#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২২
সোহান আমার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার মনে কোনো ঝড় এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে। চুপ রইল বেশ কিছুক্ষণ। আমি তার নীরবতা দেখে বললাম
– কথা কেন বলছিস না? এত চুপ কেন আছিস? কোনো সমস্যা?
– নাহ! এমনি। তোকে আজকে আমার বাসায় নিয়ে যাব। তারপর বলব কী হয়েছে। এখন কিছুই বলব না। আগে তুই খাবার খা। তারপর বিশ্রাম কর। সন্ধ্যায় আমার বাসায় নিয়ে যাব তারপর রাতে তোর বাসায় তোকে দিয়ে আসব।
– না রে সোহান। সরাসরি বাসায় যাব তারপর পরদিন কোনো এক সময় তোর বাসায় যাব। আপাতত কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি কিছুদিন। সব ঠিক ঠাক হোক আগে।
– তোর ইচ্ছা। আর যেদিন বাসায় যাবি সেদিন নাহয় তোর উত্তরটা দিব। আর এখন একটু বিশ্রাম নে। বিকেলে তোকে বাসায় পৌঁছে দিব।
আমি খাওয়া শেষ করে চোখটা বন্ধ করলাম। কেন জানি না শুধু অরন্যকে চোখে ভাসছিল। এমন কেন হচ্ছে বারবার। মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় বলতে পারছে না। যদিও আমি তাকে ঘৃনা করি প্রবল। তবে এ মূহুর্তে অরন্যকে বারবার মনে পড়ছে। এতকিছুর পর তার প্রতি বিন্দু পরিমাণ ভলোবাসা অবশিষ্ট নেই। যেটা আছে সেটা রাগ,ক্ষোপ আর প্রখর ঘৃনার স্তূপ। চোখটা ভয়ে বন্ধ করেও খুলে ফেললাম। সোহান আমাকে বারবার চোখ খুলতে বন্ধ করতে দেখে বলল
– অপ্সরা এনিথিং রং?
– নাথিং সোহান। তবে অস্বস্তি হচ্ছে। মাথাটা ভার হয়ে আছে নাহয় বাসায় চলে যেতাম এখনি। এত খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ব পুনরায় বুঝতে পারে নি।
– একটু বিশ্রাম নে। শরীরটা ভালো লাগলেই বাসায় দিয়ে আসব। এত চিন্তা করিস না। পরিস্থিতি সবসময় অনুকূলে থাকবে না। একটু তো প্রতিকূলতা আসবেই।
আমি হালকা হালকা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। চুপ হয়ে শুয়ে রইলাম। অবচেতন মন শুধু বারবার অতীতে ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় মানুষকে কতটা বদলে দেয় সেটা নিজেকে দেখেই বুঝতে পারতেছি। একটা সময় অরন্যকে পাগলের মতো চাইতাম। তাকে পাওয়ার জন্য জীবনে কত কিছুই না করেছিলাম৷ আর আজকে অরন্যের থেকে নিজেকে ছাড়াতে এত কিছু করছি। আচ্ছা আমি কী অরন্যকে ফিরিয়ে দিতে পারতাম যদি সে বিনয় নিয়ে আমার সামনে আসত। হয়তো পারতাম না। কিন্তু মিথ্যা নাটকের বেড়াজালে আটকে দিয়ে আমাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছে তারপর তাকে মেনে নিতে পারছি না। সম্পর্ক ভাঙ্গে সে সম্পর্ক আবার গড়ে। অরন্য তিনটা বছর আমাকে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছে সেটা আমি জানি। তবে তারপর সে আমাকে যেভাবে চেয়েছে তাতে আমার মন বিগড়ে গেছে।
মাথাটা টনটন করে ব্যথা করছে। শরীরের ক্লান্তি ক্রমশ বাড়ছে ক্রমশ কমছে। কেমন যেন ছটফট করছে সারা শরীর। আমি হালকা তাকালাম। সোহান নিজের হাতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ক্লান্ত চেহারা সে সাথে মলিনতার ছাপ। এ হাসপাতালে থাকতেও ভালো লাগছে না। তাই সোহানকে বললাম
– আমাকে বাসায় নিয়ে দিয়ে আয়। ভালো লাগছে না এখানে থাকতে। ডাক্তারের সাথে একটু কথা বল। বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
সোহান আমার কথা শুনে উঠে গিয়ে বাইরে গেল ডাক্তারের সাথে কথা বলতে। আমি শুয়ে শুয়ে অতীতেই বারবার ডুব দিচ্ছিলাম। জীবনের অধ্যায় গুলো বরাবরেই ছন্নছাড়া। কখনও কষ্ট কখনও মলিনতা আবার কখনও সুখে পরিতৃপ্ত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহান চলে আসলো। আমার হাতটা ধরে বলল
– আমাকে ভর দিয়ে উঠ। উঠতে পারবি তো নাকি একটু বিশ্রাম করবি,নাকি হুইল চেয়ার আনব?
আমি সোহানের হাতটা শক্ত করে ধরে উঠে বললাম
– উঠতে পারব। সমস্যা নেই।
সোহান কে ধরে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়ি দিয়ে বাসায় এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা নক করলাম। আমার কন্ঠ শুনতেই বাবা বললেন
– এতক্ষণ যেখানে ছিলে সেখানে যাও। এ বাসায় তোমার কোনো জায়গা নেই। আমাদের মেয়ে মরে গেছে। যে মেয়ে আমাদের কথা শুনবে না তাকে আমাদের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিতে ঘৃনা হয়। এ ঘরে তোমার কোনো জায়গা নেই।
বাবার কথা শুনে সোহান বাবাকে বুঝাতে লাগল। তবে বাবার একটা কথায় আমি যেন বাসায় ঢুকতে না পারি। আমি তাদের মেয়ে না। সোহান বেশ কতক্ষণ বুঝিয়ে আমাকে বলল
– এভাবে তো তোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। তুই আপাতত আমার বাসায় চল তারপর আংকেল আন্টিকে বুঝিয়ে যা ব্যবস্থা করার করব।
আমি আর কী করব। সোহানের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কোনো দোষ না করেও আজকে নিজের বাসায় উঠতে পারলাম না। নিজের পরিবারের কাছে মৃত হয়ে গেলাম। হায়রে জীবন। এত ভয়ানক না হলেও পারত। এত ভয়ানক কেন জীবনটা?
সোহানকে নিয়ে তাদের বাসায় গেলাম। বাসায় ঢুকতেই একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে সোহানকে দৌড়ে এসে বাবা, বাবা বলতে লাগল। আমি বেশ বিস্মিত হলাম। সোহান তো বিয়ে করে নি বলেছিল তাহলে এ বাচ্চা কার? বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম
– বাচ্চা টা কী তোর? আর তুই তো বলেছিলি তুই বিয়ে করিস নি। তাহলে বাচ্চা এলো কোথায় থেকে?
সোহান বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দুগালে চুমু দিয়ে বলল
– এর জন্যই আমি এতদিন বিয়ে করে নি। বাচ্চাটা আমার না আমার বড় ভাইয়ের। ওর মা ওর যখন এক বছর ছিল তখন ছেড়ে চলে যায় অন্য একজনের হাত ধরে। এরপর থেকে ভাইয়া পাগল হয়ে গেছে। পাঁচ বছর সম্পর্কের পর বিয়ে। ভালোবাসার পূর্ণতা পেয়ে যখন হারিয়ে ফেলে সেটা আর মেনে নিতে পারে নি। ভাইয়া পাগলা গারদে আছে। ভাইয়ার ঘটনার পর থেকে কেন জানি না কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারিনি৷ বারবার মনে হয়েছে মেয়েরায় পারে একটা সাজানো স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে। এর পর থেকে টুকটুকি কে নিজের সন্তানের মতো দেখে এসেছি। নিজের চেয়েও বেশি ওকে ভালোবাসি৷ তোর যেমন ছেলেদের নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতা ঠিক তেমনি আমার মেয়েদের নিয়ে। তোর কাছে একটা ছেলে মানেই অনেক খারাপ আর আমার কাছে একটা মেয়ে মানেই অনেক স্বার্থপর। দুজনের ঘটনা ভিন্ন তবে মূলপাঠ এক।
এর মধ্যেই টুকটুকি বলে উঠল
– বাবা উনি কে? উনি কি আমার মা? প্রতিদিন তোমাকে মা এনে দিতে বলি আজকে তো সত্যি সত্যিই নিয়ে এসেছো। আমি মায়ের কোলে যাব।
টুকটুকির কথা শুনে সোহান জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল
– আরে মামনি কী বলছো। উনি তোমার…
বাকি কথা সোহানকে বলতে না দিয়ে আমি সোহানের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম
– আমিই তোমার মা আসো আমার কোলে।
সোহান আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি সোফায় বসে সোহানকে বললাম টুকটুকিকে কোলে দিতে। শরীরটা এত ভালো না তবুও টুকটুকিকে কোলে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি টুকটুকিকে কোলে নিয়ে বললাম
– টুকটুকির বয়স কত?
– পাঁচ বছর।
আমি টকটুকিকে জড়িয়ে ধরে রইলাম। মনে হচ্ছিল নিজের সন্তান এটা। আমার সন্তানটা পৃথিবীতে আসলে হয়তো টুকটুকির মতোই কথা বলত। টুকটুকিকে কোলে নিয়ে একটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই সোহানের ফোনে কল আসলো। সোহান কলটা ধরতেই কেমন জানি আনমনা হয়ে গেল। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল।
– তুই একটু স্থির হয়ে বস। একটা কথা আছে। নিজেকে আগে সামলে নে।
আমি বুঝতে পারছিলাম না সোহান কী বলবে। তাই শান্ত গলায় বললাম
– কী বলবি বল।
(চলবে)