#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৭
সারাদিন আর রাত এসব ভাবনাতেই কেটে গেল। পরদিন সকালটা শুরু করলাম নতুন ঘটনার সূত্রপাত দিয়ে।
সকালে উঠেই আমি নিজেকে সামলে নিলাম। আকাশটা হালকা মেঘাচ্ছন্ন। কখনও মেঘ কখনও রুদ্দুরের খেলা করছে। কখনও বা অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে পরক্ষণে ধমকা বাতাস দিয়ে সবকিছু আলোকিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার মনের ভেতেরের খেলাটায় বাহিরে হচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি আরেকবার মনে হচ্ছে আশার আলো খুঁজে পাচ্ছি।
জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। এমন সময় মা আসলো। এসেই আমার দিকে এগিয়ে বলল
– জানালা দিয়ে বাতাস আর এত ধূলো আসছে তুই জানালা খুলে রেখেছিস কেন? কী রে অপ্সরা তোর হয়েছে টা কী?
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। চোখে জল তখন টলমল করছিল। এই বুঝি জলটা গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। বুঝতে পারছি না কী করব। মাকে হুট করে জড়িয়ে ধরলাম। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মা আমাকে টেনে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
– কী রে… হয়েছে কী তোর? এ কয়েকদিন যাবত তোকে বেশ আনমনা লাগছে। কী হয়েছে বল তো।
আমি হালকা গলায় বললাম
– মা কখনও যদি তোমার মেয়ে তার ভালোর জন্য কোনো স্টেপ নেয় তুমি কী কষ্ট পাবে?
– তোর ভালো হবে এটা তে কষ্ট পাওয়ায় কিছু নেই। তোর কী হয়েছে বলবি?
– এখন বলতে পারছি না। কিছু কাজ বাকি। কাজগুলো করেই বলব।
– আবিরের সাথে কিছু হয়েছে?
মায়ের মুখে কথাটা শুনে হুহু করে কেঁদে উঠলাম। মা আমাকে ধরে বলল
– কী হয়েছে তোর? বল কিছু একটা।
আমি চোখটা মুছতে মুছতে বললাম
– কারও সাথে কিছু হয় নি। তবে মা আবিরের সাথে আমার বিয়েটা হচ্ছে না।
মা আমার দিকে তাকিয়ে আরও আড়ষ্ট হয়ে বলল
– এ বিয়ে ভাঙলে মানুষ কী বলবে মা। তুই হুজুগের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নিস না।
– মা তোমার মেয়ের প্রতি তোমার কোনো ভরসা নেই? তোমার মনে হচ্ছে আমি হুজুগে এমন করছি? মা গো তুমি কী মানুষের কথা নিয়েই পড়ে থাকবে নাকি মেয়ের ভেতরে বয়ে যাওয়া কষ্টের নদীর গভীরতাটা পরিমাপ করবে। একটা বিয়ে ভাঙ্গার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। তোমাকে আমি কিছুই এখন বলব না। তবে চাই তোমরা পাশে থাকো। এমন হইয়ো না যেখানে বিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে আমাকেই হারিয়ে ফেললে।
– দেখ এ চার বছর তোকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছি। বিয়ে করতে চেয়েছিস আবিরকে আমরা রাজি হয়েছি। সবাই জানে তোর এনগেজমেন্ট হয়েছে এখন বিয়ে ভাঙলে প্রতিটা মানুষ তোকে টেনে কথা বলবে। এ পাড়ার মানুষ তো তোর আগের ঘটনা জানে। তাদের মুখ আটকাবি কী করে। সবাই বলে মেয়েকে বেশি স্বাধীন করে আমি ভুল করেছি। যতই তুই চাকুরি কর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তোকে কেউ মূল্যায়ন করবে না। তোর দোষ খুঁটিয়ে বের করবে। এ বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। মারে এমন করিস না। ঝামেলা টুকিটাকি হবেই। তাই বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিবি। সমাজ নিয়ে চলতে হয়। সমাজের কথাটাও ভাব।
মায়ের কথা শুনে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। যদিও এটা পুরোপুরি মায়ের দোষ না। একটা মেয়ের ২৫ পার হয়ে গেলেই সবার কানাকানি শুরু হয় মেয়েটা বিয়ে কেন করছে না। তখন পরিবারও বিবেকহীন হয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সমাজ তখন পরিবারের মানুষ গুলোকেও পাগল করে দেয়। মস্তিষ্ক বিকৃত ঘটায়। এই তো কিছুদিন আগে খবরের কাগজে দেখালাম মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না বলে মা মেয়েকে খুন করে ফেলেছে। সেটার একটা মূখ্য কারণ হলো এ সমাজ। সমাজের মানুষ গুলো মেয়েদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে,এত এত কথা বলা শুরু করে যে তখন মেয়ের পরিবারও বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। কখনও মাথা চাপড়ায় কখনও বা বুক চাপাড়াতে থাকে। এর মধ্যে কিছু মানুষের ঘটে মানসিক বিকৃতি। তখন সে কি করে ফেলে সে নিজেও টের পায় না। তাই তখন জঘন্য কাজ করতেও তার বিবেকে বাঁধে না। এখন মায়ের সাথে উগ্র আচরণ করলেও সেটা হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আমি মাকে ধরে খাটে বসালাম। তারপর বললাম
– মা আমার বিয়ে হয়ে ডিভোর্স হয়ে গেলে তুমি মানতে পারবে?
– এসব কথা কেন বলছিস?
– কারণ আছে। বলো মানতে পারবে কী না।
– না, পারব না।
– আমাকে কী জেনে শুনে কোনো চরিত্রহীন ছেলের হাতে তুলে দেবে? বা এমন কোনো ছেলে যাকে তুমি বিয়ের আগেই জানো তোমার মেয়েকে সে কষ্ট দেবে তখন কী তুমি মেয়ের সুখের কথা ভাববে নাকি সমাজের কথা ভেবে সে ছেলের সাথে বিয়ে দিবে। ঠান্ডা মাথায় উত্তর দাও।
– অবশ্যই আমার মেয়ের সুখ আগে।
– তাহলে মা এখানেই থাকো। আমি এখন থেকে যা যা করব সুখে থাকার জন্য। তুমি শুধু সময়ে অসময়ে পাশে থেকো। আবিরের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে না। এটার কারণ ও জানতে পারবে। আপাতত বিষয়টা সবাইকে বলার দরকার নেই। আর শুনো রিজিক যেখানে থাকে সেখানেই বিয়ে হবে চিন্তা করো না। ৪০ বছর বয়সী মেয়েদেরও বিয়ে হচ্ছে। আর আমার বয়স ২৭ পার হলো। তবে এত চিন্তা কেন? আমাকে যে রাজপুত্র আর অনেক যোগ্য ছেলে বিয়ে করতে হবে তা’ না। আমি এমন কাউকে বিয়ে করব যে সাবলীল,সাধারণ আর ভালো। আমি তোমাকে আস্তে আস্তে সব বলব। শুধু এটাই কামনা করি কখনও ভুল বুঝবে না। এবার আমার জন্য নাস্তা বানাও একটা কাজ আছে কাজে যাব।
মা আর কোনো কথা বলল না। হয়তো মায়ের বিষয়টা বোধগম্য হয়েছে হয়তো হয়নি। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আলমিরাটা খুলে সবচেয়ে সুন্দর শাড়ি বের করলাম। আজকাল নিজেকে গুছিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ঝেঁকে বসেছে। শাড়িটা বের করে পরে নিলাম। নিজেকে পরিপাটি করে কলেজে কল দিয়ে ছুটি নিলাম।
তৈরী হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। যদিও খেতে ইচ্ছা করছে না তবুও জোর করে খেয়ে নিলাম। বাসা থেকে বের হয়েই থানায় গেলাম।
সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করলাম সোহান বসে আছে। আমি ওকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলাম। ওকে দেখেও আমি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কিছুটা না দেখার ভান করেই পাশের একটা চেয়ারে বসলাম। এর মধ্যেই ও বলে উঠল
– আরে অপ্সরা না তুই? একদম বদলে গেছিস। আগের আর বর্তমানে তেমন কোনো মিল নেই। আমি তো চিনতেই পারছিলাম না। তবে কপালের পাশে কাটা দাগ দেখে নিশ্চিত হলাম এটা তুই। কেমন আছিস?
আমি হালকা হেসে বললাম
– ভালো তুই?
ওহ বলে নিই। সোহান হলো আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। স্কুল কলেজ আমরা এক সাথেই পার করেছি। আমি কোনো ছেলের সাথে কথা না বললেও সোহানের সাথে বলতাম। কিন্তু অনার্সে উঠার পর অরন্য পছন্দ করত না তাই সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। এতদিনে ওকে আমি ভুলেই গেছিলাম। আজ হঠাৎ তাকে থানায় দেখে একটু চমকালাম। সে হালকা হেসে বলল
– ভালো। তা থানায় কী জন্য?
– একটা জিডি করব।
– কিসের?
– একটু ব্যক্তিগত। বলতে পারছি না। তা তোর দিন কেমন চলছে কোথায় আছিস?
– এই তো আছি ভালোই।
– কী করছিস?
– বাবার ব্যবস্যাটায় দেখছি। আর তুই তো কলেজে আছিস তাই না?
– তুই জানলি কী করে? আর বুয়েটে পড়ে জব না করে ব্যবস্যা করছিস কেন?
– তুই ভুলে গেলেও আমি তোর খু্ঁজ মাঝে মাঝে নিই। আর অন্যের অধীনে চাকুরি আমার মোটেও পছন্দ না।
আমি হালকা হেসে বললাম
– বাপের টাকা আছে তাই ভালো লাগে না অন্যথায় চাকুরি ছাড়া উপায় ছিল না। তা কী জন্য এখানে?
– বাসায় ডাকাতি হয়েছে গতকাল।
– কী বলিস। কী কী নিয়ে গেল?
– তেমন কিছু তো ছিল না। তবে ২৫ ভরির মতো মায়ের গয়না ছিল আর ৪ লাখ ক্যাশ টাকা ছিল।
– ভালোই তো নিয়ে গেছে তাহলে। কে বা কারা করতে পারে ধারণা আছে?
– ঐরকম সন্দেহ তো কাউকে আপাতত করতে পারছি না, দেখি কী করা যায়। য়দিও আমার কাজ শেষ। তবে তোকে বাইরে দেখেই বসে ছিলাম যাতে এড়িয়ে যেতে না পারিস। হুট করে কী এমন হলো সেই যে তুই কথা বলা বন্ধ করলি আর কোনো খুঁজ নেই।
সোহানের প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কারণ যে মানুষটার জন্য তাকে আমি ছেড়েছিলাম সে মানুষটার জন্য আজকে থানায় এসেছি। আমার নীরবতা দেখে সোহান বলে উঠল
– হয়েছে উত্তর লাগবে না৷ ভালো থাকিস। আর তোর আইডিতে এখনও ব্লক লিস্টে হয়তো পড়ে আছি। আর ফোন নম্বরটা আছে তবে কল দেয়ার সাহস পাই নি। বরাবরেই তুই রাগী কী থেকে কী বলিস তাই৷ ভালো থাকিস।
– হুম আচ্ছা।
আর কোনো কথা এগুলাম না। ছেলে মানুষ দেখলেই কেন জানি না স্বার্থপর মনে হয়। সোহান বের হয়ে গেল। আমিও জিডি করে খানিক পর থানা থেকে বের হয়ে উকিলের কাছে গেলাম। উদ্দেশ্য অরন্যকে ডিভোর্স দেওয়া। ডিভোর্সের কাজটা আগে সাড়তে হবে। ডিভোর্সের সকল ব্যবস্থা করে বাসায় আসলাম। আগামি সপ্তাহে এ সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করব। অরন্য আর আবিরের অফিসে অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থাও করে আসলাম। আজকে বেশ শান্তি লাগছে। নিজের অজান্তেই মনে হলো এক বড় পাথর বুকের উপর থেকে নেমেছে।
কাজ শেষে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হুট করেই গর্জন দিয়ে বৃষ্টি নামা শুরু করল। আমি আমার ব্যাগটা মাথার উপরে ধরে দৌড়ে এক দোকানের নীচে দাঁড়ালাম। এর মধ্যেই সোহান আমার সামনে হাজির। সোহানকে দেখে পুনরায় অবাক হলাম। সে কি আমাকে অনুসরণ করছে নাকি অন্য কিছু। সোহানকে সামনে দেখেও আমি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলাম না৷ সোহানেই হালকা কাশি দিয়ে বলল
– আবারও দেখা হয়ে গেল। তা এতক্ষণ কোথায় ছিলি। কোনো সমস্যা?
আমি বৃষ্টির পানিটা শাড়ি ধরে হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বললাম
– কোনো সমস্যা নেই। কেন কিছু বলবি?
– নাহ। দেখলাম উকিলের কাছে গিয়েছিস।
আমি কিছুটা রাগী গলায় উত্তর দিলাম
– তুই কী আমাকে অনুসরন করছিস?
সোহান জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল
– তা কেন হবে। দেখলাম তাই বললাম। কিছু হয়েছে কী?
– কিছু না হলে তো উকিলের কাছে যেতাম না।
– বলা যাবে কী?
– বলা যাবে না কেন? ডিভোর্সের জন্য গেছিলাম।
সোহান কথাটা শুনে মুখটা কালো করে ফেলল। এরকম একটা উত্তর সে আশা করে নি। ফ্যাকাশে মুখে বলল
– তোর বিয়ে কবে হলো আর ডিভোর্সেই বা কাকে দিচ্ছিস।
সাবলীল কন্ঠে জবাব দিলাম
– বিয়ে হয়েছে চার বছর আগে এখন ডিভোর্সের প্রয়োজন তাই ডিভোর্স দিচ্ছি।
– কাকে বিয়ে করেছিস শুনলাম না তো।
– অরন্যকে।
আমার উত্তর শুনে সোহানের মুখটা আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল
– কিন্তু যতদূর জানি অরন্য অন্যত্র বিয়ে করেছে। তুই কী হেয়ালি শুরু করলি নাকি।
– হেয়ালি না সত্যি। আর জটিল সম্পর্ক সরল করার জন্যই এ ডিভোর্স। আর সবকিছু বুঝতে চাওয়াও উচিত না। ৭-৮ বছর তোর সাথে যোগাযোগ নেই এত দিনের কাহিনি তো একদিনে বুঝে যাবি না। যাইহোক বৃষ্টি কমেছে আমি গেলাম।
– যদি কিছু মনে না করিস আমি পৌঁছে দিই। তোদের কী আগের বাসাটায় নাকি পরিবর্তন করেছিস।
– বাসা পরিবর্তন করেছি অনেক আগেই। আর ধন্যবাদ কোনো সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই। ভালো থাকিস।
বলেই রাস্তায় এসে একটা রিকশা ভাড়া করে বাসায় আসলাম।
ভেজা শাড়িটা পাল্টে নিলাম। শুকনো কাপড় পরে ভেজা চুল গুলো চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে লাগলাম। নিজের মধ্যে প্রশান্তি কাজ করছে যে আমি এখন নিজেকে শক্ত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি এটা ভেবে।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই কলিং বেলের শব্দ পেলাম। মা দরজা খুলে আমার রুমে এসে বলল
– কে জানি এসেছে তোর সাথে দেখা করতে। আমি ভাবলাম হয়তো সোহান এসেছে। কিন্তু সোহানকে তো মা চেনার কথা।
কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে আঁৎকে গেলাম। কারণ সোহান আসে নি। যে এসেছে তাকে দেখে ভাবতে লাগলাম নতুন নাটকের সূচনা হবে নাকি আবার?
চলবে