প্রাক্তন পর্ব-১৮

0
1099

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৮

যে এসেছে তাকে দেখে ভাবতে লাগলাম নতুন নাটকের সূচনা হবে নাকি আবার? কারণ আবিরের বর্তমান জি এফ সাহেরা এবং অরন্যের স্ত্রী নাফিসা এসেছে। দুজনকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলাম। তবে বিস্ময়টা মুখ অবয়বে আনলাম না। খানিকটা নিজেকে শান্ত করে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম

– আপনারা আমার বাসায় কী জন্য?

নাফিসা প্রশ্নের জবাবে বলল

– অরন্য কোথায়?

প্রশ্নটা শুনেই আমার রাগটা বেড়ে গেল। বেশ কটু গলায় বললাম

– অরন্য কোথায় আপনি খুঁজে বের করুন। আমার কাছে বলতে কেন এসেছেন? আর আবার নতুন নাটক করতে চলে এসেছেন। এর আগে অরন্য না হারিয়েও হারিয়ে যাওয়ার নাটক করেছে এখন আপনি শুরু করেছেন সে একই নাটক।

– শুনো মেয়ে আমি তোমাকে যা বলছি তার উত্তর দাও। দেশে এসেছি গতকাল। অরন্যকে কোথাও পাচ্ছি না। অরন্য কোথায় বলো। অরন্যকে না পেলে ভালো হবে না কিন্তু।

– দয়াকরে এসব নাটক বন্ধ করুন। আর আমার কাছে অরন্যকে না খুঁজে থানায় যান প্লিজ।
অরন্য আর আবিরের নামে জিডি করে এসেছি। আপনাদের নামেও এসব ঝামেলা করলে একই কাজ করতে বাধ্য হব। আপনারা দয়াকরে এসব নিয়ে আমাকে কিছু বলতে আসবেন না।

পাশ থেকে সাহেরা বলে উঠল

– তোমার জন্য আমার সম্পর্কে ভাঙ্গণ ধরেছে। তোমাকে আমি ছাড়ব না। অরন্য ভইয়ার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তোমাকে দায়ী করে মামলা করব। যে অশান্তি আর ঝামেলা লাগাইছো সেটার শেষ করব।

সাহেরার কথা শুনে আমি একটু হেসে বললাম

– যে মেয়ে নিজের প্রেমিককে অন্যায় কাজে সাহায্য করার অনুমতি দেয় তার কাছ থেকে এমন কথা আশা করায় যায়। দোষটা আবিরের সাথে আপনারও। আপনি একই দোষে দোষী। একটা মেয়ের জীবন নিয়ে আবির আর অরন্য খেলেছে আর আপনি জানার পরও সায় দিয়েছেন। সেখানে সমান অপরাধে আপনিও অপরাধী। আর আপনাদের মামলা করার স্বাধীনতা আছে করতে পারেন। আমিও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার ক্ষমতা আছে সেটা আমি করব৷ আপনারা আপনাদের গতিতে এগিয়ে যান। আমি নাহয় আমার গতিত এগিয়ে যাই। এবার আসতে পারেন। আর চা কফি খেলে বসুন ব্যবস্থা করছি। যদিও বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এখন বের হওয়াটা ঠিক হবে না। বসুন আমি চা কফি আনার ব্যবস্থা করছি। যতই হোক প্রথম এসেছেন। এ বাসার অতিথি আপনারা। কিছু খেয়ে যান।

আমার কথা শুনে দুজনেই ফুসিয়ে উঠল। প্রতিত্তোর না দিয়েই মূল দরজাটা বেশ জোরে সোরেই খোলে বের হয়ে গেল। আমি চুল গুলো হাত দিয়ে আঁচরাতে আঁচরাতে নিজের রুমে এসে বসলাম। মা আমার কাছে এসে বলল

– করা ছিল ওরা। আর ঐভাবেই কেন কথা বললি?

আমি মৃদু গলায় উত্তর দিলাম

– আবির যে মেয়েকে পছন্দ করে সে মেয়ে আর অরন্যের স্ত্রী।

মা কিছুটা বিস্মিত গলায় বলল

– আবিরের পছন্দ থাকলে তুই কী ছিলি আবিরের? আর অরন্যের স্ত্রী কেন তোর কাছে এসেছে? অপ্সরা সবটা খুলে বল আমাকে।

আমি মায়ের মুখে অশান্তির ছাপ লক্ষ্য করলাম। মাকে হালকা করে ধরে বসিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমস্ত বললাম। মায়ের চোখ টলমল করছে। মাকে দেখতে খুব অসহায় লাগছে। মা আমাকে ধরে বলল

– তোর যে এত সহ্য শক্তি জানতাম না। শুধু জানতাম আমার মেয়েটা অনেক রাগী। কিন্তু আমার মেয়ের যে এত সহ্য শক্তি জানতাম না। মানুষ যা ইচ্ছা বলুক তুই তাতে কান দিস না। তোর মতো করে তুই লড়াই করে যা। তোর বাবার হার্টের সমস্যা আস্তে আস্তে আমি সবটা খুলে বলব। তুই চিন্তা করিস না। কোনো দরকার লাগলে মাকে বলবি। নিজের মধ্যে এভাবে জমিয়ে রাখলে যে আরও কষ্ট পাবি। আমাকে বললে তোর হালকা লাগবে। যা এবার খয়ে নে কিছু।

আমি মায়ের কথায় যেন স্বস্তি পেলাম। এতদিন কাউকে বলতে পারতাম না। আজকে যেন বলার মতো সঙ্গী পেলাম। ভরসার একটা জায়গা পেলাম। ভালোবাসার একটা হাত পেলাম।।যে হাতে কোনো প্রতারণা নেই বরং পুরোটা হাতেই ভালোবাসায় মুড়ানো।

মা চোখের জল মুছতে মুছতে বসা থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে গেল। আমি আমার ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার ফোন ভাইব্রেট করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। আমি কলটা ধরলাম। ওপাশ থেকে সোহানের কন্ঠ ভেসে আসল। কন্ঠটা শুনে বললাম

– কেন কল দিয়েছিস। আজকে দেখার পর থেকেই কেমন জানি করছিস।তোর কাজে আমি রিতীমতো বিরক্ত হচ্ছি সেটা বুঝতে পারছিস না?

– অপ্সরা আমি তো তোকে প্রেম নিবেদন করছি না।তোর ভালো বন্ধু আমি ছিলাম। হঠাৎ করে তুই যোগাযোগ বন্ধ করলি। আজকে হঠাৎ তোকে দেখে সে বন্ধুত্বটা জেগে উঠেছে। তোর বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা কী আমার নেই। আর তুই এত রেগে কেন যাচ্ছিস। তোকে কল দিতে বড্ড ভয় লাগে। এজন্যই এত বছর কল দেই নি। আজকে কেন জানি না মনে হলো তুই অনেকটা শান্ত হয়ে গেছিস তাই কল দেওয়ার সাহস পেলাম । আমাদের বন্ধুত্বটা তো ঠিক করে নিতে পারি।

সোহানের কথায় আর দ্বিমত করতে পারলাম না। হালকা করে বললাম

– ঠিক করে নেওয়ার তো কিছু নেই। বন্ধু ছিলাম আছি। তবে এর বাইরে কিছু না।

-আরে এর বাইরে কী হবে। এবার বল তুই কেমন আছিস?

– অনেক ভালো।

– আচ্ছা আমি একটা বিষয়ে দ্বিধায় আছি। তোর কথার মানে আমি বুঝি নি। একটু কী বলবি?

– এসব বিষয় বলতে চাচ্ছি না। আর এসব বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস ও করবি না।

– করলাম না।

– বিয়ে করিস নি?

– এখনও সুযোগ হয়ে উঠে নি।

– ভালো। রাখলাম। পরে কথা হবে।

– কালকে কী তুই ফ্রী আছিস?

– কেন?

– এক কাপ কফি খেতাম। তুই তো কফি অনেক পছন্দ করিস। বিশেষ করে কোল্ড কফি। একবার মনে আছে তোর কফিতে এক চুমুক দিয়েছিলাম তাই রাগে আমার কফিতে থুথু দিয়ে আমার মাথায় ঢেলে দিয়েছিলি। তোর কত রাগ ছিল। এখনও কী তেমনেই আছিস নাকি একটু রাগ, জেদ কমেছে।

– তোর কথা হয়েছে?

– হ্যাঁ অনেক আগেই।

– তাহলে কলটা রাখ। আর তোর কফি তুই খা।

বলেই কলটা কেটে হালকা হাসলাম। সে পুরনো দিনগুলো বেশ রঙ্গিন ছিল। সোহান ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। আমার যত অকর্ম আছে সব কাজে সে সহয়তা করত। স্কুল পালানো। ক্লাস ফাঁকি দেওয়া। আর কোনো ভাবে যদি ও সাহায্য না করত তাহলে সকল রাগ ওর উপর ঝেড়ে দিতাম। সে সময়গুলো সত্যিই অনেক রঙিন আর ঝলমলে ছিল। পুনরায় স্কুল আর কলেজের জীবনে যেতে পারলে অনেক ভালো হতো। যত বড় হয়েছি ততই জটিলতা যেন আকঁড়ে ধরল।

আবারও গর্জন দিয়ে বৃষ্টি নামছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। অরন্য কী সত্যি নিখোঁজ হলো নাকি আবার কোনো নাটক। ইদানীং যা হচ্ছে সব কিছুতেই একটা রহস্য লুকিয়ে থাকে।

পরদিন সকালে গেলাম কলেজে। ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরলাম বিকেলে। বিকেলে বাসায় ফিরতেই পুলিশের মুখোমুখি হলাম। কারণ নাফিসা মামলা করেছে। অরন্যকে পাওয়া যাচ্ছে না তাই আমাকে দায়ী করে মামলা করেছে সে। আমাকে জিজ্ঞাসা বাদ করল। আমি পুরো বিষয় খুলে বললাম। উনারা মামলাটা তদন্ত করবে বলে জানিয়ে গেল। সে সাথে জোরালো প্রমাণ না থাকায় তারা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারলো না। বাসায় সবাই বিষয়টা জানলো। এলাকায় ও জানাজানি হলো হালকা। আমাকে ধরে নিতে পুলিশ এসেছিল কথাগুলো যেন হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়ল। বিব্রতকর একটা পরিস্থতির সম্মুখীন হলাম।

তবে পরিবারের যথেষ্ট সাপোর্ট পাচ্ছি এটাই বড় বিষয়। কে কী বলল সেটা গায়ে লাগানোর প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্তু অরন্য কোথায়। অরন্য কী কোথাও ইচ্ছা করে লুকিয়ে পড়েছে নাকি গায়েব হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না। চিন্তা যেন গ্রাস করছে আমাকে। সারাদিনের ব্যস্ততা সে সাথে এসব চিন্তা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। বাসার সবাই নিস্তব। তাদের মুখেও চিন্তার ছাপ। আমি ঘরে বসে আছি। এ জীবন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছি। যতই বিষয়টা সহজ করার চেষ্টা করছি ততই জটিল হয়ে যাচ্ছিল।

রাতটা কোনোরকম কাটিয়ে দিলাম।।সোহান দু বার কল দিয়েছিল। ইচ্ছা করেই ধরে নি। সকাল সকাল উঠে বাইরে হাঁটতে গেলাম। সকালে হাঁটলে মন মানসিকতা শান্ত হয়।

রাস্তাটা বেশ শান্ত। দু একটা টঙের দোকান খোলেছে সবে। হালকা বাতাস আসছে। এ বাতাসে হাঁটতে বেশ ভলো লাগছে। একাকীত্ব টাকে বেশ উপভোগ করছিলাম। এর মধ্যেই মনে হলো কেউ একজন মুখ চেপে ধরল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম অরন্য। আমার গা হাত পা কাঁপতে লাগল। আমি কিছুটা জোর খাটিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিলাম। তবে বলতে পারছিলাম না। হাতে আর মুখে এমন ভাবে ধরেছে যে নড়তে পারছিলাম না। পুরো রাস্তাটা ফাঁকা। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে এত নীরব রাস্তায় চলে এসেছি খেয়াল নেই। আর এ শহরে জোরে চিৎকার দিলেও কেউ সহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। এমন সময়..

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে