প্রাক্তন পর্ব-২৬

0
1126

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৬

কারণ নাফিসা বলল

– অপ্সরা বিশ্বাস করো আমি অরন্যকে খুন করিনি। আমি ওকে কেন খুন করতে যাব। অরন্য আমাকে কাবিনের ৩০ লাখ টাকাও দিয়ে দিছে৷ আর সবচেয়ে বড় কথা ও কোথায় ছিল সেটাই তো আমি জানতাম না। আমাকে কে ফাঁসিয়েছে জানি না। আমার হাতের ছাপেই বা কীভাবে গেল বুঝতে পারছি না৷ আমি এতটা নির্দয় না যে অরন্যকে মেরে ফেলব। অরন্যের সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা নেই। সেদিন সালমানের সাথে আমার রাস্তায় দেখা হয়৷ তার সাথে ঝামেলা হয়, বেশ কথা কাটাকাটি হয়ে আমি বাসায় চলে আসি।

সালমান রাতে কয়েকবার কল দেয়। আমি আর ধরিনি। রাতেই সালমান লন্ডন চলে যায়। আর অরন্যের লাশও পরদিন পাওয়া যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম সালমান খুন করেছে তবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলতেছে অরন্যের খুন হয়েছে সকাল দিকে। তখন সালমানের উপর আমার সন্দেহ চলে যায়। কারণ সালমান রাতের ফ্লাইটেই লন্ডনে চলে গিয়েছিল। তবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। যে জায়গায় আমি অরন্যের খোঁজ খবরেই পাচ্ছিলাম না সেখানে আমি অরন্যকে খুন করব কীভাবে? সালমানকে টেক্সট করেছিলাম৷ সে উত্তরে বলল আমাকে আর কোনো সাহায্য সে করবে না। সে আর কোনোদিন দেশে আসবে না। তারও ধারণা আমিই অরন্যকে খুন করেছি। আমি একা হয়ে পরি। আমি জানি না আমার হাতের ছাপ অরন্যের গলায় কী করে গেল। অপ্সরা আমার যা শাস্তি হওয়ার তো হবে৷ হয়তো এটা প্রমাণ করতেও পারব না আমি অরন্যকে খুন করিনি তবুও তোমাকে বললাম। কারণ শাস্তি হওয়ার আগে একটা মানুষ অন্তত জানুক আমি তাকে খুন করেনি।

আমি নাফিসার কথা শুনে একটু তীক্ষ্ণ গলায় বললাম

– সত্যিই কী খুন করো নি? নাকি কোনো নাটক করছো?

– অপ্সরা আমার শাস্তি যা হওয়ার সেটা নির্ধারিত হয়েই আছে। এখন নাটক করে লাভ নেই। তোমার বন্ধু আমি না যে এসব বললে তুমি আমাকে সত্য উদঘাটনে সাহায্য করবে তবুও বলছি কারণ মনের শান্তির জন্য। আমি নিজেও জানতাম না অরন্য কোথায় ছিল। আমি আবারও বলছি অরন্যকে আমি খুন করেনি। আমাকে কেউ এ নোংরা খেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। কেন জানি না মাঝে মাঝে তোমাকেও সন্দেহ হয়।

নাফিসার এ দোটানা বলে দিচ্ছে সে অরন্যকে খুন করেনি৷ নাহয় সন্দেহের তীর আমার দিকে ছুড়ত না। একটা মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন সে এমন অনেক কিছুই ভাবে। তবে এটা নাফিসার নাটকও হতে পারে। আবার মনে হচ্ছে আমি অরন্যের মতো কাউকে দেখলাম তাহলে সেটা কে ছিল? সেটা কী আদৌ আমার কল্পনা ছিল নাকি কোনো বাস্তবতা। সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। নাফিসাকে হালকা গলায় বললাম

– তুমি একজন মানুষের গলায় হাত না দিলে তো ছাপ পাওয়ার কথা না। সেটা কী করে সম্ভব?

নাফিসা পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল

– আমিও সেটার মানে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার হাতের ছাপ কী করে গেল। আমি তো এতটা জঘন্য না। একটা ছেলেকে খুন করে তার শরীর এসিড দিয়ে পুড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত করব। সত্যিই আমি জানি না।

বেশ অবাক সুরে বললাম

– অরন্যের লাশ কী এসিড দিয়ে পুরানো অবস্থায় ছিল?

নাফিসা ভাঙ্গা গলায় বলল

– আমি লাশ দেখেনি৷ তবে বলা হয়েছে আমি নাকি অরন্যকে গলা টিপে মেরে লাশ গুম করার জন্য পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছি। জানি না কে করেছে এমন। তবে আমাকে যে মুখ্য গুটি বানিয়ে চাল চেলেছে সেটা বুঝতে পারছি৷ পুলিশ নাকি ব্যাপারটা অদন্ত করছে৷ তবে তাদের উপর আমার কোনো ভরসা নেই। তদন্ত করার পরও হয়তো আমাকেই দোষী বলবে৷ আমাকেই শাস্তি দিবে। আচ্ছা তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসেছো কেন?

নাফিসার কথাগুলো শুনার পর আমার বিয়ের সংবাদটা ওকে দিতে পারলাম না। কেন জানি মনে হচ্ছে নাফিসা যা বলছে সত্যি। হয়তো অরন্য মরেনি৷ হয়তো মরেছে তবে সেটার দোষ নাফিসার না৷ তাই এ মুহুর্তে নাফিসাকে বিয়ের সংবাদ দিতে গেলে অনেকটা কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো হয়ে যাবে। তাই নাফিসাকে ব্যাপারটা চেপে গেলাম। তেমন কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম

– তুমি থাকো। আমি আসছি। পরে কথা হবে। হয়তো দেখা করার সুযোগ আর হবে না। এসেছিলাম এমনিতেই।

কথাটা বলেই চলে আসলাম। হাজারটা প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। নাফিসার সাথে দেখা করতে আমি একা গিয়েছিলাম। সোহান বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে বের হতে দেখেই বলল

– এত দেরি হলো কেন বের হতে? আরেকটু হলে তো চিন্তায় পড়ে যেতাম।

– কিসের চিন্তা শুনি? নাফিসা তো জেলের মধ্যে থেকে আমাকে কিছু করবে না৷ চল বাসায় যাওয়া যাক।

– তুই কী ডিস্টার্ব কোনো বিষয় নিয়ে?

আমি সেহানের দিকে তাকিয়ে তার হাতটা ধরে বললাম

– নাহ! তেমন কিছু না। চল গাড়িতে উঠা যাক। অনেক দিন আইসক্রিম খাওয়া হয় না৷ চল আমাদের কলেজের সামনের দোকানটা থেকে আইসক্রিম খেয়ে আসি।

সোহান আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে হেসে দিয়ে বলল

– তোর কী মনে হয় এত বছর পরও সে দোকান আছে? কবেই সে দোকান ভেঙ্গে গেছে। চল একটা রেস্টুরেন্টে বসি৷ সেখানে গিয়ে আইসক্রিম খাব নে।

– চল তাহলে।

বলেই গাড়িতে উঠলাম। আমি সামনের সিটে হেলান দিয়ে বসলাম। সোহান গাড়ি চালাচ্ছে। আমি হুট করে সোহানকে বললাম

– আমার কেন জানি মনে হচ্ছে নাফিসা অরন্যকে খুন করেনি৷ তার কথা শুনে এমনেই মনে হচ্ছে। আর আসার সময়ও কেন জানি না মনে হলো অরন্যকে রাস্তায় দেখেছি। আমি যে শার্ট টা অরন্যকে গিফট দিয়েছিলাম সে শার্ট টা পরেই রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল।

আমার কথা শুনে সোহান হুট করে গাড়িটা ব্রেক কষল। গাড়িটা থামাতেই আমি ওর দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– এসব কী আবোল তাবোল বলতেছিস? সকালে অরন্যকে তুই কীভাবে দেখবি৷ একটা মৃত ব্যক্তি কী ফিরে আসা সম্ভব? আর নাফিসা তো মিথ্যাও বলতে পারে। আমরা কী সবাইকে চিনি? মানুষকে চেনা কী এত সহজ? এত কাহিনির পর ও এখনও মানুষ চিনলি না। আর তোকে একটা মানসিক ডাক্তার দেখাতে হবে। অরন্যের ভূত তোর মাথায় চেপেছে এটা নামাতে হবে৷ আর অপ্সরা আমি তোর স্বামী। আমার সামনে প্রাক্তনকে নিয়ে বললে আমার হিংসা হয়। একটু তো বুঝবি।

– সোহান মশকরা করিস না। আমি কেন জানি না বিষয়টাতে নাফিসা কে দোষ দিতে পারছি না। কোনো রহস্য তো লুকিয়ে আছেই। অরন্যকে ঘিরে এমন কিছু আছে যেটা আমি বা তুই জানি না।

– আমার বাল আছে। তোর এসব প্যাচাল থামাবি? আজকেই তোকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ঠিক মতো কাউন্সিলিং করলে ঠিক হয়ে যাবে সব।

বেশ রাগী গলায় উত্তর দিলাম

– তোর কী আমাকে পাগল মনে হয়?

সোহান আমার গালটা টেনে তার কাছে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল

– তোকে আমার পাগলি মনে হয়। মানসিক ডাক্তার শুধু পাগলদের দেখায় না। এই যে তুই মৃত একটা মানুষকে দেখছিস। যেখানে সমস্ত রিপোর্ট বলে দিচ্ছে এটা অরন্যের লাশ। তার পরিবারও শনাক্ত করেছে সেখানে তুই বলছিস ও বেঁচে আছে৷ অপ্সরা নিজেকে সামলে নে। অতীতে এখনও ডুবে আছিস। এ অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। পেটে একজন আছে তার কথা ভাব।

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম

– তার কথায় ভাবতে গিয়েই তো এত ভাবছি। এ অতীত যে পিছু ছাড়ে না।

– তুই ছাড়লেই ছাড়বে। তুই যে ধরে আছিস তাই।

– বাদ দে। আইসক্রিম খেলে মাথা ঠিক হবে। মাথায় হয়তো জং ধরে গেছে। গাড়ি স্টার্ট দে।

সোহান চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে রেস্টুরেন্টে চলে আসি। রেস্টুরেন্টে গিয়ে আইসক্রিম অর্ডার করে দুজনেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। সোহান হাসতে হাসতে বলে উঠল

– আগে তো আমার আইসক্রিমে থুথু মিশিয়ে দিতি যাতে করে দুটোই তুই খেতে পারিস। এখন থুথু মিশালেও সমস্যা নেই আমি খেতে পারব।

বলেই হুহু করে হেসে দিল। আমি হালকা করে হাসলাম। আগে কত দুষ্টই না ছিলাম আমি। হাসতে হাসতে পাশ ফিরে তাকাতেই মনে হলো অরন্যকে দেখেছি। সে উঠেই বাইরের দিকে চলে গেল। আমিও বসা থেকে হুট করে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে আসলাম।

( চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে