প্রাক্তন পর্ব-২৭

0
1235

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৭

আমিও বসা থেকে হুট করে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে আসলাম। আমাকে বাইরে আসতে দেখে সোহানও বাইরে আসলো। আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল

– কী রে হুট করে বাইরে আসলি কেন? কী হয়েছে? কাউকে কী দেখেছিস?

আমি আশেপাশে খু্ঁজতে লাগলাম। আশেপাশে দেখে লক্ষ্য করলাম কেউ নেই। ভাবুক গলায় সোহানকে উত্তর দিলাম

– মনে হয়েছিল অরন্য বের হয়েছে রেস্টুরেন্ট থেকে।

আমার কথায় বিরক্ত হওয়ার কারণ থাকলেও সোহান তেমন বিরক্ত হলো না৷ আমাকে ধরে বলল

– তুই একটু বেশিই ভাবছিস। এখানে কেউ নেই। অরন্যকে দেখলে সে কী উধাও হয়ে যাবে? মৃত মানুষকে নিয়ে এত চিন্তা করা ঠিক হচ্ছে না। বাবুর উপর প্রভাব পড়বে। সে কখন থেকে একটা কথায় বলে যাচ্ছিস। একটু নিজেকে সামলে নে। আমি জানি তোর সাথে যা হয়েছে এতকিছুর পর নিজেকে সামলানো অনেক কঠিন। তবে নিজের সন্তানের জন্য হলেও নিজেকে সামলে নে। আমাদের জীবন তো সবসময় আমাদের মতো করে চলে না৷ তোর যেটা হচ্ছে সেটা অত্যাধিক চিন্তা থেকে। সিজোফ্রেনিয়া রোগ এটা। যাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করা হয় তাকে বাস্তবে দেখেছে বলে মনে হয়। এজন্যই বলেছিলাম একজন মানসিক ডাক্তার দেখাই। তুই তো রাজি না। তবে একটু নিজেকে সময় দে। যেটা হয়েছে সেটা মানতে শিখ। আমার একটা ভুল হয়েছে নাফিসার কাছে নিয়ে গিয়ে। নিয়ে গিয়েছিলাম তোকে একটু স্বস্তি দেওয়ার জন্য। উল্টা নাফিসা তোকে অশান্ত বানিয়ে দিল। যাইহোক যা হবার তো হয়েছেই এখন চল আইসক্রিম খাওয়া যাক। বাসায় টুকটুকি তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মেয়েটার দিকে তো তোর লক্ষ্য রাখতে হবে৷ তাকে তোর আদর থেকে বঞ্চিত করিস না।

সোহানের কথা শুনে আমার যেন বোধদয় হলো। সত্যিই তো বিষয়টা নিয়ে আমি একটু বাড়াবাড়ি করছি। আর সোহান আমার স্বামী এটাও আমাকে দেখতে হবে। কোনো স্বামীই তার স্ত্রী এর প্রাক্তনকে সহ্য করতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। অরন্যকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি সোহানের সাথে একটু অন্যায় করে ফেলতেছি। যেটা একদম অনুচিত। আমি নিজেকে সামলালাম। সোহানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। তারপর হালকা সুরে বললাম

– তুই যা বলিস তাই হবে। সত্যিই হয়তো এটা আমার মানসিক রোগ না হয় এমনটা হত না। চল আইসক্রিম খাই। মাথা এলোমেলো লাগছে।

সোহান আমার মাথার চুলে আঙ্গুল দিয়ে হালকা মেসেস করে বলল

– পাগলি একটা।

বলেই দুজন রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম পুনরায়। আইসক্রিম ততক্ষণে চলে আসলো। সোহান আর আমি আইসক্রিম টা খেতে লাগলাম। আমি যত চেষ্টা করছি সোহানের দিকে মনোযোগ দিতে ততই মনোযোগ যেন অরন্যের দিকে যাচ্ছিল। নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হচ্ছিলাম। তবুও সামলে নিয়ে দুজন আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে বাসায় আসলাম।

বাসায় আসতেই টুকটুকি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– মা কোথায় গিয়েছিলে?

আমি টুকটুকিকে কোলে তুলতে চাইলে সোহান বাঁধা দিল। সোহানের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললাম

– কোলে নিতে বাঁধা দিচ্ছিস কেন?

– টুকটুকির বয়স ৫ বছর। ও একটু হেলদি বাচ্চা। এখন কোলে না তোলায় ভালো। আদর কর এমনিতে কর। রিস্ক নিস না কোনো। এ বাচ্চার কিছু হলে আমার মনকেও আমি শান্ত করতে পারব না আর তুই ও আরও ভেঙ্গে পড়বি। আমি চাই না এমন কিছু হোক। সবদিক দিয়ে তুই সাবধানে থাক।

সোহানের কথা গুলো শুনে আমার চোখের কোণে জল জমে গেল। একটা মানুষ এত নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে কী করে। আমি টুকটুকিকে কোলে তুললাম না। ওর গালে কয়েকটা চুমু দিয়ে রুমে নিয়ে গেলাম। ওর জন্য আনা চকলেটটা ওর হাতে দিলাম। ও আমার পাশে বসে হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগল। কোথায় গিয়েছিলাম তাকে কেন নিই নি। আমি হেসে হেসে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে সোহানের মা এসে বলল

– মা মেয়ের ভালোবাসা যেন এভাবেই অটুট থাকে। আরেকটা নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাই।

আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললাম। মা আমার লজ্জা দেখে হালকা হেসে চলে গেল। আমি টুকটুকির সাথে এদিকে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। টুকটুকিকে গোসল করালাম দুপুরের খাবার খাওয়ালাম তারপর ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। মাথাটা বেশ ব্যথা করছে। টেবিলে হাত রেখে হাতে কপাল ঠেকিয়ে চেয়ারে বসলাম। সোহান হাতে করে তেলের বোতল এনে আমাকে ডেকে বলল

– চল উঠ। মাথায় তেল দিয়ে দিই ভালো লাগবে।

আমি উঠতে চাচ্ছিলাম না। তবুও সে জোর করে আমাকে বসিয়ে মাথায় তেল দিয়ে মেসেস করতে লাগল। মাথার ব্যথাটা যেন আস্তে আস্তে কমছিল। আমি সোহানকে বললাম

-ব্যাথাটা অনেকটায় কমেছে।
– কে তেল দিয়ে দিছে দেখতে হবে তো। চল খাবি।

দুজন একসাথেই খেলাম। মা কল দিয়ে বলল সোহানকে নিয়ে বাসায় যেতে তবে এখন কেন জানি বাসায় যেতে মন চাচ্ছিল না, তাই না করে দিলাম। মাকে বললাম সোহান ব্যবসার কাজে ব্যস্ত পরে আসব। মা ও আর বাড়াবাড়ি করল না। দিন গড়িয়ে রাত নামল সোহানের হাতে মাথা রেখে শুয়ে আছি। সোহান আমার ঘাড়ের গন্ধ নিচ্ছিল। ওর বুকে মাথা রেখে যেন অনেকটা স্বস্তি মিলছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– সবসময় এভাবে থাকিস। তোকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। কখনও ছেড়ে চলে যাবি না।

আমি হালকা হেসে বললাম

– বেশি ভালোবাসাও ভালো না রে। একটু কম বাসিস। যাতে কখনও হারিয়ে গেলেও সহ্য করে নিতে পারিস।

সোহানের ঠোঁট দুটো দিয়ে আমার ঠোঁট জোরা চেপে ধরল। পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বলল

– এমন বলিস না। আমি কখনও তোকে হারাতে চাই না। ভীষণ ভালোবাসি তোকে।

আমি আর কিছু বললাম না। তার বুকে মাথা লুকালাম।

পরদিন সকালে উঠেই তৈরী হলাম কলেজে যাওয়ার জন্য। সোহান আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলল

– আমি গাড়ি রেখে যাচ্ছি। তুমি গাড়ি করে চলে যাও। একটা কাজে শহরের বাইরে যাব। রাতের মধ্যেই চলে আসব।

আমিও সোহানের দিকে তাকালাম। তার গালে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ দিয়ে কানের কাছে গিয়ে বললাম

– তাড়াতাড়ি চলে এসো। অপেক্ষায় থাকব।

সোহান হালকা করে আমাকে বুকের মধ্যে ঝাঁপটে ধরে বলল

– সে তো আসতেই হবে। প্রিয়তমা যে অপেক্ষা করবে। আচ্ছা আজকে আমরা কত সাবলীল ভাবে তুমি করে বললাম তাই না।

হালকা হাসি টেনে বললাম

– আস্তে আস্তে আরও সাবলীল হয়ে যাবে। যা তো তুই এবার।

সোহান বের হয়ে গেল। আমিও তৈরী হয়ে টুকটুকিকে নাস্তা খাইয়ে দিয়ে মায়ের কাছ থেকে বলে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলাম। ড্রাইভার চাচা গাড়ি চালাচ্ছে। হুট করে গাড়ির আায়না দেখে মনে হলো অরন্য আমাকে বাইক চালিয়ে অনুসরন করছে। তবে এবার উত্তেজিত হলে চলবে না৷ এটা আমার কল্পনা নাকি বাস্তব সেটা আগে নিশ্চিত হতে হবে। আমি ড্রাইভার চাচাকে বললাম

– চাচা দেখেন তো আয়নায় কোনো ছেলেকে দেখছেন কী না কালো শার্ট পরা বাইক চালাচ্ছে।

চাচা আয়নায় তাকিয়ে বলল

– হ্যাঁ দেখতে পারছি। কালো হ্যামলেট ও পরেছে তাই না?

– হ্যাঁ চাচা।

তার মানে এটা আমার কল্পনা না। শার্ট টা অরন্যের সেটা আমি ভালো করেই চিনি। চাচাকে বললাম

– চাচা গাড়িটা একটু থামান।

চাচা গাড়িটা থামাল। সে বাইকটা গাড়িটা থামতেই গাড়িটা পার করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বাইকের নম্বরটা আমার খুব ভালো করে চেনা। এটা যে অরন্যের বাইক বুঝতে আর বাকি রইল না। এবার আমি নিশ্চিত এটা অরন্য। চাচাকে বললাম কলেজের দিকে যেতে। আমি সিউর অরন্য আমার পিছু নিবে। চাচা গাড়ি স্টার্ট করে কলেজের দিকে যাচ্ছে। সে বাইকটা এক মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে পুনরায় আমার পিছু নিল। চাচা কলেজের সামনে এসে বলল

– চলে এসেছি।

আমি গাড়ি থেকে নামলাম। নামতেই বাইকটা থেমে গেল। দেখেও না দেখার ভান করে কলেজে ঢুকলাম। কলেজে ঢুকতেই কলিগরা বলতে শুরু করল

– হুট করে বিয়ে করলে বিয়ের দাওয়াত কিন্তু পেলাম না।

আমি এক গাল হেসে বললাম

– দিব। একটু সমস্যার জন্য দেওয়া হয়নি।

– দাওয়াত যেন পেয়ে যাই। যাইহোক কংগ্রাচুলেশনস। আর ফেসবুকে এখনও সিনগেল কেন। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেন্জ করো।

সত্যিই তো আমি সিনগেল না, তাহলে ফেসবুকে সিনগেল দিব কেন। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সোহানের সাথে ট্যাগ করে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিলাম। হুট করে বিয়ের স্ট্যাটাস দেওয়ায় সবাই একটু চমকালো বটে।

আর এদিকে লক্ষ্য করলাম অরন্য নীচে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও হ্যামলেট পরা। তবুও আমাকে নিশ্চিত হতে হবে। ওর একটা ছবি তুলে রাখতে হবে। আমি নীচে গেলাম। কৌশলে অরন্যের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক পাশে এসে তাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। লক্ষ্য করার পর শুধু একটু না অনেকটায় চমকালাম আশ্চর্য ও হলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে