প্রাক্তন🖤
লেখাঃ সাকিব সাদমান
পর্বঃ ০৬
আমি মুচকি হেসে বললাম,
হৃদয় তো অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছে। এখন সময় পাহাড় সমান অভিমানকে চাপা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। (আমি)
সেও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।
তারপর আমি চলে আসি। তবে আসার সময় পার্কের দিকে নজর যায়। পার্কে লিলু একটি ছেলের সাথে খুব কাছাকাছি ভাবে বসে আছে।
অনেকটা অবাক হলাম।কারণ যে মেয়ে অতীতের সম্পর্কের জন্য নিজের বিয়ে ভেঙে দেয় সে এভাবে এমন জায়গায় থাকবে সেটা আশা করিনি।
দূরে থেকে বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা গেলেও আরো সঠিক ভাবে সব বুঝতে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি যে লিলু এতে আর কোন সন্দেহ নেই। তবে এরকম কাছাকাছি অর্ধ অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখতে হবে সেটা কল্পনায় আসেনি।
আমি তাদের কাছে গেলাম। আমাকে দেখে নিজেকে ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খুবই রাগ হচ্ছে লিলুর উপর। যদি ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল তাহলে বিয়েতে রাজি হওয়ার নাটক করে কেনই বা রাতে হাঙ্গামা করে বিয়ে ভেঙে দিল?
যদি তার জীবনে কেউ ছিল!! তাহলে এত নাটকীয়তার কি প্রয়োজন ছিল?
নিজেকে সামলে ভাঙা গলায় বললো,
আপনি? এখানে!! (লিলু)
কেন আশা করেননি হয়তো? (আমি)
না মানে? আসলে হয়েছে!! (লিলু)
আর তাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি। আমিই বলতে থাকি,
অতীতের সম্পর্কে জেনে ছিছি করা মেয়েটার আজই তার বর্তমানের সাথে দেখবো কল্পনা করিনি। কাল রাতে বড় বড় গলায় অনেক কিছুই তো বললেন!! তাহলে সেই নেতিবাক্যগুলোই আজ কোথায়? এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন ইজ্জত বিলিশে দিচ্ছেন? (আমি)
লিলু কিছুটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
আপনি বসুন। আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি। প্লিজ এখানে ঝামেলা বাঁধিয়ে লোক জড় করবেন না!! প্লিজ, (লিলু)
মেয়েটার করুন চেহারার কাছে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। তবে কঠুর স্বরে বলি,
কি বলবেন? বলেন তাড়াতাড়ি, আপনার হাতে প্রচুর সময় থাকতে পারে কিন্তু আমার হাতে নেই। (আমি)
লিলু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে,
ওর নাম রিফাত। পড়াশোনা শেষ করেছে দু’বছর হলো। কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না। তাই বাসায় জানাতে পারছি না। তাই তো প্রতিবারই কোন না কোন উপায়ে সবাইকে না করে দেই। আপনার বেলায় শুধু প্রাক্তনের কথা বলে সব শেষ করেনি বরং এরকম অনেকের সাথেই করেছি। শুধু সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য। (লিলু)
বাহ্!!! খুব ভালো পারেন আপনারা। নিজের করা দোষগুলো অন্যের উপর চাপিয়ে নিজে ভালো সেজে নিজের স্বার্থটা ঠিকই হাসিল করতে পারেন। খুব তো কাল রাতে বললেন আমি কত কিছুই না করেছি? প্রাক্তনের সাথে। কিন্তু আপনার এই বর্তমান দেখে বুঝতে পেরেছি যে আপনার কাজগুলোই আপনি কালকে রাতে প্রকাশ করেছে। তবে সেগুলো আমার উপর চাপিয়েছেন। (আমি)
প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এসব বিষয়ে কাউকে কিছু জানিয়েন না দয়া করে। (লিলু)
ভালোবাসার মাঝে যে ছেলে শারীরিক চাহিদা খুঁজে সে কখনোই আপনাকে ভালোবাসে না। বরং আপনার চেহারা ও দৈহিক গঠনটাকেই ভোগ করতে চায়। (আমি)
না জেনে কারো সম্পর্কে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করবেন না। আমি না হয় কাল রাতে সব দোষ আপনার উপর চাপিয়ে ভুল করেছি। কিন্তু এখন যে কথাগুলো আপনি বলতেছেন সেগুলো কি ঠিক হচ্ছে? (লিলু)
আচ্ছা ঠিক আছে। আমিই এতক্ষণ যা বলেছি সবটা ভুল বলেছি। কিন্তু এত মিথ্যাচার দিয়ে সম্পর্ক ডেকে রেখে কি এগিয়ে যেতে পারবেন? (আমি)
তাহলে কি করবো? এখন তো কেউই আমাদের মেনে নিবে না। (লিলু)
কিন্তু একবারও কি চেষ্টা করেছেন? চেষ্টা না করেই হার মেনে নিয়েছেন? নিজেকে হারিয়ে শুধু মিথ্যাচার সৃষ্টি করছেন না বরং আপনার সাথে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের মন ভেঙে দিচ্ছেন। (আমি)
তাহলে এখন উপায়? (লিলু)
আপনারা বিয়ে করেন। বাকিটা আমি আপনাদের বাড়িতে সামলে নিব। বিয়ে না করলে হয়তো এখন কাউকেই মানাতে পারবেন না। (আমি)
কিন্তু এটা কি ঝটপট সম্ভব? একজন উকিল দরকার সাথে সার্টিফিকেট। সময় তো লেগেই যাবে? (লিলু)
আজ শনিবার। কাল দুপুর ১০ টায় আপনার উনাকে নিয়ে এখানেই তৈরি থাকবেন। আপনাদের রেজিস্ট্রি বিয়ে কিভাবে দিতে হয় সেটা আমিই ব্যবস্থা করে দিব। (আমি)
কথাটা শুনার পর অনেকটাই খুশি হয়েছে লিলু। সে খুশি হয়ে প্রায় আমাকে জড়িয়ে নিতে চেয়েছিল কিন্তু কোন এক দ্বিধায় আটকে গেছে।
তারপর তাদের বিয়ের প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। অদ্ভুত কি হাসি মেয়েটার? কিন্তু আফসোস কাল ছেলেটা আসবে না। বরং ছেলেটা সম্পূর্ণ যোগাযোগই বন্ধ করে দিবে।
কাল তার মুখে হাসির বদলে এক বুক কষ্ট ও নিরাশা থাকবে। আবেগ প্রবণতার থেকে কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে কষ্টটাকেও স্বাদরে গ্রহণ করা যায়।
ছেলেটা যে লিলুকে না বরং ওর রুপ ও যৌবন কে ভালোবাসে সেটা তার অশ্লীল চাহনিতেই প্রকাশ পায়। কিন্তু লিলু এখন মায়া নামক আবেগের ছলে রয়েছে। চাইতেও সে এগুলো দেখতে পাবে না।
তাই বাস্তব পথে হাঁটিয়ে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করে দিব। স্টেশনে চলে এসেছি। আজ ছায়াকে অদ্ভুত ও অশান্ত লাগছে।
তার পেটে চাপ ধরে কোঁকড়াচ্ছে। হয়তো তার ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখানে কেউ তাকে হাসপাতাল অবধি পৌঁছে দিবে না। তার এরকম কষ্টটা কয়েকজন ভিডিও করবে। তারপর সামাজিক মাধ্যমে বড় ক্যাপশন দিয়ে লেখবে,
“ইশশ সাহায্য করার মতো কেউ নেই।”
অদ্ভুত না? অদ্ভুত হলেও এটাই বাস্তবতা। চাইলেও কেউ করতে চায় না। কারণ কারো কাপড় ময়লা হয়ে যাওয়ার ভয়। কারো শরীরে দূর্গন্ধ লেগে যাওয়ার ভয়। কেউ তো এই ময়লাওয়ালা মানুষকে ঘৃণাই করে। তাইতো কেউ আগ বাড়িয়ে যায় না।
আমিই তাকে উঠিয়ে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দিলাম। আমাদের স্বপ্নের মতোই তার প্রসব ব্যাথা উঠেছে। তাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি আর সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে।
আজও স্বপ্নের ব্যতিক্রম হয়নি!! বরং সেটাই হয়েছে যেটা একদিন বটগাছের নিচে বসে দু’জন কল্পনায় গেঁথেছিলাম। তবে আজ বাচ্চাটা অন্য কারো। আর সেই মানুষটাও অন্যের স্ত্রী৷
হাসপাতালে সঠিক সময়ে পৌঁছে গেলেও বিপত্তি হয় তখন যখন তারা হাসপাতালে ছায়াকে ভর্তি করতে অস্বীকার করে। কারণ জানতে চাইলে বলে,
“ওমন অপরিষ্কার ও ফকির মিসকিনদের হাসপাতালে ভর্তি করলে নাকি হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হবে। আর হাসপাতালের রেপুটেশন নাকি খারাপ হবে।”
অদ্ভুত এমন কথা শুনে রাগ যে কারো উঠবে। তবে জানি আমি এই এলাকার নই। তাই রাগ দেখালে সমস্যার সমাধানের জায়গায় উল্টো আরো বিগড়ে যাবে।
তাই তাদের ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। তাদের এটাই বলি,
“কোন অসহায় মহিলা বা পুরুষ কে হাসপাতাল কতৃপক্ষ সাহায্য করলে পরিবেশ ও রেপুটেশন কিছুই নষ্ট হবে না। বরং পরিবেশটা সুন্দর হবে আর রেপুটেশন বৃদ্ধি পাবে। আর হাসপাতালের কর্মীদের দায়িত্বই হচ্ছে রুগীদের সেবা করা তাদের দূরে ঠেলে দেওয়া নয়।”
এমন কথার মাঝেও তারা তাদের কথাই অটুট হয়ে রয়ে গেল। সোজা আঙুল যখন কাজ হয় না তখন আঙুল বাঁকাতেই হয়। আর আঙুল না বাঁকালে বাঙালি সোজা হয় না।
আমি আমার বন্ধু যে পুলিশ কমিশনার তাকে ফোন দেই। তার আপন মামাই হচ্ছে আইনমন্ত্রী। তাই বিষয়টা আমার জন্য শুরু থেকেই সহজ হবে। তবে আগে সোজা আঙুলে চেষ্টা করে দেখলাম। নয়তো পড়ে নানা রকম বাহানা করবে।
বন্ধুকে সবটা খুলে বলার পর এলাকার এএসপি মিনিট বিশেক এর মধ্যে হাজির হয়। তারপর আর কি? যা হবার তাই হয়!! স্যার স্যার বলতে সকল কার্যক্রম শুরু করে। তবে এতটা সময় প্রিয় মানুষের ব্যাথাগুলো অনুভব করতে পেরেছি।
অফিসারকে ধন্যবাদ জানাই। সে আমাকে তার ব্যক্তিগত নাম্বার এবং কোন সমস্যা হলে তাকে জানাতে বলে। তারপর সে বিদায় নেয়।
খুব ইচ্ছে তাকে যখন ওটিতে নিয়ে যাবে তখন ডাক্তার কে রিকুয়েষ্ট করে আমিও ভেতরে যাব। যখন বাচ্চার আগমন ঘটবে তখন তার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবো।
এসব ভাবনার মাঝেই নার্স এসে বলে এবি পজিটিভ (AB+) রক্তের প্রয়োজন। তাও চার ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। হাসপাতালের ব্যাংকে দু ব্যাগ রয়েছে তবে এখনো আরো দুব্যাগ প্রয়োজন।
আমিও কোন না কোন উপায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে একজনকে পেলাম যে কিনা রক্ত দিতে চায় স্ব-ইচ্ছায়। রক্তের উৎস তো পেয়ে গেলাম এখন শুধু অপেক্ষা করার পালা।
বসে বসে ভাবতে ছিলাম ছায়ার বাবার কাছে খবরটা পৌঁছাবো কিনা? কিন্তু ইতিমধ্যে সেও এসে হাজির হয়। অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ যে এতকিছু জানে অবশ্যই সে নজরটা বসিয়ে রেখে গিয়েছিল।
আবারও একজন নার্স আসে আমার কাছে।
চলবে……..
বিদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।