#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৯)
লেখনীতেঃ#বৃষ্টি_শেখ
তানিয়াদের বাড়ি থেকে প্রিয়তারা ফিরল দুপুরের পর পর। তখন ঝুম বৃষ্টি। ঘোলাটে শহর। শির শির করে উঠেছিল মেরুদণ্ড। শীত আর বৃষ্টি দুটো একসাথে ভালো লাগে না কারোই। দুই প্রকৃতিকে দুই ভাবে দেখতেই ভালো লাগে। এছাড়া প্রিয়তার ঠান্ডা লেগেছে আগেই। ও বাড়ি থেকে অনেকগুলো কেকের টুকরো আর খাবার প্যাক করে দিয়েছে তানিয়া। রাতে রান্না করতে হবে না বলে প্রিয়তা খুশি। কিছু তরকারিও বেঁচে যাবে।
আরহাম পড়তে বসেছে। গায়ে পাতলা চাদর। পড়তে পড়তে পাশে থাকা ছোট বাটি থেকে কেকের টুকরো মুখে দিচ্ছে। আড়চোখে তাকাচ্ছে প্রিয়তার দিকে। বেলকনিতে বসে পড়ছে প্রিয়তা। গরম চায়ের কাপ বেলকনিতে টুল পেতে তার উপরেই রেখেছে। চায়ের গরম ধোঁয়া উড়ছে। প্রিয়তা সেদিক থেকে নজর সরিয়ে বাড়ির নিচের রাস্তায় চোখ বুলাল। একজন ব্যক্তি সাইকেলে চড়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটার হাতে অনেক গুলো কাগজ। এ বাড়িটির ভিতরে প্রবেশ করল ছেলেটা। প্রিয়তা সবটাই দেখল সূক্ষ্মচোখে। এর দু মিনিট পরেই দরজায় খটখট শব্দ হলো। এখন কে আসবে? মনে প্রশ্ন নিয়ে দরজা খুললো প্রিয়তা। দরজার ওপ্রান্তে সাইকেলে চড়ে বাড়িটিতে প্রবেশ করা লোকটাকেই দেখল প্রিয়তা। লোকটার বয়স আনুমানিক পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। রোগা ফিনফিনে চেহারা। গায়ে মোটা জ্যাকেট। প্রিয়তাকে দেখে ছেলেটা ভদ্রতাসূচক হাসল। বললো,
” আপনার নামে চিঠি আছে ম্যাম।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কে তাকে আবার চিঠি দেবে এত ঘটা করে? কি সব হচ্ছে আজকাল? দ্বিধা নিয়ে প্রিয়তা নড়চড়ে দাঁড়াল। গম্ভীর হয়ে বললো,
” আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমাকে চিঠি দেওয়ার মতো কেউ নেই। চিঠির তো প্রশ্নই অসে না।
” আপনার নাম প্রিয়তা না? আপনার ঠিকানা তো এটাই দেওয়া।
প্রিয়তা খাম নিতে হাত বাড়াল। খামের উপরে প্রিয়তার নাম আর ঠিকানা দেখতে পেল। অতঃপর নিজের চিঠি বুঝতে পেরে খাতায় সাইন করে দিল। ছেলেটা চলে যেতে উদ্যত হতেই প্রিয়তা পিছু ডাকল। জিজ্ঞেস করলো,
” এখন তত চিঠির যুগ নেই। ডাকপিয়ন এখন দেখাই যায় না। আপনি সত্যিই চিঠি বিলি করেন?
হাসল ছেলেটা। কাগজ গুলো ভালো মতো আঁকড়ে ধরল। থুতনিতে থাকা কয়েকটা দাড়িতে হাত বুলাল। বললো,
” আমি সেই যুগটা এই সময়ে আনতে চাইছি ম্যাম। আমাদের অনলাইনে একটা পেজ আছে। সেখানে সবাই সবাইকে চিঠি লিখে পেজের ইনবক্সে দেয়। এবং আমরা সেই চিঠি পোস্ট করে প্রাপককে মেনশন দেই। এমনটা করতে করতে আমরা বুঝতে পারলাম শুধু অনলাইনে নয়, অফলাইনেও আমরা চিঠি আদান প্রদান করে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ সুমধুর করতে পারি।
” আমাকে এই চিঠিটা কে দিয়েছে? আপনি নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে জানেন। খামে প্রেরকের নাম, ঠিকানা কিচ্ছু নেই।
” স্যরি ম্যাম। যারা গোপনীয়তা বজায় রেখে চিঠি পাঠাতে চায় আমরা তাদের নাম বলতে পারি না।
প্রিয়তা কথা বাড়াল না। এদের নিয়ম সম্পর্কে বুঝে গেছে সে। হাত পা বেঁধে রেখে দিলেও ছেলেটা প্রেরকের নাম বলবে না। তাই আর কথা না বলে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করল প্রিয়তা। খামটি হাত দিয়েই ছিঁড়ে ফেলল প্রিয়তা। স্থির হয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসল। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টানল। একটা সময় চিঠি নামক যোগাযোগ পদ্ধতিটাকে ভিষণ পছন্দ করতো প্রিয়তা। চিঠি পেতে ইচ্ছে করতো খুব। আবেগ মিশ্রিত চিঠি দেখলে মন ভরে যেত প্রিয়তার। কল্পনা করতো তার একজন একান্ত মানুষ হবে। নিজের সমস্ত ভালোবাসা মিশিয়ে চিঠি লিখবে। প্রিয়তা ঠোঁট ছোয়াবে সেই চিঠিতে। বক্ষপিঞ্জরে রেখে ঘন ঘন শ্বাস ফেলবে খুশিতে।
সেসব আর কোথায়? জীবন কোথায় এনে ফেলল তাকে। জীবনের রঙ গুলো ছিনিয়ে নিল যত্ন নিয়ে। বাস্তবতা বুঝতে শিখিয়ে দিল। আপন মানুষ পর হলো। মৃত্যুর ভয় তাড়া করল। আর কত? আর কত সইবে প্রিয়তা? সবকিছুরই নাকি শেষ আছে। এই অশান্তির সমাপ্তি আদৌ ঘটবে? মাঝে মাঝে ভয় হয় প্রিয়তার। নিজের কল্পনাকে বড্ড বেমানান লাগে। নিজেকে কেমন তুচ্ছ মনে হয়। কেউ কোথাও তার জন্য অপেক্ষা করে নেই। প্রিয়তা কাগজের ভাঁজ খুলল। নিজের নামটা দেখে অবাক হলো না। এইবারে প্রিয়তার নামের পাশে হবু অর্ধাঙ্গিনী লেখা। প্রিয়তা হসে ফেলল লেখাটুকু পড়ে।
হবু অর্ধাঙ্গিনী( প্রিয়তা )
তুমি বিশেষ কেউ নউ, নক্ষত্রের মতো অসম্ভব কিছু নউ। তোমার মাদকতা মেশানো চোখে আমার প্রতি ভালোবাসা নেই। তবুও ভালোবাসার যে প্রতিজ্ঞা করেছি তা রাখার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। তোমাকে প্রায়ই দেখি, প্রায়ই শুনি। অবাক হই আমি। আমার ভালোবাসার মানুষটা এত সুন্দর কেন? এত উজ্জল কেন? ঘোর লেগে যায় কেন আমার? উত্তর কি আছে তোমার কাছে? আমি নিজস্ব অনুভূতি বিশ্লেষণ করতে পারি না। কখনো করিওনি। বাট নাউ, আই হ্যাভ টু সে ইউ, আই লাভ ইউ।
প্রিয়তা গভীর চোখে মুগ্ধ হয়ে লেখাটুকু পড়ল।বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রিয়তা। এইভাবে কে লিখল? কেন লিখল? প্রিয়তা কি লোকটাকে চিনে?
—-
প্রিয়তার ঘরের গ্যাস সিলিন্ডার শেষ। ভোর ছাড়া গ্যাস আসে না। এক মাসেই সিলিন্ডার শেষ হয়ে গিয়েছে। আজ রাতে রান্না না করলেও চলবে। কিন্তু সকালে? সকালে কি করবে? গ্যাস পেতে হলে ভোরে উঠে রান্না করে কলেজে যেতে হবে, এরপর আবার রয়েছে টিউশনি। প্রিয়তার মাথা ঘুরতে লাগল। এত এত খরচ কিভাবে সামলাবে মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না।
বিকেলে প্রিয়তা পড়তে বসেছে। পরিক্ষার আগে পুরো দমে পড়াশোনা করতে চাইছে। হঠাৎ জাস্টিন বিবারের “লেট মি লাভ ইউ” গানটা শুনতে পেল সে। উচ্চ স্বরে বাজতে থাকা গান শুনে বিরক্ত হলো প্রিয়তা। ছাদ থেকে গানের শব্দ আসছে। এ সময় কে বক্স বাজাবে? প্রিয়তা আরহামকে পড়া দেখিয়ে উঠে দাঁড়াল। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। আরহাম ও প্রিয়তার পিছু পিছু বের হলো। দরজা পেরিয়ে ছাদে প্রবেশ করতেই কান ঝাঁঝিয়ে এলো প্রিয়তার। অত শব্দ না হলেও প্রিয়তার মাথা ব্যথার কারণে শব্দটা বেশিই মনে হচ্ছে। ছাদের রেলিংয়ের পাশে প্রহর আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরণে কালো ফতুয়া আর জিন্স। প্রহর দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে। প্রিয়তা পা বাড়াবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেল। অতঃপর একটু এগিয়ে এসে উচ্চস্বরে বললো,
” মিউজিকের ভলিউম টা কমান প্লিজ। আমাদের ডিস্টার্ব হচ্ছে।
প্রহর কথা থামিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকাল। মেয়েটাও প্রিয়তার পানে তাকিয়ে প্রিয়তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। প্রহর তা দেখে মুচকি হাসল। বক্সের ভলিউম কমিয়ে দিল। সামনের চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
” পরিচিত হও। ও প্রিয়তা। তোমাকে ওর কথাই বলেছিলাম। কেসটা সলভড করতে প্রিয়তা আমাদের খুব হেল্প করেছে।
লিরা মিষ্টি হাসল। মেয়েটার মাঝে বিদেশী বিদেশি ভাব আছে। গায়ের রঙ তার অতিরিক্ত ফর্সা। সাদা চামড়া মানেই বিদেশী এমনটা কখনো মনে হয়নি প্রিয়তার। বাংলাদেশেও অনেক সাদা চামড়ার, সুন্দর মানুষ আছে। তবুও মেয়েটাকে দেখে বিদেশি বিদেশিই লাগল। পোশাঈ পরিচ্ছদ মার্জিত লাগল। লিরা হাত বাড়াল প্রিয়তার দিকে। নম্র স্বরে বললো,
” হাই, আ’ম লিরা। ফ্রম ইংল্যান্ড।
” হ্যালো, আমি প্রিয়তা।
” আমি তোমার কথা শুনেছি প্রহরের মুখে। প্রহর ওয়াজ রাইট। হি সেইড, ইউ লুক লাইক আ বার্বি ডল। নাউ আই সি দ্যাট।
প্রহর থতমত খেল। প্রিয়তা সেদিকে না তাকিয়ে বললো,
” আপনি বাংলা জানেন?
” ইয়েস, আই নো দিস ল্যাঙ্গুয়েজ। বিকজ লং ডেইস এগো আই ওয়াজ লিভ ইন দি বাংলাদেশ। মাই প্যারেন্টস্ ওয়াজ বর্ন(Born) ইন বাংলাদেশ। দ্যাটস হোয়াই আই হ্যাভ টু লার্ন বাংলা।
” আচ্ছা। আমি আসলে আমার ভাইকে পড়াচ্ছিলাম। আপনাদের মিউজিকের কারণে পড়তে সমস্যা হচ্ছিল।
এইবার লিরা আরহামের দিকে তাকাল। আরহাম এতক্ষণ চুপচাপ বোনের পাশে দাঁড়িয়ে কথোপকথন শুনছিল। সে বুঝেছে লিরা মেয়েটা মিশুক। ব্যবহার যথেষ্ট মার্জিত। লিরা নিচু হয়ে আরহামের থুতনিতে হাত রাখল। বললো,
” হেই বেবি। তোমার নাম কি?
” মাই নেইম ইজ আরহাম।
” উইল ইউ বি মাই ফ্রেন্ড?
আরহাম প্রিয়তার দিকে তাকাল। প্রিয়তা মুচকি হাসল। অতঃপর আরহাম হাত মেলাল। হাসল একটু। প্রিয়তা ছাদ থেকে নেমে আসল। প্রহর প্রিয়তার পিছু পিছু এলো। পিছন থেকে পায়ের শব্দ শুনে প্রিয়তা থমকাল। পিছু ফিরে প্রহরকে দেখে অবাক হলো প্রিয়তা। কণ্ঠ নামিয়ে কিছু বলার পূর্বেই প্রহর সিঁড়ির হাতল ধরে পথ আটকে দাঁড়াল। সম্মোহনী চোখে চেয়ে বললো,
” তুমি আমার এওয়ার্ড ফানশনে যাও নি কেন প্রিয়তা? আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে।
” কাজ ছিল। তানিয়া আপুর বাসা থেকে এসে আমি টায়ার্ড ছিলাম।
” কি হয়েছে?
” কি হবে?
” তোমার কণ্ঠ, আচরণ, অঙ্গভঙ্গি আমার অন্যরকম লাগছে।
” আপনার বাবা এসেছে আমাকে তো বলেননি।
” তুমি আমার সাথে রুড বিহেইভ করছো। বলার সময় পাইনি।
” বিয়ে কবে হচ্ছে?
” কিসের বিয়ে?
” কিছু না।
” কি বলতে চাও। বলো প্লিজ।
” কিছু বলতে চাই না। সামনের মাসে আমি আর আরহাম এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমি চাই না আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হোক। তাই আপনি আমার থেকে দুরত্ব বজায় রাখবেন প্লিজ।
প্রহরকে বাক্য ব্যয় করতে দিল না প্রিয়তা। দ্রুত পায়ে সিড়ি ভেঙে নেমে গেল। সব কথাই প্রহরের মাথার উপর দিয়ে গেল। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে বোধগম্য হলো না। প্রিয়তার করুণ মুখ স্পষ্ট বুঝতে পারল প্রহর। শুধু বুঝতে পারল না মেয়েটার ভিতরকার পরিস্থিতি।
__________
প্রিয়তাদের নিচের ফ্ল্যাটে একটি নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। তারা এসেছে মাসের প্রথমেই। কিন্তু প্রিয়তার সাথে পরিচয় হয়নি সেই নতুন ভাড়াটিয়ার। প্রিয়তা গুঁড়ো মাছ কিনেছে। কাটাকুটি করার পর ধুয়ে মাছ ফ্রিজে রাখতে গিয়েছিল নিচে। নিচের ফ্ল্যাটের এক বৃদ্ধার ফ্রিজে সবসময় মাছ, মাংস রাখে প্রিয়তা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে নতুন ভাড়াটিয়ার সাথে দেখা। সেই পরিবারে সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন। স্বামী, স্ত্রী, আর সন্তান। পরিবারের কর্তা রায়হান সাহেবের স্ত্রীর সাথে প্রিয়তার আলাপ হয়েছে অনেকক্ষণ। আপুটার সাত বছরের একটি ছেলে আছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে আপুটা খুব অনুরোধ করল আরহামকে নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য। প্রিয়তা জোরাজুরি করার পর মেনে নিল। কারণ বেঁচে থাকলে হলে আশপাশের মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে চলতে হয়। সবাইকে আপন ভেবে কাছাকাছি রাখতে হয়। কখন কোন বিপদে, কাকে কাজে লাগে তা তো বলা যায় না।
