প্রাক্তন পর্ব-০১

0
2100

#প্রাক্তন
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা।
#পর্ব-১

আজকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসতেছে। বেশ সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন পাত্র পক্ষ আসবে দেখতে। অপেক্ষার প্রহর বেশিক্ষণ গুণতে হলো না। মিনেট পাঁচেকের মধ্যে পাত্রপক্ষ চলে আসলো। ঘরের দরজার ওপাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম পাত্রকে। এর মধ্যেই ভাবি এসে কানটা টেনে ধরে বলল

– কিছুক্ষণ পর তো দেখতেই পারবে এখন এত উতলা হচ্ছ কেন?

আমি আর কোনো কথা বললাম না। সরাসরি চুপ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ভাবি এসে আমার হাতে শরবতের গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে বলল

– যাও এবার সামনে যাও। আর মন ভরে দেখো।

আমি পাত্র পক্ষের সামনে গিয়েই কেঁপে উঠলাম। পাত্রের ঠিক পাশেই আমার প্রাক্তন বসে আছে।যার সাথে আমার সম্পর্কের ছেদ হয়েছে চার বছর হলো। তখন আমার বয়স ছিল তেইশ। আর আজকে সাতাশে পা দিয়েছি। তাকে দেখে শুধু আমি না আমার পুরো পরিবার অবাক হয়েছে। কারণ আমার প্রাক্তনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েও বিয়ের একদিন আগে বিয়েটা ভেঙ্গে গেছিল। কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না আবিরের সাথে অরন্যের যোগসূত্র কী করে? আবির হলো আমাকে দেখতে আসা পাত্র আর অরন্য হলো আমার প্রাক্তন। অরন্যকে দেখার পর তার চোখে আমার চোখ পড়ল। তার সে চেনা চোখ যেন আজ বড্ড অচেনা। কেন জানি না তার চোখে চোখ পড়তেই আগের সব সামনে ভেসে উঠল।আমি দ্রূত তার চোখ থেকে চোখটা সরিয়ে নিলাম আর সে ও নীচের দিকে তাকিয়ে পড়ল। তার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার পরিবারের দিকে তাকালাম।লক্ষ্য করলাম আমার মতো তারাও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও হয়তো জানত না আবিরের সাথে অরন্যের যোগসূত্র আছে। আমি চুপ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। শরীরে বল পাচ্ছিলাম না। হাত দুটো কাঁপতেছিল। এর মধ্যেই আবিরের মা বলে উঠল

– কী ব্যপার মা দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।

বলেই আবিরের ঠিক পাশে জায়গা করে দিল। আমি শরবতের গ্লাসটা রেখে যতই আবিরের দিকে এগুচ্ছিলাম বসার জন্য ততই বুকটা কাঁপতে লাগল। বেশ সাহস সঞ্চয় করে আবিরের পাশে বসলাম। আবিরের ঠিক পাশেই অরন্য বসা। আবিরের পাশে বসতেই আবিরের মা আমার থুতুনীটা ধরে মুখটা তুলে বলল

– বাহ! আমার মা তো দেখতে মাশআল্লাহ। আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে।

আবিরের মায়ের মুখে এমন প্রসংশা শুনার পর মন না চাইতেই আমার প্রাক্তনের মায়ের কথা মনে পড়ল যিনি কী না আমাকে বলেছিল আমার মুখটা গ্রাস কার্প মাছের মতো বড়। আমার গায়ের রঙ এই শুধু ফর্সা।আমার চেহারা ভালো না। আমি খাটো অথচ আমি লম্বায় আমার প্রাক্তনের সমান ছিলাম। প্রাক্তনের মায়ের সে কথাতে আমি তখন কোনোকিছুই বলে নি শুধু শুনে গিয়েছিলাম। মনে কষ্ট পেলেও মনকে বুঝ দিয়েছিলাম মায়েরা তো সন্তানকে কত কিছুই বলে। আর আজকে যখন আবিরের মা এত প্রসংশা করল তাও প্রাক্তনের সামনে নিজের চোখে জলটা ছলছল করতে লাগল। আমি নিজেকে চাইলেও সামলাতে পারছিলাম না। চোখের কোণে জমে থাকা জলটা এই বুঝি পরে যাবে। এবার উনি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– তা তোমার নাম কী মা?

আমি মৃদু গলায় জবাব দিলাম

– অপ্সরা।

– সত্যিই তো তুমি অপ্সরী। নামের সাথে রূপের অনেক মিল আছে। তা তুমি কী করতেছ?

আমি গলার সুরটা একটু নীচু করে বললাম

– কলেজে শিক্ষকতা করছি পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে। আর সে সাথে একটা ব্যবস্যাও আছে।

কথাটা বলার সাথে সাথে আবিরের মা বলে উঠল

– আমার ছেলের পছন্দ এত ভালো হবে বুঝতে পারেনি। তোমার যদি কিছু নাও থাকত তোমাকেই আমার বাড়ির বউ করে নিতাম। এত কিছু করো মাশআল্লাহ।

আবিরের মায়ের মুখে এ কথাটাও শুনার পর মনটা কেমন জানি আনমনা হয়ে গেল। অতীতে ডুবে গেলাম পুনরায়। চার বছর আগে আমার প্রাক্তন আমাকে বাদ দিয়েছিল আমি সাধারণ একটা ভার্সিটিতে পড়ি,কোনো জব করি না,আমার জীবনে আমি কিছু করতে পারব না সেজন্য। অথচ তখন আমার জীবনে চাকুরী বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছা ছিল না। শুধু ইচ্ছা ছিল অরন্যের বউ হব। ওকে নিয়ে সংসার করব। কিন্তু যেদিন অরন্য দশ বছরের সম্পর্ক বিয়ের আগের দিন এই কারণে ভেঙ্গে দিয়েছিল সেদিন আমি জানি কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম। এত অপমান সহ্য করেছিলাম যে চারপাশের সবাই আমাকে নিয়ে উপহাস করত। অথচ অরন্যকে ভালোবাসতাম সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে। তার যখন চাকুরী ছিল না তখনও আমি তারেই ছিলাম। আর তার চাকুরী হওয়ার পর সে হয়ে গেল অন্য কারও। স্বার্থপরতা কাকে বলে সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। অরন্যকে সেদিন বলেছিলাম আমাকে একটু সময় দাও। সময় দিলেই দেখবে ভালো কিছু করে দেখাতে পারব। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়েই দেখাব আমি। তিনটা বছর সময় দাও। সেদিন তার থেকে তিনটা বছর সময় আমি পাই নি। বরং শুনতে হয়েছে আমার দ্বারা কিছু সম্ভব না। কিছুদিন পর তার অন্যত্র বিয়ের খবরটা কানে আসে। মানতে খুব কষ্ট হয়েছিল। দশ বছরের সাধনার বস্তুটা অন্য কেউ সাধনা না করেই পেয়ে গেল সেটা মানতেই পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল আল্লাহ আমার দরখাস্তটা কেন কবুল করল না। অথচ যে মেয়ে অরন্যকে চায়নি সে পেয়ে গেল। কোনোভাবেই মনকে সেদিন বুঝাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। মা বুঝিয়ে বলল কষ্ট পেও না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাসার সবাই শাত্ত্বণা দিতে লাগল। দু একবার মরতে গেছিলাম কিন্তু পরিবারের জন্য বারবার ব্যর্থ হয়েছি। মানা বা সহ্যের বাইরে চলে গেছিল ব্যপারটা তবুও মেনে নিয়েছিলাম। আজকে আমি ঠিকেই প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা তবে সে আজ প্রাক্তন।

মনটা অস্থির হয়ে যাচ্ছে। হালকা হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ছি। আবিরের মা আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– চুপ কেন মা? আমাকে বুঝি শ্বাশুড়ি হিসেবে পছন্দ হয়নি?

আমি এবার অতীত থেকে বর্তমানে এসে মোলায়েম কন্ঠে উত্তর দিলাম

– তা কেন হবে মা? আপনাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।

আবিরের মা মৃদু হাসলো।

আবির পেশায় একজন গণপূর্ত ক্যাডার।আবিরের সাথে পরিচয় হয় একটা এক্সিডেন্টের মাধ্যমে।সেদিন আমি রাস্তা দিয়ে আনমনে হেঁটে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। হুট করে একটা গাড়ি এসে আমাকে ধাক্কা দেয়।তারপর কী হয় বুঝে উঠার আগেই আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই। গাড়িটা আবিরের ছিল। আবির গাড়ি থেকে নেমে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার চোখ মুখ তখন ঘোলা। ঘোলা চোখে আবিরকে শুধু দেখেছিলাম। আবির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর জ্ঞান ফেরার পর আবিরের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আমার পরিবার বলেছে আবির ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়েছে।তার জরুরি একটা কাজ আছে সে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সেখান থেকে সে আমার খোঁজ নেয়। তারপর ফোনে কল দেয় আর কিছুদিন কথা বলার পর আজকে পুরো পরিবার নিয়ে আসে। আবির আমার যোগ্যতা দেখেনি,রূপও না। তবে তার ভালো লাগার কারণটা আমি জানি না। শুধু অনুভব করতে পারি আবির আমাকে অনেক পছন্দ করে। আমার প্রাক্তনও একজন বিসিএস ক্যাডার ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা । সে আমাকে বাদ দেওয়ার আরেকটা কারণ ছিল আমাদের বন্ডিং নাকি স্ট্রং হবে না। কারণ আমি তখন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ছিলাম না। অনার্স পড়ুয়া একটা স্টুডেন্ট ছিলাম।আর সে তখন বিসিএস ক্যাডার। তাই সে এ বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বিয়ের ঠিক আগেরদিন। আর তখনই বিয়েটা ভেঙ্গে অন্যত্র বিয়ে করে নেয়।

অথচ সম্পর্ক ছেদের চার বছর পর এত সংগ্রাম করে সে পথ পাড়ি দিয়ে আজকে আমার বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছে অন্য একজনের সাথে আর আজকেই আমার কালো অতীতটা সামনে এসে হানা দিল। আবিরের মায়ের কথায় অতীতে ডুবে থাকা আমার মনটা বর্তমানে আসলো। আবিরের মা এবার সবাইকে বলল

– আমার তো মেয়ে বেশ পছন্দ হয়েছে। আপনারা বললে আজকেই রিং পড়িয়ে দিয়ে যাব। এ মেয়ে কে তো আমার আজকেই ঘরে নিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। তবে সব কিছু গুছানো হয়নি বলে পারলাম না।

আমার বাবা, মা কথাগুলো শুনে হাসি মুখে বলল

– এ তো খুশির কথা। আপনার যা মর্জি। মেয়ে তো এখন আপনারেই।

– তা তো ঠিকেই বলেছেন। আবিরের বাবা থাকলে আজকে অনেক খুশি হতো। আমি আমার ছেলেটাকে তার বাবার মৃত্যুর পর অনেক আদর যত্ন করে মানুষ করেছি। একটা মাত্র ছেলে আমার। আপনার মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার বাড়িতে তার কষ্ট হবে না। মা মেয়ে মিলে বেশ ভালো থাকব।

এরপর অরন্যের দিকে তাকিয়ে আবিরের মা বলল

– অরন্য পাত্রী পছন্দ হয়েছে তো?

আবিরের মা কথাটা বলার সাথে সাথে আমার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল।সেই সাথে আমার পরিবারেরও মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এমন একটা পরিস্থিতিতে এত বছর পর পড়ব বুঝতে পারি নি। কালো অতীতটা কাটিয়ে উঠার পরও যেন আজকে আবার সামনে এসে পড়ল।

আমি অরন্যের দিকে তাকালাম। অরন্যও আমার দিকে তাকাল। তার চোখে চোখ পড়তেই সে পুরনো ভালোবাসাটা চড়াও দিয়ে উঠল। হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। হার্টবিট বেড়ে যেতে লাগল। ঘামতেও লাগলাম। অরন্য চাপা গলায় জবাব দিল

– আমি তো আগেই বলেছিলাম আন্টি, আবিরের পছন্দ খারাপ হবে না। সব দিক দিয়েই পারফেক্ট মাশআল্লাহ।

অরন্যের কথা শুনে ভেতরে একটা ব্যাঙ্গ হাসি উঠল। একসময় যে বলত আমি ইমপারফেক্ট আমারা দ্বারা কিছুই হবে না। আজ সে বলছে আমি পারফেক্ট। আবিরের মা অরন্যের কথা শুনে আবিরের দিকে আংটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– আবির অপ্সরাকে পড়িয়ে দে তো।

আবির আংটিটা নিয়ে পড়াতে নেওয়ার সময় বাসার বিড়ালটা আবিরের পাশ ঘেষে যায়। ফলে আংটিটা আবিরের হাত কেঁপে নীচে পড়ে যায়। আংটিটা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অরন্য আংটিটা তুলে আবিরের দিকে বাড়িয়ে দিল। আবির একরাশ হেসে আমার হাতটা ধরে অরন্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– নে পড়া। আমি তো হাত ধরেই আছি। বিড়ালটা এমন সময় এমনভাবে আসলো হাতটা কেঁপে উঠেছিল। আমি আবার পড়াতে নিয়ে পড়ে যায় কী না ভয় লাগছে। তুই এই পড়া।

অরন্য আবিরের কথার জবাব না দিয়েই আমার হাতে আংটিটা পড়িয়ে দিল আর আবির হাতটা ধরে রাখল। এদিকে কেন জানি না বিষয়টা বেশ অসহ্যকর লাগতে লাগল৷ আমি নিজেকে তবু সামলে নিলাম।

আবিরের মা বেশ খুশি৷ আমার বাসার সবাই খুশি। আবির,অরন্য আর আমার হবু শ্বাশুড়ি আংটি পড়ানো শেষে নাস্তা করে বিদায় নিল।

আর আমি ঘরে এসে কাপড়টা না পাল্টেই জানালার পাশে বসলাম। আগের অতীতটায় কেন জানি ডুব দিতে মন চাচ্ছিল। কত ভালোবাসা আর আবেগ ছিল তখন। সেদিন ভালোবাসাটা হেরে গেছিল টাকার কাছে। কত ভাবনা মনে আসছে। অরন্য আবীরের কী হয়? সে প্রশ্নও বারবার মনে আসছে। প্রশ্নটা মনে আসতেই মনে হলো আবিরকে কল দিয়ে জানা দরকার অরন্য কী হয় তার। সাথে সাথে আবিরকে কল দিলাম। কিন্তু

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে