাছে আসে। অতি চমৎকার কণ্ঠে প্রিয়তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

” আপনার মলিনতার সুর,
আমার কাঁপিয়ে তোলে বুক।

_______

ব্যথাতুর স্থানে মলমের প্রলেপ পরতেই হৃদস্পন্দন থামে প্রিয়তার। শাড়ির অর্ধেকাংশ মেঝেতে লুটিয়ে আছে। পিঠের নিচ অংশের শাড়ি সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে আছে কোমর। প্রিয়তার ভ্রূক্ষেপ নেই। শাওয়ার নিয়ে আরহামের সাথে সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরে শুতেই চোখটা কেমন লেগে গিয়েছিল। গতরাতের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের দৃশ্য চোখের পাতায় আটকে ছিল। প্রহরের শ্বাসরুদ্ধকর উপস্থিতি, হাতের বিচরণ, অধরের ঝড় সবই যেন এক স্বপ্ন। ঘুমের মাঝেই ঘাড়ে শীতল পদার্থের ছোঁয়া পেয়ে অবাক হয় না প্রিয়তা। গা দুলিয়ে হাসে। বলে,

” ব্যথা দেওয়ার সময় মনে ছিল না?

” আপনিও তো আমাকে ব্যথা দিয়েছন প্রিয়তা। পিঠে আঁচড়ে, কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন। দীর্ঘ দিন দূরে থেকে আমাকে যন্ত্রণা বাড়িয়েছেন। অভিযোগ এবার আমি করি?

প্রিয়তা কথা বলে না। প্রহর সময় নিয়ে প্রিয়তার ঘাড়ে মাসাজ করে। ঔষধের প্যাকেট থেকে ঔষধ বের করে প্রিয়তার হাতে গুঁজে দিয়ে পানির গ্লাসটাও এগিয়ে দেয় প্রিয়তার সম্মুখে। প্রিয়তা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
” এত ঔষধ কিসের?

” ভিটামিন, পেইন কিলার, স্পট রিমুভাল মেডিসিন।

প্রহরের কল আসে। কলটা জরুরী হওয়ায় সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কানে ফোন চেপে চোখের ইশারায় প্রিয়তাকে খেতে বলে ঔষধগুলো। প্রিয়তা গা ব্যথার ঔষধ চিনে। ঔষধ খেতে বরাবরই অসহ্য লাগে তার। সে তো দুর্বল নয় যে ভিটামিন লাগবে। দাগে মলম দেওয়া হয়েছে, ওই ঔষধেরও প্রয়োজন পরবে না। কেবল ব্যথার ঔষধ খেয়ে বাকিগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দিল প্রিয়তা। এত ঔষধ মানুষ কিভাবে খায়?

_____

ইহান ল্যাপটপে মেইল চেইক করছে। তানিয়া বিছানার এক প্রান্তে বসে খাবার খাচ্ছে। আজ রান্না তানিয়া নিজে করেছে। তবে তরকারিতে ঝালের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। তানিয়ার নিজেরই খেতে গিয়ে জিভ, ঠোঁট পুড়ছে। বাকিরা কিভাবে খাবে ভেবে মন খারাপ হলো তানিয়ার। ভাতের লোকমা মুখে তুলতেই ঝালে ঠোঁটে জ্বলন শুরু হলো। ইহানের সামনে খেতে বসেছে। খাবার কোনোভাবেই ফেলা যাবে না। খাবার অপচয় করা পছন্দ করে না ইহান। অপরদিকে তানিয়া খেতেও পারছে না খাবারটুকু। ঝালে চোখ-মুখ লাল হয়ে আসছে তার। বুক পুড়ছে। ইহান আড়চোখে তাকায় তানিয়ার পানে। তানিয়া বুঝতে পারে। দাঁত কেলিয়ে বোকা হাসে সে। ললাটে ভাঁজ পড়ে ইহানের। বলে,

” হাসো কেন?

থতমত খায় তানিয়া। বলে,

” কই হাসছি?

“এতক্ষণ লাগে খেতে? কখন বসেছো হিসেব আছে? জলদি খেয়ে আমার জন্য খাবার আনো।

তানিয়ার ভয় হয়। এই তরকারি দিয়ে কিভাবে খেতে দিবে ইহানকে। বকে ত্যানাত্যানা করে ফেলবে তাকে। মুখ নত করে তানিয়া বলে,

” খেতে ইচ্ছে করছে না।

” আমাকে খাইয়ে দাও তবে।

হতবাক চোখে তাকায় তানিয়া। বিস্ময় আকাশ ছোঁয়। রক্তিম ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,

” আমার এঁটো খাবার খাবেন?

ইহান তানিয়ার দিকে তাকিয়ে দ্রুত নজর সরায়। বলে,
” এক কথা বারবার বলাও কেন?

অগত্যা বাধ্য হয়ে তানিয়া বিছানার মাঝ বরাবর আসে। চশমা ঠিক করে ভাতের লোকমা তুলে দেয় ইহানের মুখে। ভয়ে থিতিয়ে যায় তানিয়ার চোখ। ইহান ঝাল খায় না, খেতে পারে না। ঠোঁটের জ্বলনে দিক্বিদিক হারায় তানিয়া। ভাবে ইহান ধমকাবে, খেতে গিয়ে ঝালে কাহিল হয়ে পড়বে। কিন্তু না! ইহান খাবার চিবিয়ে কোনো অভিব্যক্তি দেখায় না। অবাক হয় তানিয়া। ইহানের অভিব্যক্তি জানতে চায়। নিজ মুখে স্বীকার করে,

” রান্না আমি করেছিলাম। খুব ঝাল হয়েছে। আমিই তো খেতে পারছি না। আপনি..

ইহান ছোট হা করে। তানিয়া বুঝতে পারে আবার ও খাবারটুকু খেতে চাইছে ইহান। তানিয়া সময় ব্যয় করে না পুনরায় তুলে দেয় ভাতের লোকমা। ইহান চিবোয়। কোনোরুপ বাক্য বিনিময় করে না। পরপর কয়েকবার খাবার খেয়ে ঢকঢক করে পানি খায় ইহান। তানিয়া প্লেট নিয়ে বেরিয়ে যায়। ইহানের থানায় যাওয়ার সময় আসে। ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে তৈরী হয় ইহান। রিভলবার পকেটে গুঁজে তানিয়াকে ডাক দেয়। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে তানিয়া। ইহানকে পর্যবেক্ষণ করে। ইহানের ঠোঁট ও লালচে হয়ে গেছে। চোখের শিরা গুলো রক্তিম হয়ে আছে। তানিয়ার মায়া হয়। জিজ্ঞেস করে,

” ডাকছেন?

ইহান পিছু ফিরে। অফিস সরঞ্জাম ফাইলে ভরে তানিয়ার নিকটে এসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

” চুমু দাও, ফাস্ট।

তানিয়া ভড়কায়। বিচলিত নয়নে তাকায় ইহানের পানে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,

” আমি? আপনাকে?

ইহানের গাম্ভীর্যপূর্ণ চাহনি তানিয়ার দিকে মেলে। বলে,

” তো অন্য কাউকে দিতে চাও নাকি? চালু করো। সময় নেই।

তানিয়া বাইরে নজর ফেলে। ইলমা বেগম দেখে ফেললে? চশমা ঠিক করে ইহানের নিকটে আসে তানিয়া। চোখ বুজে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ইহানের গালে চুমু দিতে উদ্যত হলে ইহান বলে ওঠে,
” ঠোঁটে দাও।

অবাক চোখে তাকায় তানিয়া। সুযোগটা ফেলতে চায় না। তানিয়া দু হাত উঠিয়ে ইহানের গালে হাত রাখে। পা উঁচিয়ে ইহানের পায়ে রাখে। ভেজা অধর আলতো করে স্পর্শ করে ইহানের অধরে। ছোট্ট একটি চুমু দিয়ে সরে আসার পূর্বে ইহানের শক্তপোক্ত হাত তানিয়ার পিঠে চাপ প্রয়োগ করে। তানিয়া ঝুঁকে আসে ইহানের দিকে। ইহান অপর হাত রাখে তানিয়ার কানের নিচে। অধরজোড়া পুনরায় চেপে ধরে তানিয়ার অধরে। সময় গড়ায়। চঞ্চল হয় তানিয়া। সরে আসার চেষ্টা করেও পারে না। হাল ছাড়ে। জড়িয়ে নেয় ইহানকে। লজ্জায় চোখ বুজে নেয় অজান্তে।

______

তানিয়া আর ইহান বসে আছে অফিসরুমে। তানিয়ার নত মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে, নিঃশব্দে হাসে ইহান। মেয়েটা কেমন লজ্জায় বুদ হয়ে আছে। কোনো কথাই বলছে না আজ। ইহান তানিয়ার লজ্জাকে বাড়িয়ে দিতে বলল;

” এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? চুমুই তো।

তানিয়া তড়িৎ বেগে মাথা তুলে। আশপাশে মানুষ আছে কিনা দেখে নেয়। ঠোঁটে আঙুল চেপে বলে,

” চুপ। কেউ শুনে ফেলবে।

” শুনুক।

” লজ্জা, সংকোচ কি সব চলে গেছে?

” চলে গেলেই বোধহয় ভালো হতো।

হাসে তানিয়া। কাজে মনোনিবেশ করে। খানিকক্ষণ বাদে প্রহর আসে থানায়। প্রহরকে দেখে উঠে দাঁড়ায় ইহান আর তানিয়া। প্রহরের পাশে প্রিয়তা দেখে খুশি হয় ওরা। মিষ্টি হাসে। সলজ্জ চোখে তানিয়া প্রশ্ন করে,

” কেমন আছেন স্যার? প্রিয়তা, কেমন আছো?

প্রহর হাসে। তানিয়াকে বসতে বলে। চেয়ার ঠিক করে দেয় তানিয়া। প্রিয়তাকে বসতে দেয়। কফি আনতে বলে ওদের জন্য। প্রহর বসতে বসতে তীক্ষ্ম চোখে বলে,

” আমরা ভালো আছি। তোমাদের কি খবর?

ইহান বলে,
” ভালো আছি। মিথিলা দেওয়ানকে আনতে পাঠিয়েছি। বোস। চলে আসবে।

অপেক্ষা করে প্রহর। টুকটাক আলোচনা হয় তাদের মাঝে। প্রিয়তা গল্প শুরু করে তানিয়ার সাথে। হাসি মজা করে। প্রিয়তাকে আনা হয়েছে সত্য জানার জন্য। প্রহর চায় প্রিয়তা সব জানুক। সময় গড়ায়। ফোর্স আসে দীপা খন্দকারকে নিয়ে। লেডি কনস্টেবল টেনে আনে দীপাকে। প্রহর আর প্রিয়তাকে দেখে ক্ষেপে যায় দীপা। খেঁকিয়ে ওঠে। বলে,

” আমাকে এখানে এনেছো কেন? তোমাদের সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।

হাসে প্রহর। ভ্রূ চুলকায়। বলে,
” সাহস দেখানো তো সবে শুরু ম্যাম। চুপচাপ এখানে বসুন আর প্রশ্নের উত্তর দিন। নইলে পুলিশ কি করতে পারে তা আপনি হারে হারে টের পাবেন।

প্রিয়তা অবাক হয় দীপাকে এখানে দেখে। প্রশ্ন করতে উদ্যত হতেই তানিয়া থামায়। ইশারায় সবটা শুনতে বলে। দীপা চুপ করে বসে থাকে। চোখ পাকায়। ক্ষোভে ফুঁসে। প্রহর নির্বিকার চিত্তে তাকায়। কথাগুলো নিজ মনে সাজায় এলোমেলো বাক্যগুলো। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

” মিসেস দীপা খন্দকার, উপসস সরি। মিথিলা দেওয়ান। আরিফ হোসাইন আপনার কত নম্বর স্বামী বলুন তো?

দীপা হতবাক চোখে তাকায়। থতমত খায়। প্রিয়তার মনেও প্রশ্ন জাগে। প্রহর হাসে। বলে,

” থাক, আপনাকে বলতে হবে না। আমিই বলছি। আরিফ হোসাইন আপনার তিন নম্বর স্বামী। আপনি প্রথম বিয়ে করেছিলেন দু হাজার বারোতে। আপনার প্রথম স্বামী ছিলেন জমির দালাল। জমিজমা নিয়ে ব্যবসা করতেন। টাকা আয় করতেন ভালোই। কিন্তু টাকা জমাতে পারতেন না। সব টাকা বোনদের জন্য ব্যয় করতেন। আপনাকে সেভাবে টাকাপয়সা দিতে পারতেন না বলে আপনি রমিজ আকবরের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাননি। দীর্ঘ পাঁচ বছর সংসার করার পর আপনার মনে হয়েছে রমিজের সংসারে থেকে আপনার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। টাকা-পয়সা কিছুই জমাতে পারছেন না। সব অর্থ ননদদের সংসারে ব্যয় হচ্ছে। খোলাখুলি আলাপ করার পর বুঝতে পারলেন রমিজ আপনাকে নিয়ে চিন্তা করেন না, আপনার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা নেই লোকটার। তাই আপনি মিউচুয়াল ডিভোর্স চাইলেন। কাবিনের টাকা দিতে নাকোচ করলেন রমিজ। তাই আপনি নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কাবিনের পুরো টাকা আদায় করলেন। এরপর সেই টাকা নিয়ে আনন্দে কাটালেন অনেকগুলো দিন। কি তাইতো?

বিস্ফোরিত চোখে তাকায় দীপা। প্রহর আবার বলে,

” দ্বিতীয় বিয়ে করলেন সতেরো সালের শেষের দিকে। স্বামী সামিন রহমানের ব্যবসা ছিল। বিয়ে করে দু বছর সংসার করার পর তার সাথেও একই ঘটনা ঘটালেন। শুধু কি তাই? লোকটার সম্পত্তির অর্ধেকাংশ লিখিয়ে নিলেন নিজের নামে। আইন নারীদের ক্ষেত্রে একটু সেনসিটিভ। নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে আইন প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল। পুরুষের কথার চেয়ে নারীর কথাকে বেশি প্রায়োরিটি দেয় আইন। এই সুযোগটাই আপনি নিলেন। সম্পত্তি হাতিয়ে চাঁদপুর ছেড়ে ইন্ডিয়ায় গেলেন। ওখানে থাকাকালীন অনেক পুরুষের সাথেই সম্পর্ক ছিল আপনার। আরিফ হোসাইন মানে প্রিয়তার বাবাকে অনলাইনে পেলেন আপনি। সেসময় প্রিয়তার বাবা একটু ডিপ্রেসড ছিলেন। স্ত্রী পরকিয়ায় জড়িয়ে গিয়েছে বলে প্রিয়তার বাবা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আপনি তাই বন্ধুর ন্যায় আচরণ করলেন আরিফ আঙ্কেলের সাথে। প্রেমের সম্পর্ক গড়লেন। আরিফ আঙ্কেলের সাথে যখন সম্পর্ক ছিল তখনও আপনি আরো কয়েকজনের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। সব শেষে বিয়ে বসলেন আরিফ আঙ্কেলের সাথেই।

এতটকু বলে থামল প্রহর। প্রিয়তার চোখে পানি। তার বাবাকে ঠকিয়েছে সবাই। ঠকিয়ে নিজেদের মতো চালিয়ে গেছে। দীপার বায়োডাটা শুনে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তার। দীপা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,

” ভুল বলছো তোমরা। পারিবারিক শত্রুতা এখানে টেনে আনছো।

ইহান বলে,
” সব প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। আপনার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট এসেছিল অনেক আগে। আপনাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি কারণ আপনি দেশের বাইরে ছিলেন। প্রমাণ হাতে নিয়েই আপনাকে ধরতে গিয়েছি।

প্রহর এবার আসল কথা টানে। দৃঢ় চোখে তাকিয়ে বলে,

” আঙ্কেলকে আপনি খু”ন করেছেন। ইনজেকশন পুশ করে। এর শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে।

কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। প্রহরের কাছে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
” আব্বু তো স্ট্রোক করে মারা গিয়েছে। আমরা তো আব্বুকে হসপিটালে দেখলাম। আপনি কি বলছেন?

প্রহর প্রিয়তার মাথায় হাত রাখে। প্রিয়তার উত্তেজিত কণ্ঠ প্রহরের নিকট অত্যন্ত ব্যথিত ঠেকে। প্রিয়তার জীবন নিয়ে ভাবতে গেলেই মায়া হয় মেয়েটার প্রতি। খারাপ লাগে খুব। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে প্রহর বলে ওঠে,
” আপনার আব্বু খুন হয়েছে প্রিয়তা। উনি স্ট্রোক করেছিলেন ঠিকই, স্ট্রোক করার পর বেঁচেও গিয়েছিলেন। আপনার সৎ মা উনাকে বাঁচতে দেননি। আমি সেদিন আপনার আব্বুকে দেখতে চেয়েছিলাম মনে আছে? দীপা আন্টি আমাকে মৃত দেহ দেখতে দেননি। তবুও আমি দেখে ফেলেছিলাম। আপনার আব্বুর ঘাড়ে তিল আছে। সেই ঘাড়ের তিলের মাঝখানটা নীলাভ রঙ ধারণ করেছিল। তিল নীলাভ রঙের হতেই পারে তবুও আমার একটা খটকা লেগৈছিল। ইহানকে বলেছিলাম লাশ দাফন না করতে। আপনার আব্বুকে দাফন করা হয়নি সেদিন। ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল উনাকে। আপনি যদি জানতে পারতেন আপনার আব্বুকে দুদিন বরফে রেখে টেস্ট করা হয়েছে, কবর দেওয়া হয়নি, তাহলে আপনি খুব কষ্ট পেতেন। এজন্য আপনাকে বলিনি। আপনার আব্বু আপনাকে শেষ সময়ে এসে খুব মিস করেছেন প্রিয়তা। হসপিটালের বেডে বারবার আপনার নাম জপেছেন। সেজন্য দীপা আন্টি না পেরে বাধ্য হয়ে আমাদের ফোন করে যেতে বলেছিলেন। মারা যাওয়ার পর আমরা যাতে উনাকে সন্দেহ না করি সেজন্য ফোন করে মৃত সংবাদ টাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ নেই। উনি ধরা পড়ে গিয়েছেন। বিষের প্রতিক্রিয়ায় মারা গেছেন। আঙ্কেল প্রমাণ আছে আমাদের হাতে।

প্রিয়তার চোখে পানি। বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে সে। নিশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। সত্য জানতে পেরে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মাথা ভনভন করছে। হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তার। শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে। নিজেকে সংযত করতে পারে না প্রিয়তা। কেঁদে ফেলে শব্দ করে। উন্মাদের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দীপার গায়ে। দীপার হাতে চাপ প্রয়োগ করে শক্ত কণ্ঠে বলে,

” আপনি, খারাপ, মনুষ্যত্বহীন, নিচ। আপনি আমার আব্বুকে খুন করেছেন। আমাকে এতিম করেছেন। তোকে আমি মেরেই ফেলবো। মেরে জেলে যাবো। লোভী কোথাকার।

প্রিয়তা পরপর ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় দেয় দীপার গালে। দাগ বসে দীপার ফর্সা গালে। দীপাও খেঁকিয়ে ওঠে। প্রিয়তার গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হতেই লেডি কনস্টেবল আটকায়। প্রহর আটকায় প্রিয়তাকে। নিজের কাছে টানে। বলে,

” আইন নিজের হাতে তুলতে হবে না আপনাকে। উনার ফাঁ”সিই হবে। একটি খুন, দুজনকে ব্ল্যাকমেইল করে সম্পত্তি আদায়, আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করা। সব মিলিয়ে উনি আজন্ম থেকে যাবেন জেলে। নয়তো ফাঁ”সি।

ইহান হকচকিয়ে বলে ওঠে,
” তোদের মে”রে ফেলার চেষ্টা করেছে ও?

প্রহর থেমে বলে,
” হ্যাঁ। আরহামের অ্যাক্সি”ডেন্ট উনিই করিয়েছিলেন। আসলে আঙ্কেল অনেক আগে থেকেই চাইছিলেন আরহামকে কিছু সম্পত্তি লিখে দিতে। দীপা আন্টি এটা মানতে পারেননি। আরহামকে সম্পত্তি গ্রহণে অক্ষম বানাতে চেয়েছিলেন। উনি আমাদের খোঁজ খবর রাখতেন। উনিও জাফরের মতো ভেবেছিলেন প্রিয়তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। তাই আমাদের সম্পর্ক ভা”ঙা আর আরহামের ক্ষতি দুটোই একসাথে করতে চেয়েছিলেন উনি। লোক দিয়ে প্রিয়তাকে কল করে বলেছিলেন আমার শত্রুরাই আরহামের অ্যাক্সি”ডেন্টের কারণ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে এসেছে। আগের ঘটনাগুলোর সত্যতা জানতে পেরেছি এখন।

প্রিয়তার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। আব্বুর জন্য পড়ান পুড়ে প্রিয়তার। জ্বলে ওঠে বক্ষস্থল। ক্ষত-বিক্ষত হয় হৃদয়। সে তো আরিফের ক্ষতি চায়নি। চায়নি এভাবে উনি মারা যান। তবে কেন প্রিয়তার সাথেই এমন হয়? কেন সুখ এত দ্রুত ফুরিয়ে যায়?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৮ )

আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। আকাশের তারা গুলো একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে। শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রিয়তাকে।প্রিয়তার কোলে ঘুমিয়ে আছে আরহাম। বোনের সাথে গল্প করতে করতে কখন যে ছেলেটার চোখ লেগে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি সে। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রিয়তা ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে তার ভাই ঘুমে ঢুলছে। চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে ছেলেটার। প্রিয়তা ভাইয়ের ছোট্ট মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে নেয়। বসে থাকে দীর্ঘসময় ধরে। হাত বুলিয়ে দেয় আরহামের মাথায়। চুমু খায় খানিক ক্ষণ পর পর। বেলকনি থেকে বাইরের পরিবেশ দেখতে বেশ ভালোই লাগছে প্রিয়তার। আরহামকে বিছানায় ঠিকঠাক ভাবে শুইয়ে দিয়ে পুনরায় বেলকনিতে ফিরে সে। হাতে তার কাচে বন্দী ছবি। ছবিটিতে আরিফ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে গোলাপী রঙের টাওয়ালে পেঁচানো আরহামকেও দেখা যাচ্ছে। আরিফের পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়েছে প্রিয়তা। ছবিটা তুলে দিয়েছিল প্রীতিলতা। পোজ দিতে গিয়ে অনেক মজা হয়েছিল সেদিন। ভাবতেই চোখ ভিজে আসে প্রিয়তার। কতই না সুখী ছিল তারা। কোনো কিছুর অভাব ছিল না তাদের। আনন্দে কেটে যেত সব দিন। খুনশুটিতে মেতে থাকতো প্রিয়তা। স্কুল থেকে ফিরেই আম্মুর পাশে বসে আড্ডা দিতো সে। কাজ থেকে ফিরে আরিফ সিঙারা, ভেলপুরি, চটপটি নিয়ে আসতো। একসাথে খেতো বাড়ির সবাই। আর আজ? আজ কে কোথায় গিয়ে আস্তানা গড়েছে সে খবর ও কেউ রাখে না। কেমন চলছে সবার জীবন?

প্রিয়তার কণ্ঠ কাঁপে। ছবিটিতে হাত বুলায় সে। নোনা পানির কণা ছবিটিতে পড়ে। ঝাপসা হয় প্রিয়তার চোখ। আব্বুর ছবিতে চুমু আঁকে সে। গভীর কণ্ঠে বলে,

” আব্বু, ও আব্বু। ফিরে আসো না। আমি তো তোমাকে সেই কবেই মাফ করে দিয়েছি। তুমি বোঝোনি? ফিরে আসো না। ওই মহিলা তোমাকে মেরে ফেলেছে না? ও খুব শাস্তি পাবে দেখে নিও। ও সুখে থাকবে না। তুমি ফিরে এসো প্লিজ। আমি তোমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি তাইনা? আর কখনো করবো না। তুমি আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিও। তোমার ক্ষতি আমি কোনোদিন চাইনি, কোনদিন না।

কাঁদে প্রিয়তা। ছবিটা বুকে জড়িয়ে রাখে। এলোমেলো লাগে সবকিছু। জীবনটাকে বৃথা মনে হয়। তছনছ করে দিতে ইচ্ছে হয় সব। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি ওঠে প্রিয়তার। পুনরায় ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলে,

” আমার এত দুঃখ কেন আব্বু? আমার এত যন্ত্রণা কেন?

নিদারুণ যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে প্রিয়তা। গলা শুষ্ক হয়ে আসে। মাথা ব্যথায় কুঁচকে আসে মুখ। জ্বালা হয় বুকে। অন্তস্থলে দহন জ্বলে। প্রহর বাড়ি ফিরে। ডাকে প্রিয়তাকে। প্রিয়তা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ছবিটি রেখে ঘরে প্রবেশ করে। প্রহরকে ক্লান্ত দেখায়। প্রিয়তার দিকে না তাকিয়ে ঘড়ি টেবিলে রাখতে রাখতে বলে,

” আরহাম ঘুমিয়েছে কখন? আমি যে চিকেন ফ্রাই আনলাম ওর জন্য। না খেয়েই ঘুমাল?

প্রিয়তা চোখ মুছে। মলিন হাসে। বলে,
” পড়াশোনা নেই। শুধু ঘুমায়।

প্রিয়তার কণ্ঠ ভেঙে গেছে। প্রহর বুঝতে পারে প্রিয়তার অবস্থা। হাত পা ধুয়ে প্রিয়তাকে টেনে বেলকনিতে নিয়ে আসে। মৃদ্যু হাওয়ায় প্রিয়তার দীর্ঘ লম্বা চুল দুলে ওঠে। প্রহর অবাধ্য চুলগুলোকে প্রিয়তার কানে গুঁজে মোলায়েম কণ্ঠে বলে,

” খুব কষ্ট হচ্ছে আমার প্রিয়র?

প্রিয়তা নাক টানে। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,
” কষ্ট ছাড়া কিচ্ছু তো নেই জীবনে।

প্রহর প্রিয়তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নেয়। ঘাড়ে চুমু আঁকে আলতো ভাবে। প্রিয়তার ঘাড়ে চিবুক রেখে তর্জনী আকাশের দিকে তুলে প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলে,

” যে তারাটি আজ সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছে, ওটাই আপনার আব্বু। দেখুন প্রিয়।

প্রিয়তা অবাক চোখে তাকায় তারাগুলোর পানে। আকাশে থাকা অনেকগুলো তারার ভিড়ে একটি তারা সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছে। আশপাশের এতগুলো তারার ভিড়ে এই একটি তারা-ই নজর কাড়ছে। প্রিয়তা নিজেও তর্জনি ওঠায়। বলে,

” ওইটা?

মাথা নাড়ে প্রহর। বলে,
” বাবা যেমনই হোক। মেয়ের সুখে বাবা খুশি হতে বাধ্য। আপনাকে আমার নিকট সুখী দেখে আপনার আব্বু হাসছে। তাই তো এত আলো ছড়াচ্ছে। দেখুন।

এই মুহুর্তে প্রিয়তা অবুঝ, নাদান ইমম্যাচিওর হয়ে গেল যেন। প্রহরের কথাটুকু খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিল প্রিয়তা। মুখে হাসি ফুটল। উজ্জল চোখে বলল,

” ওইযে, আব্বু। ওই তারাটার দিকে তাকিয়ে আব্বুকে স্মরণ করলে আব্বুর মুখ ভেসে উঠছে। ওটাই আব্বু। হ্যাঁ ওটাই।

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটার দুঃখ গুলো এত গভীর যে কেউ শুনলেও দুঃখ পাবে। প্রিয়তাকে সময় দেয় প্রহর। বলে,

” আপনি আপনার আব্বুর সাথে কথা বলুন প্রিয়। আমি আরহামকে ডাকি।

প্রহর চলে যেতেই প্রিয়তা বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মন খারাপ হয় খুব। আশপাশে তাকিয়ে খানিক উচ্চস্বরে বলে ওঠে,

” জেনে রাখো প্রকৃতি। তুমি ভুল মানুষের উপর প্রতিশোধ নিয়েছো। আব্বুর প্রতি আমার কখনো ঘৃণা জন্মায়নি, বিতৃষ্ণা জন্মায়নি। অভিযোগ করার দায়ভার এত কষ্টের হবে জানলে আমি বোবা হয়ে থাকতাম। মনে মনেও আব্বুর প্রতি অভিযোগ করতাম না।

প্রহর চলে আসে ঘরে। আরহাম ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমোচ্ছে। পাতলা চুলগুলো উড়ছে। আরহামের ঘন, বড় চোখের পাপড়িগুলো দেখতেও ভালো লাগে। প্রহর খুব ধীর করে কণ্ঠে ডাকে আরহামকে।

” আরহাম। ওঠো।

আরহাম উঠে না। একদম বোনের মতো হয়েছে ছেলেটা। প্রথম ডাকে উঠতে চায় না একদম। প্রহর আরহামের পাশে বসে। কণ্ঠ একটু উঁচু করে বলে,

” আরহাম। উঠো। খাবে না?

আরহাম চোখ মেলে। আশপাশে তাকিয়ে সকাল হয়েছে কিনা দেখে। ঘুমুঘুমু কণ্ঠে বলে,

” ডাকো কেন ভাইয়া?

” তুমি বলেছিলে চিকেন ফ্রাই খাবে। আমি কিনে আনলাম। এসে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। এখন ঘুমানোর সময়? উঠো। খেয়ে আবার ঘুমোবে।

আরহাম পিটপিট করে তাকায়। হাত দিয়ে নাক ঘঁষে। অলস ভঙিতে বলে,
” খুব ঘুম পাচ্ছে ভাইয়া। পরে খাবো।

এইবার প্রহর ধমক দেয়। ছেলেটা না খেয়ে ঘুমোবে এটা হয়? আরহামকে ছাড়া সবাই বাইরের খাবার খাবে? অন্যায় হবে খুব। একটু ধমকে প্রহর বলে উঠে,

” ভাইয়া কিন্তু আর কথা বলবো না। না খেয়ে ঘুমোতে হবে না। খেয়ে আবার ঘুমোবে। এখন ওঠো। নিধি অপেক্ষা করছে। ফ্রাইটা খুব মজা হয়েছে। খেতে আসো।

আরহাম উঠতে চেয়েও উঠে না। প্রহর জগে থাকা পানি হাতের তালুতে নিয়ে আরহামের মুখে ছিটিয়ে দেয়। আরহামের মুখ মুছিয়ে দেয় পানি দ্বারা। অতঃপর কোলে করে নিয়ে যায় ডাইনিং টেবিলে।

_______

তানিয়া একটা ভুল করে ফেলেছে। ভুলটা বড়সড় না হলেও ভয় লাগছে তানিয়ার। ইহান রাগী মানুষ। জানতে পারলে একদম মেরে ফেলবে তাকে? মেরে ফেলবে? নিজ মনে আওড়ায় তানিয়া। না না। পুলিশ হয়ে খুন করবে? সামান্য একটা পারফিউমের জন্য নিজের স্ত্রী কে খুন করবে না ইহান। উঁহু গায়েও হাত তুলবে না। কিন্তু বকবে, হ্যাঁ খুব বকবে তানিয়াকে। ঝড় হবে বাড়িটাতে।

ইহান থানা থেকে ফিরে। তানিয়ার জন্য গোলাপ ফুলের তোড়া এনেছে সে। গোলাপ গুলো তানিয়াকে দিবে কি দিবে না এই নিয়ে দ্বিধায় আছে ইহান। গোলাপগুলো তানিয়ার হাতে দিয়েই বা কি বলবে সে? কেন এনেছে জানতে চাইলে কি উত্তর দিবে? ভাবতে পারে না ইহান। গোলাপগুলো রেখে দেয় ওয়ারড্রবের উপরে। তানিয়া ঘরে এলেই দেখতে পাবে ফুলগুলো। পুলিশের ইউনিফর্ম ছেড়ে টি শার্ট পড়ে তানিয়ার জন্য অপেক্ষা করে ইহান। ঘর জুড়ে কমলার ঘ্রাণ ভাসছে। নাক উঁচু করে ঘ্রাণ শুকে ইহান। তানিয়াকে ডাকে ততক্ষণাৎ। ভীত ভঙ্গিতে ঘরে আসে তানিয়া। চশমা ঠেলে তটস্থ হয়ে তাকায় ইহানের পানে। বলে,

” ডাকছেন কেন?

ইহান পুনরায় ঘ্রাণ শুকে বলে,
” ঘরে এয়ার ফ্রেশনার দিয়েছো কেন? এই ঘ্রাণটা আমার পছন্দ না। আম্মা কিনে এনে রেখেছে স্প্রে টা। আমি ব্যবহার করিনি কখনো। ঘ্রাণটা বিশ্রী। ঘরে স্প্রে করেছো কেন হঠাৎ?

তানিয়া চমকায়। ইহানের নিকট একটি দামী, ব্র্যান্ডের পারফিউম ছিল। দুবাই থেকে এক বন্ধু ইহানকে পারফিউমটা পাঠিয়েছিল মাস তিনেক আগে। মাঝারি কাচের বোতলে থাকায় অনেকদিন ব্যবহার করা গিয়েছে পারফিউমটা। ড্রেসিং টেবিল পরিষ্কার করতে গিয়ে হাতে লেগে পারফিউমের কাচের বোতলটি মেঝেতে পড়ে ভেঙে গিয়েছে। যতটুকু পারফিউম ছিল পুরোটাই মেঝেতে পড়ে গেছে। কাচ গুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মেঝেতে। ভয় পেয়ে যায় তানিয়া। দ্রুত কাচ তুলে মেঝেটা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেলে। কিন্তু পারফিউমের কড়া, সুন্দর ঘ্রাণ পুরো ঘরে বিরাজমান ছিল। কোনোভাবেই যাচ্ছিল না সুন্দর ঘ্রাণটা। ইহান ঘরে ঢুকলেই বুঝতে পারবে তার শখের পারফিউমটা পুরো ঘরে স্প্রে করা হয়েছে। তাই তানিয়া কমলার সুঘ্রাণ দেওয়া এয়ার ফ্রেশনার ঘরে স্প্রে করে দিয়েছে। পারফিউমের ঘ্রাণটা লুকাতে এই ব্যবস্থা করার পর বিপদ বাড়ল যেন। এয়ার ফ্রেশনারের ঘ্রাণটা ইহানের পছন্দ নয়। তানিয়া থতমত খেয়ে বলল,

” ওয়ারড্রবের পিছনে ইঁদুর মরে পড়ে ছিল। অনেকদিন ধরে মরা ইঁদুর পড়ে ছিল বলে পচে দুর্গন্ধ বেরিয়েছিল ঘরে। তাই তো এয়ার ফ্রেশনার দিলাম।

ভ্রূ কুঁচকাল ইহান। বললো,

” কই আমি তো দুর্গন্ধ পাইনি এতদিন। আমার ঘরে ইঁদুর ও তো ছিল না।

সন্দিহান চোখে তাকায় ইহান। তানিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে। কি বলবে ভেবে পায় না। তবুও বলে,

” ছিল আপনি খেয়াল করেননি।

ইহান বোধহয় বিশ্বাস করল। ড্রেসিং টেবিলে নজর ফেলল। সেথায় তানিয়ার লোশন, শ্যাম্পু, তেল, পাউডার সবকিছু গুছিয়ে রাখা। আগে এসব ছিল না। কেবল ইহানের ব্যবহৃত সামগ্রীই ছিল। তানিয়া ঘর পরিষ্কার করেছে তা বুঝেছে ইহান। ঘরটাকে দেখতে ভালো লাগছে। খানিক হেসে ইহান বলে ওঠে,

‘ তুমি তো খুব কাজের হয়ে গেছো তানু। আই লাইক ইট।

মুখ ফুলায় তানিয়া। প্রশংসা শুনে ভালো লাগার কথা ছিল তানিয়ার, কিন্তু তানিয়া খুশি হতে পারল না। তেজস্বী কণ্ঠে বলল,
” আপনি তো মনে করেন আমি কোনো কাজই পারি না।

ইহান হাসে। তানিয়া নিজের ভুল স্বীকার করতে উদ্যত হয়। স্বামীর সাথে এত লুকোচুরি করতে বিবেকে বাঁধে। ইহানের কাছে এসে মাথি নত করে তানিয়া বলে,

” আপনার প্রিয় সুগন্ধিটা আমি ভেঙে ফেলেছি।

ইহান তানিয়ার দিকে তাকায় স্বাভাবিক ভঙিতে। তানিয়া পুনরায় কিছু বলতে নিলেই ইহান থামায়। বলে,

” আমি জানি।

অবাক হয় তানিয়া। ইহানের পাশে বসে পড়ে ধপ করে। বলে,

” আপনি কিভাবে জানেন?

” হুট করে আজ ঘরে এয়ার ফ্রেশনার দিয়েছো, ড্রেসিং টেবিলে সব থাকলেও শুধু পারফিউমটা নেই, তোমাকেও ভীত দেখাচ্ছে। বুঝবো না কেন?

” আপনি তো আমাকে বকলেন না? আপনার প্রিয় ছিল ওটা।

ইহান চমৎকার হাসে। তানিয়াকে তড়িৎ গতিতে কাছে টেনে আনে। কোলে বসায় নিজের। তানিয়ার ঘাড়ে চিবুক রেখে ভরাট পুরুষালি কণ্ঠে বলে,

” ভালোবাসার মানুষের এমন ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি মাফ করাই যায়।

কেঁপে ওঠে তানিয়া। ঘাড়ে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া পায়। ইহানের এহেন মোলায়েম কণ্ঠ ভারী মধুর লাগে। বারংবার শুনতে ইচ্ছে করে ইহানির কণ্ঠ। নিজেকে দমায় তানিয়া। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

” আপনি কি ইনডিরেক্টলি আমাকে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে সম্বোধন করছেন?

তানিয়ার পেটে হাত রাখে ইহান। চুমু আঁকে তানিয়ার কপোলে। বলে,

” ডিরেক্টলিই বলছি।

তানিয়া চুপ থাকে। নিজেকে খুব বিশেষ মনে হয় তানিয়ার। ইহান পুনরায় ডাকে।

” তানু,

থমকে থাকে তানিয়া। শব্দ বেরোয় না কণ্ঠনালী থেকে। ইহানের ডাকে মনে হয় মাদক মেশানো। সম্মোহনী কণ্ঠে তানিয়া উত্তর দেয়,

” হুহ্?

ইহান চুপ থেকে ফিসফিস করে বলে,
” ভালোবাসি।

_______

প্রিয়তা বালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে বিছানার অপর প্রান্তে। প্রহর ঘরে ঢুকে প্রিয়তাকে পর্যবেক্ষণ করে। বাল্ব নিভিয়ে প্রিয়তার পাশে এসে শোয়। শক্তপোক্ত হাত দ্বারা পেটে চাপ প্রয়োগ করে প্রিয়তাকে নিজের কাছে আনে। মেয়েটার শরীর নরম। কাছে এলেই কেমন নেশা ধরে যায়। প্রিয়তার গায়ে ওড়না নেই। বক্ষ উন্মুক্ত। বক্ষবিভাজনের নরম মাংসপিণ্ডের ভাঁজ চোখে লাগে প্রহরের। সেদিক থেকে চোখ সরায়। প্রিয়তা জড়িয়ে ধরে প্রহরকে। বলে,

” আরহাম ঘুমিয়েছে?

প্রহর আরহামকে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। কারন প্রহর নিজেই ছেলেটার কাচা ঘুম ভেঙে দিয়েছে। প্রিয়তা তাই বলেছিল আরহাম না ঘুমোলে প্রহরকে আজ খুব বকবে সে। অগত্যা বাধ্য হয়ে আরহামের সাথে এত রাত অবধি খেলাধুলা করে ঘরে ফিরল প্রহর। লোকটা আরো ঘনিষ্টভাবে আঁকড়ে ধরে প্রিয়তার কোমর। বলে,

” ঘুমিয়েছে।

প্রিয়তা মুখ গুঁজে প্রহরের বলিষ্ঠ, সুঠামদেহী বুকে। নাক ঘষে সেথায়। প্রহর হাসে। প্রিয়তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

” কাল ভোরে আমরা ঢাকায় ফিরবো প্রিয়।

” কাল? এত তাড়াতাড়ি?

” আপনার ইউনিভার্সিটি, আমার চাকরি, আরহামের স্কুল সবই তো ওখানে। আমার ছুটির মেয়াদ শেষ। আরো গ্যাপ দিলে বস অফিস থেকে বের করে দিবে। তখন আপনার স্বামী
যে বেকার হয়ে যাবে প্রিয়।

” কাল না গেলে হয় না?

” উঁহু হয় না। মাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। টিকিট কেটেছি। আবার আসবো প্রিয়। কাল যেতেই হবে।

প্রিয়তা মানে। প্রহরের গভীর, অন্তর্ভেদী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। হেসে বলে,

” নিভৃতে যেইজন রয়ে যায়,
সে-ই তো প্রিয়জন।❤

_______

বেশ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য তৈরী হলো প্রিয়তা আর আরহাম। আরহামের ভিষণ মন খারাপ হয়। এখানে থাকতেই বেশি ভালো লাগে আরহামের। তবুও প্রহরের কথা শুনে ঢাকায় যেতে আপত্তি নেই আরহামের। ভালো শার্ট প্যান্ট পড়ে আরহাম এসে দাঁড়াল দরজার সম্মুখে। প্রিয়তা একে একে বিদায় জানাল সবাইকে। এখান থেকে যেতে তার ও খারাপ লাগছে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রিয়তা লাগেজ টেনে দরজার সম্মুখে আসতেই চির চেনা মুখের এক মহিলাকে দেখতে পায়। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয় প্রিয়তা। প্রীতিলতাকে এতদিন পর সামনাসামনি দেখে কেমন অভিব্যক্তি দেখানো উচিত বুঝতে পারে না সে। প্রীতিলতার শরীর রুগ্ন, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। কেমন বিমর্ষ হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার পানে। প্রীতিলতার চোখে পানি চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে শ্বাস নিচ্ছে খুব কষ্ট করে। প্রিয়তা মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটার প্রতি রাগ, ক্ষোভ কোনোটাই দেখায় না প্রিয়তা। কি বলা বা করা উচিত ভেবে পায় না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে প্রিয়তার। আবেগ ঠেলে বেরিয়ে আসে। প্রীতিলতা এগিয়ে আসে ধীর পায়ে। শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে ডাকে,

” প্রিয়তা।

প্রিয়তাও ধীর পায়ে এগোয়। আম্মুকে এসময় এখানে দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি কষ্ট জমে প্রিয়তার হৃদয়ে। দম নিতে কষ্ট হয়। চোখের কার্ণিশে পানি জমে। ঢোক গিলে বলে,

” আম্মু, তু..তুমি। এখানে?

প্রীতিলতা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে প্রিয়তাকে। প্রিয়তার মাথা নিজের ঘাড়ে আঁকড়ে ধরে। হু হু করে কেঁদে ফেলে মহিলা। ঢুকরে ওঠে। ফর্সা মুখখানি লাল হয় প্রীতিলতার। অগোছালো চুলগুলো পানিতে ভিজে মুখে এঁটে থাকে। কান্না একটু কমিয়ে প্রীতি বলে,

” কেমন আছিস মা?

মায়ের কণ্ঠস্বরে প্রিয়তার শরীর কেঁপে ওঠে। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় হৃদয়। এ ডাক শোনার আশায় যেন মুখিয়ে ছিল প্রিয়তা। প্রিয়তার হুঁশ ফিরে। বুঝতে পারে ভুল হচ্ছে। ততক্ষণাৎ ছেড়ে দেয় প্রীতিলতার বুক। মনে পড়ে প্রীতিলতার বিশ্বাসঘাতকতার কথা, পরকিয়ায় জড়িয়ে আরহাম আর তাকে বের করে দেওয়ার কথা, আরিফের মৃত্যুর কারণটাও মনে পড়ে প্রিয়তার। চোখ মুছে সে। দৃঢ় হয় চোখ। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে ওঠে,

” কি চাই আপনার? কেন এসেছেন?

প্রীতিলতা মুখে হাত চেপে কাঁদতে থাকে। মিসেস নাবিলা প্রিয়তা আর প্রীতিলতার কথোপকথন শুনে প্রীতিলতাকে চিনতে পারে। মহিলাকে কাঁদতে দেখে মায়া হয় উনার। প্রীতিলতাকে নিয়ে গিয়ে বসায় সোফায়। কাচের গ্লাসে পানি এনে দেয়। প্রিয়তা গম্ভীর থাকে। প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বিরক্ত ঠেকে সবকিছু। পুনরায় কণ্ঠে জোর এনে বলে,

” প্রশ্নের উত্তর দিন। আবার কি কেড়ে নিতে এসেছেন আপনি? আর কি চাই আপনার?

প্রীতি ফোলা চোখ দুটো মুছে উঠে দাঁড়ায়। অসহায় কণ্ঠে বলে,
” আমি খুব অসুস্থ প্রিয়তা। আমি আশ্রয় চাইতে এসেছি।

ভ্রু কুঁচকায় প্রিয়তা। প্রহর গিয়েছে কিছু কেনাকাটা করতে। এসময় লোকটা থাকলে পরিস্থিতি খুব সহজেই সামলাতে পারতো। কোন সময় কোন অভিব্যক্তি দেখানো উচিত তা প্রহর বেশ ভালোই জানে। এই মুহুর্তে প্রহরকে খুব চাইল প্রিয়তা। মিসেস নাবিলা জিজ্ঞেস করলেন,

” আপা, কি হয়েছে আপনার?

” আমার গর্ভপাত হয়েছে আপা। আমি গর্ভবতী ছিলাম। আমার বর্তমান স্বামী খুব খুশী ছিল সে বাবা হবে বলে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল ? সব শেষ হয়ে গেল। তিন দিন আগে কিছুটা ব্লাড বেরোয়, সেই রাতে প্রচুর ব্লিডিং হয়। ডক্টর জানায় আমার বাচ্চা পেটেই নষ্ট হয়ে গেছে। গোপনাঙ্গে সিস্ট ধরা পড়েছে। যোনিতে টিউমার হয়েছে। অপারেশন করেছে সেই রাতে। ডাক্তার জানিয়েছে আমি আর মা হতে পারবো না। কোনোদিন না। সেই ক্ষমতা হারিয়েছি আমি।

বলার সাথে সাথেই কেঁদে দিল প্রীতিলতা। কেঁদে কেঁদেই বলল,
” হাসপাতালে ছিলাম দুদিন। আমার শাশুড়ি কিংবা স্বামী কেউই আমাকে এ দুদিন দেখতে আসেনি। অপারেশনের বিল ও দেয়নি। আজ বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। ওরা আমাকে দেখেই দরজা বন্ধ করে দিল। সন্তান জন্মদানে অক্ষম কোনো মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারছে না আমার শাশুড়ি। আমার স্বামী আজিজ আমাকেমুখে মুখেই তিন তালাক দিয়ে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। তার সন্তান চাই। কিন্তু আমার তো সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমি এখন কোথায় যাবো বলেন? চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি কিছুদিন আগে। সবে অপারেশন হয়েছে। হাঁটতেও পারছি না, পেটে ব্যথা হচ্ছে। কি করবো বলেন? এখন তো কাজ করা সম্ভব না। কোথায় যাবো আমি?

প্রিয়তা সবটা শুনে। হু হু করে ওঠে তার বুক। এতকিছু হয়ে গেল অথচ সে কিছুই জানে না। জেনেই বা কি করতো সে? এই মহিলার জন্যই তো তার আব্বু মরেছে। কি করে প্রিয়তা ভুলবে সে কথা? প্রীতি এগিয়ে আসে প্রিয়তার নিকটে। প্রিয়তার হাত ধরে বলে,

” আমাকে ক্ষমা করে দে প্রিয়তা।

প্রিয়তার খানিক মায়া হয়। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা তার মা। সে যতই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, খারাপ হোক না কেন সে তো প্রিয়তার মা-ই। এই মানুষটা প্রিয়তাকে জন্ম দিয়েছে, পেটে রেখেছে দশ মাস। উনিশটা বছর প্রিয়তার সব দায়িত্ব পালন করেছে প্রীতিলতা। স্থান দিয়েছে নিজের গৃহে। ষোলটি বছর অতি যত্নে লালন-পালন করেছে। সন্তান হিসেবে মায়ের পাশে থাকাটা প্রিয়তার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব কিভাবে এড়িয়ে যাবে সে? কিভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবে? উক্ত অনুরোধে প্রিয়তা মলিন হাসে। বলে,

” আপনাকে ক্ষমা করতে না পারার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। তা আমি এড়িয়ে যাবো না। আর না অতিত ভুলে যাবো।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে