#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা।
#পর্ব- ২
কিন্তু তিন থেকে চার বার কল দেওয়ার পরও আবির কলটা ধরল না। আমি ফোনটা পাশে রেখেই অস্থির মনে আকাশের দিকে তাকালাম। তিনটা বছর পর এমন আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছি মনে হচ্ছে। বাইরে থেকে মৃদু মন্দ বাতাস তখন শরীরে এসে ঝাঁপটা দিচ্ছিল। এর মধ্যেই ভাবি এসে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল
– কী ব্যপার ননদীনি চুপ কেন? আর আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েই বা আছো কেন? তবে আজকে একটা ব্যপার খুব অদ্ভুত লেগেছে।
আমি নিজের মনকে সামাল দিয়ে বললাম
– কোন ব্যপারটা?
– ঐ যে তোমাকে আংটি পড়িয়েছে পাত্রের পাশের ছেলে। আমার তো একদম বলে দিতে মন চেয়েছিল যে পাত্র ছাড়া পাত্রের পাশের জন কেন আংটি পড়াবে। আর বাবা, মা ও একদম চুপ কেন ছিল বুঝতে পারছিলাম না।ঐ মুহূর্তে কেন জানি না মনে হচ্ছিল সবাই চিন্তিত। এত ফ্যাকশে হয়ে ছিল কেন বলো তো?
আমি ভাবি কে কী জবাব দিব বুঝতে পারছিলাম না। সারা গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। ভাবি এ বাসায় এসেছে দু বছর যাবত। উনি অরন্যের ব্যপারে তেমন কিছুই জানে না। নীরবতা বিরাজ করছে চারদিকে। আমি নিশ্চুপ। ভাবি হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল
– কী ব্যপার এত চুপ কেন? কখন থেকে একা একাই বকে যাচ্ছি।
এর মধ্যেই আমার ফোনে কল আসলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম অবির কল দিয়েছে। ভাবির কথা উপেক্ষা করে ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনির দিকে এগুলাম। ভাবি তেমন কোনো কর্ণপাত না করে রুম থেকে চলে গেল। আমি বেলকনিতে গিয়ে কলটা ধরতেই আবির বলে উঠল
– অপ্সরা সরি। অরন্য হুট করে এক্সিডেন্ট করে বসে যার কারণে ঐ সময়টায় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কল ধরতে পারিনি।
অরন্য এক্সিডেন্ট করেছে শুনে বুকের ভেতরটায় তুলপাড় শুরু হয়ে গেল। পুরনো সে আবেগটা যেন মনে আবার বাসা বাঁধতে শুরু করলো। আমি অস্থির গলায় বললাম
– এখন উনার কী অবস্থা? আর কোথায় আছে?
– মাথায় হালকা চুট পয়েছে। আর এখন হাসপাতালে আছি একটু পর বাসায় যাব।
– কোন হাসপাতালে?
– তোমাদের বাসার কাছেই হাসপাতালে।
– আমি কী আসব?
– এখন আর তোমাকে আসতে হবে না। মা কে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। অরন্য একটু সুস্থ হলে ওকে নিয়ে আমি বাসায় চলে যাব।
– আসি একটু। তোমার সাথেও আবার দেখা হয়ে যাবে।
আবির হালকা হেসে জবাব দিল
– তা আমার সাথে দেখা করতে আসবে নাকি অরন্যকে দেখতে। মনে তো হচ্ছে অরন্য বাহানা মাত্র।
– তুমি যা ইচ্ছা ভাবো।
বলেই মুখটা গোমরা করে ফেললাম। আবির এবার হালকা গলায় বলল
– আচ্ছা আসো।
আমি আবিরের কথার কোনো জবাব দিলাম না। কলটা কেটে বেরিয়ে পড়তে লাগলাম।মা আমার পথ আটকে দিয়ে বলল
– কোথায় যাচ্ছিস?
– এই তো আবির কল দিয়েছিল। ওর সাথে একটু কথা আছে। সামনের গলিতে দাঁড়িয়ে আছে।
মা আমার দিকে তীব্র সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। মায়েরা হয়তো সত্যিই টের পায় সব। আমিও মায়ের দিকে তাকালাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে কটু গলায় বলল
– আমাকে আড়াল করছিস না তো কিছু?
– মা তুমিও না। এখন কী আড়াল করে কিছু করার বয়স আছে নাকি। চাকুরি করছি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। এখন তো সব বলেই করার বয়স।হুট করে এমন কথা জিজ্ঞেস করছো যে?
মা চোখটা অন্য দিকে নিয়ে বলল
– না কিছু না এমনি। যা তোর কাজে যা।
বলেই মা ঘরের দিকে পা বাড়াল। আমিও ঘর থেকে বের হলাম। অরন্য আসার ব্যপার টা আমার পরিবারে প্রভাব ফেলেছে সেটা বেশ ভালোই বুঝা যাচ্ছে। আমার পরিবার হয়তো বিয়েটা নাকোচ করে দিত। তবে আমার পছন্দে ওরা এসেছে তাই না করেনি। এ চার বছর আমাকে বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। কেন জানি না আবিরের সাথে কথা বলার পর তার প্রতি এক অদ্ভুত মায়া কাজ করেছিল তাই ফেলে আসা অতীতটা মুছে দিয়ে নতুন জীবনে পা রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে জীবনের শুরুতেই যেন অতীতটা আবার সামনে থুবরে পড়ল। ভাবতে ভাবতেই হাসপাতালের সামনে এসে আবিরকে কল দিলাম। আবির কল ধরে বলল
– তুমি বাইরে দাঁড়াও আমি আসছি।
বলেই কলটা কেটে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে হাজির হলো। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
– কী ব্যপার এত অস্থির কেন? একটু আগে দেখলে আবার দেখার লোভ সামলাতে পারো নি তাই না?
আমি ভ্রুটা কুচকে বললাম
– মোটেও তা না। তোমার বন্ধু অসুস্থ তাকে দেখতে আসলাম।
– কে বলেছে অরন্য আমার বন্ধু?
আবিরকে এবার জিজ্ঞেস করার মূখ্যম সুযোগ পেলাম অরন্য তার কী হয় জানার। আমি চট করেই জিজ্ঞেস করে বসলাম
– ভাইয়া তাহলে তোমার কী হয়?
– ও আমার আত্মার ভাই হয়।
– মানে?
– সে এক লম্বা কাহিনি। পরে একদিন বলব। আপাতত চলো।
আমি আবিরের কথার কোনো মানে বুঝতে পারছিলাম না। কিসের আত্মার ভাই। আবির মাঝে মাঝে এমন হেয়ালি করে কথা বলে যার কোনো মানে আমি বুঝতে পারি না। এর মধ্যেই আবির হাত টানতে টানতে অরন্যের সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। আমি অরন্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অরন্য আমার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন আবিরের জন্য পারছিল না। অরন্য কিছু বলার আগেই আবির বলে উঠল
– তোর ভাবি তোকে দেখার জন্য ছটফট করছিল। তাই চলে এসেছে। বুঝ এবার তোর হবু ভাবির তোর প্রতি কত টান।
অরন্য চুপ। আমি আবিরের কথায় ব্যাগরা দিয়ে বললাম
– সবসময় তোমার হেয়ালি চলেই। চুপ করো তো একটু।
এমন সময় একজন নার্স এসে আবিরের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল
– স্যার এ ঔষধ আর ইনজেকশনটা আনতে হবে।
আবির কাগজটা হাতে নিয়ে আমাকে এক কোণে বসিয়ে বলল
– তুমি একটু বসো আমি ঔষধ গুলো নিয়ে আসতেছি।
বলেই অাবির বাইরে গেল। আমি এক কোণে বসে আছি। কোনো কথায় আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। শুধু বের হচ্ছে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। এমন সময় অরন্যের কন্ঠ কানে আসলো। সে বলল
– কেমন আছো অপ্সরা?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম
– এই তো বেশ ভালো। আপনি?
– ভালো আছি।
– আপনার স্ত্রী নাফিসা কেমন আছে?
অরন্য এবার চুপ। আমার প্রশ্নে যেন সে দ্বিধায় পড়ে গেল। আমি তাকে দুটানায় পড়তে দেখে আবারও জিজ্ঞেস করলাম
– বললেন না তো কেমন আছে আপনার স্ত্রী ।
ও হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল
– ভালো আছে। আচ্ছা তুমি কী আজকের দিনটা ভুলতে পেরেছো?
– কেন আজকে কী কোনো স্পেশাল ডে ছিল নাকি?
– স্পেশাল কী না বলতে পারব না। তবে আজকে কত তারিখ বলো তো।
– ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ।
– লিপ ইয়ার তাই না?
– হুম লিপ ইয়ার, কেন?
– আজ থেকে চার বছর আগে আমরা এদিনে একটা কাজ করেছিলাম সবাইকে আড়াল করে আর বলেছিলাম চার বছর পর সিলেব্রেট করব। ভুলে গেছ?
অরন্যের কথাটা শুনে আমি থমকে গেলাম। শরীরটা মেজমেজ করতে লাগল। এখানে বসে থাকার রুচিও জাগছে না। অরন্যের প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ আমার সারা শরীরটা গ্রাস করছে। এত জঘন্য একটা মানুষকে আমি দেখার জন্য উতলা হয়ে পড়েছিলাম। আমার সারা শরীরে রাগটা ক্রমশ বাড়তে লাগল। কালো অতীতকে যতই ভুলতে চাচ্ছি ততই সেটা সামনে এসে চড়াও দিচ্ছে। অস্থিরতা কাজ করছে অনেক। নিজের অস্তিত্ব ক্রমশ বিলীন হতে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আগের ভয়ানক সময় গুলো চোখের সামনে ভাসছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সে মুহূর্তে আবির এসে বলল
– কী হলো যাচ্ছ কোথায়?
আমি হালকা গলায় বললাম
– ভালো লাগছে না বাসায় যাব। বলেই সামনের দিকে এগুলাম। আঁড়চোখে অরন্যের দিকে তাকালাম সে ও কোনো চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।
আবির আমার হাতটা টেনে বলল
– কী হয়েছে? আমাকে বলো।
– মাথাটা ঘুরাচ্ছে।
– দাঁড়াও আমি দিয়ে আসছি তোমায়।
– তোমাকে যেতে হবে না। তুমি রোগী সামলাও। আমি যেতে পারব।
বলেই তড়িঘড়ি করে কেবিন থেকে বের হলাম। তাড়াহুড়ো করে একটা রিকশা নিলাম। রিকশায় বসে আকাশটার দিকে তাকালাম। তারা গুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ভেতরটা কেন জানি এত আলোর মাঝে থেকেও অন্ধকারে ডুবে আছে। আমি চুপ হয়ে রইলাম খানিক্ষন। রিকশাওয়ালা মামা বাসার সামনে এসে বলল
– মামা চইলা আইছি নামেন।
মামার কন্ঠে আমি ভাবনার ঘোর থেকে বের হলাম। মামাকে ভাড়া দিয়ে বাসায় আসলাম। বাসায় আসার পর চার বছর আগের স্মৃতিটা সামনে ভাসতে লাগল।
সেদিন ছিল ২০১৬ সালের লিপ ইয়ার। অরন্য সবে চাকুরিতে জয়েন করেছে৷ আমাকে সারপ্রাইজ দিবে তাই হুট করে ঢাকায় আসে। আমি অরন্যের সাথে দেখা করতে গেলাম। অরন্য আমার কাছে এসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল
– তোমার জন্য চকলেট আনতে ভুলে গেছি।
– এ আর নতুন কী। সবসময় তো ভুলে যাও। এখন যাবে কোথায়?
– টি এস সিতে চলো। সেখানে তুমি আমাকে বাদাম ছিলে দিবে আর আমি খাব। পুডিং এনেছো তো?
– কখনও আনতে ভুল করেছি নাকি? এনেছি, ব্যাগেই আছে।
– তোমার বানানো পুডিং খেলে কী মনে হয় জানো?
– কী?
– মনে হয় বিষ খেয়েও অমৃত খাচ্ছি।
আমি রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম
– তার মানে আমি তোমায় বিষ খাওয়ায়?
অরন্য আমার হাতটা ধরে বুকের কাছে নিয়ে বলেছিল
– হয়েছে রাগ করতে হবে না। কারণ রাগ করার জন্যই বলেছি। রাগ করলে বেশ সুন্দর লাগে তোমায়।
আমি মৃদু হাসলাম। এবার একটা রিকশা নিয়ে রিকশায় উঠে টিএসসির দিকে এগুতে লাগলাম। বরাবরেই অরন্যের কাঁধে মাথা রেখে ওর গায়ের গন্ধটা আপন করে নিচ্ছিলাম। এমন সময় মাথায় কী ঝেঁকে বসলো জানি না হুট করেই বলে উঠলাম
– চলো বিয়ে করে নিই। আজকে তো লিপইয়ার। চার বছর পর আমরা বিয়ে সিলেব্রেশন করব। পালিয়ে বিয়ে করার খুব ইচ্ছা।
অরন্যও আমার দিকে তাকাল। হুট করেই রিকশাওয়ালাকে বলল
– মামা আশে পাশে কোনো কাজী অফিস থাকলে চলেন।
মামাও কাজী অফিসে নিয়ে গেল। আমি অরন্যের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালাম। সেদিন কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা করেও নিলাম। বিয়ে শেষে কাগজ পত্র গুলো অরন্যের কাছে রেখে দিলাম। আর অরন্যের দিকে যখন কবুল বলার পর তাকিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল দুনিয়ার সবচেয়ে শুদ্ধতম পবিত্র চাহনীটা চাহিয়াছিলাম। সে চাহনী টা এখনও সামনে ভেসে আসছে। ধুপ করেই বর্তমানে ফিরে আসলো মন। অস্থিরতা বাড়তে লাগল। বিয়ের ব্যপারটা এখন পর্যন্ত পরিবার জানে না। আর যেদিন অরন্য বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল সেদিনও কেন জানি না লুকিয়ে করা বিয়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে মন চাইল না। যেদিন শুনেছিলাম সে অন্যত্র বিয়ে করেছে সেদিন নিজের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে না চাইতেও মেনে নিতে হয়েছিল। ক্রমশেই চোখটা ঝাঁপসা হয়ে গেল। জলটা গাল বেয়ে পড়তে লাগল। অতীত থেকে যতই দূরে যেতে চেয়েছিলাম না চাইতেও অতীতটা সামনে এসে পড়ল। আর অরন্যই বা কেন সে অতীতটা আজকে মনে করিয়ে দিল। সে তো তার পছন্দ মতো ময়েে বিয়ে করে সুখে আছে। আজকে কেন এত বড় ধাক্কাটা আমাকে দিতে হলো। আমাকে ভালো থাকতে দেখে অরন্যের বরাবরেই ভালো লাগে না। যতবারেই ভালো থাকি ততবারেই সে একটু একটু করে বিশাল বড় একটা ধাক্কা দিত। আজকে চারটা বছর পর ওর সাথে দেখা আজকেও তার ব্যতিক্রম করল না। ক্রমশেই নিঃশ্বাসটা ভারী হয়ে যেতে লাগল। এমন সময় আবির কল দিল। আবিরের কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে আবির অস্থির গলায় বলল
– অপ্সরা একটু তাড়াতাড়ি আসো। ভীষণ বিপদে পড়েছি।
বলেই আবির কলটা কেটে দিল। এর মধ্যে ভাবি এসে বলল
– অপ্সরা আবির কল দিয়েছিল, তোমাকে আবার একটু গলির মাথায় যেতে বলেছে। অনেক ইমারজেন্সি বললো।
আমার বুকটা ছেদ করে উঠল। আবিরকে এতটা সিরিয়াস হতে কখনও দেখি। বিষন্ন মনটায় ছটফটানি বাড়তে লাগল। অরন্যের অবস্থা খারাপ হলো না তো? চোখের জলটা মুছে দৌঁড়ে গেলাম গলির মাথায়।
চলবে।