#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫
খুঁজতে খুঁজতেই অরন্যের আইডিটা দেখে আমি পুনরায় আশ্চর্য হলাম। আবির বলেছে অরন্য বিয়ে করেনি। আর আইডিতে প্রোফাইল পিকে দেখা যাচ্ছে অরন্যের বউ নাফিসার সাথে অরন্যের হস্যজ্জ্বোল ছবি যা ১ বছর আগে আপলোড করেছে সে। অরন্য সচরাচর ঘনঘন প্রোফাইল পিক চেন্জ করে না। হয়তো এখনও সে অভ্যাসটা রয়ে গেছে। তবে বাকি পোস্ট গুলো হয়তো ফ্রেন্ডস করা, তাই বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারছি না। কিন্তু আবির কেন বলছে অরন্য অবিবাহিত। আবিরের সাথে যদি অরন্যের পরিচয় ১ বছরও হয় তবুও তারা একে অপরের আইডিতে এড হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে আবির কী করে বলছে অরন্য বিবাহিত নয়। আমার ভাবনাগুলো আরও প্রশ্নের ঘুরপাকে জড়িয়ে যাচ্ছে। কী করা উচিত বুঝতেও পারছি না। নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছিলাম অতীতটা ফেলে এখন সে অতীতটায় ব্যাগরা দিয়ে বসেছে। সে সাথে হাজারটা রহস্যে মুড়িয়ে যাচ্ছি। মনের অস্থিরতা বাড়তে লাগল অনেক। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। অরন্যের সাথে কথা বলতে হবে। আবিরের সাথে অরন্যের সকল যোগসূত্র বের করতে হবে।
মাথাটা বেশ ঘুরপাক খেতে লাগল। অরন্য আর আবিরের রহস্যে মুড়িয়ে যাচ্ছি একের পর এক। আবার কোনো নতুন ভুল করার আগে সে রহস্যের উদঘাটন করতে হবে। কেন অরন্য চার বছর আগের সব সামনে আনতে চাইছে আর আবির এতদিন অরন্যের কথা বলল না কিন্তু এনগেজমেন্ট এর দিন হুট করেই কেন অরন্য কে নিয়ে আসলো। আংকটিটাও অরন্য পড়াল। একের পর এক ঘটনা এটাই জানান দিচ্ছে অরন্য চায় অতীতটা সামনে আসুক। কিন্তু তার স্ত্রী বর্তমান থাকার পরও কেন এমন চাচ্ছে? কেনই বা আবিরকে সে তার স্ত্রী এর কথা লুকিয়েছে। আর স্ত্রী থাকলে অবশ্যই অরন্যের বাসায় আসার কথা আবিরও তার স্ত্রী কে দেখার কথা। সেক্ষেত্রে তার স্ত্রী কখনও হয়তো অরন্যের বাসায় আসে নি। দু বছর আগে সে ঢাকায় এসেছে এর মধ্যে তো স্ত্রী আসার কথা। আর অরন্য যদি বিয়ে না করে তাহলে এ মেয়েটা কে অরন্যের প্রোফাইল দখল করে আছে। অরন্যের স্ত্রী কে ও মেনশন করা। অরন্যের স্ত্রী এর আইডি হয়তো ডিএকটিভ তাই আইডিতে ঢুকা যাচ্ছে না। অরন্যের স্ত্রী নাফিসার সাথে যদি সম্পর্কচ্ছেদও হয় তাহলে তো নাফিসার ছবি প্রোফাইলে থাকার কথা না।
উফ… সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে বারবার। কী করব কীভাবে এ রহস্যের উদঘাটন করব৷ আবেগের বশে আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। চুপ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ । মনের অস্থিরতা বাড়তে লাগল। নিজেকে সামলে নিতে হবে। অস্থিরতা নিয়ে যেকোনো কাজ করলেই সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। মোবাইলটা রেখে চুপ হয়ে অতীতে ডুব দিলাম। সেই কালো অতীতটা সামনে এসে থুবরে পরলো যে অতীতটাকে ভুলতে চেয়েছি বহুবার। যে অতীতের করালগ্রাসে টানা তিন বছর পুড়ে মরেছি। কাউকে বলতেও পারে নি আবার সহ্যও করতে পারেনি।
সম্পর্কচ্ছেদ আর বিয়ে ভাঙ্গার দেড় মাস হয়েছিল সবে। সেদিন দুপুরের নাস্তা খেয়েছিলাম এশার সময়। খাবার টা হাতে নিয়েও গিলতে পারছিলাম না। অনেকটা জোর করেই খাবার টা খেয়ে নামাজে দাঁড়াই। নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে খুব কেঁদেছিলাম। মোনাজাত শেষে যখনই উঠে দাঁড়াই তখনই মাথাটা ঘুরে যায়। হালকা হালকা বমি ভাব হতে লাগে। নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিই। মুখ ধুয়ে রুমে আসতেই আমার মনটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে। লুকিয়ে বিয়ে করার পর অরন্যের সাথে বেশ কয়েকবার ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। এখন কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি মা হতে চলেছি। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পাগলের মতো অরন্যকে কল দিলাম। বারবার মেসেজ দিলাম। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। কারও কাছে বিষয়টা শেয়ার করে হালকা হব সেটারও উপায় পাচ্ছিলাম না। পুনরায় নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে কাঁদতে লাগলাম। অরন্য বিয়ে করেছে ইতিমধ্যে সেটা কানেও এসেছে। আমার সাথে লুকিয়ে বিয়ের ছয়মাস পর এবং পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার একমাস পরেই সে বিয়ে করে নেয় অন্যত্র। আর আজকে আমার এ অবস্থা হলে এর দায়ভার কে নেবে। কার কাছে আমি মুখ দেখাব। আমার এ সন্তান জারজ নামে পরিচয় পাবে। আর অরন্য যদি চাপে পড়ে আমাকে এর জন্য বিয়েও করে সেখানে আমি বা আমার সন্তানের কোনো মূল্য থাকবে না। আর আমার সন্তান বারবার পরিচয়হীনতায় ভুগবে। আমিও প্রতিষ্ঠিত না যে এ বাচ্চার দায়িত্ব নেব। সব মিলিয়ে বেশ অস্থির লাগছিল তখন।
তবুও শেষবার অরন্যের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অরন্যের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলাম। সারারাত সেদিন এতটায় ছটফটানিতে কেটেছিল যে সেটা বলে প্রকাশ করার ভাষা আমার কাছে নেই। পরদিন নিজেকে সামলে নিয়ে টেস্ট করালাম পরিবারের থেকে লুকিয়ে। ক্লাস আছে বলে বের হয়ে হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করাই। টেস্ট করানোর পর, রিপোর্ট হাতে পেয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। কারণ রিপোর্ট পজিটিভ ছিল। হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়েই আমি কাঁদতে লাগলাম। এ বাচ্চাকে আমি দুনিয়া দেখাতে পারব না ভেবেই আকুল হয়ে যাচ্ছিলাম। অথচ এ বাচ্চা ছিল পবিত্র। তবুও আমি মা হয়ে এ বাচ্চাকে খুন করব। অসহায় হয়ে সেদিন কাঁদছিলাম। এ অসহায়ত্বের মাত্রা ছিল প্রখর।
বাসায় এসে সেদিন কী পরিমাণ কেঁদেছিলাম বলতে পারব না। সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকে কল দিলাম। সেও উপায় না পেয়ে বাচ্চা গর্ভপাত করাতেই বলল। হাতে তখন টাকা ছিল না। শুধু মোবাইলটা ছিল। এটা বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সেদিন রাতে কাঁদতে কাঁদতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরও বড় একটা ধাক্কা খেলাম। অরন্য তার স্ত্রী এর সাথে ঘুরতে গেছে আর সেটার ছবি ওয়ালে আপলোড দিয়েছে সেটার স্ক্রিনশট অরন্যের এক বন্ধু আমাকে পাঠাল। ছবিটা দেখে যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম সে আমার গিফট দেওয়া শার্ট পরে বউয়ের সাথে ঘুরতেছে এটা দেখে। অথচ ভাবনায় আসলো শার্ট টা পরতে তার হাত কাঁপলো না একবারও। একটা বারও আমার কথা মনে হলো না। দশ বছর তো কুকুর, বিড়াল লালন পালন করলেও মায়া হয় আর আমিতো জলজ্যান্ত মানুষ ছিলাম। তার কী শার্ট টা পরার সময় আমার কথা মনে হয়ে বুক কাঁপে নি । যে শার্ট টিফিন, রিকশা ভাড়া, বইয়ের টাকা থেকে কিছু বাঁচিয়ে, জমিয়ে ওর জন্য কিনেছিলাম। একদিকে ও নাফিসাকে নিয়ে ঘুরছে আর এদিকে আমি ওর চিন্হ বহন করে কাঁদছি। সেদিন মনে হয়েছিল দুনিয়া এত নিষ্ঠুর না হলেও পারত। অন্তত বাচ্চাটাকে পরিচয় দিতে পারত। অনেক কষ্ট হচ্ছিল। নিঃশ্বাস ভরী হয়ে যাচ্ছিল।
সেদিনেই আমার আইডিটা ডিএকটিভ করি। ১৭ হাজার টাকার মোবাইল এক বন্ধুর সাহায্যে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করি। আর নিজের জমানো কিছু টাকা গুছিয়ে আমার সন্তানকে এক সপ্তাহ পরে খুন করি। যেদিন সন্তান খুন করি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম মাতৃত্ব কতটা মূল্যবান একটা মেয়ের জন্য। কেউ বাচ্চা পায় না আর আমি আমার বাচ্চাটাকে পরিচয় দিতে পারব না বলে খুন করেছিলাম। নিজেকে সবচেয়ে পাপী মনে হয়েছিল। বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে পাগলের মতো করছিলাম । বারবার মনে হচ্ছিল কী করলাম আমি। কিন্তু হাত পা ছিল বাঁধা।
কথাটা মনে করেই আমি শুয়া থেকে দরফর করতে করতে উঠলাম। সহ্য হচ্ছে না আর। এ অতীত আমি ভুলতে চাই। কেন সে অতীতটা সামনে আসছে। কেন সে অতীতটা আমার বর্তমানের সুখটা গ্রাস করছে। কেন সে অতীতটা আমার গুছানো জীবনটা অগুছালো করছে। আমি এর উত্তর চাই।
আবার দরফর করতে লাগল বুক। আজকের মতো যদি সেদিন থাকতাম তাহলে আমার বাচ্চার পরিচয় আমি আদায় করে নিতাম। কিন্তু সেদিনের মানসিকতা আর পরিস্থিতি ছিল একদম বিপরীত যার জন্য এত নিকৃষ্ট কাজ করতেও আমি বাধ্য হয়েছিলাম। অরন্যের প্রতি তীব্র ঘৃনা বাড়তে লাগল।ঘৃনায় গা গুলিয়ে বমি আসা শুরু করল। পৃথিবীতে যদি আমি কাউকে ঘৃনা করি সেটা অরন্যকে। আর আজ এত বছর পরও অরন্য একটুও বদলায় নি আমাকে নিয়ে খেলার প্রবণতা এত বছর পরও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে।
মনে মনে এসব বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। নিজের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। নিভে যাওয়া আগুনটা যেন আবার জ্বলে উঠেছে।ছটফটানি বাড়তে লাগল আমার। সে সাথে মাইগ্রেনের চরম ব্যথা। মাথা দেয়ালে ঠুকতে লাগলাম অসহ্য এ যন্ত্রণায়। কড়া ডোজের ঔষধ সেবন করে মাথাটা খাটে এলিয়ে দিলাম। অনেক পরে ব্যথাটা মৃদু হলো। আর আমার চোখে হালকা ঘুম আসলো।
সেই সাথে সকাল হলো নতুন এক ব্যথার সূচনা নিয়ে। কারণ-
চলবে