#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৫
সোহান কী আমার সাথে নাটক করল? কারণ ক্যালেন্ডার টা হাতে নিতেই কিছু ছবি মেঝেতে পড়ল। মনে হয়েছিল ছবিগুলো হয়তো সোহানের কোনো গোপন ছবি যেগুলো ক্যালেন্ডারে এভাবে রেখেছে। প্রথমে এমন কথাটায় মনে চলে এসেছিল। ক্যালেন্ডার হাতে নিতেই ছবিগুলো উল্টো হয়ে পড়েছিল তাই। পরক্ষণেই অবিশ্বাসের চাদর টা মন থেকে সরে গেল, যখন ছবি গুলো মেঝে থেকে তুলে উল্টো করে ধরে নিজের চেহারাটায় দেখলাম। ছবিগুলো বেশ পুরনো নবম,দশম শ্রেণী এবং কলেজে থাকা অবস্থায় তুলা। ৮-১০ টা ছবি তুলে রাখা আছে। প্রতিটি ছবির পেছনে সেদিনের ঘটে যাওয়া কাহিনি ছোট করে বর্ণণা করা আছে। বেশ ভালোই লাগল বিষয়টা দেখে। অন্তত কেউ একজন তো আমাকে ভালোবাসে। তার মনের গহীনে তো অপ্সরা নামটা রয়েছে। আমি চুপ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ছবিগুলো যথাস্থানে রেখে খাটের কোণে এসে বসলাম। ভেতরটা বেশ প্রশান্তি লাগছে। মনটাতেও বেশ স্বস্তি লাগছে। নিজের জীবনের মোড় হয়তো ঘুরবে। হয়তো এত দিনের কষ্ট সব সুখ হয়ে পরিণতি পাবে আবার না ও পেতে পারে। তবে নিজেকে সেভাবেই গড়ে নিয়েছি যাতে করে ভালো খারাপ যাই হোক মেনে নিব আমি। অরন্যকে একটু একটু মনে পড়লে ও সেটা দমিয়ে নিচ্ছিলাম বারবার। অরন্যের শাস্তি কামনা করেছিলাম তবে মৃত্যু না। সৃষ্টি কর্তার লীলা ছিল ভিন্ন তাই সে আজ ওপারে। দোয়া করি সে যেন জান্নাতবাসী হয়।
বেশ কিছুক্ষণ একা বসে রইলাম। টুকটুকিরও পাত্তা নেই। একা বসে থাকতে তেমন ভালো লাগছে না। টুকটুকিকে খুঁজে বের করে ওর সাথে একটু সময় কাটালে মনটা সিক্ত হবে। তাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার দিকে পা বাড়াতেই লক্ষ্য করলাম সোহানের মা এসেছে। সোহানের মা আমার দিকে তাকিয়ে বেশ হালকা গলায় বলল
– একটু বসো ঐখানে, কথা আছে।
মনের ভেতরটা হালকা কম্পিত হলো। মনে হলো উনি বলবেন, এ বিয়েতে উনি রাজি না কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে উনি বলে উঠলেন
– তোমার মা বাবার সাথে কথা বললাম উনারা সন্ধ্যায় আসবেন। আর আজকেই তোমার আর সোহানের বিয়ে দিতে চাই। অনেক ঝামেলা গেল আর নতুন কোনো ঝামেলা হওয়ার আগেই সব শেষ করতে চাই। একটা অনুগ্রহ রাখবে শুধু, আমার ছন্নছাড়া ছেলেকে ছেড়ে কখনও কোথায় যেও না। ওর জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে দিও। বড় ছেলের পরিণতি যেন ছোট ছেলের না হয়।
উনার কথা শুনে আমি চাপা কন্ঠে জবাব দিলাম
– আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না আমি এমন কিছুই করব না যাতে করে সোহান কষ্ট পায়। আর আমি সোহানকে ততটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করব যতটুকুতে সে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারে। না পাওয়ার যন্ত্রণা কত প্রখর আমি জানি। এমন কিছু হবে না। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
– এখন থেকে মা ডেকো। আর একটু তৈরী হও। সন্ধ্যায় কাজী আসবে বিয়ে পড়াতে। একটু তো নিজেকে গুছাও সাজগোজ করো। কাউকে আপাতত বলতে চাচ্ছি না বিয়ের ব্যাপারটা। বিয়ে হওয়ার পর সবাইকে জানাব।
আমি লজ্জা মাখা মুখে মাথা নেড়ে গেলাম। আড়চোখে দরজায় তাকিয়ে দেখলাম সোহান দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সোহানের হাসি দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম। মা সোহানের উপস্থিতি টের পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। সোহান এবার আমার কাছে আসলো। আমি সোহানের দিকে তাকালাম। এ প্রথম ওর দিকে তাকাতে বেশ লজ্জা লাগছে। ওর উপর খবরদারি করতে লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি সত্যিই নতুন বউ। সোহান আমার অবস্থা দেখে আমার হাতটা ধরে তার কাছে এনে বলল
– আজ একটু সুন্দর করে সাজবি। সরি সাজবে। তোকে যেন সরি তোমাকে হবে। তোমাকে যেন পরীর মতো লাগে। কপালে লাল টিপ দিবি। ধুর তুমি করে ডাকতে পারব না তুই করেই ডাকব কেমন।
আমি মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বললাম আচ্ছা। সোহান আমার হাতটা টেনে তার কাছে আনল। টকুটকি এর মধ্যে উপস্থিত হতেই সোহান হাতটা ছেড়ে দিল। আমি টুকটুকিকে কোলে নিয়ে সোহানের কানে কানে বললাম
– আমিও তোরে ভালোবাসি।
বলেই রুম থেকে প্রস্থান নিলাম। টুকটুকির সাথে কিছুক্ষণ খেলে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। তারপর গোসল করতে গেলাম। ভালো করে গোসল করলাম। চুলগুলো বেশ যত্ন করে শ্যাম্পু করেছি। আজকে অনেক ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে যন্ত্রণার পর যেন স্বস্তি মিলছে। নিজেকে বেশ পরিপাটি করে ফেললাম।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। বাবা, মা সবাই আসলো। মা আমার কাছে এসে বলল
– মারে অভিমান করেছিলাম তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ক্ষমা করে দিস। তোরে আল্লাহ দু হাত ভরে দিছে। সোহানের মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। আল্লাহ তোকে তাই দিছে।
বাবাও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল
– ক্ষমা করে দিস তোকে ভুল বুঝার জন্য।
তাদের প্রতি রাগটা বেশিক্ষণ করতে পারলাম না। ভাই আর ভাবী এসেও ক্ষমা চেয়ে নিল। একটা বিয়ে যেন সমস্ত পরিস্থিতি পরিবর্তন করে দিল। অথচ এরাই গতকাল পর্যন্ত আমার মুখ দেখতে চায়নি। কষ্টটা চেপে গেলাম শুধু। কাজী আসলো। দুই পরিাবর একসাথে বসলো। আমি আজ লাল বেনারসি পরেছি। হাতে লাল চুড়ি। কপালে লাল টিপ। যে সাজটা সাজতে চেয়েছিলাম চার বছর আগে কিন্তু ব্যর্থতার গ্লানি সেদিন আটকে দিয়েছিল সব। আজকে সে একই সাজটা সেজেছি। যেন অনেক কষ্টের পর প্রাপ্তি।
কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করল। আমাকে কবুল বলতে বলল। কবুল বলার সময় বেশ জোর গলায় কবুল বললাম। তিনবার কবুল বলেই কেঁদে দিলাম। আজকে আমি নতুন জীবনে পা দিয়েছি। একজনের সন্তান আমার পেটে আরেকজনের বউ আমি হব। কেউ না জানুক আমি আর সোহান সবটা জানি। সোহানও কবুল বলল। দুজনের সুখ চেয়ে মোনাজাতের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হলো।
বিয়ের পর আমাকে নিয়ে বসানো হলো সোহানের রুমে। মা,বাবা রাতের খাবার খেয়ে বাসায় চলে গেল। যাওয়ার আগে আমাকে মন ভরে দোয়া করে গেল। টুকটুকি বেশ কয়েকবার রুমে এসে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে গেল। মা কয়েকবার রুমে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে কী না। আমি মাথা নেড়ে না করলাম। অথচ সোহানের পাত্তা নেই। যার জন্য বসে আছি সে কই। ঘড়ির কাটায় রাত এগারটা বাজে। এখনও সোহান আসলো না৷ বেশ রাগ লাগছে ওর উপর। বিড়বিড় করে সোহানকে বকতে লাগলাম। এর মধ্যেই সোহানের আগমণ ঘটল। হাতে খাবারের প্লেট। আমার পাশে এসে বসে বলল
– বিড়বিড় করে আমাকেই বকছিস তাই না?
– তো কী করব? তোকে বকব না তো আদর করব?
সোহান খাবারের প্লেটটা বিছানার পাশে রেখে আমার কানের কাছে এসে বলল
– আমি তোর স্বামী ভুলে যাস না। আমাকে বকবি কেন আদর করবি।
আমি সেহানের কথা শুনে একটু জোরেই হেসে দিলাম। ও আমার হাসি দেখে গাল টেনে বলল
– এবার খা। এখনও তো খাসনি। পেটে একজন না খেয়ে আছে সেটার খবর কী আছে।
আমি সেহানের চোখের দিকে তাকালাম। এত ভালোবাসা আর মায়া এ চোখে। সত্যি বলতে সুপার হিরো আছে। তবে তাদের সংখ্যা কম। আর এ অল্প সংখ্যার মধ্যে সেহান একজন যে কী না নিরদ্বিধায় সবটা মনে নিয়েছে। তার ভালোবাসার কাছে সব হেরে গেছে। আমি সেহানকে নম্র সুরে বললাম
– তুই খাওয়ায়ে দে। নাহয় খাব না।
সোহান প্লেটে ভাত মাখতে মাখতে বলল
– হা কর খাইয়ে দিই। আরেকটা সুখবর দিই।
আমি মুখে ভাত নিয়ে চিবুতে চিবুতে বললাম
– কী?
– কালকে নাফিসার সাথে জেলে দেখা করার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের বিয়ের খবরটা ওকে দিব।
– এতকিছুর দরকার কী ছিল?
– তোর কষ্টটা দেখেছে তোর সুখটা যেন দেখে তাই। আমি তোকে আর কষ্ট পেতে দিব না।
আমি খাবার চিবুতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম এ মানুষটা বুঝে আমি কিসে ভালো থাকব। বলার আগেই যেন সব বুঝে ফেলে। আমি সোহানের কাঁধে মাথাটা রেখে বললাম
– আর খাব না।
সোহান হালকা ধমক দিয়ে বলল
– এখনি সব শেষ করবি।
আমি কাঁধ থেকে মাথা তুলে বললাম
– তুই খেয়েছিস।
– তোকে খাইয়ে খাব।
– টুকটুকি কোথায়?
– মায়ের সাথে।
– এখানে নিয়ে আয়।
– আজকে আনতে চাচ্ছি না। আমি অনেক রোমান্টিক সেটা তো তোকে বুঝাতে হবে। টুকটুকিকে এনে সে বুঝানোতে ব্যাগরা দিতে চাই না।
সোহানের কথাটা শুনেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। সোহান ভাতের ধলা মুখে দিতে লাগল আমি খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষে অবশিষ্ট যেটুকু প্লেটে ছিল সেটা সোহান খেয়ে নিল।
তারপর সোহান ঠিক আমার পাশে এসেই শুয়ে আমার মাথাটা তার হাতে রাখল। আমার কানের কাছে এসে বলল
– তুই খুশি তো?
আমি হালকা করে তার কানের কাছে গিয়ে বললাম
– অনেক খুশি।
পরদিন সকালে উঠেই সোহানকে নিয়ে নাফিসাকে দেখতে গেলাম। যাওয়ার পথে কেন জানি না আমার মনে হলো আমি অরন্যকে দেখেছি। তবে মনের ভুল বা মানসিক রোগ থেকেও সেটা হতে পারে। কারণ সারাদিন একই চিন্তা মানসিক ভাবে আহত করে তুলে। আর সে মরে গেছে তাকে দেখার তো প্রশ্নই আসে না।
নাফিসার কাছে যেতেই সে আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো। আমি কিছু বলে উঠার আগেই সে গড় গড় করে কয়েকটা কথা বলল যা শুনে আমি নতুন রহস্যের গন্ধ পেলাম। সে সাথে মনে প্রশ্ন জাগল আদৌ কী অরন্য মরেছে? নাকি পুরোটা একটা ফাঁদ। কারণ নাফিসা বলল
চলবে