প্রাক্তন পর্ব-০৪

0
1106

#প্রাক্তন
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৪

তবে এখন মনে হচ্ছে কোনো কোনো সময় অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে গিয়েও সময়ের পরিক্রমায় তা পুনরায় ব্যগরা দিয়ে বসে।

কারণ বক্সটা খুলে দেখলাম চারটা সাদা গোলাপ, চারটা চন্দ্রমল্লিকা,চারটা সূর্যমূখী ফুল দিছে। সে সাথে চারটা কিটকাট চকলেট। চারটা ছোটো টেডি। আমার প্রিয় কিছু জিনিস যেগুলো আমি অরন্যকে দিছিলাম। এতবছর পরও অরন্য জিনিসগুলো আগলে রেখেছে ভেবে কিছুটা বিস্মিত হলাম। বুঝায় যাচ্ছিল সে আমাদের বিয়ের চার বছর সিলেব্রেশন করেছে। কিন্তু এটা কেন সে করছে। সে বিয়ে করেছে চার বছর আগেই। আমার সাথে ওর লুকিয়ে বিয়ে হওয়ার বিষয়টা কেউ জানত না। ছয়মাস পড়েই অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের ব্যপারটা পরিবারকে না জানিয়েই আমরা পরিবার মানিয়ে নিয়েছিলাম। হুট করে তার কী অনুভূতি হলো জানি না সে বিয়ে টা ভেঙ্গে দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে। তখন আমার কাছে বিয়ের কোনো কাগজ ছিল না। কোনো প্রমাণ ও ছিল না। রাস্তাঘাট খুব একটা চিনতাম না তখন। কোন কাজী অফিসে গিয়ে যে বিয়ে করেছিলাম সেটাও বেমালুম ভুলে গেছিলাম। যেখানে বিয়ে করেছি সেটারেই প্রমাণ ছিল না সেখানে এ বিয়ে নিয়ে লড়াটা যুক্তিহীন মনে হয়েছিল। কারণ আমি লড়তে গেলেই তখন আইন আমার কাছে প্রামাণ চাইত। কিন্তু সে প্রমাণ আমার কাছে ছিল না। সব প্রমাণ ছিল অরন্যের কাছে৷

পরবর্তীতে অরন্যের অন্যত্র বিয়ের পর এ বিষয়টা আমি ভুলার চেষ্টা করেছি বহুবার। একটা সময় পর নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলাম। অরন্যের সাথে যোগাযোগ টাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল পুরোপুরি। তাই যেখানে বিয়ের অস্তিত্ব ছিল না সেখানে নতুন করে আমার ডিভোর্স দেওয়ার ও কোনো উপায় ছিল না। বলা যায় অনেকটা মাঝ নদীতে পড়ে ডুবে মরার মতো অবস্থা। এখন এত বছর পর অরন্যের হাবভাব দেখে কেন জানি না আমার কাছে ব্যপারটা বেশ স্বাভাবিক লাগছে না। বারবার বিষয়টা গোলমেল লাগছে। আবিরের সাথে অরন্যের যোগসূত্র কী। অরন্যই বা চারবছর পর অতীতটা সামনে আনতে কেন চাচ্ছে। যে অতীতটা সে নিজে বিলীন করে দিয়েছিল।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। বুঝতে গেলেও সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। অরন্যের প্রতি ঘৃনাটা আরও বাড়তে লাগল। এ মানুষটা সারাটা জীবন আমাকে কষ্টের অনলে পুড়িয়েছি। আর আজকেও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। আবিরকে আমার অতীত সম্পর্কে কিছুই বলে নি। কারণ আমি আমার অতীতটা নিচ্ছিন্ন করে সামনে এগুতে চেয়েছিলাম। আর সেটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবিরকে সবটা বলা দরকার। কিন্তু কীভাবে বলব। হাত পা কাঁপছে। জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার পরও যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় আবিরের কল আসলো। রাত তখন বারোটা। ভাবতে ভাবতে কখন যে এত রাত হয়ে গেছে খেয়ালেই করিনি। কলটা ধরে হ্যালো বলার আগেই অবির উচ্ছাস নিয়ে বলল

– অরন্য তোমায় কী দিয়েছে বললে না তো?

আবিরের কথা শুনে আমার বিরক্তি বেড়ে গেল। বিরক্তির সুরে বলে উঠলাম

– অরন্যকে ছাড়া কী আর কোনো কথা তোমার মুখে নেই? এ পাঁচ মাসে এ লোকটার কথা একবারও শুনলাম না। আর আজকে হুট করে তোমাদের সাথে উনি আসলো আর আসার পর থেকে শুধু উনাকে নিয়ে প্রসঙ্গ উঠছে। আমাদের আজকে এনগেজমেন্ট হয়েছে আবির। আমাদের নিজেদের কত কথায় থাকতে পারে। তুমি তা ‘ না করে শুধু অরন্য ভাইয়ার কথায় বলে যাচ্ছ। একই প্রসঙ্গে কথা আর ভালো লাগছে না আবির।

আবির আমার রাগের কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে অনেককটা চুপ থেকে বলল

– অপ্সরা তুমি হঠাৎ করে এভাবে রেগে গেলে কেন? অরন্যের সাথে তোমার আগে পরিচয় ছিল না তাই ওর কথা তোমাকে বলিনি। আর আজকে তোমাকে কী দিয়েছে জানার জন্য প্রশ্ন করলাম। এতে রাগ করার মতো কী বলেছি বুঝতে পারিনি। যদিও একটু ঝামেলা আজকে হয়েছে অরন্যের এক্সিডেন্ট এই সেই মিলিয়ে তবুও তো দিনটা ভালোই কেটেছে। আর আমি তো তোমাকে যতদূর চিনি অল্পতে বিরক্ত হয়ে যাওয়ার মেয়ে না। যথেষ্ট শক্ত এবং গুছালো মেয়ে। আজকে তোমার মধ্যে আমি কেন জানি না খুব অস্থিরতা আর বিরক্তি লক্ষ্য করছি। আমাকে খুলে বলো। তুমি যদি মনে চেপে রাখো আমি তো বুঝতে পারব না।

আমি কী আবিরকে সবটা বলে দেবো এখনি নাকি সময় নিব। স্থির হয়ে ভাবতে লাগলাম। ভাবনাটা ব্যাগরা দিয়ে আবির বলল

– কী হলো অপ্সরা কখন থেকে হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছি। চুপ হয়ে কী ভাবছো? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছো?

আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী জবাব দেবো। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বললাম

– আমার একটু ঘুমেই পাচ্ছে।

– আচ্ছা তাহলে ঘুমাও।

বলে ফোনটা রাখতে নিলে আমি আবিরকে ডেকে বললাম

– আমার কথায় কী রাগ করেছো?

– রাগ করিনি। তবে তোমাকে বুঝার চেষ্টা করেও আজকে বুঝতে পারছি না তাই নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে।

– থাক এত বুঝতে হবে না। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছিল তাই এমন করে ফেলেছিলাম। এখন একটু ভালো লাগছে। আচ্ছা আবির…

বলেই থেমে গেলাম। আবির আমাকে থেমে যেতে দেখে বলে উঠল

– কী বলবে বলো।

– কখনও যদি শুনো আমি তোমার কাছে কিছু লুকিয়েছি তুমি তা জানার পর কী করবে?

– লুকানো বিষয়টাতে যদি তুমি দোষী না হও। আর সেটা যদি তুমি তোমার সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য লুকিয়ে থাকো এবং আমার দিক ভেবে লুকিয়ে থাকো আমি ক্ষমা করে দেবো। কারণ মানুষের জীবনে এমন কিছু থাকেই যেটা একমাত্র সৃষ্টি কর্তা ব্যতীত আর কাউকে বলা যায় না। বলতে গেলেও বারবার আটকে যায়। কিন্তু হঠাৎ এমন বলছো কেন?

আবিরের কথাগুলো শুনে মনে বেশ শান্তি পাচ্ছিলাম। আবিরকে হালকা গলায় বললাম

– না এমনি। তবে কিছু যদি তোমার কাছে কখনও আড়াল করেও থাকি সময় সুযোগ বুঝে সঠিক সময়ে বলব। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো এমন কিছুই করব না যাতে করে তুমি কষ্ট পাও। একদম ঠকাব না তোমায়। কারণ ঠকানোর কষ্ট কতটা প্রখর সেটা খুব কাছ থেকে উপভোগ করেছি। তোমাকে একদিন বলেছিলাম না আজকের এ অপ্সরা এমনি এমনি নিজেকে গড়ে তুলে নি। বরং বাস্তবতার চরম আঘাতে নিজেকে শক্ত করে এ পর্যায়ে এসেছে।

– সে জন্যই তোমাকে আমার বেশি ভালো লেগেছিল। যদিও কারণটা বলো নি তবে যে মেয়ে একটা ধাক্কা থেকে নিজেকে শেষ করে না দিয়ে গড়ে নিতে পারে সে আর যাই করুক অন্যায় করবে না। আমি তোমাকে অনেক ভরসা করি বলেই তোমার প্রতিটা কথাকে সম্মান করি। অপ্সরা পাঁচ বছর যাবত হয়তো তোমাকে চিনি না, চিনি পাঁচমাস যাবত। তবে তোমাকে এতটা ভালোবেসেছি বুঝাতে পারব না। ভালোবাসতে যুগ যুগান্তরের সময় লাগে না কখনও কখনও ক্ষণিকের একটু দেখায় ভালোবাসা যায়। হাসপাতালে যেদিন তোমায় দেখেছিলাম সেদিন থেকেই তোমার প্রতি একটা দূর্বলতা কাজ করা শুরু করেছে। আর সে থেকেই এত কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা তোমায়। মানুষ বলে দূর্বলতা প্রকাশ করা উচিত না এতে অবহেলা বাড়ে। কিন্তু তোমার কাছে দূর্বলতা প্রকাশ করে দিলাম অবহেলা করো না।

– আবির… যে তোমাকে চায় সে তুমি দূর্বলতা প্রাকশ করার পর আরও আগলে রাখবে আর যে চায় না সে তুমি দূর্বলতা প্রকাশ না করলেও চলে যাবে। আমি তোমায় কথা দিলাম তোমাকে কষ্ট দিব না। তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করব৷ তোমার দূর্বল জায়গা নিয়ে খেলব না বরং ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবো। ঘুমাবে কখন?

– ঘুম তো উড়ে গেছে তোমার মিষ্টি কথায়। এত গুছিয়ে কথা বলো।

আমি মুচকি হাসলাম

– তুমিও তো কম কথা জানো না। এতক্ষণ তো ঘুমে গড়িয়ে পড়ছিলি এখন তো দেখি তোমার চোখের ঘুমও উড়ে গেছে।

– তা তো একটু গেছেই। আবির আকাশটার দিকে একটু তাকাও।

– বিছানায় আছি শুয়ে। জানালার পাশে যেতে হবে। ঠান্ডা, ঠান্ডা লাগছে একটু। বাইরে থেকে হালকা ঠান্ডা বাতাস ও আসছে। আর বিশেষ কথা অরন্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে কী যেন বিড়বিড় করছে। এখন ঐখানে যাওয়াটা কী ঠিক হবে।

আবিরের মুখে পুনরায় অরন্যের কথা শুনে একটু বিরক্তি আসলেও সামলে নিলাম। অরন্যের সাথে এখন আমার অদ্ভুত মিল আছে সে আকাশ দেখছে আর আমিও। আমি আবিরকে হালকা গলায় বললাম

– ভাইয়া কী তোমাদের সাথেই থাকে। আর ভাইয়াকে চেনো কতদিন যাবত?

– অনেকদিন। আর আমাদের সাথে থাকে না। আমাদের কমপ্লেক্সের পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। আগে পোস্টিং ছিল গ্রামে। দুই বছর চাকুরির পর ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে। এরপর থেকেই আমাদের পাশের কমপ্লেক্সেই থাকে।

– আজকে বাসায় যায়নি? উনার পরিবার কী চিন্তা করবে না?

– এখানে ও একাই থাকে। ওর বাবা,মা বাড়িতে থাকে। আর ভাই বোন গুলো যে জায়গায় পড়ে সে জায়গায় হোস্টেলে থাকে।

– উনার স্ত্রী?

আবির আমার কথায় আচমকা হেসে জবাব দিল

– ও তো এখনও বিয়ে করে নি। স্ত্রী আসবে কোথায় থেকে?

আবিরের মুখে কথাটা শুনে আমি চমকালাম। অরন্য বিয়ে করেনি এটা কী করে সম্ভব।৷ অরন্যের বিয়ের ছবি আমি নিজে দেখেছি। বিয়ের পর প্রতিদিন সে তার বউকে নিয়ে ঘুরতে যেত আর সেটার ছবি নিজের ওয়ালে দিত। আর সবাই সে ছবি আমাকে স্ক্রিনশট দিয়ে পাঠাত। এ ছবির অত্যচারে আমি আমার আইডি ডিএকটিভ রাখি বহুদিন। কারণ নিজেকে সামলে নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিই। সে সময় টা কাটিয়ে উঠা এত সহজ ছিল না। বলতে যতটা সহজ লাগে সংগ্রাম করাটা ঠিক তার বিপরীতে ছিল। অতীত ভুলাটা সহজ না।

“যে অতীতে একবার দাগ লেগে যায় সে অতীত ভুলা কঠিন।কাগজে যেমন পেন্সিলের দাগ টানার পর তা রাবার দিয়ে ঘষে তুলার পরও অস্পষ্ট দাগ বিদ্যমান থাকে। অতীতও ঠিক তেমন তাকে যতই মন থেকে মুছে ফেলা হোক না কেন অস্পষ্ট হয়ে সেটা মনের এক কোণে গেঁথে থাকে।”

আর আমি সে অতীতটাকে পেছনে ফেলে নিজেকে যোগ্য করে তুলি। কিন্তু আবির এসব কী বলছে। মিনেট পাঁচেক আমি চুপ। আবির কথা বলে যাচ্ছে হ্যালো হ্যালো বলছে আমি কিছুই বলছি না। কী বলব ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছি না। আবির একটু জোরালো গলায় বলল

– অপ্সরা তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো?

আমি এবার উত্তরে বললাম

– হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কী জানি বলতেছিলাম আমি?

– অরন্যের বিয়ে নিয়ে।

– হ্যাঁ। আচ্ছা উনাকে চেনো কতদিন যাবত?

– বারবার এত প্রশ্ন করছো কেন? ওকে আমি ছোট থেকেই চিনি।

বুঝতে পারলাম আবির একটু বিরক্ত হয়েছে।।এভাবে বারবার অরন্যের বিষয়ে জেরা করা উচিত হচ্ছে না। এ রহস্যের উদঘাটন আমাকেই করতে হবে। আমি আবিরকে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম

– ঘুম পাচ্ছে অনেক। ঘুমানো দরকার। মা কী কিছু বলেছে বাসায় গিয়ে?

– মা রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়েছে আমরা বাসায় আসি রাত সাড়ে এগারটায়। মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ এখনও হয়নি। হলে জানাব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আর অপ্সরা….

বলেই আবির থেমে গেল। আমি আবিরকে ডেকে বললাম

– বলো আবির কী বলবে?

– বড্ড ভালোবাসি তোমায়?

– আমিও বড্ড ভালোবাসি।

বলেই কলটা রেখে দিলাম। কাল কলেজে ক্লাস নেই। তাই দেরি করে ঘুমালেও সমস্যা হবে না। তবে অরন্য বিয়ে করেনি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। হুট করেই আমার আইডির ব্লক লিস্টে গিয়ে অরন্যের আইডিটা খু্ঁজতে লাগলাম। এতদিন ব্লক ছিল আর মুভ করার পর থেকে তার আইডি দেখার মতো রুচিও জাগে নি কখনও। তবে আজকে আইডিটা দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি সাথে সাথে ব্লক লিস্ট খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতেই অরন্যের আইডিটা দেখে আমি পুনরায় আশ্চর্য হলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে