প্রাক্তন পর্ব-২১

0
1150

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২১

তারপর থানায় গেলাম। থানায় যাওয়ার পর শুরু হলো নতুন নাটক। আমি চেয়ারে বসে মামলাটার কথা জিজ্ঞেস করতেই সামনের চেয়ারে বসা পুলিশ মহাশয় আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলল

– স্বামীর সাথে শারিরীক সম্পর্ক হলে ধর্ষণ হয় কোন যুক্তিতে?

আমি কিছুটা রাগান্বিত হয়ে উত্তর দিলাম

– মানে?

পুলিশ মাহাশয় একটা চোখের ভ্রূ উঁচু করে তাকিয়ে বললেন

– অরন্য সাহেব তো আপনার স্বামী হয়। চার বছর আগে বিয়ে করেছিলেন। আবির সাহেব আপনাদের বিয়ের কাগজ আমার কাছে দিয়েছে। এখন কথা হচ্ছে অরন্য আপনার স্বামী হলে সে তো আপনার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতেই পারে তাতে তো কোনো দোষ দেখছি না। স্বামী, স্ত্রীর সহিত মিলিত হলে সেটা তো ধর্ষণ হবে না। ধষর্ণের মামলা কেন করলেন। এক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের মামলা গ্রহণ যোগ্যতা পাবে তবে ধর্ষণের না। আজকাল মনে হয় মেয়েরা বেশি মর্ডান সাজতে গিয়ে স্বামীর সাথে মিলন বিষয়টাকে ধর্ষণ বলে উঠে।

আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম

– না জেনে এত কথা কেন বলছেন? আমার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার সাথে মিলিত হলে সেটা ধর্ষণের সামিলেই। স্বামী স্ত্রী এর সম্পর্ক হয় মধুর। আর আমাদের সম্পর্ক ছিল বিষাক্ত। আর যাকে এত সাপোর্ট দিয়ে কথা বলেছেন সে কী করেছে জানেন? বিয়ে করে বিয়ের প্রমাণ লোপাট করে অন্যত্র বিয়ে করেছিল। সেখানে যখন শান্তি মিলছিল না তখন আমার কাছে এসেছিল ফিরে। আমাকে যখন পাচ্ছিল না তখন জোর করে ধরে নিয়ে আমার সাথে অন্যায় ভাবে এ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাহলে সেটাকে আমি ধর্ষণ কেন বলব না? যাকে আমি স্বামী মানিই না সে তো আমার সাথে মিলিত হলে বিষয়টা নিশ্চয় আমার জন্য সুখকর হবে না। তাই ধর্ষণের মামলা করেছি। আর বাকি রইল বিয়ের ব্যপার। আজ থেকে এ সম্পর্ক থেকে আমি মুক্ত। ডিভোর্স দিয়ে এসেছি। এখন থেকে অরন্য আমার স্বামী না। সুতরাং আমার জায়গায় আমি ঠিক আছি।

– আপনি মনে হয় নিজেকে খুব বেশি স্মার্ট মনে করেন। শুনেন ডিভোর্স আজকে দিলেও যেদিন আপনার সাথে এমন হয়েছিল সেদিন অরন্য আপনার স্বামাী ছিল। আপনাদের মতো কিছু মহিলাদের জন্য ছেলেরা বিগরে যায় তখন ছলেরা অন্য জায়গায় সুখ খুঁজে। আপনাকে দেখে মনে হয় আপনার চরিত্রে যথেষ্ট গড়বড় আছে। পাশে এ ছেলেটা কে শুনি? তার জন্যই কী স্বামীর নামে এমন মামলা করেছেন।

কথাটা শুনে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। কেন জানি না বেশ জোরসোরেই চেঁচিয়ে উঠে বললাম

– আপনার সাহস কী করে হয় এমন কথা বলার। প্রতিটা কথা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। একটা মেয়ের মামলা নেওয়ার নামে কীভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে সেটা আমি তুলে ধরব। আপানাকে মামলা নিতে হবে না। মামলা অন্য জায়গায় গিয়ে করব। দরকার হলে নিজের জীবন দিয়ে লড়ব তবুও হারব না। আর শুনেন নিজের ঘরে মেয়ে থাকলে তার কথা চিন্তা কইরেন একটু। ভেবে দেইখেন তার সাথে এমন হলে আপনি কী করতেন। আমার যতদূর মনে হচ্ছে আপনাকে মোটা অংকের টাকা খাওয়ানো হয়েছে। তবে চিন্তা নেই আপনি আপনার গতিতে চলুন আমি আমার গতিতে চলব। এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব।

বলেই টেবিল থেকে সকল কাগজ গুলো টেনে নিয়ে সোহানকে নিয়ে বের হলাম। সোহান শুধু আমার দিকে বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল৷ থানা থেকে বের হতেই সোহান বলে উঠল

– আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুই এত স্ট্রং হয়ে গেছিস। যে মেয়ে কথা বলতে পারত না সহজে।।অল্পতে ভয় পেয়ে যেত। সে কী না পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে এত কথা বলে আসলো। আর তুই কথাগুলো রেকর্ড করে রেখেছিস। বাহ এত ভলো বুদ্ধি তোর মাথায় আসলো কী করে? মানুষ তো বিপদে পড়লে বিবেক দিয়ে কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে আর তুই তো পুরো কাজটা সুন্দর করে গুছিয়ে করছিস।

আমি হালকা দম ছেড়ে বললাম

– পরিস্থিতি মানুষকে অনেক শেখায়। প্রতিটা পদে পদে বাঁধা পেয়েছি। আর শিখেছি। এখন কী করব বুঝতে পারছি না। ঐ পুলিশ অফিসারটা মনে হয় ঘুষ খেয়ে টাল হয়ে আছে তাই এসব আবোল তাবোল বলে ধামা চাপা দিতে চাচ্ছে সব।

সোহান নিজের চিবুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল

– আমার একটা বন্ধু পুলিশ ক্যাডার। ঢাকাতেই পোস্টিং হয়েছে। চল একবার তার কাছে যাওয়া যাক। পরামর্শ তো নিতে পারব। আর এ পুলিশের বিরুদ্ধে ও স্টেপ নিতে পারব।

শত রুক্ষতার মধ্যেও যেন একটু শীতলতা পেলাম। আমি সাবলীল সজীব নিঃশ্বাস টেনে পরক্ষণে তা ছেড়ে দিয়ে বললাম

– চল যাওয়া যাক।

গাড়িতে উঠলাম। সোহান গাড়ি চালাতে লাগল। আর আমি ভাবতে লাগলাম আজকে সোহানের মতো কেউ পাশে আছে বলে সংগ্রামটা সহজ মনে হচ্ছে। আজকে আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি বলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি। অথচ সেসব মেয়েদের অবস্থা চিন্তা করছি যারা কোনো চাকুরি করে না। যাদের কোনো বড় পুলিশ অফিসারদের সাথে পরিচয় নেই। যাদের দুনিয়ায় টাকাও নেই বড় কোনো হাত ও নেই। তাদের সংগ্রামটা কত কঠিন। ভাবতেই গা টা শিউরে উঠল। মনে মনে কয়েকবার আলহামদুলিল্লাহ বললাম। অন্তত আমার দশা তাদের থেকেও তো ভালো। সেসব মেয়েরা না পারে লড়াই করতে না পারে নিজের কথা কাউকে বলতে। এভাবে না বলতে বলতেই মেয়েগুলো একটা সময় পাথর হয়ে যায় আর না হয় দম বন্ধ করে বিলীন হয়ে যায়। কাফনের কাপড়কে আপন করে নেয়। মাটির সজীবতায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়। সত্যিই তাদের জীবন বড্ড কঠিন। তাদের কথা ভেবে যেন একটু প্রশান্ত পাচ্ছিলাম। ছোট বেলায় একটা বান্ধবী ছিল নাম মিলি। তখন আমি নবম শ্রেণীতে পড়তাম। সে সবসময় বলত দুনিয়া দেখলে সবসময় নীচের দিকে দেখতে হয়। মানে কে কত কষ্টে আছে সেটা আবিষ্কার করতে হয় তাহলে নিজেকে সুখী মনে হবে। কিন্তু অন্যের সুখ আবিষ্কার করলে কষ্ট ছাড়া কিছুই মিলবে না। আজকে তার বাস্তব উদাহরণ গুলো পাচ্ছি। মিলিকে প্রচন্ড রকম মিস করছি। মনে হচ্ছে ওর দেখা যদি পেতাম। কিন্তু সেটা আর সম্ভব না। কারা যেন মিলিকে হত্যা করেছে। কলেজে উঠার সাথে সাথে আমার কাছের বান্ধবীটাকে আমি হারিয়ে ফেলি। মিলিকে কারা হত্যা করেছে জানি না। তবে খুব ইচ্ছা হয় মিলির হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করতে কেন এমন করেছে সে উপায় আর নেই। মিলির আবছা মুখটা চোখে ভাসছে। হালকা হাসির রেখা যেন তার মুখে সবসময় ফুটে উঠত। না জানি মেয়েটা পরকালে কেমন আছে। দোআ করি সে যেন অনেক ভালো থাকে। আর তার জীবনের সমস্ত কষ্টগুলো যেন সেখানে সুখে পরিণত হয়। গাড়ির সিটে হেলান দিতেই যেন চোখটা লেগে আসলো। সারা রাতের ঘুম যেন এখন চোখে ঝেঁকে বসলো। চোখটা মেলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। খানিকক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠতেই লক্ষ্য করলাম আমি হাসপাতালে শুয়ে আছি। নিজেকে হাসপাতালে দেখে অবাক হলাম। সোহান আমার পাশে বসে আছে। আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– হাসপাতালে আসলাম কখন? আমার কী হয়েছিল?

সোহানের ক্লান্ত মুখটা বলে উঠল

– জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে।প্রেসার একদম কমে গেছিল। এতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল তোর। তিন ঘন্টা হয়ে গেছে। যাইহোক স্যালাইন চলছে সবকিছু স্বাভাবিক। ডাক্তার বলল ঘুম থেকে উঠলে যেন কিছু খেতে দিই। ফুড পান্ডায় খাবার অর্ডার করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে গরম স্যুপ চলে আসবে। এসময় তো খাওয়া দাওয়া একটু বেশি করবি। সারাদিন এত চাপ নিলে শরীর তো চলবে না। মনের জোরের সাথে তো শরীরের জোরও দরকার।

আমি বুঝতেই পারি নি যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। শরীরটা যদিও অসাড় লাগছিল। তবে বুঝতে পারি নি। আমি সোহানকে মৃদু গলায় বললাম

– বাবা, মা কে কী বলেছিস? তারা কী আসবে?

সোহান চুপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– এখন এসব চিন্তা করতে হবে না। একটু বিশ্রাম কর।

– বাবা, মা কী কিছু বলেছে? লুকাস না। আমাকে বল।

– তারা তো তোর উপর একটু রেগে আছে জানিসেই। কল দিছিলাম। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তোর কোনো ব্যপারে তারা আর নেই। যদিও এটা অভিমান থেকে বলেছে। সময় মতো অভিমান কেটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। এসব নিয়ে ভাবিস না।

সোহানের কথা শুনে কেন জানি না বুকটা মোচড় দিতে লাগল। শুধু ভাবছিলাম আমি কী এমন করেছি যে বাবা মা আমাকে এভাবে ভুল বুঝলো। তাদের কত ভালোবাসি আমি। যা কিছু করছি সবকিছু একেবারে শেষ করার জন্যই। তাহলে কেন সবাই ভুল বুঝে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মাথাটা ভার লাগছে। চোখটা বন্ধ করে রাখলাম। সোহান উঠে যেন কোথায় গেল। মিনেট পাঁচেকের মধ্যে আবার ফিরেও আসলো হাতে একটা স্যুপের বাটি নিয়ে৷ আমার পাশে বসে স্যুপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল

– চিন্তা রেখে হা কর। নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখ। আর আমার বন্ধুর সাথে কথা হয়েছে। সে বলেছে সব ব্যবস্থা করবে। যতটুকু সাহায্য লাগে করবে। আর ঐ অফিসারের বিরুদ্ধে ও স্টেপ নিবে৷ এখন একটু খেয়ে নে। আস্তে আস্তে একটু একটু করে আমরা শান্তির দিকে যাচ্ছি। একদিন ঠিকই কাঙ্ক্ষিত শান্তির দেখা মিলবে। কী রে কথা শুনেই যাচ্ছিস। হা কেন করছিস না। হা কর।

আমি সোহানের কথায় যেন সম্ভিত ফিরে পেলাম। হা করে মুখে স্যুপ টা নিয়ে গিলতে লাগলাম। এর মধ্যেই সোহান বলে উঠল

– মনে আছে অপ্সরা কলেজে পড়ার সময় যখন তুই পরীক্ষায় লিখতে পারতি না আমি তোকে লিখে দিতাম। কী জ্বালানোই টা ‘না, তুই জ্বালিয়েছিস। নিজে তো কিছু পড়তিই না তবুও খবরদারি করতি। না দেখালেই পরীক্ষা হল থেকে বের হয়ে আমার চুল টেনে ধরতি। তোর জন্য কলেজের ফাস্ট বয় হয়েও কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে৷ বাবারে কি ডেন্জারাস ছিলি। আর কারও সাথে তো এমন করতি না। আমাকে বোকা পেয়ে আমার সাথেই এমন করতি।

সোহানের কথা গুলো শুনছিলাম। তবে চোখে যেন সে স্মৃতিগুলো সব ভাসছিল। মধুময় স্মৃতি গুলো আজ বড্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে বের হয়। হালকা হেসে বললাম

– সে জীবনটায় অনেক ভালো ছিল।কোনো দায়িত্ব ছিল না। যতই বড় হচ্ছি ততই যেন সব ঘিরে ধরেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যেন বড় দায়।

– ভাবিস না জীবনটা আবার নতুন করে গড়ে উঠবে।

– আচ্ছা তুই এখনও বিয়ে কেন করিস নি? কাউকে কী পছন্দ করিস?

সোহান আমার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার মনে কোনো ঝড় এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে