#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২৩
আমি বুঝতে পারছিলাম না সোহান কী বলবে। তাই শান্ত গলায় বললাম
– কী বলবি বল।
সোহান মাথাটা নীচু করে বলল
– আংকেল তুই আসার পরেই স্ট্রোক করেছেন। কোন হাসপাতালে আছে জিজ্ঞেস করলাম বলল না। বারবার জানার চেষ্টা করলাম বলল না। তোর ভাই কল দিছিল। ওরা তোর বাবার এ অবস্থার জন্য তোকে দায়ী করছে। কারণ তোর বিষয়টা পত্রিকায় তোর ছবি দিয়ে ছাপা হয়েছে। অনেকে তা দেখে তোর বাবাকে কটুক্তি করে কথা বলেছে। তাই সেটা নিতে না পেরে এ অবস্থা।
সোহানের কথা শুনে মনটা ভেঙ্গে গেল। ভাবতে লাগলাম আমি দোষী না তবুও আমার ছবি ছাপিয়ে সবাইকে জানাতে হলো। আর যারা অপরাধ করল তাদের কেউ চিনল না। এ সমাজ শুধু ভূক্তভেগীদের ভোগান্তিতে ফেলতে ব্যস্ত। সবাই আমাকে দোষ দিচ্ছে তাতে তাদের কোনো হুঁশ নেই। সবাই যেন আমাকে দোষী করতেই ব্যতিব্যস্ত। মানুষ কিছু বুঝুক আর না বুঝুক কথা শুনাতে মহা ব্যস্ত। কাউকে কয়টা কথা শুনিয়ে যেন তারা শান্তি পায়। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। চোখ দিয়ে গড় গড়িয়ে পানি পড়ছে। টুকটুকি আমার চোখের জল মুছে দিতে ব্যস্ত। আমার ফোনটা নিয়ে মামাকে কল দিয়ে বাবা কোন হাসপাতালে জিজ্ঞেস করলাম। মামাও আমাকে দুইটা কথা শুনিয়ে রেখে দিল। ঠিকানা দিল না বাবা কোথায় আছে। কষ্টে যেন আরও বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। যাদেরকে কল দিচ্ছিলাম সবাই কথা শুনাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বড় অন্যায় করে ফেলেছি। অনেক খুঁজ নেওয়ার পরও জানতে পারলাম না বাবা কোন হাসপাতালে। মা,ভাই তো কল ও ধরছে না। বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে। আজকে বাবার কিছু হলে সেটার দায়ভার আমার উপর পড়বে। সবাই বলবে আমি বাবার খুনী। আমার জন্য বাবা মারা গেছে। কেউ বলবে না কিছু মানুষের বিষের মতো জবানের জন্য বাবার মৃত্যু হয়েছে। চোখে যেন আপন গতিতে পানির ধারা বইয়ে চলেছে আর টুকটুকিও চোখের জল মুছতে মহা ব্যস্ত। সোহান পাশে দাঁড়িয়ে আছে তবে কী সান্ত্বনা দিবে সে ভাষা সোহানের নেই। আমার বুকটা ধরফর করছে বাবাকে এক মুহূর্ত দেখার জন্য তবে বাবার খুঁজ মিলল না।
এর মধ্যেই সোহানের মা আসলো। আমাকে সোফায় বসে কাঁদতে দেখে মোটেও চমকাল না। উনার কাছে বিষয়টা অতিস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যদিও জানি না কেন। তবে মনে হচ্ছে সোহান আমার ব্যপারে আন্টিকে সব বলেছে। আন্টি আসার সাথে সাথে টুকটুকি কোল থেকে নেমে গিয়ে আন্টিকে ধরে বলল
– দাদুমনি মা কাঁদছে কেন? মা কে বলো, না কাঁদতে। মায়ের কান্না দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে তো। ও দাদুমনি। মাকে বলো না, কান্না না করতে।
আন্টি এবার টুকটুকির কথা শুনে একটু বিচলিত হলো। ইতোমধ্যে আমি যে টুকটুকির মা হয়ে গেছি সেটা উনি হয়তো বুঝতে পারে নি। সোহান নির্বাক। এ পরিস্থিতিতে সে কী বলবে সেটা সোহানের হয়তো জানা নেই। চুপ হয়ে আছে সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। আন্টি সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল
– কী রে অপ্সরা কাঁদছে কেন? আবার কী কিছু হয়েছে?
সোহান হালকা গলায় বলল
– ওর বাবা অসুস্থ। আর বাকি ব্যাপার তো তুমি জানো।
আন্টি আমার পাশে এসে বসলো। টুকটুকি এবার আমার কোলে বসলো। আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
– মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছ তো সহ্য একটু করতেই হবে। মেয়েরা বিয়ে করলেও দোষ,বিয়ে না করলেও দোষ। শান্তি কোথাও নাইরে মা। শান্তি খুঁজে নিতে হয়। রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আগে কিছু খেয়ে নাও। মারে সামনের পথটা চলতে হবে। ভেঙ্গে গেলে হবে না। ছোট বেলায় তোমাকে দেখেছিলাম। কত সুন্দর ছিলে। আর আজ নিজের যত্ন না নিতে নিতে কেমন হয়ে গেছ দেখেছো কী। যাও ঘরে গিয়ে নিজের যত্ন নাও। নিজেকে আগে সুন্দর করো স্বাভাবিক করো বাকিসব দেখবে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তুমি স্বাবলম্বী মেয়ে তোমার চিন্তা কী এত।
আন্টির কথায় একটু সাহস মিলল। বসা থেকে উঠতেই যেন মাথাটা ঘুরপাক খেল। সোহান হালকা হাতে আমাকে ধরে ফেলল। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে সোহানকে ধরে বললাম কোন রুমে যাব বল। সোহান আমাকে ধরে নিয়েই পাশের রুমে গেল। আমাকে শুইয়ে দিয়ে বলল
– আগে বিশ্রাম কর।
আমি শুইয়ে রইলাম। কোনো উত্তর দিলাম না। সোহান রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফোনটা বেজে উঠল। আবিরের মা কল দিয়েছে। আমি কলটা ধরতেই বললাম
– মা.. মা বলেও কথা ঘুরিয়ে বললাম আন্টি কী বলবেন বলুন।
আবিরের মা বেশ নরম গলায় বলল
– মা ডেকেও কেন পরে আন্টি ডাকলে? পূত্র বধূ করতে পারব না তবে মেয়ের জায়গাটা তো আগেই দিয়ে দিছি। মা রে আমি এসবের কিছুই জানতাম না। জানলে এত নোংরামো আমার ছেলেকে দিয়ে করতে দিতাম না। আমি জানি তোমার সাথে যা হয়েছে অনেক বড় অন্যায় হয়েছে। এর দায় এড়ানো যাবে না। তবে আবিরের চাকুরিতে কোনো সমস্যা করো না। আমার একটা মাত্র ছেলে। ওকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে পারমানেন্ট কোনো স্টেপ যেন না নেয় মা। আমার রোজগারের আর কেউ নেই পরিবারে। আবিরের ইনকাম ছাড়া সংসার অচল হয়ে পড়বে। এরকমটা করো না মা। যা হয়েছে তার জন্য আমি মা হয়ে আবিরের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। তুমি ক্ষমা করে দাও।
আমি চুপ হয়ে শুনে আবিরের মা কে বললাম
– আচ্ছা আমি বিষয়টা ভাববো। ভালো থাকবেন।
আর কিছু বলতে পারলাম না কলটা কেটে দিলাম। মনে হচ্ছে আমি কী সত্যিই বাড়াবাড়ি করছি নাকি ঠিক আছে। পরক্ষণেই মনে হলো তারাও আমার সাথে কম বাড়াবাড়ি করে নি। তাহলে আমি কেন ছেড়ে দিব। ফোনটা আবার বেজে উঠল। কলেজের প্রিন্সিপাল কল করেছে। কলটা ধরে সালাম দিলাম উনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন
– অপ্সরা যেভাবে তোমার বিষয়টা ফোকাস হয়েছে সেটা সত্যিই আমরা আশা করিনি। কলেজের প্রতিটি স্টুডেন্টের উপর এর প্রভাব পড়বে। আপাতত কী বাড়াবাড়ি না করলে হয় না। কলেজের একটা রেপোটেশন আছে সেটা যেন নষ্ট না হয়।
উনার কথাটা শুনে হালকা রাগ জমল। বেশ জোরেসোরেই বললাম
– অন্যরা না হয় অশিক্ষিত বোকা,আপনি তো শিক্ষিত। আমি কেন তাদের ছেড়ে দিব। কলেজের স্টুডেন্টরা আমার থেকে কী শিক্ষা নিবে তাহলে? তারা এ শিক্ষা নিবে কীভাবে অন্যায় করার পরও অন্যায় কারীকে ছেড়ে দিতে হয়? এটা কী আদৌ উচিত হবে তাদের ছেড়ে দেওয়া।
– তুমি বিষয়টা নেতিবাচক করে নিচ্ছ। বিষয়টা তা না। কলেজের বাচ্চাদের উপর এটার প্রভাব পড়বে। সে সাথে অভিভাবকদের উপর। কলেজের সুনামও নষ্ট হবে।
– কলেজের সুনাম কখনও একটা টিচারের ব্যাক্তিগত বিষয়ের উপর নির্ভর করে না। এটা পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত বিষয়। এটার সাথে কলেজের কোনো কিছু জড়িয়ে নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে স্থগিত করব কী না সেটা শুধু আমার ব্যাপার। আমাকেই ভাবতে দিন। কলেজের কোনো ব্যাপার হলে আমি আপনার কথা মেনে নিতাম। তবে আমার ব্যাক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার অনুরোধ রইল।
– আচ্ছা করলাম না। তেমাকে জানানো বা সাবধান করার দরকার ছিল সেটা করলাম। বাকিটা একান্তই তোমার ব্যাপার।
বলেই কলটা কেটে দিল। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম। সবাই যেভাবে আমার পেছনে উঠে পড়ে লেগেছে মনে হচ্ছে অন্যায় আমি করেছি। এ সমাজ তো বদলে দিবে না কাউকে আর এ সমাজ ও বদলানো যাবে না তাই নিজেকে বদলে নিজের স্থান তৈরী করে নিতে হবে।
সাহস জুগাতে লাগলাম মনে। আবির তার শাস্তি পাচ্ছে। নাহয় তার মা কল দিত না। অরন্যের হদিশ নেই। নাফিসাও আর কল দেয়নি৷ নোংরা সম্পর্কের থেকেও মুক্তি পেয়েছি৷ বাবা কোথায় আছে জানি না। বাবার জন্য খরাপ লাগছে। মন থেকে বাবার জন্য দোয়া করে যাচ্ছি। জানি এ খারাপ সময় বেশিদিন থাকবে না তবে খারাপ সময় গুলো বড্ড বাজে তাড়াতাড়ি যেন পার হয় না। টুকাটুকি এসে আমার পাশে বসল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
– মা চোখ বন্ধ করো আমি মাথা টিপে দিচ্ছি। একটু ঘুম দাও তুমি।
বলেই কপালে হালকা চুমু দিল। টুকটুকির শীতল স্পর্শ আমাকে আলিঙ্গন করল। তাকে ধরে জড়িয়ে নিলাম বুকে। বেশ মিশে পড়েছে। জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।
ঘুম থেকে উঠার পর সোহান যা বলল তা শুনে নিজের মধ্যে ঝড় বইতে লাগল।
(চলবে)