সকালে আরহাম আর প্রিয়তা এলো রায়হান সাহেবের ঘরে। রায়হান সাহেব তখন অফিসে। বাড়িতে ছিল তার স্ত্রী হালিমা আর ছেলে রাকিব। প্রিয়তারা ফ্ল্যাটে আসতেই রান্নাবান্না শুরু করে দিল হালিমা। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা আর খাওয়া দাওয়ার পর প্রিয়তা ঘরে ফিরতে উদ্যত হলো। আরহাম তখন খেলায় ব্যস্ত। আরহাম ফিরতে চাইল না প্রিয়তার সাথে। রাকিবের সাথে খেলনা দিয়ে খেলছিল সে। কিছুতেই ফিরতে চাইল না ঘরে। প্রিয়তা রেগে গেল কিছুটা। বললো,
” চলো আরহাম। পরে আবার আসবে। অনেকক্ষণ হলো আমরা এসেছি।
আরহাম অনুনয় করে করে বলে উঠল,
” পরে যাবো আপু। একটু খেলা করেই চলে যাবো।
হালিমা আপু আরহামকে রেখে যেতে বললো। অগত্যা বাধ্য হয়ে একাই ঘরে ফিরল প্রিয়তা। পড়তে বসল আবার। দুপুরে টিউশনিতে গিয়ে স্টুডেন্টদের পরিক্ষা নিবে সে। এম সি কিউ এর পরিক্ষা। সেসব প্রস্তুত করল অনেক সময় নিয়ে। প্রিয়তার ফাঁকা ফাঁকা লাগল। আরহাম আসেনি তখনো। উঠবে উঠবে করে লিখতে লিখতে উঠা হলো না প্রিয়তার। কিছুক্ষণ পর কান্নার শব্দ এলো বাইরে থেকে। প্রিয়তা কান খাঁড়া করল। আরহামের কান্নার স্বর শুনে বুকটা ধক করে উঠল প্রিয়তার। তড়িঘড়ি করে বই খাতা রেখে উঠে দাঁড়াল সে। দরজার পাশে আরহামকে কান্না করতে দেখে জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে। প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠল। অজানা আশঙ্কায় মলিন হলো চেহারা। ভাইয়ের এমন কান্নায় প্রিয়তার চোখ চিকচিক করে উঠল। চোখের কার্ণিশে অশ্রর চিহ্ন দেখা দিল। প্রিয়তার কান্না পাচ্ছে ভিষণ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। জড়ার কারণে কথা আটকে আসছে বারবার। নাক টানল প্রিয়তা। আরহামের মাথার দু পাশে হাত রেখে বলে উঠল,
” কাঁদছো কেন আরহাম? কি হয়েছে?
আরহামের ফর্সা,নরম গাল পানিতে টইটম্বুর। একবার গাল মুছে দিলে আবার পানির দেখা মিলছে। নাক মুখ লাল হয়ে গিয়েছে আরহামের। ডান কান রক্তিম হয়েছে। আরহামের হেচকি তোলার শব্দ কানে বিঁধছে প্রিয়তার। আরহাম কেঁদে যাচ্ছে অনবরত। প্রিয়তা পুনরায় জিজ্ঞেস করল। আরহাভ কেঁদেই চললো। এইবার প্রিয়তার কণ্ঠ স্বাভাবিক। গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। আরহাম ভয় পেল। দুর্বল কণ্ঠে বললো,
” আপু রাকিব আমাকে মেরেছে।
” কেন মেরেছে তোমায়?
” ওর খেলনা ধরেছি বলে আমার কান মুচড়ে দিয়েছে। দেখো না খুব ব্যথা করছে আপু।
প্রিয়তা কানে হাত দিল। গরম হয়ে আছে ডান পাশের কান। রক্তিম হয়ে আছে। মুচড়ে দেওয়া জায়গাটায় হাত বুলাল প্রিয়তা। আরহামের এমন করুণ কণ্ঠে দুর্বল হলো সে। তবুও সেইসব বুঝতে না দিয়ে প্রিয়তা রয়েসয়ে দাঁড়াল। বললো,
” তোমাকে আমার সাথে আসতে বললাম। আসো নি। বড়দের কথা না শুনলে এমনই হয়। রাকিব তোমাকে মারল হালিমা আপু কিছু বললো না?
” আন্টি দোকানে। আমি রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়িটা ধরেছি বলে আমার হাতে থাপ্পড় মেরে আমাকে কান ধরে এখানে এনে দিয়েছে। পেটে ঘুষি মেরেছে। আমি আর কিচ্ছু করিনি আপু।
” ঘরে চলো। আমি রাকিবকে বকে দিবো।
” তুমি আমাকে গাড়ি কিনে দিবে? আমি আর কক্ষনো ওই ঘরে যাবো না।
” গাড়িটার দাম কত?
” সাড়ে সাতশো। তুমি কিনে দিবে আপু?
” না। অত টাকা আমার কাছে নেই। এত খেলতে হবে না।
আরহাম ঠোঁট উল্টাল। নরম চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাচ্চাটার রাগ হলো বোধহয়। এমন জীবন যাপনে অভ্যস্থ নয় বলে আরহামের একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে মানিয়ে চলতে। রাগান্বিত হয়ে আরহাম বলে উঠল,
” আমাকে ওটা কিনে না দিলে আমি ভাত খাবো না। তুমি ভালো নও। আমাকে শুধু বকো। আমাকে খেলনা দাও না। আমি কিচ্ছু খাবো না
” বেতন পেলে দিবোনি।
” তুমি দিবে না জানি। আমায় প্রমিস করো দিবে।
প্রিয়তা রেগে গেল। যদিও এ মুহুর্তে রাগ করা বোকামো। তবুও প্রিয়তা রেগে গেল। এত এত যন্ত্রণা তার সহ্য হচ্ছে না। আগের মাসের ভার্সিটির মাসিক ফি দেওয়া হয়নি। স্যার বলেছে টাকাটা দিলেই পরিক্ষা দিতে দিবে। এ নিয়ে টেনশনে আছে প্রিয়তা। দু দিন পর ঘর খুঁজতে হবে। এ নিয়েও ভাবনার শেষ নেই তার। অপরদিকে মিসেস নাবিলার কথা শুনে প্রিয়তা জোর হারিয়েছে। সব দিক থেকে নিজেকে অসহায়, অবলা লাগছে। এ সমাজে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না এমনিতেই। তার উপর আরহামের এমন বায়না অসহ্যকর ঠেকল প্রিয়তার কাছে। কষে চড় মারল আরহামের গালে। মুহুর্তেই আরহাম হতবিহ্বল হলো। পলকহীন ভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। ফর্সা গালে চার আঙ্গুলের দাগ পরে গেল আলহামের। আরহাম কাঁদতে ভুলে গেল। হা করে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে। প্রিয়তা আরো দুটো কিল বসাল আরহামের পিঠে। ভয়ানক এক শব্দ হলো। আরহাম শুয়ে পরল মেঝেতে। গায়ে ময়লা লেগে গেল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল এবার। প্রিয়তার এই চিৎকার ও বিরক্তিকর ঠেকল। আরহামের গাল চেপে ধরে বললো,
” সবসময় শুধু আবদার আর আবদার। তোমাকে কি কি দিলে তুমি সুখী হবে? তুমি বুঝো না কিছু? আমার কাছে টাকা নেই বুঝো না? এত বড়লোকি স্বভাব কেন তোমার? আব্বু আম্মু তো রাখেনি তোমায়। আমার ঘাড়ে এসে পরতে হয়েছে। আমার কাঁধে দায়িত্ব পরেছে। পরিস্থিতি বুঝো না? তোমার জ্বালা আমার সহ্য হচ্ছে না আরহাম।
আরহাম কাঁদতে লাগল শব্দ করে। কষ্ট পেল ভিষণ। দৌড়ে ছাদে উঠে গেল সে। প্রিয়তা বসে রইল দরজার বাইরেই। কান্না পেল খুব। কিয়দংশ সময় পর লিরা আর প্রহর এলো প্রিয়তার সামনে। প্রহরের কোলে আরহাম মুখ গুঁজে আছে। প্রহর আরহামকে দাঁড় করাল। হাত বাড়িয়ে প্রিয়তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে চাইল। প্রিয়তা অগ্রাহ্য করলো সেই সহানুভূতির জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হাত। একটা কঠিন কাজ করে ফেলল প্রহর। এই প্রথম বার প্রিয়তাকে ছুঁয়ে দিল সে। প্রিয়তার বাহু ধরে ফেলল ছেলেটা। দু বাহু ধরে উঠে দাঁড় করাল প্রিয়তাকে। অবাকের শেষ সীমানায় গিয়ে প্রিয়তা পুতুলের ন্যায় উঠে দাঁড়াল। প্রহর গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বললো,
” আরহামকে মেরেছো কেন?
” আমার ভাই, আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি মেরেছি। আপনাকে কৈফিয়ত দিবো কেন? অকপটে বলে উঠল প্রিয়তা। কঠিন চাহনি তার।
লিরা এগিয়ে আসল। মেয়েটা আসলেই চমৎকার । আরহামের কান্নায় ব্যথিত সে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে লিরা বলে উঠল,
” হোয়াট হ্যাপেন্ড প্রিয়তা? ওকে মেরেছো কেন? আহ্, বাচ্চা। ব্যথা পেয়েছে। তোমাকে অন্যরকম লাগছে।
প্রহর বলে উঠল,
” আমি তোমার থেকে একটা আশা করিনি প্রিয়তা। আরহামের বাবা-মা থেকেও নেই। তুমিই ওর একমাত্র আপন জন। কিভাবে পাষণ্ডের মতো মেরেছো দেখো। দাগ হয়ে গিয়েছে। এখন কান্না করছে ছেলেটা।
প্রিয়তা উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করলো। আরহামকে টেনে কাছে টানল সে। রাগান্বিত হয়ে বলে উঠল,
” তুমি সবাইকে গিয়ে বিচার দিচ্ছো? যাও ওদের কাছেই। ফারদার আমার কাছে আসবে না।
প্রহর রেগে গেল। অতি নিকটে এসে দাঁড়াল প্রিয়তার। কঠিন স্বরে বললো,
” সমস্যা কি তোমার? কাল থেকে এমন রুড বিহেইভ করছো কেন সবার কাছে?
” হ্যাঁ আমি রুড। তো? আপনার কি? আমার যা ইচ্ছে আমি করবো। আমার পার্সোনাল লাইফে এন্টারফেয়ার করবেন কেন? যে পারছে সে এসে আমাকে আর আমার ভাইকে অপমান করছে, অসম্মান করছে। ছেলেটাকে ভোলাভালা পেয়ে মেরে দিচ্ছে ইচ্ছে মতো। আমি কিছুই করতে পারছি না। বড়লোক ঘরের ছেলে বলে এত আবদার করতে হবে তার কোনো মানে আছে? বলে কিনা রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়ি না পেলে ভাত খাবে না। এখন আমি কি করবো? পুরো মাসের বাজারের টাকা দিয়ে ওর জন্য গাড়ি কিনবো? আমার কি দুর্দশা চলছে আমিই বুঝতে পারছি। এক পা চলতে গিয়ে দু পা পিছিয়ে যাচ্ছি। একের পর এক আঘাত পেয়ে যাচ্ছি। সবাই তো শুধু সহানুভূতি দেখাতে পারে। প্রকৃতভাবে আমার পরিস্থিতি বোঝার মতো কেউ নেই। আমি সম্পূর্ণ একা। আরহাম বোঝে না আমাকে। অভাবের কথাও বোঝে না। কেন বুঝবে না? বুঝতে হবে।
প্রহর কথা থামিয়ে দিল। লিরাকে বললো আরহামকে নিয়ে যেতে। লিরা চলে গেল অসহায় ভঙ্গিতে। প্রহর দুরত্ব আরো কমাল। কাঁপা হাতে দু হাত দিয়ে প্রিয়তার গালে হাত রাখল। চোখের দিকে চেয়ে থেকে বললো,
” তুমি পারবে প্রিয়তা। সবটা সামলাতে পারবে। কোনো না কোনো ব্যবস্থা হবেই। ধৈর্যহারা হইয়ো না। আমি তোমার পাশে আছি।
চলবে?