প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৫

0
677

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৫)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

দুপুরের আগেই পার্কে যেতে চেয়েছিল প্রিয়তা। কিন্তু আজ যেহেতু বেতন পাবে তাই বেতন নিয়ে তবেই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানিং করেছে সে। কুসুমের মা লাঞ্চে খেতে আসবেন বাসায়। প্রিয়তা ভেবেচিন্তে দুপুরে কুসুমের বাসায় এসেছে পড়াতে। প্রিয়তার পরণে কালো হিজাব আর কালো থ্রিপিস। কালো সালোয়ার দিয়ে পায়ের সর্বত্র ঢেকে নিয়েছে সে। কুসুমের পাশাপাশি কোয়েলকে পড়াতে গিয়ে বিরাট ঝামেলা লাগে প্রিয়তার। প্রায়সই নির্দিষ্ট সময়ের অধিক সময় পড়াতে হয়। কুসুম আর কোয়েল দুজনেই প্রিয়তার কাছে পড়তে ভালোবাসে। সামনে কোয়েলের পরিক্ষা বলে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে প্রিয়তা। এক একটি টপিক বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে বিরক্তি ছাড়াই।

দুপুর একটা বাজে কুসুমের মা খেতে আসলেন। প্রিয়তাকে দেখে সালাম দিলেন তিনি। পাশের রুমে চলে গেলেন খাওয়ার জন্য। প্রিয়তা দুজনকে ভালো মতো পড়াতে লাগল। আসার সাথে সাথেই বেতনের কথা বলার মতো বোকা প্রিয়তা নয়। তাই কুসুমের মা পার্স নিয়ে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তখন প্রিয়তা বেতনের কথা তুলল। বললো,

” আন্টি আজকে বেতন দেওয়ার কথা ছিল।

কুসুমের মা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন। প্রিয়তার কথায় তার বেতনের কথা মনে পড়েছে এমন ভাব ধরলেন তিনি। বললেন,

“আর বইলা না গো বেতন পাইয়া ঘর ভাড়া, দোকানের বিল, কিস্তি দিয়া হাতে দুই হাজার টাকা হাতে। পুরা মাস চলতে হইবো বুঝোই তো। আমি তোমারে দুই মাসের বেতন এক সাথে দিয়া দিমুনি। চিন্তা কইরো না।

প্রিয়তা ভড়কাল। মাথা নত হলো। টাকাটা তার দরকার। মাস শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগে। কুসুমের মা বেতন পেয়েছে এটাও জানে প্রিয়তা। তাই তো ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল তার। খানিক দৃঢ় কণ্ঠে প্রিয়তা বললো,

” আমাকে শুধু কুসুমকে পড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পড়াতে এসে একই এমাউন্টে দুজনকে পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি মেনে নিয়েছি এটা। কিন্তু মাস শেষ হবার পর ও টিউটরের বেতন না দেওয়া কি ঠিক আন্টি? অনেক হয়েছে। আর পড়াতে আসবো না। আজ আমার বেতনটা দিলেই আমি চলে যাবো।

” সামনে মাইয়ার পরিক্ষা। এহন চইলা যাইতে চাইলে হইবো নাকি?

” আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি আন্টি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে বোধহয় দুজনকে এভাবে পড়াতে চাইতো না। আঙ্কেলকে আমি টাকা দেওয়ার কথা বলে দিবো। আজকে আমি আমার বিকাশে টাকা দেখতে চাই। আমি আর আসবো না

পুনরায় বললো,
– এমন ব্যবহারের জন্য দুঃখিত।

প্রিয়তা বেরিয়ে এলো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। কুসুমের মা ঘর ভাড়া, বিদ্যুত বিল, দোকান খরচ সবই দিতে পেরেছে। শুধু আটকে আছে প্রিয়তার বেতন। কোচিংয়ে গিয়ে প্রিয়তা ছয় হাজারের জায়গায় ছ হাজার আটশো টাকা পেল। প্রিয়তা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কোচিংয়ের হেড স্যারেরদিকে। প্রিয়তার পড়ানোর ধরন, ব্যবহার, স্টুডেন্টদের নাকি ভালো লেগেছে। তাই বাকি আটশো টাকা প্রিয়তাকে বোনাস দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আরো বাড়াতে পারেন তারা।

প্রিয়তা টাকা গুলো নিয়ে আপনমনে হাঁটতে লাগল। এই টাকাগুলো প্রিয়তার প্রথম উপার্জন। পরিশ্রম করে প্রিয়তা এই টাকাটা পেয়েছে। আনন্দে প্রিয়তা কেঁদে ফেলল রাস্তায়। খুশিতে মুচকি হেসে উঠল সে। হিসাব কষতে লাগল সবকিছুর। কিছুক্ষণ বাদেই বিকাশে টাকা পাওয়ার মেসেজ দেখতে পেল প্রিয়তা। আরো খুশি হলো প্রিয়তার হৃদয়। আরহামের জন্য রাস্তা থেকে একটা খেলনা গাড়ি কিনল। টাকাটা নিয়ে বাড়ি ফিরল সে। পরিশ্রম যেন আজ স্বার্থক হলো।

____________

বাড়িতে ফিরে খাবার গরম করে রেখে প্রিয়তা বেলকনিতে বসল। হিন্দি গান শুনতে শুনতে প্রিয়তা নিচে তাকাল। খানিকক্ষণ বাদে প্রিয়তার মনে হলো একজন লোক এ বাড়ির সদর দরজার আশপাশে ঘুরাঘুরি করছে। প্রিয়তা দৃষ্টি দৃঢ় করল। অনেকটা সময় নিয়ে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর বুঝতে অসুবিধে হলো না এই লোকটা জাফরের লোক। জাফরের লোক ছাড়া প্রিয়তাকে নছরে রাখার মানুষ এখন নেই।

বিরক্তিতে মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ বের করল প্রিয়তা। সামনের ছোট চুল গুলো বিরক্তি সহকারে কানে গুঁজে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করল। প্রিয়তার মন খারাপ হলো আবার। কি করবে এই ভেবে চিন্তিত হলো সে। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগে প্রিয়তা সিদ্ধান্ত নিল প্রহরকে সবটা জানাবে। এরপর যা হবে তা দেখে নিবে। এমন সৎ একজন পুলিশ অফিসারের অগোচরে তার জন্য ফাঁদ পাতবে প্রিয়তা? এটা তো অন্যায়। এর পরিণতি অবশ্যইভয়াবহ হবে। প্রহর যদি কোনোভাবে জানতে পারে? তাহলে তো প্রিয়তাকে ভুল বুঝবে। সমাজের চোখেও খারাপ হবে প্রিয়তা। জিতে যাবে দেশের শত্রুরা। অন্যায়ের সংখ্যা বাড়বে। একজন সৎ পুলিশ অফিসার হারিয়ে যাবে সিলেট থেকে। জাফরের ক্ষমতা জিতে যাবে।

প্রিয়তা কল লিস্টে প্রহরের নাম্বার খুঁজল। নির্দিষ্ট নম্বরটা পেয়ে ডায়াল করার আগ মুহুর্তে বুড়ো আঙ্গুল ফোন থেকে তুলে নিল প্রিয়তা। পুনরায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে আওড়াল,

” জাফর লোকটা খুব ধুরন্ধর প্রিয়তা। হি ক্যান ডু এনিথিং। হয়তো বা তোর ফোন-কল অ্যাপটাও নিয়ন্ত্রণ করে লোকটা। ধরা পড়তে পারিস তুই। ট্র্যাক জিনিসটাকে তুচ্ছ মনে করিস না।

প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। ঘরে এসে ওড়না ভালোমতো পেঁচিয়ে প্রহরের ফ্ল্যাটে যেতে চাইল। ততক্ষণাৎ মনে পড়ল ওদিনের অপমানের কথা। প্রিয়তা ও বাড়িতে ঢুকতে পারে না। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে ওই বাড়িতে আর কখনো পা রাখবে না। সেই প্রতিজ্ঞা কি করে ভাঙবে? আর না ভাঙলে প্রহরকে আলাদা ভাবে জানাবে কিভাবে? কল করলে জাফর জেনে যাবে। ছাদে কথা বললেও বুঝে যেতে পারে।

প্রিয়তা চিন্তায় পড়ল। পায়চারি করল গরে। দাঁত দ্বারা নখ কাটল। নজর বুলিয়ে পাশে আরহামের খাতা, কলম দেখে হাসল প্রিয়তা। বুদ্ধি বের হলো। দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে খাতা, কলম বের করে চিঠি লিখল। সেই চিঠিতে খোঁজ খবর নেওয়ার কোনো বাক্য ছিল না। চিঠির নিয়মকানুন ও ছিল না। এটাকে চিঠি হিসেবে ধরল না প্রিয়তা। জরুরী কথাগুলোই কেবল লিখে গেল।

পুলিশম্যান,

আপনাকে একটা বিষয় জানাতে চাইছি। আজ জাফর আলী এ বাড়িতে এসেছিলেন। আমার ঘরেও এসেছিলেন। আপনাকে ফাঁদে ফেলতে এখন আমাকে ব্যবহার করতে চান জাফর। আমাকে বড়সড় হুমকি দিয়েছেন উনি। আরহামকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আমি আপনার ক্ষতি চাই না, আর না ওই লোকটাকে সমর্থন করি। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আমি ওদের নজরবন্দি। আপনাকে ফোন করে সবটা বলে দিলে ধরা পড়তে পারি বিধায় কাগজে লিখছি। আমার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। আপনাকে আমার দ্বারা শেষ করার পরিকল্পনা আমরা সফল হতে দিতে পারি না। কিছু একটা ভাবুন।

প্রিয়তা বলছি,

ঘর থেকে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। আরহাম সিঁড়িতে খেলছিল। প্রিয়তা খুব সাবধানে আরহামের কাছে এলো। ভাইকে কোলে বসিয়ে কন্ঠ নরম করে ফিসফিসিয়ে বললো,

” তোমাকে একটা কাগজ দিবো আরহাম। কাগজটা তুমি পুলিশম্যানকে দিয়ে আসবে। কেউ যেন কাগজটা না দেখে। একদম লুকিয়ে, সবার আড়ালে দিবে। শুধুমাত্র পুলিশম্যানকেই দিবে। অন্য কারো হাতে যেন না পরে। মনে থাকবে? এই নাও।

প্রিয়তা কাগজটা আরহামের পকেটে রেখে দিল। আরহামকে মিসেস নাবিলা এখনো ভালোবাসেন। এই সময়ে আর কোনো উপায় নেই। একজনকে যেভাবেই হোক প্রহরের কাছে যেতে হবে। বাধ্য হয়ে আরহামকে পাঠাতে হলো ও ঘরে। মনে মনে লজ্জিত হলো প্রিয়তা। আরহাম খুশি মনেই উপরে উঠল। ফ্ল্যাটে গেল। প্রিয়তা বসে রইল সিঁড়িতে। আরহামের ফিরে আসার অপেক্ষা করল। মনে মনে ভয় হলো প্রিয়তার। মিসেস নাবিলা জেনে গেলে বিষয়টা খারাপ হবে। যদিও প্রিয়তা এমন কিছু লিখেনি যাতে কারো অসম্মান হয়। যাতে কেউ তাকে খারাপ ভাবে। বরং প্রত্যক্ষ ভাবে প্রহরকে সাহায্য করছে প্রিয়তা।

দীর্ঘ দশ-বারো মিনিট পর আরহাম ফিরল। দীর্ঘ বলার কারণ প্রিয়তার কাছে এটুকু সময় অনেক আশঙ্কায় কেটেছে, অনেকটা সময় মনে হয়েছে। প্রহর কি বলবে? আরহাম কাজটা ঠিকমতো করতে পারবে কি না এ নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল প্রিয়তা। আরহাম ফেরার সাথে সাথে প্রিয়তা জিজ্ঞেস করলো,

” উনি কিছু বলেছে তোমায়?

আরহাম শার্টের পকেট থেকে আরেকটি কাগজ বের করল। কাগজটা হলদে রঙের। কালার পেপার মনে হলো প্রিয়তার। তবে কাগজটা ভালোই মোটা। প্রিয়তা কাগজটা নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে গেল। নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেল প্রিয়তার। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজের ভাঁজ খুললো সে। সেথায় লেখা।

প্রিয়তা,

আপনি যা লিখেছেন সে সবই আমি জানি। আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আরহামের সুরক্ষা আমি দিবো। ভাবছেন এসব কিভাবে জানলাম আমি? তন্ময়ের দেওয়া ঘড়িটা আপনি সবসময় পরে থাকেন। আর না পরলে ঘড়িটা ঘরের ভিতরেই থাকে। আপনার ঘড়িতে জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস সেট করা প্রিয়তা। তানিয়া ওটা আপনার ঘড়িতে সেট করে দিয়েছে। আপনার ঘরে কে এলো আর কে গেল, কে কি বললো সবটা আমি জানতে পারি। আমরা জানতাম আপনি এসবে জড়িয়ে পড়তে পারেন। তাই তানিয়া আপনাকে এখনো নজরে রাখে। তানিয়া এই খবরটা আমাকে সকালেই জানিয়েছে। আপনি ভয় পাবেন না প্লিজ। আমি প্রহর আপনাকে নিরাপত্তা দিবো কথা দিচ্ছি। কেউ আপনাদের ক্ষতি করতে পারবে না। আপনি শুধু জাফরের কথায় হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাবেন ব্যস। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি। আবার ও বলছি ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি।

পুলিশম্যান।

প্রিয়তার আনন্দে কান্না পেল। সাথে কৌতুহলী হলো সে। তোষকের পাশে পরে থাকা ঘড়িটাতে হাত বুলাল প্রিয়তা। ঘড়িটা অনেকদিন আগে তন্ময় তাকে দিয়েছিল। অনেক দামি না হলেও কম টাকার নয় ঘড়িটা। প্রিয়তা সবসময় ঘড়িটা হাতে রাখার চেষ্টা করে।

ট্র্যাক সম্পর্কে ধারণা নেই প্রিয়তার। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘড়িটা দেখতে লাগল। ঘড়ির শেষ প্রান্তের এক কোনায় একটা মেডিসিনের মতো লম্বা আর গোলাকার কালো বস্তু দেখতে পেল। বুঝতে পারল এটাই সেই উদ্ভট বস্তু, যার দ্বারা প্রিয়তা পুলিশম্যানের নজরবন্দি হয়ে রয়েছে। মনে মনে খুব খুশি হলো প্রিয়তা। বিরাট বড় একটা বোঝা বুক থেকে নেমে গেল মনে হচ্ছে তার। নিজেকে দায়মুক্ত মনে হচ্ছে। প্রহরের ভরসার বাণী বারংবার ফুটে উঠছে চোখের পাতায়।

______________

বিকেলে বেশ ভালো মুডেই আরহামকে নিয়ে পার্কে এসেছে প্রিয়তা। পার্কের আশপাশটাও ঘুরে দেখল আজ। পেছন পেছন যে জাফরের লোক তাকে অনুসরণ করছে এটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারল প্রিয়তা। মাঝে মাঝে মুচকি হাসল সে। আজ পার্কটাতে প্রচুর ভিড়। একজন গায়িকা এসেছে এখানে। সকলেই সেদিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা আরহামকে আইসক্রিম, ললিপপ কিনে দিল। একসাথে কানামাছি খেলল চোখ বেঁধে। মাঠের কোণে থাকা স্টেজে জনতার ভিড়। শব্দে কান ঝাঁঝিয়ে উঠছে প্রিয়তার। প্রিয়তাকে অনুসরণ করা লোকটাকে এতক্ষণে ভালমতোই চিনেছে প্রিয়তা। একবার ও প্রিয়তাদের থেকে দূরে সরছে না লোকটা। জাফরের ভক্ত বলে মনে হচ্ছে লোকটাকে।

ওদিক থেকে বাংলা গানের সুর ভেসে আসছে। তোমায় “হৃদ মাঝারে রাখবো” এই গানটি প্রিয়তা প্রায়ই শুনে। গানের সাথে সাথে ঠোঁট নাড়াল প্রিয়তা। লোকজনের হৈ হুল্লোরে পুরো মাঠটা অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রিয়তার মনে হলো এই পার্কটা যেহেতু বাচ্চাদের জন্য তাই গায়িকার উচিত ছিল ছোটদের ছড়া, কবিতা কিংবা গান গেয়ে শোনানো। এই গানটা বোধহয় বড়দের জন্য।

প্রিয়তা খেয়াল করল তাকে অনুসরণ করা ব্যক্তিটি ফোন কানে চেপে ধরে আছে। এত আওয়াজে লোকটা ফোনের অপর প্রান্তে থাকা মানুষটির কথা বুঝতে পারছে না। যেজন্য লোকটা পার্ক থেকে বেরিয়ে আসল। প্রিয়তা স্থান ত্যাগ করল। অনুষ্ঠানের বিপরীত দিকে চলে এলো। এখানে অত আওয়াজ নেই। গানের হালকা শব্দ ভেসে আসছে। সেদিনের মতো আজ ও একই ঘটনা ঘটল। একটা ছেলে এলো প্রিয়তার কাছে। ছেলের পড়ণে স্যান্ডু গেঞ্জি। গায়ের রং ফর্সা। হাতে একটি থালা। সেখানে খুচরো দু-পাঁচ টাকার নোট আর কয়েন। প্রিয়তা মুখ ফিরিয়ে নিল। ছেলেটা ডাকল। বললো,

” আপু আমাকে কিছু টাকা দিন না।

প্রিয়তা আড়চোখে তাকাল। ছেলেটার করুণ মুখ। মায়া মায়া গোলাকার চোখ। কণ্ঠ অমায়িক। দাঁত গুলো চিকচিক করছে ছেলেটার। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছৈ। প্রিয়তা এড়িয়ে যেতে পারল না। জিজ্ঞেস করল,

“- তোমার আম্মু কোথায়? সে তোমাকে ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছে?

ছেলেটা অবাক হয়ে তাকাল। অপমানিত হলো বোধহয়। মাথা নত করে বললো,

” আম্মু অসুস্থ। তার ঔষধ কিনতেই ভিক্ষা করি।

প্রিয়তা বিশ্বাস করল না। বললো,

” আমার কাছে টাকা নেই। সরি।

ছেলেটা মাথা নত করে মলিন মুখে চলে যেতে উদ্যত হলো। কি মনে করে আবার সামনে ফিরে প্রিয়তাকে দেখল। বললো,

” আপনাকে তো আমি চিনি।

” আমাকে চিনো? কিভাবে?

” আপনার ছবি দেখছি আমার বসের বন্ধুর হাতে।

” আমার ছবি?কণ্ঠে বিস্ময় প্রিয়তার।

” হ্যাঁ আপনার ছবিই দেখেছি।

” তোমার বস কে? বসের বন্ধুই বা কে?

‘বসের বন্ধুকে তো চিনি না। আমার বসের নাম খলিল। বসের বন্ধু বসকে আপনার ছবি দেখিয়ে বলেছিল ” এই হলো সেই মেয়ে। এই মেয়েটাই হবে আমাদের টোপ। পুলিশের সাথে ওঠাবসা ওর”।

” কি বলছো?

” আপনাকে একটা কথা বলি। বস আর বসের বন্ধুর থেকে দূরে থাকবেন। নইলে আপনাকেও আমাদের মতো ভিক্ষা করাবে। আপনি তো বড়। কেউ ভিক্ষা দিবে না। আপনার হাত-পা কেঁটে ফেলবে ওরা। দূরে থাকুন ওদের থেকে।

প্রিয়তা থতমত খেল। ভয় হলো ভিষণ। জিজ্ঞেস করলো,

” তোমার বসের বন্ধু কি খুব লম্বা? বড় গোঁফ আছে লোকটার? দাঁড়ি আছে? শ্যামলা মতন?

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক বুঝাল। প্রিয়তা আশপাশে তাকাল আবার। প্রিয়তা এতক্ষণ যা বর্ণনা দিয়েছে তা জাফরের অবয়বের। তবে কি জাফর এসবেও যুক্ত? ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে লোকটা? প্রিয়তা বললো,

” এসব কথা আর কাউকে বলোনি? পুলিশের কাছে যাওনি?

আমার আব্বু মারা গেছে। আম্মুর পেটে বাবু। আমি ভিক্ষা না করলে আম্মুকে মেরে ফেলবে ওরা। পুলিশকে জানালে আমাকেও মেরে ফেলবে। আপনাকে বলেছি কারণ আমার মনে হলো আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। আপনার তো পুলিশের সাথে খুব খাতির।

প্রিয়তা সবটা বুঝল। বিশ টাকার নোট দিয়ে ছেলেটিকে দ্রুত বিদায় দিল সে। জাফরের লোক যেন কোনোভাবে ছেলেটার সাথে প্রিয়তার যোগাযোগ জানতে না পারে এজন্য। পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো সে। রিকশায় বসে কিছু জল্পনাকল্পনা করল। ফোন বের করে জাফরকে কল দিল। বললো,

” আপনার কথায় রাজি হয়েছি। অফিসারের থানায় যাচ্ছি আমি। বলবো এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই দেখা করতে এসেছি। থানা থেকেই মিশন শুরু করতে চাইছি।

” বেশ। আমার সাথে কোনো চালাকি করলে কিন্তু,

” আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি। আমি চিটিং করবো না। আপনার লোককে বলবেন ভালো মতো ফলো করতে। উনাকে নিয়ে বেরও হতে পারি। যদি ধরে ফেলে আপনার লোককে? সব শেষ কিন্তু।

” সমস্যা হবে না

” টাকা দিবেন তো স্যার? মুচকি হেসে বলল প্রিয়তা।

” পাবে পাবে। আগে কাজ টা হোক।

প্রিয়তা কল কাটল। জাফরকে বিশ্বাস করাতে হবে প্রিয়তা লোভী। প্রহরের বিরুদ্ধে সে সব করবে। জাফরের হয়ে কাজ করতে প্রিয়তার কোনো দ্বিধা নেই।

প্রিয়তা প্রথমে বাড়ি ফিরল। এখন প্রহর বাসায় থাকবে না প্রিয়তা তা জানে। আরহামকে ঘরে রেখে প্রিয়তা আবার ও বের হলো। রিকশা ডেকে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পিছনে একটা বাইক ও চললো। প্রিয়তা থানায় পৌছে কনেস্টবল কে প্রহরের কথা বলল। প্রহরের কেবিনে পৌঁছে প্রিয়তা সালাম দিল। ডেস্কের তিন কোণায় তিনটি টেবিলে ইহান, প্রহর আর তানিয়া বসে আছে। প্রিয়তা আশপাশে নজর বুলাল। প্রিয়তাকে দেখে মিষ্টি হাসল তানিয়া। বললো,

“তুমি এখানে? কেমন আছো প্রিয়তা?

” আলহামদুলিল্লাহ্ আপু। আপনি কেমন আছেন?

” আলহামদুলিল্লাহ্। বসো।

একটা চেয়ার আনা হলো। প্রিয়তা বসল সেখানে। ইহানের উদ্দেশ্যে বললো,

” আজ কালের মধ্যে থানায় নতুন কেউ জয়েন করেছে?

ইহান ভাবল। বললো,

” হ্যাঁ আজই তো।

” উনি আশেপাশে আছে?

” না।

প্রিয়তা সবটা প্রহরকে জানাল। সবটা জেনে ভিষণ অবাক হলো তিনজন। প্রহর কিছু একটা ভাবল সময় নিয়ে। ইহানের উদ্দেশ্যে বললো,

” সাকিব ছেলেটার স্কুল ওই পার্কের থেকে পনেরো মাইল দূরে তাই না ইহান? কোনোভাবে কি সাকিব ও ওখানেই আছে?

পুনরায় প্রহর বললো,

” আমি প্রিয়তার সাথে বের হচ্ছি। ওকে অনুসরণ করা লোককে বিশ্বাস করাতে হবে প্রিয়তা তাদের কথামতো চলছে। তানিয়া আর তুই এক্ষুণি পার্কে যাবি। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করবি। কোনো ক্লু পেলে কালেক্ট করবি। এট্যাক করবো সময় বুঝে।

______________

“স্যার চলুন বাদাম ভাঁজা খাই।

ইহান ভ্রু কুঁচকে তাকাল তানিয়ার দিকে। কাজ করতে এসে খাওয়া, বসার বিষয়টা ভালো লাগে না ইহানের। এমনিতেই ঘুরে ঘুরে কোথাও কোনো প্রমাণ পায়নি। কেউ কিছুই বলতে পারছে না। সাক্ষী হিসেবেও তো বাইরের কয়েকজনকে লাগতো। কোনো কিছু না পেয়েই তানিয়া খাওয়াদাওয়ার কথাটা তুলেছে। ইহান চুলগুলোকে ঠিক করে বললো,

” কাজের সময় কিসের খাওয়াদাওয়া? ওঠো। আরো সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

তানিয়া নড়ল না। পার্কের বাইরের ছোট টুলে বসে রইল। ইহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এই মেয়েটার দ্বারা কিচ্ছু হবে না বুঝে নিল। বললো,

” তুমি এখানে থাকো। আমি দেখছি।

তানিয়া মাথা নাড়ল। ইহান সামনে এগিয়ে আরো কিছু মানুষকে জিজ্ঞেস করলো বাচ্চাদের সম্পর্কে। অতঃপর বাদাম ভাজা আর পানির বোতল নিয়ে বসল তানিয়ার পাশে। তানিয়ার হাতে সেসব গুঁজে দিয়ে বললো,

” তুমি বাড়ি যাও। তোমার থেকে তো কোনো লাভ হচ্ছে না।

” আশ্চর্য স্যার। আমি কিছুই করছি না? এখানে বসে আমি নজর রাখছি কেউ আমাদের অনুসরণ করছে কি না। এটা কি কাজ নয়?

” আমি বসে বসে দেখি তুমি যাও মেয়েদের জিজ্ঞেস করে এসো।

” বাদামটা খেয়ে নিই। যাচ্ছি।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে