#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩
চোখের জলটা মুছে দৌঁড়ে গেলাম গলির মাথায়। গলির মাথায় গিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। এপাশ ওপাশ তাকিয়েও আবিরকে পেলাম না। আবিরকে সাথে সাথে কল দিলাম। আবির কলটা ধরেই বলল
– তুমি কোথায়?
– আমি গলির মাথায়। তুমি কোথায় আর ঠিক আছো তো?
– আমি একটু সামনের দিকে। তুমি সামনের দিকে আগাও। আর কিছু ঠিক নেই। সব শেষ হয়ে গেল মনে হচ্ছে। অরন্যও যে কী করে বসে।
আবিরের কথাটা শুনে বুকটা মুচরাতে লাগল। চোখে মুখে শোকের গ্লানি ভেসে উঠল। পাগলের মতো গলির থেকে সামনের দিকে এগুলাম। গলির শেষ মাথায় তিন রাস্তার মোড়ে একটা বড় রেস্টুরেন্ট। সেটার সামনে যেতেই আচমকা পার্টি স্প্রে এর আক্রমণে মনে হচ্ছে সাদা মেঘে ভেসে যাচ্ছি। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে এসব। বাসায় গেলাম মাত্র আধা ঘন্টা হলো এর মধ্যেই এত জরুরী তলব এখন আসার পর এসব আচমকা পার্টি স্প্রে ছাড়ার কারণটা বুঝতে পারছি না। আমি বেশ রেগে গিয়েই চোখে মুখে থাকা পার্টি স্প্রেটা হাত দিয়ে সরিয়ে বললাম
– কী শুরু করেছো এসব? হুট করে এমন করে ডেকেছোই বা কেন? আবির বিষয়টা বেশ বিরক্তিকর লাগছে।
বলেই যখন আবিরের দিকে তাকালাম তখন খেয়াল করলাম অরন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমার জোরালো কন্ঠ শুনে অরন্যের পেছন থেকে আবির সামনে এসে বলল
– অপ্সরা রেগে গেলে নাকি?
– রাগব না তো কী করব বলো? এমনভাবে ডেকেছো আমি ভেবেছি কী না কী হয়েছে।৷ এসে দেখি এমন।আমি এর কোনো মানেই বুঝতেছি না।কতটা চিন্তিত ছিলাম আমি সেটা কী উপলব্ধি করতে পেরেছো?
আবিরের মুখটা চুপসে গেল। হালকা গলায় জবাব দিল
– অপ্সরা রাগ করো না। অরন্যের আজকে এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই ওর কাছে বারবার মনে হচ্ছিল আজকের দিনটা ওর এক্সিডেন্টের জন্য মাটি হয়ে যাচ্ছে। ও আগে থেকেই আমাদের জন্য প্ল্যান করে রেখেছিল।তবে এক্সিডেন্ট হওয়ার জন্য সে প্ল্যান সঠিক সময়ে কাজে লাগাতে পারে নি। তুমি হাসপাতাল থেকে আসার পর ওর খুব ইচ্ছা হলো আমাদের জন্য কিছু করার। তাই তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এভাবে আসতে বলল।
আবিরের মুখে কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার রাগটা সাথে সাথে দমে গেল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। মাথায় কিছুই কাজ করছে না। অরন্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে রহস্যময় হাসি দিচ্ছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই অরন্য বলে উঠল
– ভাবি আমি দুঃখিত যদি বিরক্ত করে থাকি। রাগানোর জন্য মোটেও এমন করি নি। আমি শুধু আপনাদের একটা সারপ্রাইজ দিতে এমন করেছি। আমি সত্যিই আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। বিষয়টা যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায় তাহলে আমাকে মাফ করে দিয়েন।
আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অরন্যকে না বুঝেই উত্তর দিলাম
– আমি একটু চিন্তিত ছিলাম। ভাবলাম আবিরের কিছু হয়ে গেল কী না। সে সাথে আপনিও অসুস্থ ছিলেন। তাই সবমিলিয়ে এমনটা আশা করতে পারে নি। তাই একটু উচ্চ সুরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। মনে করার কিছু নেই।
অরন্য আমার কথা শুনে মুখে হাসির রেখা টানল। মুখটাকে প্রশস্ত করে হাসি দিয়ে বলল
– তাহলে চলুন ভেতরে গিয়ে বসা যাক। আপনার জন্য বিশেষ একটা সারপ্রাইজ আছে।
আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম
– আবার কিসের সারপ্রাইজ। আর আপনার শরীর ঠিক আছে তো?
– আমার শরীর একদম ঠিক। ডাক্তারদের এত সহজে ভেঙ্গে পড়লে হয় না। ( বলায় তো হয়নি অরন্য পেশায় একজন ডাক্তার)।
পাশ থেকে আবির আমার হাতটা টেনে ধরে বলল
– হয়েছে সব বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। চলো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। অরন্য আমাদেরকে কী সারপ্রাইজ দেয় দেখি।
বলেই হাতটা টেনে রেস্টুরেন্টের দিকে যেতে লাগল।আমিও রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেলাম। রেস্টুরেন্টের এক কোণে আমি আর আবির বসলাম।অরন্য সে মুহূর্তে একটা কেক এনে বলল
– তোদের এনিভার্সারি সরি এনগেজমেন্ট উপলক্ষে একটা কেক আনলাম। অপ্সরাকে কেটে সিলেব্রেশন করতে বলবি। কেমন?
আবির উৎকন্ঠা নিয়ে কেকের বক্সটা অরন্যের হাত থেকে নিয়ে বক্সটা খুলল। বক্সটা খোলার সাথে সাথে আবিরের মুখটা মলিন হয়ে গেল। আবিবের মুখটা মলিন হতে দেখে আমি কিছুটা উৎসুক হয়ে কেকের দিকে তাকালম। কেকের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম।কারণ কেকে লেখা ” শুভ ৪র্থ তম বিবাহ বার্ষিকী”।
লেখাটা দেখেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। অরন্য কিসের সিলেব্রেশন করতে চাচ্ছে সে কী চার বছর আগে ঘটা বিয়ের সিলেব্রেশন করতে চাচ্ছে নাকি আমাদের এনগেজড এর। এসব ভাবতে ভাবতেই আবির অরন্যকে বলে উঠল
– কী রে অরন্য এ কেকের উপর এমন লেখা কেন?
অরন্য আবিবের কথায় সাড়া দিয়ে বলল
– কেন কী লেখা?
আবির অরন্যের দিকে কেকটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
– দেখ কী লেখা।
অরন্য কেকটা দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বলল
– হয়তো যারা লিখেছে তারা ভুল করেছে। এজন্যই সাথে দাঁড়িয়ে থেকে একটা জিনিস আনা উচিত।অনলাইনে অর্ডার দিলে এমনেই হয়। কী লিখতে বলে দিয়েছি আর কী লিখে দিয়েছে। এখন তো চাইলেও ঠিক করতে পারব না। এক্সিডেন্ট টা না হলে এমন হতো না।সব কাজে ঝামেলা হচ্ছে শুধু।
বলেই অরন্য উত্তেজিত হয়ে গেল।অরন্যের উত্তেজনা দেখে আবির অরন্যকে সাত্ত্বণা দিয়ে বলল
– এত রাগ করার মতো কিছু হয়নি।ভুল তো মানুষেই করে। হয়তো অন্য কাস্টমারেরটা ভুল করে এখানে লিখে ফেলেছে। সমস্যা নেই কেক তো কেটে খাবই।ভুল লেখা থাকলেই কী আর ঠিক লেখা থাকলেই কী। আমরা তো ভুল ঠিক জানি। কোনটা ভুল কোনটা ঠিক। আমরা বুঝে নিলেই হবে। তুই যে কষ্ট করে আমাদের জন্য এতকিছু করেছিস এটাই তো অনেক। ব্যপার না। এত প্যারা নিস না। আমি আর অপ্সরা কিছুই মনে করিনি।আমরা বিষয়টা ম্যানেজ করে নিচ্ছি।কী বলো অপ্সরা।
কথাটা শেষ করেই আবির আমার দিকে তাকাল।আবিরের চাহনী দেখে আমি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
– যা হয়েছে তো হয়েছেই। সমস্যা নেই এভাবে কেটে নিলেই হবে।
কথাটা বলা শেষ করতেই আবির আমার দিকে ছুরিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
– নাও। এবার কাটি চলো।
আমি ছুরিটা নিয়ে যখনই কেকটা কাটতে যাব ঠিক তখনেই আরন্য আটকে দিয়ে বলল
– একটু থাম আবির, ভাবির জন্য একটা উপহার আছে।
বলেই একটা বড় বক্স আমার দিকে এগিয়ে দিল। আবির বেশ উৎসাহ নিয়ে বক্সটা খুলতে গেলে অরন্য আটকে দিয়ে বলল
– আরে আবির গিফট টা আমি অপ্সরাকে দিয়েছি তোকে না। তুই পরে জেনে নিস কী দিয়েছি। আমার সামনেই বক্স খুলা শুরু করেছিস কেন? সত্যিই তুই কিছু বুঝিস না। বোকা বোকা কাজ করিস। বিয়ের এক্সসাইটমেন্টে ইদানীং একটু বেশিই বোকা হয়ে যাচ্ছিস।
অরন্যের কথা শুনে আবির মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমার দিকে তাকাল। গালটা হালকা ফুলা করে পরক্ষণেই গালের ভেতরের সবটা বাতাস বের করে বলল
– বাসায় গিয়ে বলো কিন্তু কী দিয়েছে। আর চলো কেকটা কেটে ফেলি।
আমি আর আবির কেকটাতে ছুরি লাগালাম। মনে হচ্ছিল ছুরিটা আমার বুকে আঘাত করছিলাম। কী থেকে কী হচ্ছে সব যেন এলোমেলো লাগছে। কেকটা কেটে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম। রাত তখন নয়টা বাজে। মায়ের কল পাওয়ার পর মনে হলো বেশ রাত হয়ে গেছে। আমি কলটা ধরতেই মা বলল
– কী রে কোথায় তুই? রাত নয়টা বাজে এখনও বাসায় আসছিস না।
– মা আবিরের সাথে। এইতো চলে আসবো এখনি।
– আবিরকে দে তো।
মায়ের কথা মতো আমি আবিরের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলাম। আবির মায়ের সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে বলল
– তোমার মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। চলো দিয়ে আসি তোমায়।
আমিও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। এর মধ্যে অরন্য বলে উঠল
– আবির তুই অপ্সরাকে দিয়ে আয়। আমি অন্য গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি।
– আরে বোকা তোকে একা ছাড়ব নাকি। এমনিই চুট পেয়েছিস। আমাদের সাথেই চল। অপ্সরাকে নামিয়ে আমি আর তুই চলে আসব।
অরন্য আর না করলো না। এর মধ্যে আবির বলল
– আমি ওয়াশ রুম থেকে আসতেছি একটু। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো অপ্সরা। দুই মিনিট লাগবে শুধু।
আমি মাথা নাড়লাম। আবির ওয়াশ রুমে গেল। অরন্য হালকা হেসে এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-চার বছর আগে যে ইচ্ছা পোষণ করেছিলে চার বছর পর সেটা পূরণ করে দিলাম। আমাদের চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী পালন করে ফেললাম। কেমন লেগেছে বলো?
আমার বুক তখন কাঁপতে লাগল। কেন জানি না সবকিছু একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আর এত দ্রূতই সবকিছু হচ্ছে যে কী করা ঠিক বা ঠিক না সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। এখনও আমার আর অরন্যের ডিভোর্স হয়নি। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ বা আইনের দৃষ্টিতে ও আমি আর অরন্য স্বামী স্ত্রী। যদিও সে সম্পর্কটাকে আমি মন থেকে ঘৃনা করি। সে সাথে অরন্যকে। তবুও কেন জানি না তার প্রতি আমার ক্ষীণ অনুভূতি চলে আসে। যদি তার প্রতি আমার অনুভূতির ঘর ভর্তি শূন্যতা থাকত তাহলে এতটা দূর্বলতা তার প্রতি এত বছর পরও কাজ করত না। কিন্তু যত দূর্বলেই আমি তার প্রতি হই না কেন মন থেকে আমি তাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করি। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী তাকে মনে করি। যে কী না আমাকে এতকিছুর পরও টাকার জন্য ছেড়েছিল। কিন্তু আজ চার বছর পর কেনই বা সে এমন করছে। হুট করে তার এ পরিবর্তন আমাকে একটু হলেও ভাবাচ্ছে। আমি চুপচাপ এসব ভেবে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যেই আবির এসে বলল
– চলো তাড়াতাড়ি।
তিনজনেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমি আর আবির সামনে বসলাম আর অরন্য পেছনে। আমি এবার কিছুটা ইচ্ছা করেই আবিরের কাঁধে মাথাটা হেলিয়ে দিলাম। আবির আমার মাথার সামনে থাকা কয়েকটা চুল আঙ্গুলে প্যাঁচ দিয়ে একটু টেনে পরক্ষণেই তা ছেড়ে দিয়ে বলল
– কী হয়েছে?
– মাথা ব্যথা করছে। একটু এভাবে থাকি।
আমি মোটেও আবিরের সাথে এত খোলামেলা ছিলাম না। আবিরের সাথে আমার পরিচয় পাঁচ মাসের। পাঁচ মাসে আবিরের সাথে বেশ ফ্রি হয়ে গেলেও এভাবে কখনও মাথা রাখে নি৷ আজকে হুট করে এভাবে মাথা রাখতেই আবিরও হালকা অবাক হলেও চুপ ছিল। আবির গাড়িটা স্টার্ট দিল। গাড়ির সামনের আয়নায় পেছনে থাকা অরন্যের মলিন মুখটা ভেসে আসছে। বেশ শান্তি লাগছে এখন।
বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে পা টা বাড়াতেই অরন্য পিছু ডেকে বলল
– ভাবি গিফট টা রেখে যাচ্ছেন।
বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকিয়ে গিফটটা হাতে নিলাম। তাড়াতাড়ি করে বাসায় এসে রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকেই শাড়িটা প্রথমে পাল্টে নিলাম। তারপর অনেকটা ফ্রেশ হয়ে বিছানার কাছে এসে বক্সটা খুললাম। বক্সটা খোলার পর আমার অস্থিরতা আরও বাড়তে লাগল। এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল সব। পুরনো অতীত,পুরনো স্মৃতি সব সামনে এসে জমা হলো। আগে সবাই বলত সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে যাবে। তবে এখন মনে হচ্ছে কোনো কোনো সময় অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে গিয়েও সময়ের পরিক্রমায় তা পুনরায় ব্যগরা দিয়ে বসে।
চলবে