#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৫)
রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। প্রিয়তা বসে আছে বিছানার মাঝ বরাবর। প্রহর এখনো ঘরে আসেনি। ঘড়ির কাটা টিকটিক শব্দ করে সময় জানান দিচ্ছে। প্রিয়তার অগোছালো লাগে নিজেকে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে বিছানায়। বারোটা দশে ঘরে ফিরে প্রহর। ছেলেটার গায়ে পাঞ্জাবি। চুলগুলো গোছালো প্রিয়তাকে এখনো জেগে থাকতে দেখবে আশা করেনি প্রহর। প্রিয়তাকে বসে থাকতে দেখে খানিক অবাক হলো সে। ভেবেছিল প্রিয়তা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু না, প্রিয়তা তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছে অধীর চিত্তে। প্রহরকে দেখেই কেমন হেলেদুলে উঠল প্রিয়তা। লজ্জায় নত হলত মুখ।
প্রহর প্রিয়তার সম্মুখে এগিয়ে আসে। প্রিয়তা তন্ত্র পায়ে নামে বিছানা থেকে। খানিক ঝুঁকে ডান হাত দিয়ে প্রহরের দু পা ছুঁয়ে সালাম করে। বিষয়টা ভালো লাগে না প্রহরের। স্ত্রীর নত মুখের চিবুক দু আঙুল দ্বারা সোজা করে। স্ত্রীর পানে তাকিয়ে থাকে অপলক। প্রিয়তার চোখ জোড়া ফোলা ফোলা। কেঁদে চোখ-মুখ লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। প্রিয়তার ডাগর ডাগর চোখে কষ্টের রেশ। ধক করে ওঠে প্রহরের বুক। প্রসাধনী ব্যবহার ব্যতিত অগোছালো স্ত্রী কে বড্ড নিষ্পাপ লাগছে প্রহরের নিকট। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সে বলে,
” পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবেননা। মুখে মুখেই সালাম দিবেন। মনে থাকবে?
প্রিয়তা মাথা নাড়ে। প্রিয়তার মাথা থেকে আঁচল সরে যায়। খানিক হেসে যত্নের সাথে আঁচলটা ঠিক করে দেয় প্রহর। প্রিয়তাকে বিছানায় বসিয়ে পাঞ্জাবির উপরের একটি বোতাম খুলতে থাকে। প্রিয়তা তাকিয়ে থাকে স্বামীর পানে। প্রশ্ন করে,
” এত দেরি হলো যে, কোথায় ছিলেন?
প্রহরের হাত থামে। ভড়কায় না ছেলেটা। মেকি হেসে বলে,
” কেন? আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?
প্রিয়তা থমকায়। পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। প্রহর বুঝে যায় প্রিয়তার মনের কথা। প্রহরের জন্য অপেক্ষা করছিল মেয়েটা। বলতে পারছে না সংকোচে, লজ্জায় পাঞ্জাবিটা পাল্টে ডেনিম শার্ট গায়ে জড়ায় প্রহর। প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলে,
” শাড়িটা বেশ ভারী আর ঝকমকে। ঘুমোতে পারবেন না। চেঞ্জ করে আসুন।
প্রিয়তা লাগেজে থাকা প্লাজু আর ঢিলেঢালা লেডিস ডেনিম শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ছোটে। মুখ আর হাত পা ধুয়ে প্লাজু আর শার্ট পরেই বের হয় প্রিয়তা। গলায় জড়ায় সিল্কের ওড়না। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রিয়তা থমকে যায়। এতক্ষণ জ্বলে থাকা বাল্বটা এখন নেভানো। পুরো ঘরটা অন্ধকার। গুমোট অন্ধকারে সামনে পা ফেলতেও ভয় লাগে প্রিয়তার। চঞ্চল হয় প্রিয়তার কায়া। এদিক ওদিক তাকিয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে প্রহরকে ডাকে,
” প্রহর, কোথায় আপনি? এত অন্ধকার কেন?
প্রহরের উত্তর আসে না। হঠাৎই শীতল এক শক্তপোক্ত হাত প্রিয়তার পেটে বিচরণ করতে থাকে। প্রিয়তার গলায় আর পেটে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে সান্নিধ্যে আগলে রাখে অবয়বের প্রশস্ত বুকের সাথে। প্রথমে ভয় পেলেও খানিকক্ষণ দম নিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। পারফিউমের ঘ্রাণটা ভিষণ চেনা চেনা লাগে। গভীর স্পর্শ আঁকা মানুষটাকে চিনতে অসুবিধে হয় না প্রিয়তার। ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে অনায়াসে। হাত দুটোর উপর প্রিয়তা তার নরম হাত চেপে ধরে। প্রশান্তিতে চোখে বুজে বলে,
” ভয় পেয়েছিলাম তো।
প্রহর মুখ গুঁজে প্রিয়তার ঘাড়ে। ওষ্ঠ ছোঁয়ায় নিবিড় ভাবে। কেঁপে উঠে প্রিয়তা। ছটফট করে বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। অস্থির লাগে প্রিয়তার। হৃদস্পন্দন থামে। স্বেদজল গড়ায় ললাট বেয়ে। প্রহর হাতের বন্ধন ছিন্ন করে পিছন থেকে পুনরায় জড়িয়ে ধরে প্রিয়তাকে। প্রিয়তার ঘাড়ে মাথা রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,
” আমি ছাড়া আপনাকে ছোঁয়ার সাধ্যি কার?
প্রিয়তার ভালো লাগে এই গভীর আলিঙ্গন। কিন্তু এ আলিঙ্গনের সময়সীমা দীর্ঘ হয় না। প্রিয়তাকে ধীরে সুস্থে বিছানায় বসায় প্রহর। রঙ বেরঙের মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে ঘরের সর্বত্রে। অতঃপর প্রিয়তার পিঠের দিকে এসে শুয়ে পরে নির্বিকার চিত্তে। প্রিয়তাকেও ইশারায় শুতে বলে পাশে। প্রিয়তা বাধ্য মেয়ের মতো প্রহরের পাশে শোয়। প্রহর কাছে টানে প্রিয়তাকে। স্ত্রীর মাথায় হাত বুলায়। শক্তপোক্ত এক হাত রাখে প্রিয়তার নরম গালে। দীর্ঘ সময় ধরে চুমু খায় ললাটের মাঝখানে। জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে খানিকক্ষণ। প্রিয়তার কান্না পায়। চোখের পাপড়ি ভিজে আসে। আব্বুর মৃত্যুর বিষয়টা তাকে ভেঙে দিয়েছে। আনন্দ উল্লাস সব যেন কেড়ে নিয়েছে। প্রহরের চোখ জোড়া বন্ধ। নিঃশব্দে কাঁদে প্রিয়তা। শব্দ করে না কোনো। মোমবাতি গলে নিভে গিয়েছে মাত্র। পুরো ঘরটা আবারও অন্ধকার হয়েছে। এই অন্ধকারে প্রিয়তা মন ভরে কাঁদে। শ্বাস ফেলে ঘর ঘন। প্রিয়তার পেটে শক্ত হাতের বিচরণ গাঢ় হলো হঠাৎ। প্রিয়তা হকচকিয়ে তাকায় প্রহরের পানে। প্রহর চোখ বুজেই বলে ওঠে,
” আর কাঁদবেন না প্রিয়তা। অনেক তো হলো।
প্রিয়তার হাত পৌছায় প্রহরের পিঠে। প্রহর চোখ খুলে প্রিয়তার দিকে সম্মোহনী দৃষ্টি ফেলে। প্রিয়তার নাকে নাক ঘঁষে। লজ্জায় জুবুথুবু হয় প্রিয়তা। নিচু কণ্ঠে বলে,
” আপনি কি করে বুঝলেন আমি কাঁদছি?
” আমি বুঝি আপনাকে প্রিয়তা।
প্রিয়তার চোখ পুনরায় অশ্রুসিক্ত হয়। বলে,
” আব্বু কেন চলে গেল বলুন তো? আব্বু হয়তো আমার উপর রাগ করে আছে। ভাবছে আমি তার মৃত্যুতে শোকাহত নই। স্বামী, সংসার নিয়ে আনন্দে আছি খুব।
” এমনটা ভাববেন না প্রিয়তা। ঘুমান। অনেক রাত হয়েছে। অসুস্থ হয়ে পরবেন। বি স্ট্রং প্রিয়তা। এখনো অনেক কিছু জানা আপনার বাকি। ঘুমোন
” ঘুম আসছে না তো।
” আসবে। আমি আদর দিই?
প্রিয়তা দ্রুত প্রহরের বুকে মুখ লুকায়। লাজে রাঙা হয় প্রিয়তার মুখশ্রী। চোখ বুজে ততক্ষণাৎ। বলে,
” ঘুমোচ্ছি, ঘুমোচ্ছি।
_______
সকাল সকাল ব্যাগ ভরতি বাজার এনেছে আজিজ। বাড়িতে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। আজিজ তার সন্তানের আগমনে বেশ আনন্দিত। কোনো কাজই বাদ রাখছে না সে। খাইরুন নাহার এর ব্যবহার বদলেছে। প্রীতির সাথে সর্বক্ষণ ভালো আচরণ করেন মহিলা। প্রীতিকে কোন কাজই করতে দিতে চান না। বাড়ির সব কাজ নিজের হাতেই করেন। প্রীতি চাকরি ছেড়েছে গতকাল। শরীর আজকাল ভালো যায় না তার। অফিসে তার অনুপস্থিতির পরিমাণ বেড়েছে। অফিসে কাজ করতে গিয়েও ঝামেলা হয় বেশ। এদিক ওদিক একটু হাঁটাহাটি করলেই যেন দম বেরিয়ে আসে। অফিসের সব কলিগ গত কয়েকদিন ধরে বলছিল চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসতে। আর গত দুদিন ধরে আজিজ আর খাইরুন নাহার ও জোড়াজুড়ি করছিলেন চাকরি ছাড়ার জন্য। শেষমেশ সন্তান আর নিজের অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে গতকাল চাকরিটা ছেড়েছে প্রীতি। বাড়িতে আরাম করছে। খাইরুন নাহারের নাতি-নাতনির প্রতি ভালোবাসার কারণে আগলে নিয়েছেন প্রীতিকেও। সর্বদা প্রীতির খেয়াল রাখছেন তিনি। আজিজ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে স্ত্রীকে খুশি রাখার। প্রীতির আজকাল নিজেকে সুখী সুখী লাগে। অনাগত সন্তানের প্রতি ভালোবাসা যদিও বাড়েনি, তবুও সবার ভালো ব্যবহারের আশায় প্রীতি সন্তানকে নিয়ে ভাবছে আজকাল। তবে নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছে না, এটা যেন হবারই ছিল। প্রিয়তার সাথে দেখা করার ইচ্ছেটাও ঝেঁকে বসেছে প্রীতির। আরহাম কেমন আছে? কতটুকু লম্বা হয়েছে ছেলেটা? প্রিয়তার জীবন কেমন চলছে? জানতে ইচ্ছে হয় প্রীতির। সময় হয় না দেখতে যাওয়ার। শুনেছে প্রিয়তা ফিরেছে। এখানেই আছে মেয়েটা। আরিফের মৃত্যুর সংবাদ শুনেছে প্রীতি। কেঁদেছে খানিক। মন খারাপ হয়েছে প্রচণ্ড। তবে লাশ দেখতে যেতে পারেনি সংসার হারানোর ভয়ে। আজিজ যদি জানতে পারে প্রাক্তন স্বামীর লাশ দেখতে অতদূর ছুটে গিয়েছে প্রীতি, তবে যাচ্ছে তাই বলে গালমন্দ করবে।
আজিজের ডাকে ধ্যান ভাঙে প্রীতির। হাত মুখ ধুয়ে বাইরে আসে। বাজার-সদাই রান্নাঘরে রাখছেন খাইরুন নাহার। প্রীতি বাইরে আসায় আজিজ বলল,
” কি কি রান্না হবে চটপট মাকে বলো। তোমার মনের মতো সব রান্না হবে। আমার বাচ্চা তৃপ্তি করে খাবে।
হাসে প্রীতি। এগিয়ে এসে বলে,
” তোমার বাচ্চার কি আমার পছন্দের খাবার ভালো লাগবে?
এহেন কথায় রুষ্ট হয় আজিজ। খেঁকিয়ে বলে,
” পছন্দ হবে না কেন? তোমারই তো গর্ভে আছে সে। তুমি যা খাবে তাই তো ওর পেটে যাবে নাকি। মায়ের পছন্দ-ই তো অনাগত সন্তানের পছন্দ।
প্রীতি কয়েক পদ খাবারের নাম বলে। খাইরুন নাহারের হাতে হাতে কাজ করতে প্রীতি এগিয়ে যায় রান্নাঘরে। খাইরুন নাহার সব সবজি গুছিয়ে কিচেন ড্রয়ারে রাখছিলেন। প্রীতিকে এগিয়ে আসতে দেখে বললেন,
” তুমি আবার আইতে গেলা ক্যান কউ তো? আমি কি সব করবার পারি না? আগে একাই একশো জনের লাইগা রান্দন করছি।
প্রীতি শসায় কামড় বসিয়ে বলে,
” আপনি তো আগে বলতেন আপনার শরীর ভালো যায় না। এজন্যে এলাম।
হাসেন খাইরুন। বলেন,
” আমার নাতি আইবো শুইনাই আমার রোগব্যাধি চইলা গেছে। কোনো রোগবালাই নাই এহন।
প্রীতি হাসে। গা ম্যাজ ম্যাজ করছে খুব। বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। লজ্জাস্থানে কিছুটা ভেজা ভেজা অনুভব করে। দ্রুত ওয়াশরুমে ছোটে প্রীতি। লজ্জাস্থান থেকে বের হওয়া তরল রক্তে একটুখানি ভিজে যায় শাড়ির নিচে থাকা বস্ত্র। অবাক হয় সে। প্রেগন্যান্সির সময় পিরিয়ড হবার তো কথা নয়। আগে এমনটা হলে স্বাভাবিক ভাবেই নিতো বিষয়টা। কিন্তু এখন এমন তরল দেখে ভয় পেল প্রীতি। চিন্তিত হলো বেশ।
_____
প্রিয়তা যে এ বাড়ির নতুন বউ তা সে অনুভব করতে পারছে না। মনে হচ্ছে এ যেন নিজেরই বাড়ি। চোখ মেলে সর্ব প্রথম প্রিয় পুরুষের দিকে নজর যায় প্রিয়তার। প্রহর তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। চুলগুলো ছেলেটার অগোছালো হয়ে চোখে এসে পড়েছে। ঘুমন্ত মুখখানা ভারী সুন্দর লাগছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় স্বামীর পানে। প্রিয়তা নজর ফেরায় না। তাকিয়ে থাকে সময় নিয়ে। খানিকক্ষণ পর উঠতে নিলেই পেটে প্রহরের হাতের বন্ধন গাঢ়ভাবে দমবন্ধ হয় প্রিয়তার। ভ্রূ কুঁচকায় ফেলে। মিছে বিরক্তি নিয়ে বলে,
” আপনি তাহলে ঘুমোননি? অভিনয় করছিলেন?
চোখ বুজেই হাসে প্রহর। প্রিয়তার বিরক্তি ভাব কাটে। অপলক চেয়ে থাকে প্রহরের হাসির পানে। লোকটা এত সুন্দর কেন? কেন এত মাদকতা এই মানুষটা ঘিরে? প্রহর বলে ওঠে,
” ঘুমোলে কি জানতে পারতাম আমার স্ত্রী আমাকে এত ভালোবাসে? এত চোখে হারায় আমাকে।
হেচকা টানে প্রিয়তাকে নিজের বুকের উপরে তুলে প্রিয়তার বক্ষদেশে চুমু আঁকে প্রহর। প্রিয়তা লজ্জায় মূর্ছা যায়। সরে আসে ততক্ষণাৎ। মেঝেতে দাঁড়িয়ে বলে,
” বাজে বকবেন না। ফ্রেশ হবেন। উঠুন জলদি।
প্রিয়তা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে দৌঁড়ায়। পনেরো মিনিট বাদে ফিরে আসে ঘরে। প্রহর তখনো শুয়ে আছে। বিরক্ত হয় প্রিয়তা। ব্লাউজের উপরে বড়সড় ওড়না জড়িয়ে বলে,
” বের হন ঘর থেকে। শাড়ি পড়বো।
প্রহর ওঠে বিছানা ছেড়ে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,
” আমি যে আপনার স্বামী তা কি ভুলে যাচ্ছেন?স্বামীর সম্মুখে কিসের এত লাজ?
রাগে চোখ পাকায় প্রিয়তা। প্রহর উঠে বাইরে চলে যায়। প্রিয়তার হাসি পায় ভিষণ। আজ তাদের ঘুরতে যাবার প্ল্যান আছে। তাইতো ইউটিউব দেখে শাড়িটা পড়তে চাইছে সে।
______
বারবার ঘড়ি দেখছে ইহান। তানিয়া ঘুমোচ্ছে। বেশ সকাল সকাল তানিয়ার বাড়িতে এসেছে ইহান। তানিয়ার ঘুম ভাঙতে চায়নি সে। তাই বসে আছে বিছানার পাশের চেয়ারে। তানিয়ার চোখে চশমা নেই। বদ্ধ চোখ জোড়ার মণি নড়চড় করছে। ইহান পুনরায় ঘড়িতে সময় দেখে। ইহানের পরণে ট্রাউজার আর টি শার্ট। তানিয়ার ঘুম থেকে ওঠার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ইহানের ও ঘুম পায়। বুকে দু হাত গুঁজে বসে থাকে।
সময় গড়ায়। দুপুরের দিক ঘুম থেকে উঠে তানিয়া। বিছানায় বসে বড়সড় হাই তোলে। হাত পা এদিক ওদিক মেলে অলসতা কাঁটায়। ঘোলাটে চোখের কারণে দেখতে পায় না ইহানকে। পুনরায় ঘুমোতে যাবার প্রস্তুতি নিতে নিলেই ধমকে ওঠে ইহান। চেঁচিয়ে বলে,
” ফারদার আর ঘুমোবে না। কটা বাজে ইডিয়ট। কোনো ডিসিপ্লিন নেই তোমার।
হঠাৎ ইহানের এমন কঠিন বাক্যে ভয় পায় তানিয়া। হকচকিয়ে যায়। দ্রুত চশমা চোখে এঁটে ইহানের দিকে তাকিয়ে ভড়কায় তানিয়া। হন্তদন্ত হয়ে পরণে থাকা প্লাজু পায়ের কব্জিতে টেনে আনে। বলে,
” আপনি এখানে? আমি কি স্বপ্নটপ্ন দেখছি নাকি?
ইহান বিরক্ত হয় তানিয়ার এমন অহেতুক কথাবার্তায়। বলে,
” মাথাটা কি গেছে নাকি? এত এত কথা বলো তোমার গলা ব্যথা করে না? কিভাবে পারো?
” আপনি কিভাবে পারেন এত রাগারাগি করতে? এত চেঁচাতে? আপনার মাথা কি কোনোদিন ঠান্ডা থাকে না?
কথা বাড়ায় না ইহান। তানিয়ার সাথে কথা বলার মানে ঝগড়াঝাঁটি করা। এটা আপাতত চাইছে না ইহান। রাগ কমিয়ে গাম্ভীর্য বজায় রেখে ইহান বলে,
” বাড়ি চলো।
হাসে তানিয়া। খানিক ভাব নিয়ে বলে,
” নিতে এসেছেন আমায়? এত প্রেম?
” আম্মা তোমাকে মিস করছে। সেজন্য নিতে এসেছি। আমার কি অত ঠ্যাকা?
” সে যাই হোক, কোলে তুলে নিয়ে যেতে হবে। নইলে যাবো না।
চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৬)
[ প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত। বাকিরা স্কিপ করতে পারেন ]
ইহানের বিরক্তি আকাশসম। কথা বলতেও কেমন বিরক্তি ঠেকছে তার। সামনে থাকা মেয়েটা তার শখের নারী। ইহান ভালোবাসে এই মেয়েটাকে। সেই প্রথম থেকে। কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশে ইহান সর্বদাই কুণ্ঠিত বোধ করে। তানিয়াকে সে ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসি কথাটি তানিয়ার সম্মুখে বলতে চায় না ইহান। বাড়িতে তানিয়ার মা এবং বাবা দুজনেই আছেন। তাদের সামনে কিভাবে তানিয়াকে কোলে তুলে নিবে সে? নির্লজ্জের মতো তানিয়াকে কোলে তুলতে সংকোচ হচ্ছে ইহানের। তানিয়ার এহেন জেদে রুষ্ট হলো সে। বলল,
” তোমার কি পা নেই? কোলে তুলতে হবে কেন?
তানিয়া উঠে দাঁড়ায়। এখনো ব্রাশ করা হয়নি তার। ক্লোজআপের পেস্ট ব্রাশে লাগিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে তানিয়া বলে,
” পা আছে বলে কি কোলে নেয়া যাবে না?
ব্রাশ করা অবস্থায় তানিয়ার কথা বলা পছন্দ নয় ইহানের। তানিয়ার কথা বলাটা ভালো লাগল না ইহানের। চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” অ্যাই ফাজিল। আগে ব্রাশ করো দ্যান কথা বলো।
তানিয়া ভেংচি কাটে। বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ করে ফিরে আসে ঘরে। ইহান তাড়া দেয়। বলে,
” চলো এবার। আম্মাকে কথা দিয়েছি তোমায় নিয়ে যাবো।
দুষ্টু হাসে তানিয়া বলে,
” কোলে না নিলে যাবো না।
ইহান কি করবে ভেবে পায় না। বলে,
” বেশ কোলে নিবো। একটি শর্ত আছে। বাইরে গিয়ে সবাইকে বলবে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলে, পায়ে ব্যথা পেয়েছো সেজন্য আমি তোমায় কোলে নিয়েছি। ঠিক আছে?
ভড়কায় তানিয়া। রাগ হয় খানিক। বলে,
” মিথ্যে বলবো কেন? আমার পা ঠিক আছে। আপনি বলবেন তানিয়া যেতে চাইছে না। তাই জোর করে নিয়ে যাচ্ছি।
হতাশ হয় ইহান। তানিয়া এতটা জেদি ছিল না। এতটা বাচ্চামোও করতো না। সবসময় ভয় পেত তাকে। সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো। বিয়ের পর মেয়েটা পাল্টে গেছে। জেদি, একগুঁয়ে স্বভাবের হয়েছে। ইহানকে এখন আর ভয় পায় না তানিয়া। স্বামীর মতো ট্রিট করে। অথচ ইহান ভেবেছিল তানিয়া তার সাথে কখনো ফ্রি হতে পারবে না। মানতে পারবে না তাকে স্বামী হিসেবে। কিন্তু ইহানের থেকে তানিয়াই দ্রুত কদমে এগোচ্ছে। সম্পর্কটা নিয়ে ইহানের চেয়ে তানিয়াই বেশি ভাবছে, গুরুত্ব দিচ্ছে। তানিয়ার নিকট এগিয়ে আসে ইহান। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,
” তুমি তো আগে এত জেদি ছিলে না তানিয়া। আমাকে ভয় পেতে।
ইহানের চোখে চোখ রাখে তানিয়া। বলে,
” আগে আপনি স্যার ছিলেন। ঘরে-বাইরে সব ক্ষেত্রে স্যার ছিলেন। কিন্তু এখন সম্পর্কে ভিন্নতা এসেছে। এখন আপনি আমার স্বামী।
শেষ কথাটুকু বলাস লজ্জা পেল তানিয়া। নতজানু হলো। পুনরায় বলে উঠল,
” বিয়েটায় আমার অমত ছিল। রাজি হতে চাইনি আমি। বাবা আর আন্টির কথায় রাজি হয়েছি বিয়েতে। তাই বলে যে আপনাকে অবজ্ঞা করবো, আপনাকে অপমান, অবহেলা করবো এমন মেয়ে আমি নই। সবচেয়ে বড় কথা বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। এখন আমাদের উচিত সম্পর্কটাকে গাঢ় করা, টিকিয়ে রাখা। একে অপরকে সময় দেওয়া, একে অপরকে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করা। কি তাই নয় কি? আপনার আম্মা আমাকে বলেছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন। কবে থেকে ভালোবাসেন তাও জানতে পেরেছি। অবাক হয়েছিলাম খুব। বছর খানেক ধরে একজনের প্রতি আসক্ত থাকা মানুষকে কিভাবে মন থেকে সরিয়ে দিই বলুন। কিভাবে দুরে রাখি? আপনি যতই বদ,রাগী, ঝগড়ুটে হন না কেন আমা তো জানি আপনি কেমন। কতটা দায়িত্ববান।
হাসে ইহান। প্রগাঢ় হাসি। তানিয়ার গালে হাত বুলায়। চুমু খায় সশব্দে। ললাটের মধ্যিখানে কম্পিত ওষ্ঠজোড়া রাখে। চোখ বুজে নেয় তানিয়া। রাঙা হয় মুখ। শিরা উপশিরা বেয়ে শীতল স্রোত বয়। সরে আসে ইহান। হুট করে এমন কাজ বোধহয় করতে চায়নি সে। থতমত খেয়ে পরিস্থিতি এড়াতে বলে,
“চলো। বাড়ি ফিরতে হবে।
তানিয়া চটপট আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। অতঃপর ইহানের নিকট এসে বাচ্চা কণ্ঠে বলে,
” নিন কোলে নিন।
হাসে ইহান। তানিয়ার বাচ্চামো উপভোগ করে। পেটে দৃঢ় চাপ প্রয়োগ করে পাজোকোলে তুলে নেয়। তানিয়া ততক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরে ইহানের কাঁধ। বাইরে গিয়ে তানিয়ার বলা কথাটাই জানায় ইহান। খানিক লজ্জা পেলেও পরে সামলে নেয় নিজেকে। প্রেয়সীর জন্য একটু নির্লজ্জ হওয়াই যায়।
______
নিধি আর আরহাম বেরিয়েছে দুপুরে। নিধির কলেজে প্রোগ্রাম আছে। আরহামকে নিয়ে সেখানেই গিয়েছে। সেজেগুজে একদম নতুন বেশে আরহাম বেরিয়েছে। ছেলেটার সময় বদলেছে। নতুনত্ব এসেছে জীবনে। হাসিখুশি থাকে আরহাম। প্রিয়তার ভালো লাগে ভাইকে এমন সুখে থাকতে দেখে। প্রহর হাঁটছে পাশেই। প্রিয়তার গায়ে হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি। প্রহরের পরণে ম্যাচিং শার্ট। হাঁটতে হাঁটতে প্রেয়সীর পানে তাকিয়ে পুনরায় সামনে তাকায় প্রহর। আইসক্রিমের দোকানে ছুটে যায় প্রিয়তা। দুটো আইসক্রিম কিনে। বিল পরিশোধ করে প্রহর।
ভালোবাসা এক তৃপ্ত বাসনা। সবাই ভালোবেসে প্রিয় মানুষকে নিজের করতে পারে না। যারা পারে তাদের অনেকেই আবার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে না। প্রিয়তা আর প্রহর, এরা দুজনের কেউই কাউকে সেভাবে ভালোবাসার সুযোগ পায়নি। দুরত্ব তাদের বুঝিয়েছে ভালোবাসা আসলে কি? ভালোবাসা প্রয়োজন কেন?
হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়তা মুচকি হেসে বলে,
“ভাবিনি আপনার সাথে আবার দেখা হবে, ভাবিনি এক হবো আমরা।
প্রহর নিজেও হাসে। বলে,
” আমিও ভাবিনি।
এলাকার রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে। পাকা রাস্তায় দুজন মানব-মানবী হেঁটে চলেছে। প্রিয়তাকে মিষ্টি লাগছে ভিষণ। গোলগাল চেহারায় খুশি খুশি ভাব। ফুচকার গাড়ি দেখে আবার ওবায়না ধরে প্রিয়তা। বলে,
” চলুন ফুচকা খাই।
মুখ কুঁচকে ফেলে প্রহর। বলে,
” একদম না। রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খাওয়া যাবে। ফুচকা খেয়ে পেট খারাপ করতে হবে না।
মন খারাপ হয় প্রিয়তার। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। হঠাৎ একটি বড়সড় লাঠি এসে প্রিয়তার পায়ের কাছে লুটায়। অবাক হয় প্রিয়তা। আতঙ্কে আর শব্দে লাফিয়ে ওঠে। মোটাসোটা লাঠিটা আরেকটু হলেই তার পিঠে লাগতো। লাঠিটার মতো প্রিয়তা লুটিয়ে পড়তো রাস্তায়। চিৎকার করে উঠতো। কিংবা লাঠিটা প্রহরের মাথায় লাগতে পারতো। ভয়ে ঘন শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। প্রহরের দিকে তাকায় বড় বড় চোখ করে। প্রহরের তীক্ষ্ম চোখ তখন সামনে। আট-ন জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ একত্রে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। চোখে অসম্ভব আক্রোশ। হাতে লাঠি, বাঁশ, কাঠের টুকরো। অনেকটা দূর থেকেই এরা লাঠিটা ছুড়েছে তাদের দিকে। প্রহর প্রিয়তার হাত ধরে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
” বিপদ এগিয়ে আসছে প্রিয়তা। পালাতে হবে।
প্রিয়তার চোখে অনেক প্রশ্ন। পরিস্থিতিটা বুঝে উঠতে পারল না। প্রহর বুঝল প্রিয়তার অভিব্যক্তি। কঠিন স্বরে বলল,
” আপনার প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। দৌঁড়ান।
শাড়ি পড়ে হাঁটতেই অসুবিধে হয় প্রিয়তার। দৌড়ানো তার জন্য অসম্ভব একটি কাজ। তবুও প্রহরের কথার পরিপ্রেক্ষিতে ছুট লাগাল সম্মুখে। হাত ধরে প্রিয়তা আর প্রহর ছুটতে লাগল ফুটপাত দিয়ে। প্রিয়তার পা শাড়িতে পেঁচিয়ে আসে বারবার। নিজেকে সামলে প্রহরের সাথে সাথে দৌড়ানোর চেষ্টা চালায় প্রিয়তা। প্রহরের সাথে তবুও পেরে ওঠে না। কোনরকমে ছুটে চলে মৃত্যুর ভয়ে। স্বেদজল গড়ায় গা বেয়ে। দৌড়াতে গিয়ে বারংবার থেমে যায়। হাঁপিয়ে ওঠে খুব। পুনরায় ছুটে প্রহরের হাত ধরে। ছুটতে ছুটতে বিরক্তি নিয়ে প্রিয়তা বলে,
” পালাচ্ছি কেন? আমরা কি কোনো অন্যায় করেছি?
প্রহর এক পলক প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে প্রিয়তার সামনের রাস্তায় পরে থাকা ইটের টুকরো পা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
” অন্যের স্বার্থে আঘাত করেছি। এতটুকুই জানুন। কথা বলবেন না। সময় নেই।
প্রিয়তা পিছু ফিরে। লোকগুলো তখন ও দৌড়ে আসছে তাদের দিকে। প্রিয়তা চোখ বুজে নেয়। না আর পারবে না সে। আর পালাতে পারবে না। এত ভয় নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না সে। দোষ করেনি সে, কেন লোকগুলো তাদের মারতে আসবে? কেন তারা পালাবে? প্রিয়তা থেমে যায় ততক্ষণাৎ। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলে,
” আমি আর দৌড়াতে পারবো না।
প্রহর ও থামে। চোখেমুখে ফুটে ওঠে হতাশা। নিজের অপারগতা মেনে নিতে কষ্ট হয়। বলে,
” এতগুলো মানুষের সাথে আমি একা লড়াই করতে পারবো না প্রিয়তা। আমি বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দৌড়ানো ছাড়া এখন আর উপায় নেই। ওরা সংখ্যায় বেশি। হাতে অস্ত্র ও আছে। আপনাকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না প্রিয়তা।
প্রিয়তা হাসে এত এত লোকের ভিড়ে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে প্রহরের বাহু। ওরা এগিয়ে আসছে নিকটে। প্রিয়তা দ্রুত বলে ওঠে,
” আপনি একা কেন হতে যাবেন? আমি আছি তো। মার্শাল আর্ট জানি আমি। ওদের সাথে লড়তে পারবো।
আর কথা বলার সময় পায় না প্রিয়তা। দলবল এগিয়ে আসে। শক্ত মোটা কাঠ দ্বারা আঘাত করতে চায় প্রহরকে। প্রহর ট্রেনিং নিয়েছে। মোকাবিলা করার শক্তি আছে তার। প্রহর আঘাত পাওয়ার আগেই লোকটার হাত ধরে মুচরে দেয়। প্রিয়তা থেমে থাকে না। ঢাকায় ফেরার দুদিন পর প্রিয়তা বাসে করে ফিরছিল বাড়িতে। সন্ধ্যের মাঝামাঝি তখন। প্রিয়তার তখন ভয়-ডর অনেক। জীবনে নতুন যাত্রা শুরু করেছে সবে। বাসের সিটে বসে থাকাকালীন প্রিয়তা খেয়াল করে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক যুবকটি টাল সামলাতে না পেরে বারবার পড়ে যাচ্ছে। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে অপরাধীদের ন্যায় আশপাশে তাকাচ্ছে। চেষ্টা করেও নিজেকে ঠিকমতো গাইড করতে পারছে না। সন্দেহ হয় প্রিয়তার। কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করে,
” আপনি আগে কখনো বাসে উঠেননি?
লম্বায় ছেলেটি পাঁচ ফুট পাঁচের উপরে। বয়স আঠারো কি উনিশ। অতি সুদর্শন না হলেও ছেলেটার চেহারা মায়াবি। অতিরিক্ত ফর্সা গায়ের রঙ। চোখের মণি বিড়ালের ন্যায়। প্রিয়তার এহেন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খায় ছেলেটি। বোকা হেসে বলে,
” এবারই প্রথম। আমার একটু জ্বর আসছে তো। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
প্রিয়তার মায়া হয় ভিষণ। ছেলেটাকে নিজের সিটে বসিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বাড়িতে ফিরে বাকিটা রাস্তা। নামার সময় প্রিয়তা দেখে ছেলেটা তাদেরই এলাকার। ধন্যবাদ জানাতে আসে ছেলেটি। অতঃপর কথাবার্তা বলে জানতে পারে ছেলেটি খ্রিষ্টান। নাম জুনিভো। বাবা-মা মারা গেছে ছোটবেলায়। দাদু জুলফিকার-এর কাছেই মানুষ হয়েছে জুনিভো। আগে ইন্ডিয়ায় থাকতো ওরা। দু বছর আগে বাংলাদেশে এসেছে। এখানে জুনিভোর দাদুর একটি মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। প্রিয়তা শোনার পর খুব অবাক হয়েছিল। মার্শাল আর্টের একাডেমি এদিকে তেমন নেই। ছোটবেলা থেকেই মার্শাল আর্ট শেখার ইচ্ছে ছিল প্রিয়তার। মার্শাল আর্ট শেখার ইচ্ছে পোষণ করার পর জুনিভো প্রিয়তাকে নিয়ে গিয়েছিল তার দাদুর মার্শাল আর্ট একাডেমিতে। চার মাস ওখানেই মার্শাল আর্ট শিখেছে প্রিয়তা। জুলফিকার দাদু প্রচণ্ড ভালো মানুষ ছিলেন। প্রিয়তার সম্পর্কে সবই জানেন তিনি। প্রিয়তাকে তিনি নাতনির মতো ভালোবাসতেন। প্রিয়তা যখনই সময় পেয়েছে তখনই মার্শাল আর্ট শিখতে গিয়েছে ওখানে। পরিশ্রমী প্রিয়তা কঠোর মনোবল নিয়ে খুব শীঘ্রই কৌশল গুলো আয়ত্বে আনতে পেরেছে। ছোট ছোট কিন্তু প্রয়োজনীয় রণ কৌশলগুলোই শিখেছে সে। জুলফিকার বেশ ভালো ভাবেই প্রিয়তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আজ সেই শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ করল প্রিয়তা। পা দিয়ে সজোরে লাথি দিল অচেনা ছেলেটিকে। গলায় চাপ দিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুষি দিল মেরুদণ্ড বরাবর। লুটিয়ে পরল ছেলেটি। প্রহর একের পর এক আঘাত করল ছেলেগুলোকে। দুজনে খুব কম সময়ে লড়াই করে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে জয়ী হলো। প্রহর ইহানকে ফোন দিয়ে ততক্ষণাৎ জানাল ফোর্স নিয়ে আসতে। প্রিয়তা দম নিল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল হাসি। বাইরে মোটামুটি মারামারি করেছে সে। তবে এমন যুদ্ধ এই প্রথম করল প্রিয়তা। প্রহর মুগ্ধ হলো প্রিয়তার লড়াইয়ে। পুলিশ ফোর্স এলো খুব শীঘ্রই। ধরা হলো সকলকে। প্রিয়তার ভয় বাড়ে। আজ এই কৌশলগুলো না জানলে ক্ষতি হতে পারতো তাদের। প্রহর পুলিশ হলেও মানুষ। হঠাৎ এতজন মানুষের আক্রমণের সাথে পেরে উঠতো না ছেলেটা।
____
ইহানের থানার সামনে দাঁড়িয়ে প্রহর। প্রিয়তাকে বাড়িতে রেখে এখানে এসেছে সে। ইহানের সাথে কিছু আলাপ আছে প্রহরের। সবকিছু খোলাসা করতেই তার এখানে আসা। থানার দারোয়ান প্রহরকে দেখেই হাসল দাঁত কেলিয়ে। শব্দ করে পা নাড়িয়ে ললাটে হাত রেখে সালাম জানাল। হাসল প্রহর। লোকটার এই এক অভ্যেস। তাকে দেখলেই এমনভাবে বিনয়ের সাথে সালাম দেয়। প্রহর সালামের উত্তর দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। থানাটা আগের মতোই আছে। কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই গোছালো, একই রঙ করা দেয়াল। প্রহর আজ এসেছে সাধারণ মানুষ হিসেবে। তবুও থানার সব কনস্টেবল আর প্রহরের চেয়ে জুনিয়র অফিসাররা প্রহরকে দেখে এগিয়ে এলো। সকলের চোখেমুখে প্রশান্তি। প্রহরের রিজাইন দেওয়ার খবরটা জানে তারা। খুব দুঃখ পেয়েছে প্রহরের নেওয়া সিদ্ধান্তে। প্রহরকে দেখে একে একে সকলে দু পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। সালাম জানাল বিনয়ের সাথে। প্রহরের সাথে কুশল বিনিময় করল। একজন অফিসার বলল,
” আপনি কেন চলে গেলেন স্যার? আপনাকে ছাড়া থানাটা কেমন শান্ত শান্ত লাগে। কোনো আনন্দই নেই এখানে। ইহান স্যার তো এখন আর আমাদের সাথে আড্ডাই দেন না।
প্রহরের কণ্ঠে জড়তা কাজ করে।কাজের জায়গাটা তার প্রিয়। এখানকার মানুষগুলোকেও আপন করে নিয়েছে সে। সকলেই বেশ ভালোবাসে তাকে। অথচ সে সবার ভালোবাসার কথা ভাবেনি। নিজেকে ঠিক করে প্রহর বলল,
” জীবনে এমন এমন সব পরিস্থিতি আসে যে সে পরিস্থিতি আমরা চাইলেও মোকাবিলা করতে পারি না। তোমরা চিন্তা করো না। ভাগ্যে যদি পুলিশের চাকরি লেখা থাকে তো আবার জয়েন করবো। আবার তোমাদের সাথেই কাজ করবো।
প্রহর সকলকে রেখে ইহানের ডেস্কে গিয়ে বসে। বন্ধুর আগমনে খুশি হয় ইহান। তানিয়া গিয়েছে অন্য থানায়। কিছু ফাইল ট্রান্সফার করতে। ইহান হেসে বলে,
” কেমন আছিস? বিয়ের পরদিনই থানায়?
হাসে প্রহর। বলে,
” বিয়ের দিন তো তুইও থানায় এসেছিলি তানিয়াকে ফেলে।
থতমত খায় ইহান। বিয়ের কথাটা প্রহরকে এখনো জানানো হয়নি। তবে কি তানিয়া বিয়ের বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছে প্রহরকে? অবাক কণ্ঠে ইহান প্রশ্ন করে,
” তুই জানিস?
হাসে প্রহর। বলে,
‘ ঢাকায় বসেও এখানকার সব খবর রেখেছি। কটা কেস সলভড করেছিস? কজনকে এরেস্ট করেছিস? সব জানি।
মাথা চুলকায় ইহান। কথা এড়াতে প্রশ্ন করে,
” ওই লোকগুলোকে পিটিয়েছি। তুই যেটা ভেবেছিলি তাই ঠিক। মেইন কালপ্রিট ওই দীপা খন্দকার। আর ওর আসল নাম কিন্তু দীপা নয়। মিথিলা। এর আগেও এই মহিলার নামে কেস করা হয়েছিল।
বাকি কথা টুকু বলার আগেই প্রহরের ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিণে বয়স্ক এ সি পি এর নম্বর ভেসে ওঠে। প্রহরের চোখ উজ্জল হয়। ফোনটা ধরে বলে,
” হ্যালো স্যার।
ওপাশ থেকে অফিসার বলে ওঠে,
” হাই। তোমার খবর কি প্রহর? কোনো খোঁজ নেই।
” ঠিক আছি স্যার।
” কবে জয়েন করবে?
” সময় আসুক।
” সময়টা কবে আসবে প্রহর? সবাই তোমাকে চাইছে, সবাই চাইছে তুমি আবার জয়েন করো। তোমার মতো দায়িত্ববোধসম্পন্ন অফিসার আমি আর কোথায় পাবো? ভুলে যেও না তুমি শুধু একজন অফিসার নও। সততা ও ন্যায়ের প্রতীক। তোমাকে দেখে বর্তমানে সকল পুলিশ ন্যায় শিখছে। দেশের জন্য কাজ করছে। তুমি যদি এভাবে চলে যাও..
প্রহর স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সব কথা শোনে। এ কথা সে প্রায়ই শুনে উপরমহলের লোকেদের মুখে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
” আমি ব্রেক নিয়েছি, হারাইনি। ফিরতে আমাকে হবেই স্যার। আজ হোক বা কাল।
_____
আরহাম পড়তে বসেছে নিধির ঘরে। অ্যাপেল, বল, ক্যাট এগুলো ইংলিশে লিখছে খাতায়। প্রিয়তা বারবার মোবাইল চেইক দিচ্ছে। অনেক প্রশ্ন জমে আছে প্রিয়তার মস্তিষ্কে। প্রহরকে এখন দরকার প্রিয়তার। সব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। রাত ও হয়েছে। প্রহরের না ফেরার কারণে চিন্তা হচ্ছে প্রিয়তার।
প্রহর ফিরে অনেকক্ষণ পর। প্রিয়তা নিচে প্রহরের কণ্ঠ শুনে দ্রুত দৌড়ে বের হয় ঘর থেকে। দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা কাউকে বলেনি প্রিয়তা। বললেই সকলেই চিন্তা করবে। প্রহরকে দেখে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তার। মাথা রাখতে ইচ্ছে হয় প্রহরের প্রশস্ত ব্যায়ামপুষ্ট বুকে। সকলের সামনে নিজেকে সামলে নেয় প্রিয়তা। প্রহর ঘরে ফেরার সাথে সাথে প্রহরের বুকে হামলে পরে প্রিয়তা। শব্দ করে কেঁদে ফেলে। ভিজিয়ে দেয় প্রহরের শার্ট। প্রিয়তার মাথায় হাত বুলায় প্রহর। বলে,
” কাঁদছেন কেন?
প্রিয়তা চোখ উঁচিয়ে তাকায় প্রহরের পানে। বলে,
” ফোন দেননি কেন? সেই দুপুরে বেরিয়েছেন। এখন কটা বাজে খেয়াল আছে?
প্রিয়তার নরম গালে হাত বুলায় প্রহর। নাকে নাক ঘষে। চুমু খায় ঘাড়ে। জড়িয়ে ধরে প্রিয়তার মেদহীন কোমড়। কাছে টানে নিবিড়ভাবে। কানের লতিতে চুমু খায় বারংবার। প্রহরের গা থেকে মাদকীয় সুঘ্রাণ প্রিয়তার নাসারন্ধ্রে পৌঁছায়। অন্তঃস্থলে ভূকম্পন সৃষ্টি হয়। হীম শীতল হয়ে আসে গা। শিরশির কর উঠে শরীর। খাঁমচে ধরে প্রহরের কাঁধ। হাসে প্রহর। দুজনের ওষ্ঠাদ্বয় মিলিত হয়। স্ত্রীর ওষ্ঠের অমৃতসুধা পান করে প্রহর। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়। হুট করে প্রহর ছেড়ে দেয় প্রিয়তাকে। থতমত খায় প্রিয়তা। লজ্জিত হয় বেশ। প্রহর দুর্বোধ্য হাসে। প্রিয়তার কপালে কপাল রেখে ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলে,
” প্রিয়, আমার প্রিয়।
প্রিয়তা হাসে। এতক্ষণ ওষ্ঠে হওয়া ঝড়ে নেতিয়ে পরে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
” প্রিয় হলে কাছে টানছেন না কেন? হুহ্?
প্রহরের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি প্রতীয়মান হয়। বলে,
” কাছে টানছি তো, আপনিই লজ্জা পাচ্ছেন।
” উঁহু এভাবে নয়।
” কিভাবে?
নত মুখ সোজা করে প্রিয়তা। প্রহরের রসিকতা ধরতে পেরে চোখ পাকায়। অভিমানী স্বরে বলে,
” মজা করছেন আমার সাথে?
প্রহরের হাসি গাঢ় হয়। চিকচিক করে ওঠে দন্ত। ফিসফিস করে বলে,
” মজা? না তো।
” বদ লোক কোথাকার। অসভ্য!
” এখনো তো অসভ্যতামো করলামই না ।
প্রিয়তা চলে যেতে চায়। দরজা অবধি পৌঁছাতেই হাত টেনে ধরে প্রহর। দরজা লাগিয়ে দেয়। প্রিয়তাকে এক হাতে আগলে নেয় বুকে। বক্ষস্থলে পীড়া অনুভব করে প্রিয়তা। গুঙিয়ে ওঠে। প্রহরের শক্তপোক্ত হাত প্রিয়তার শরীরের সর্বত্রে বিচরণ করে। নতজানু হয় প্রিয়তা। লাজে নুইয়ে যায়। ঘাড়ে মুখ ডোবায় প্রহর। কামড়ে ক্ষত সৃষ্টি করে সেথায়। “আহ্” জাতীয় শব্দ করে প্রিয়তা। চোখ বেয়ে চিকন নোনা পানি গড়ায়। প্রহরের মায়া হয়। ছেড়ে দিতে উদ্যত হলে বাঁধা দেয় প্রিয়তা। লজ্জিত কণ্ঠে বলে,
” উঁহু, যা..যাবেন না।
চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি _শেখ