প্রাক্তন পর্ব-০৬

0
1166

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬

কারণ সকালে ঘুম থেকে উঠেই লক্ষ্য করলাম আবির কল দিয়েছে বেশ কয়েকবার। এর্লাম দেওয়া ছিল ফজরের সময়ে। সেটাও বেজে কখন বন্ধ হয়ে গেছিল খেয়াল নেই। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম সাড়ে নয়টা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আর এত প্রখর ঘুম হলো যে আবির ১১ বার কল দেওয়ার পরও ধরতে পারি নি। মুখে হাই তুলতে তুলতে আবিরকে কল দিলাম। আবির কলটা ধরতেই আমাকে ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো

– কোথায় ছিলে তুমি? এপর্যন্ত তো ফজরে তুমি আমাকে ডেকে দাও। আজকে তোমাকে এতবার কল দিলাম ফোন ধরলে না।

– মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছিল তাই ঔষধ খেয়েছিলাম। তাতেই এত ঘুম হয়েছে। কিন্তু এতবার কল দিলে কেন? কোনো বিশেষ দরকার ছিল?

– তেমন বিশেষ দরকার ছিল না। তবে এদিকে তো আমার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছিল। হাসপাতালে আছি এখন।

আমি কিছুটা বিমূর্ত গলায় বললাম

– কেন কী হয়েছে তোমার? আর এখন কেমন আছো? হুট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছো কেন?

– অপ্সরা অস্থির হইয়ো না। আমি এখন একদম ঠিক আছি। আর অরন্য যে হাসপাতাল জব করে সেটাতেই আছি।

– কিন্তু তোমার কী হয়েছিল?

– আরে বলো না প্রতিদিনের মতো মর্নিং ওয়াকে গেছিলাম। তবে ফাঁকা রাস্তায় হুট করে ট্রাক এসে ধাক্কা দেয়। পা টা ভেঙ্গে গেছে। মাথায় ও বেশ আঘাত পয়েছি,হাতের অবস্থাও খারাপ। ঐ মূহুর্তে অরন্য না থাকলে কী যে হতো। অরন্যের কাছে দ্বিতীয়বারের মতো ঋণী হয়ে গেলাম। ওর ঋণ শুধু বেড়েই যাচ্ছে।

– অরন্যের কাছে দ্বিতীয়বারের মতো ঋণী মানে? কী বলছো এসব? আর শরীর এখন কেমন? ডাক্তার কী বলেছে? কোন হাসপাতালে আছো বলো, আমি এখনি আসতেছি।

– আরে অপ্সরা এত প্রশ্ন করলে কোনটা রেখে কোনটার জবাব দিব? একটু স্থির হও। আমার কিছু হয়নি। এতটা অস্থিরতা তোমাকে মানায় না?

– তুমি কী পাগল আবির? তোমার ব্যপার নিয়ে আমি অস্থির হব না এটা কেমন করে বলো?

আবির আমার কথাটা শুনে হালকা হাসলো। হালকা হেসে বলল

– আরে আমার হবু বউটা যে আমায় এত ভালোবাসে সেটা তো জানতাম না। আস্তে আস্তে টের পাচ্ছি। এবার একটু শান্ত হও আমি তোমাকে সবটা বলছি। ঘটনা ঘটেছে সকাল সাতটায়। হাসপাতালে এসেছি সাড়ে সাতটায়। বড় কিছু হয়নি হাত পা ভাঙ্গা ছাড়া। ডাক্তার বলেছে তিনমাস বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাব। আর সময় মতো অরন্য না থাকলে আমার অবস্থা খারাপ হতো। এর আগেও অরন্য আমাকে এভাবে বাঁচিয়েছে। সেদিন অরন্য না থাকলে আমাকে পেতে না।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম

– কেন এর আগে কী হয়েছিল?

– তখন সবে চাকুরিতে জয়েন করি। ছুটি পেয়ে ঘুরতে গেছিলাম এক জায়গায়। সেখানে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আমার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। খালি রাস্তায় পড়ে ছিলাম। অরন্য সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছে। হাসপতালে নিয়ে গেছে। নিজের রক্ত দিয়েছে। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে আমার পাশে ছিল। অরন্যের সাথে সেখানেই পরিচয় আমার।

– কোথায় ঘুরতে গেছিলে তুমি?

– অরন্য যে উপজেলায় চাকুরি করে সেখানেই। সেটা তো হাওর এলাকা ছিল। তাই সেখানে ছিনতাইকারীর উপদ্রব ও বেশি ছিল। সেদিন পেটে ছুরির আঘাত খেয়ে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। অরন্যের জন্যই সেদিন বেঁচে গেছিলাম।

– কত বছর আগের ঘটনা এটা?

– তিন বছর আগের। সেদিন থেকেই অরন্যের সাথে আমার বন্ধুত্বটা জমে উঠে। এরপর ঢাকায় পোস্টিং হওয়ার পর তো সে আমার ভাইয়ের মতোই হয়ে গেছে।

– আচ্ছা তখন অরন্য ভাইয়া কোথায় থাকত? আর পরিবার সাথে নিয়ে থাকত নাকি?

– তখন তো অরন্য ব্যাচেলর ছিল। সেখানের ব্যাচেলর কোয়াটারে থাকত।

উফ আবির এসব কী বলছে। অরন্য ব্যাচেলর ছিল। কী হচ্ছে এসব। এটা কী করে সম্ভব। কিছুটা উৎসুক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম

– ভাইয়ার চাকুরি হলো এতদিন বিয়ে করেনি কেন?

– ও একজনকে ভালোবাসে। সেখান থেকে বড় একটা আঘাত পেয়েছে। এরপর থেকে আর বিয়ের নাম নিলে সে রাজি হয়নি। কত মেয়ে দেখালাম কাউকেই নাকি ওর পছন্দ হয়না। একটা মেয়ের কথা অনেকবার বলেছে। বলেছে মেয়েটাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আর সেটা বুঝতে পেরেছে একটা সময় পর। যখন তার হাতে করার মতো কিছু ছিল না।

আমার ধারণা অরন্যের স্ত্রী নাফিসাকে হয়তো সে খুব ভালোবাসত। আর তার সাথে ঝামেলা হয়েছে হয়তো। তাই কিছুটা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– মেয়েটার নাম কী? মেয়েটাকে কী তুমি চেনো? কথা হয়েছে কখনও?

– চিনি না, অরন্য কখনও ছবিও দেখায়নি, শুধু নামটা বলেছে।

– কী নাম মেয়ের শুনি?

– অপরাজিতা।

নামটা শুনে আমি থমকে গেলাম। ভাবনার সাগরে ডুবে গেলাম। চোখ মুখ ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। আবির অরন্যকে চেনে তিন বছর যাবত অথচ তার বউ নাফিসার সাথে তার পরিচয় নেই। তার বউয়ের ব্যাপারে সে কিছু জানে না। যদিও তার বউয়ের সাথে লাস্ট ছবি আপলোড হয়েছে গতবছর। এ বিষয়টায় একটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। সে সাথে আবির যে নামটা বলল সে টা অরন্যের দেওয়া আমার একটা নাম। অরন্যের প্রিয় ফুল ছিল অপরাজিতা তাই সে ভালোবেসে আমাকে এ নামটায় ডাকত। আবিরের কাছে টানা তিন বছর সে আমার কথা বলে গেছে। তাহলে অরন্য আমাকে ছেড়েছিল কেন? আর অরন্য ব্যচেলর হলে নাফিসা কে? সব কিছু এলোমেলো লাগছে। এ মুহূর্তে এ প্রশ্নের উত্তর গুলো একমাত্র অরন্য দিতে পারবে। আমার উচিত তার সাথে কথা বলা। নাহয় রহস্যের গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে যাব।

– আবির হাসপাতালের ঠিকানা দাও। আমি এখনি আসতেছি।

– আমি ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি। আর অপ্সরা সরি।

– সরি কেন?

– আমার বোকামো আর অসচেতনতার জন্য বিয়েটা পিছিয়ে গেল। তিনমাস অপেক্ষা করতে হবে আমার জন্য। পারবে না অপেক্ষা করতে? হারিয়ে যাবে না তো? বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

– একবার যখন তোমায় কথা দিয়েছি তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না সেহেতু যাব না। আমি জানি কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করা কতটা কষ্টদায়ক। আবির আমি তোমার পাশে আছি, পাশে থাকব কথা দিলাম। এ তো তিনমাসের ব্যপার। আমি আসতেছি আর মা কোথায়?

– মাকে বলার সাহস পাইনি। তুমি এসে একটু মাকে বলো। তোমার দায়িত্ব তোমার হবু শ্বাশুড়িকে কীভাবে বুঝাবা।

– হয়েছে বকাগুলো আমাকে খাওয়ানোর ধান্দা।।যাইহোক রাখলাম। এখনি তৈরী হয়ে আসতেছি।

কলটা কেটে তৈরী হয়ে নিলাম। একটা সি এন জি নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। মনে হাজারটা সংশয়ের অবসান আজকে ঘটাব আমি। অরন্যকে আজকে সব জিজ্ঞেস করব কেন এমন করছে।

সি এন জিটা তখন চলমান। শাহবাগ যেতে আরও কিছুক্ষণ বাকি। শাহবাগের পথ দিয়ে এগুতে এগুতেই পুরনো স্মৃতিতে ডুব দিলাম। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। অরন্য তখন এফ পি এস কোচিং করত নিকুন্জতে। দিলীপ স্যারের কোচিং নামেই সবাই চিনত। একদিন অরন্যের সাথে আমার বেশ ঝগড়া হলো। ঝগড়া করে ও ফোনটা অফ রেখেছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম সে কোচিং-এ যাবে। যত যাই করুক সে তার ক্লাস মিস দিবে না। আমি তখনও রাস্তা ঘাট চিনতাম না। তবুও বেশ সাহস করে রাস্তা চিনে চিনে কোচিং এর সামনে গেলাম। কোচিং এ তখন টিফিনের ব্রেক চলে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অনিশ্চয়তা নিয়ে অরন্যের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হুট করে অরন্য বের হলো। পরনে ছিল নীল রঙয়ের টি শার্ট। কালো মোটা ফ্রেমের চশমাতে চোখ গুলো আবদ্ধ। দোকানে এসে চা দিতে বলল। আমি দেখছিলাম দূরে দাঁড়িয়ে ও কী করছে। ও চা টা হাতে নিয়ে যখনেই চুমুক দিবে আমি ওর পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। অরন্য পেছন ফিরে আমাকে দেখে চমকে গেল। চোখগুলো বড় বড় করে তাকিয়ে বলল

– তুমি এখানে?

– ফোন বন্ধ করেছো কেন?

– ভালো করেছি। সারাদিন ঝগড়া করো কেন? তোমার গালি খাওয়ার এত ইচ্ছা নাই। হুদাই গালি দাও।

– এতদিন তো গালি দিয়েছি এখন পিটাব কি না বলো?

– বাড়াবাড়ি করবা না।

আমি রাগী চোখে অরন্যের দিকে তাকালাম কথাটা শুনে। আর সাথে সাথে অরন্য গলে গেল। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলো

– দাঁড়াও এখানে ব্যাগটা নিয়ে আসি। তোমার সাথেই ঘুরতে যাব এখন।

– ভয়ে পালাচ্ছ না তো এখন?

– তোমার কাছ থেকে পালিয়ে থাকা সম্ভব নাকি। অপেক্ষা করো আসতেছি।

বলেই ক্লাস রুমের দিকে গেল। পাঁচমিনিটের মধ্যেই ব্যাগ নিয়ে সামনে হাজির হলো। আমাকে হাসতে হাসতে বলল

– কোথায় ঘুরবা বলো।

– টি এস সি ছাড়া আর কোথায় গিয়েছি। সবসময় তো ঐ জায়গায়টাতেই যাই। টি এস সিতেই চলো।

অরন্যের সাথে সেদিন সি এন জি ভাড়া নিয়ে টি এস সির দিকে রওনা দিলাম। ফার্মগেট এসে আমার কী যেন হলো। হুট করে অরন্যকে বললাম

– ক্লান্ত বিকেলের রোদ হেলে পড়েছে চলো শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে যাই। ঐখান থেকে পরে রিকশা নিব। তোমার সাথে হাঁটতে মন চাচ্ছে।

– এত দূর হাঁটবা?

– ইচ্ছা হচ্ছে। হাঁটবা কি না বলো?

অরন্য সি এন জি থামিয়ে দিল। আমি অরন্যকে নিয়ে নেমে পড়লাম। দুজনের দুহাত একসাথে করে সেটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। কখনও হাত মুষ্টি করে ধরছিলাম কখনও আলতো করে। কতশত পরিকল্পনা করছিলাম। বলতেছিলাম বিসিএস টা হয়ে গেলেই আর কোনো বাঁধা নেই। একসাথে হয়ে পড়ব দুজন। কত শত কথা আর স্বপ্ন দুজন মিলে গুছাচ্ছিলাম। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের মোড়ে চলে আসলাম খেয়াল নেই। ফুলের দোকান গুলো সেখানে সারি বদ্ধভাবে সাজানো। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অরন্য কেমন করে যেন বুঝে গেছিল ফুল গুলো আমার চাই। সে দৌঁড়ে গেল ফুল আনতে। দুটো ফুল এনে আমার কানে গুজে দিল। আমি হাসতে হাসতে অরন্যের দিকে তাকালাম। সে আমাকে দেখে বলল নতুন বউ লাগছে একদম।

গাড়ির হর্ণে মধুমাখা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলাম। আশ্চর্য জনক ভাবে সি এন জি সে ফুলের দোকানগুলোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে এখন অনেকটা বদলে গেছে। ভেতরে ভতরে হালকা হাসলাম। আজকাল অতীত আর বর্তমান সব কিছু যেন আমাকে দেখে উপহাস করে।

সি এনজি টা আবার চলতে লাগল। গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল। চলতে চলতেই গন্তব্যে পৌঁছালাম। গন্তব্যে পৌঁছানোর সাথে সাথে অরন্যকে দেখতে পেলাম মূল ফটকে। আমি সি এন জি এর ভাড়াটা তাড়াতাড়ি করে দিলাম। কারণ এখন অরন্যকে প্রশ্ন করব আগে তারপর যাব আবিরের সাথে দেখা করতে। আমি দৌঁড়ে ভাড়াটা দিয়ে অরন্যের কাছে যেতেই থমকে গেলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে