প্রাক্তন পর্ব-১৬

0
1045

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৬

মোবাইল খুলতেই আমার চোখ কপালে উঠল। কারণ আবিরের মেসেন্জারে সাহেরা নামে এক মেয়ে মেসেজের উপর মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। আমি মেসেজ গুলো যতই ঘাটছিলাম ততই আমার বুকে কম্পন হতে লাগল। বুঝতে পরলাম আবিরের সাথে এই মেয়ের সম্পর্ক দীর্ঘ তিন বছরের। মেয়েটার লাস্ট মেসেজ গুলো ছিল

– অপ্সরার ঝামেলা কবে শেষ করবে। অরন্যের জন্য আর কত করবে। এসব একদম ভালো লাগছে না। অরন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে তুমি আমার মনে অনিশ্চয়তা ঢুকাচ্ছ। এ ৫ মাস যাবত আমি অনেক সহ্য করেছি আর করতে পারব না। হাত, পা ভাঙ্গার নাটক আর কত করবে? এভাবে শুয়ে বসে থেকে আর কত কী করবে? অরন্যকে ঘরে লুকিয়ে রেখে অপ্সরাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছো। তোমার মা তো কিছুই জানে না ভালো আর মন্দ। উনি তো ভেবেই নিয়েছে তুমি অপ্সরাকে পছন্দ করো। পরে তোমার মাকে কী বুঝাবে? আদৌ কী অপ্সরাকে অরন্য বিয়ে করবে নাকি তুমি৷ কী হলো মেসেজ সিন করে যাচ্ছ রিপ্লাই কেন দিচ্ছ না।

আমি মেসেজ গুলো পড়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম আবির দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে আবির অসুস্থতার নাটক করেছিল এতদিন। সে আমার হাত থেকে মোবাইলটা টেনে নিয়ে বলল

– একদম বাড়াবাড়ি করবে না।

আমি আবিরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে কোনো কথায় আমার বের হচ্ছিল না। কোন খেলায় ফেঁসে গেলাম আমি নিজেও টের পেলাম না। বিশ্বাসের খাতায় আবারও ভাঙ্গন ধরল। আমার নীরবতা যেন আমাকে ঘিরে ধরল। আবির এত বড় নাটক করল। আমি আবিরের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই দিলাম। হালকা গলায় বললাম

– তুমি অসুস্থ না? আর সাহেরা মেয়েটা কে? কেন তুমি এসব নাটক করেছো আমার সাথে? তুমি আর অরন্য প্ল্যান করে এমন করেছো? আমার সব প্রশ্নের উত্তর চাই।

আবিরের মুখে ঘন কালো মেঘের আভা ফুটে উঠেছে। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে চিন্তিত। জানতাম আবির সহজে মুখ খুলবে না। তাই আবিরকে নাড়া দিতে বললাম

– তুমি কী সহজে মুখ খুলবে নাকি তোমার নামে মামলা করব? তোমার অফিসে লিখিত অভিযোগ দিলে কিন্তুু তোমার চাকুরী থাকবে না। আশা করি তুমি সত্যিটা বলবে। আর না বলতে চাইলেও জোর নেই। বাকিটা আমি ব্যবস্থা করতেছি। যেমন কুকুর তেমন মুগুর আমি দিতে পারি। কুকুর কামড়ালে কুকুরকে কামড়ানো ঠিক না তবে একটা মুগুর দিয়ে আঘাত করে কুকুরকে তার স্থানটা বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। যতটা আবেগী আর সহজ সরল ভাবো ততটা আমি না। এ নাকফুলটা অরন্যের আমি নিশ্চিত হওয়ার পরও বাড়াবাড়ি করে নি। কারণ আমার হাতে প্রমাণ দরকার ছিল।

আবির ঢুক গিলতে লাগল। বেশ ভয় পেয়ে গেছে বুঝায় যাচ্ছে। কারণ প্রতিষ্ঠিত ছেলের দুর্বল জায়গা তার চাকুরি আমি তার সে জায়গায় নাড়া দিয়েছি। অবশ্য যা বলেছি ভয় দেখানোর জন্য না সম্পূর্ণ সত্যি। আবির হালকা গলায় বলল

– অরন্যের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তোমার কথা বলত। আমি তোমাকে চিনতাম,ছবিও দেখেছি। মা তোমার ব্যপারে জানত তবে তোমাকে চিনত না। মা এসবের কিছুই জানে না। অরন্য এ তিন বছর তোমার খুঁজ নিয়ে গেছে৷ অরন্য জানত তুমি এ পর্যন্ত কোনো বিয়েতে রাজি হও নি। কিন্তু নাফিসাকে ডিভোর্স ও দিতে পারছিল না তাই তোমার সামনেও যেতে পারছিল না৷ অরন্য আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। আমি ওর কাছে ঋণী। এদিকে তোমার পরিবার একের পর এক পাত্র দেখেই যাচ্ছিল। অরন্য বেশ অনিশ্চয়তায় ছিল। কিন্তু নাফিসার সাথে ডিভোর্স হয়নি তাই তোমার সামনেও যেতে পারছিল না। কাকতালীয় ভাবে তোমার সাথে আমার এক্সিডেন্ট হয়। সেখান থেকেই আমাদের পরিকল্পনা শুরু। অরন্য চেয়েছিল তোমার বিয়ে যেন না হয় তাই আমি তোমার সাথে কথা বলে গেছি। আর এনগেজমেন্ট এর দিন ইচ্ছা করেই অরন্যকে দিয়ে আংকটি পড়িয়েছি। অরন্য জানত যে তোমার অতীতটা সামনে নিয়ে আসলে তুমি সবটা আমাকে বলবে। আর আমি সেই সুযোগে তোমাকে ছেড়ে দিব৷ সে সময়টায় অরন্য তোমার জন্য পাগলামি করবে। মানুষ একটা ধাক্কা পুনরায় খেলে সে আগের জায়গায় চলে যায়। আমরা ভেবেছিলাম তুমি আমার থেকে একটা ধাক্কা খেলে অরন্যকে মেনে নিবে৷ তাই বিয়ে পেছানোর জন্য এত নাটক করতে হয়েছিল আর তোমাকে মেনে না নেওয়ার পেছনেও এ কারণ ছিল। কিন্তু তুমি পুরো খেলাটা পাল্টে দিলে যখন এতকিছুর পরও অরন্যকে মেনে নিলে না।

তোমার জন্য পুরো খেলাটা পাল্টাতে হলো। আমি পুনরায় তোমাকে মেনে নেওয়ার নাটক করলাম। উদ্দেশ্য ছিল ডিভোর্সের নাম করে অরন্যকে বিয়ের কাগজটা পুনরায় পাকা পুক্ত করব। আমি দুঃখিত অপ্সরা। তোমার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ নেই। যা করেছি সেটা শুধু অরন্যের জন্য। আমি অরন্যকে তোমার জন্য কষ্ট পেতে দেখেছি। জানি না ঠিক করেছি নাকি ভুল। তবে অরন্যকে ভালো রাখতে এটুকু করা। এই যে আমি আজকে দাঁড়িয়ে আছি সেটাও অরন্যের জন্য।

আর সাহেরা আমার গার্ল ফ্রেন্ড। আমি বিয়ে করলে ওকেই করব। তিন বছরের সম্পর্ক আমাদের। শুধু অরন্যের জন্য বিষয়টা পিছিয়েছি। অরন্য আর তোমার বিয়ে টা হলেই আমি বিয়ে করে নিতাম। অপ্সরা অরন্যকে আর ফিরিয়ে দিও না। এই যে আমরা এতকিছু করেছি সেটা শুধু তোমাকে আর অরন্যকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য। আর মা ও কিছু জানে না। আমার মা অনেক সহজ সরল।।দয়াকরে মাকে কিছু বলো না। আমি চাই তুমি আর অরন্য এক হয়ে যাও।

আরও কিছু বলতে নিবে আবির, আমি সুযোগ না দিয়ে আবিরের গালে জোরে চড় দিয়ে বললাম

– তোরা একেকটা কুত্তা। আমার সাথে যা করেছিস। তোদের প্রত্যেককে উপযুক্ত শাস্তি আমি দিব। অরন্য কোথায় বল।

আবির আমার রাগী কন্ঠ শুনে ঢুক গিলতে লাগল। কিছু বলছে না। আমি তার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় পুনরায় বললাম

– অরন্য কোথায়?

– পাশের রুমে।

আমি আবিরের কাছ থেকে বের হয়ে পাশের রুমে গেলাম। অরন্য তখন ঘুমুচ্ছিল। ঘরের কোণে থাকা জুতো জোরার একটা জুতো পা দিয়ে চেপে ধরে দরজাটা লাগিয়ে অরন্যকে হালকা গলায় বললাম

– অরন্য উঠো। সমস্ত কাহিনি জেনে আমি তোমাকে মেনে নিছি। আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

অরন্য ঘুম থেকেই উঠেই হালকা হেসে বলল

– আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

– কেন কী মনে হচ্ছে?

– মনে হচ্ছে মধুর স্বপ্ন দেখছি।

– এখন মনে হবে তুমি দুঃস্বপ্ন দেখছ।

– মানে?

কথাটা বলতেই আমি পায়ে চেপে রাখা জুতোটা হাতে নিয়ে এলোপাতারি কয়েকটা মেরে বললাম

– কু্ত্তার বাচ্চা,শুয়োরের বাচ্চা তোরা আমার সাথে যা করেছিস এর ফল তোদের পেতে হবে।

রুম থেকে বের হয়ে চলে আসলাম। আবিরের মা তখন বাসায় ছিল না। বাসায় এসেই দরজাটা লাগিয়ে ধুপ করে বসে পড়লাম। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এত বড় নাটকের নায়িকা হলে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। আমি দম নিতে লাগলাম। প্রতিটা মানুষকে আমি উপযুক্ত শিক্ষা দিব । এদের শাস্তি পেতেই হবে। তানা হলে এরা আরও জঘন্য হবে। যে ক্ষমতার জন্য আজকে এদের এত বড়াই সেটাই আমি কেড়ে নিব। মনে মনে কথাটা ভেবেই মাথায় গুজে থাকা ফুল গুলো টেনে বের করলাম। ছিড়ে ফেলে দিলাম মেঝেতে। শাড়িটা খুলে চোখগুলো মুছে ধুয়ে নিলাম। নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ আমাকে লড়াই করতে হবে আর নতুন লড়াই এ জিততে হবে।

সারাদিন আর রাত এসব ভাবনাতেই কেটে গেল। পরদিন সকালটা শুরু করলাম নতুন ঘটনার সূত্রপাত দিয়ে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে