প্রনয়ের দহন পর্ব-৫১+৫২

0
726

#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৫১

আজ থেকে শুরু হলো তীরের বিয়ের সকল আয়োজন। সকাল থেকে শুরু হয়েছে মেহমানদের আনাগোনা। তীর দু হাতে মেহেদী দিয়ে বসে আছে। মেহেদী আর্টিস্ট তীরের হাতে বরের নামের প্রথম অক্ষর লেখতে চেয়ে ছিলো কিন্তু তীর লিখতে দেয় নি। এই‌ হাতে ইশানের নামের অক্ষর ছাড়া অন্য কারোর নামের অক্ষর লিখাবে সেটা কল্পনাতেও আনে নি। তার চেয়ে কারোর নাম না লেখাটাই শ্রেয় মনে করলো তীর। তাই মেহেদী আর্টিস্টকেও না করে দিয়েছে কোনো নামের অক্ষর না লেখার কোনো দরকার নেই।

তীর এক ধ্যানে মেহেদী রাঙা দু হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দিনটা নিয়ে কতো শত স্বপ্ন ছিলো তীরের। সেই স্বপ্ন গুলা‌ সত্যি হচ্ছে কিন্তু সেটা ইশানের সাথে পূরণ করতে চেয়েছিলো অন্য কারোর সাথে নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলো না। ভাগ্য তো আর পরিবর্তন করা যায় না ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। এসব ভেবে তীরের চোখ থেকে দু ফোঁটা নোনা জল বেয়ে পড়লো মেহেদী রাঙা হাতের উপরে।

এমন সময় ইশা আর নীরা ঘরে প্রবেশ করলো ঘরে। তীর ওদেরকে দেখার সাথে সাথে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে চোখের জলটা মুছে নিয়ে বলল।

–এতো লেইট করলি কেন তোরা আসতে?

ইশা মুচকি হেসে তীরের পাশে এসে বসে বলে।

–সরি রে ওদিকের সব কিছু সামলে আসতে আসতে লেইট হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম তোর বিয়েতে আসবো না কিন্তু পরে ভাবলাম আমার বেস্টুর বিয়ে আর আমার ভাইয়ের বিয়ে,,,,,,

তীরের ভ্রু কুচকে আসে‌ ইশার কথা শুনে। ইশা তীরকে কিছু বলতে না দিয়ে বলা শুরু করে।

–না মানে আকাশ ভাইয়ের সাথে বিয়ে আর আমি আসবো না তা কি করে হয়? দেখি তোর মেহেদী পড়ানোটা কেমন হয়েছে?

ইশা মেহেদীতে নজর বুলিয়ে ভ্রু কুচকে তীরের দিকে তাকিয়ে বলে।

–কি রে তোর হাতে বরের নাম লিখলি না‌ কেন?

তীর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ভার গলায় বলে।

–এমনি লিখি নি।

ইশা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসিহাসি মুখ নিয়ে বলে।

–বুঝেছি,, বুঝেছি যাতে বর নিজের হাতে ওনার নাম লিখে দিতে পারে তোর হাতে তার জন্য লিখিস নি তাই তো।

তীর বিস্মিত নয়নে তাকায় ইশার দিকে। এই মেয়ের কথাবার্তা কেমন জানি সন্দেহ জনক লাগছে তার কাছে। যে মেয়ের এই বিয়েতে কোনো আগ্রহ ছিলো না সে হঠাৎ করে এমন কথা বলছে কেন? মাথা টাথা কি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? তীরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দু ভ্রু নাচিয়ে ইশা বলে।

–কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

–তুই এভাবে কথা বলচ্ছিল কেন?

–সন্দেহ হচ্ছে তো তোর, হওয়ারেই কথা আমি হঠাৎ এভাবে কথা বলছি কেন? আসলে কি বলতো গতকাল রাত্রে আমি শুয়ে শুয়ে অনেক চিন্তা করলাম তোর সাথে আমার বজ্জাত ভাইটার বিয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে।

তীর চমকে ইশার দিকে তাকায়। এই যেন অন্য এক ইশা বসে আছে তার সামনে। ইশা আবারও বলা শুরু করে।

–শোন এটা তো তুই স্বীকার করতে বাধ্য আমার ভাই একটা হিটলার। আর এই হিটলার নামটা তো তুই দিয়েছিস ভাইয়াকে। তাই এখন দেখ তোর সাথে যদি ভাইয়ার বিয়ে হতো তাহলে তোর জীবন ভাইয়া একেবারে ত্যনাত্যানা বানিয়ে ফেলতো। তার চেয়ে ভালো তুই‌ আকাশ ভাইয়াকেই বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার কর। আকাশ ভাই এতো ভালো ছেলে তুই জীবনেও খুজি পাবি না।

তীর অবিশ্বাস্য স্বরে বলে।

–হে..

–হে না হুম।

ইশা তীরের কদোকাদো মুখটা দেখে খুব হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোনো মতে হাসিটা চাঁপিয়ে রাখছে। এর মাঝে নীরা বলে উঠে।

–এই তুই চুপ করবি। আর যে কাজটা করতে এসেছিস সেই‌‌ কাজটা কর চুপচাপ এতো কথা না বলে।

–আরে বাবা করছি তো এভাবে বলার কি আছে আজব।

তীরের কষ্টে বুকটা ফাইট্ট যাইতাচ্ছে। শেষে কিনা ইশাও তাকে‌ এই‌ বিয়ে করতে বলছে। তীর মুখ যতোই বলুক না কেন ইশানকে সে তার জীবনে আর আসতে দিবে না। কিন্তু‌ এই‌ অবাধ্য মনটাকে এই অবাধ্য নি’ষ্ঠু’র মনটাকে তো সে কোনো মতেই বুঝাতে পারছে‌ না। বার বার ইশানের স্মৃতি বেহায়া মস্তিষ্কটা মনে করিয়ে দিছে।‌ চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাদের সুন্দর মুহূর্তগুলো। তীরের এখন মন চাইছে এই দুনিয়া ত্যাগ করে চলে যেতে। তাহলে যদি একটু শান্তিতে থাকতে পারে অসহ্য।

তীরকে সুন্দর করে আটপৌরে ভাবে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে ইশা। তীরের পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছে নীরা। আজকে পার্লার থেকে কোন লোক আনা হয় নি। একে বারে বিয়েতে সাজাতে আসবে তারা তীরকে। তাই ইশা আর নীরা মিলে তীরকে হলুদের সাজে সাজানোর দায়িত্ব নিলো। কাঁচা গাঁদা ফুল দিয়ে তীরকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। সম্পূর্ণ সাজ কমপ্লিট হওয়ার পর তীর আয়নার দিকে তাকাতেই নিজেকে দেখে নিজেই চমকে‌ যায়। অন্যরকম এক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। ইশা তীরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে।

–আজকে ভাইয়া তোকে দেখলে নিশ্চিত টা’সকি খেয়ে পড়ে যাবে।

তীর ইশার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। ইশা আমতা আমতা করে বলে।

–না মানে আকাশ ভাইয়ার কথা বলচ্ছিলাম আর কি। এখন তাড়াতাড়ি নিচে চল সবাই ওয়েট করছে হয়তো আমাদের জন্য।
______

তীর নিচে নামার সাথে সাথে পা‌ জোড়া থেমে যায় হেঁটে আসা হলুদ পাঞ্জাবি পড়া এক মানবকে দেখে। তীর‌ যেমন ভাবে থেমে গিয়েছে অন্য দিকে সেই মানবটাও তীরকে দেখার সাথে সাথে পা জোড়া থেমে যায়। চোখ আটকে যায় সামনে দাঁড়ানো হলুদ রঙে মোড়ানো মানবীটাকে দেখে। বুকের ধকধক শব্দটা ইশান স্পষ্ট শুনতে পারছে। বার বার মনে করিয়ে দেয়‌ এই সেই রমণী যাকে দেখলে তার দিন দুনিয়া ওল্টপাল্ট হয়ে যায়। তখন বুকের ধকধক শব্দটা এই সম্মোহনী নারীর নাম ঝপ করে। অন্য দিকে তীরও এক ধ্যানে তার সুদর্শন প্রেমিক পুরুষটার দিকে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে। হলুদ পাঞ্জাবিতে যেন আরো সুদর্শন লাগছে শ্যামবর্ণের পুরুষটাকে। দু হাতের পেশি গুলো দৃশ্যমান হয়ে ফুলে আছে। তীর বেশিক্ষণ ইশানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে‌ কিন্তু ইশানকে দেখার ইচ্ছেটা যেন কমছে না বরং বাড়ছে। আবারো‌ তীর‌ মাথা তুলে‌ ইশানের দিকে তাকালো। ইশানের স্থির চোখে আবারোও নজর আটকে গেলো। বরা বারের মতোই ইশানের চোখের চাওনি তীরকে কিছু বলতে চায় কিন্তু বোকা তীর কিচ্ছু বুঝতে পারে না কিচ্ছু না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেই হয় না সেই চোখের ভাষাও পড়তে হবে।

ইশা বান্ধবী আর ভাইয়ের চোখাচোখির চাওনি দেখে বাঁকা হেসে চিৎকার করে ভাইয়া বলে ডেকে উঠে। ইশার এমন ভ’য়ংক’র চিৎকার শুনে তীর আর ইশান দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাথেসাথে নজর‌ ফিরিয়ে‌‌ নেয়। তীর এলোমেলো ভাবে চারদিকে নজর বুলায়। এখন নিজেকে নিজেরেই চ’ড় মারতে ইচ্ছে করছে এভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকার জন্য। এটার কি কোনো মানে আছে যত্তসব আজাইরা? ইশানও পাঞ্জাবির উপরের বোতামটা খুলতে খুলতে চলে যায় শাপলা বেগমের রুমে। হঠাৎ করেই কেন জানি ইশানের প্রচুর গরম লাগছে। মন চাইছে কারোর শীতল স্পর্শ সারা গায়ে মাখতে তাহলে যদি এই গরম অনুভুতিটা একটু হলেও কমে। কিন্তু সেই শীতল স্পর্শ পেতে হলে যে ইশানকে আরো‌ কয়েক প্রহর অপেক্ষা করতে হবে।
______

ইশান মাথা নত করে শাপলা বেগমের রুমে বসে আছে। শাপলা বেগম অবাক স্বরে বলেন।

–তুমি যা বলছো তা কি সত্য নানা ভাই।

ইশান ঘাড় বাঁকিয়ে বলে।

–হুম নানু সব এভিডেন্স পাওয়ার পরেই‌ আমি আপনার কাছে এসেছি। চাইলে‌‌ আন্টির কাছে গিয়ে এসব বলতে পারতাম আমি কিন্তু আন্টিকে এসব বললে‌ হয়তো এক্ষুণি বিয়েটা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি চাই না এই বিয়েটা এক্ষুণি থেমে যাক।

বলেই থেমে যায়। ইশানকে থেমে যেতে দেখে বলে।

–তুমি এখন কি চাও নানা ভাই?

ইশান নিঃশব্দে হেসে বলে।

–ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেতে হলে একটু বেহায়া,,,না একটু নয় অনেকটাই বেহায়া হতে হয় জানেনেই তো। তাই আমিও বেহায়া‌র মতো আপনার কাছে আসলাম আপনার নাতনীকে সারা জীবনের জন্য নিজের করে পাওয়ার জন্য।

শাপলা বেগম বিস্মিত নয়নে তাকায় ইশানের দিকে। তবে কি তার মনের আশা পূরণ হতে যাচ্ছে। এসব ভেবে শাপলা বেগমের কুচকে যাওয়া ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। ইশান তা দেখে অবাক হয়ে বলে।

–কি হয়েছে নানু আপনি হঠাৎ হাসচ্ছেন কেন?

–হাসছি তার কারণ হলো আমার মনের বাসনাটা যে এভাবে তুমি পূরণ করবে তা কখন ভাবে নি।

ইশান ভ্রু কুচকে বলে।

–কি বাসনা নানু আপনার?

–তোমার সাথে তীরের বিয়ে দেওয়া এটা আমার বসনা। কিন্তু মাঝখানে আয়েশা সব গন্ডগোল পাকিয়ে দিলো। এমন কি আমাকেও কথার বেড়াজালে আটকে দিলো যাতে কিছু না করতে পারি। কিন্তু দেখো খোদার কি লিলা আয়েশা তীরের জন্য যে ছেলেটা ঠিক করেছে সেই ছেলেটার মাঝে‌ এতো বড় একটা খুদ ধরা পড়ে গেলো।

ইশান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তাহলে সে ঠিক জায়াগাতেই এসেছে এবার শুধু সঠিক সময় আসার পালা। শাপলা বেগম পুনরায় বলেন।

–চিন্তা করো না নানা ভাই তীরের বিয়ে তোমার সাথেই হবে। আমি তোমার পাশে আছি।

ইশান সৌজন্যমূলক হাসি দেয়। আহমেদ পরিবারের বড় সদস্যকে যখন নিজের পাশে পাচ্ছে তখন আর কিসের চিন্তা।
_____

–মিস্টার আকাশ শেখ আগামীকাল আপনি যদি বিয়ে করতে আসেন তীরকে তাহলে কিন্তু আপনার বড়সড় ধরণের একটা ক্ষ’তি হয়ে যাবে।

অচেনা একটা নাম্বার দেখে‌ এমন হু’ম’কি শুনে আকাশ কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে স্বাভাবিক করে‌ হাতে ধরে রাখা ড্রিংকের গ্লাসটা টেবিলের উপরে রেখে বাজখাই গলায় বলে।

–এই‌ কে‌ আপনি এভাবে রাত বিরাতে হু’ম’কি দিচ্ছেন।

লোকটা বাঁকা হেসে বলে।

–আমি…মনে করে নিন‌ আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী যে আপনার ভালো চায়।

–শুনন আমার ভালোটা আমাকে বুঝতে দেন। আর আমি কাকে বিয়ে করবো না করবো সেটা আপনাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। এাব না ভেবে নিজের চড়কায় তেল দেন।

–নিজের চড়কায় তো তেল দিচ্ছি।

–এই‌ আপনি ফোন রাখেন তো আজাইরা পাবলিক।

–ওকে ফাইন নিজের ভালোটা পাগলও বুঝে কিন্তু আপসোস আপনি বুঝতে চাইচ্ছেন না। তবে সর্তক বার্তাটা দিয়ে দিলাম তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন।

বলেই ফোন কেটে দেয়। আকাশ বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে বিয়ের আগের রাতে এভাবে কেন একজন আগন্তুক তাকে হু’ম’কি দিছে। তবে আকাশের সন্দেহ হচ্ছে ইশানকে নিয়ে ইশান আবার বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য এমন হু’ম’কি দেয় নি তো। হু’ম’কি দিলেই বা কি আকাশ এসবের পরোয়া করে না। সে সাহসী ছেলে। সে তীরকে বিয়ে করবেই করবে যা কিছু হয়ে যাক না কেন?

____

রিফাত কানের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে পা উপর পা তুলে বসে থাকা ইশানের দিকে পূর্ণ নজর দিয়ে বলে।

–ইশান তুই ঠিক কি করতে চাইচ্ছিস আমাকে পরিস্কার করে বলবি প্লিজ। আর এভাবে আমাকে দিয়ে ওই আকাশকে হু’ম’কি বা কেন দেওয়ালি। তুই ঠিক কি করতে চাইছিস ইশান? তোকে আমার সুবিধার লাগছে না।

ইশান রহ’স্য’জনক এক হাসি দিয়ে বলে।

–সেটা জনতে হলে কালকের জন্য যে তোকে অপেক্ষা করতে হবে।

–পারবো না অপেক্ষা করতে এক্ষুণি বল।

ইশান বসা থেকে দাঁড়িয়ে শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলে।

–এত অধৈর্য হলে‌ চলে একটু ধৈর্য ধর। কথায় আছে না সবুরে মেওয়া ফলে।

–তার মানে তুই বলবি না আমাকে।

ইশান রিফাতের কাছে এসে রিফাতের কাঁধে হাত রেখে বলে।

–আরেকটা কাজ আছে সেটা এখন কমপ্লিট করতে হবে আমাকে তাই এখন আমাকে যেতে হবে।

বলেই হাটা ধরে। রিফাত জোরে বলে।

–এখন আবার কি কাজ বাকি আছে তোর।

ইশানও দরজা খুলে বের হতে হতে বলে।

–সেটা সিক্রেট।

ইশান চলে যেতে রিফাত চেয়ারে বসে বিড়বিড়িয়ে উঠে।

–এই ছেলে আগামীকাল নিশ্চিত বিনা সংকেতে ঝ’ড় তুলতে চলেছে। না জানি কালকে কি হয়?

বলেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে।

_____

তীর ক্লান্ত মস্তিষ্ক আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিভোরে ঘুমাচ্ছে। ইঠাৎ করেই মনে হচ্ছে যেন কেউ ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে‌‌ আছে। তীর চাইলেও চোখ মেলে তাকাতে পারছে না শতো চেষ্টা করেও বার বার বৃথা হচ্ছে। তীর বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে নেয়। তা দেখে তীরের পাশে বসা মানুষটা নিঃশব্দে হেসে উঠে। তীর হঠাৎ করেই অনুভব করে তার কপালে উষ্ণ নরম এক ছোঁয়ার অনুভতি। আর সারা মুখে আছড়ে পড়ছে তার গরম নিঃশ্বাস। এর মাঝে আবারোও অনুভব করে নাকে‌ শীতল স্পর্শ। ডান হাতে অনুভব করলো খুচা খুচা জাতীয় কিছু একটা। সে কি কোনো বাজে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তবে তার সাথে ঘটছে। এবার ভয়ে তীরের শরীর ঘামছে চোখমুখ খিঁচে রেখেছে। তীর এসব আর সইতে না পেরে নিজের সাথে যুদ্ধ করে এক চিৎকার দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। তীরের চিৎকার শুনে ইশা বেলকনি থেকে দ্রুত পায়ে এসে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে তীরের পাশে বসে বলে।

–কি হয়েছে? এভাবে চিৎকার করলি কেন?

তীর ইশার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে।

–কোথায় ছিলি তুই এতক্ষণ?

–বেলকনিতে ছিলাম।

–বেলকনিতে কি করছিলি?

–ফোনে কথা বলচ্ছিলাম আর তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? হয়েছেটা কি?

তীর ঢোক গিলে বলে।

–একটু আগে মনে হচ্ছিলো যেন কেউ আমার কাছে ছিলো আমার খুব কাছে।

তীর কপালে আর নাকে হাত দিতে দিতে বলে।

–আমার কপালে কিছু একটা ছুঁয়ে দিয়েছিলো। আর নাকে, নাকে ঠান্ডা কিছু লাগিয়ে দিয়েছে দেখ।

ইশা তীরের নাক দেখে বলে।

–কই কিছুই তো নেই। তুই স্বপ্ন দেখছিলি তীর।

–না এসব বাস্তবে ঘটছিলো আমার সাথে।

–তোর বিশ্বাস না হলে গিয়ে দেখ তোর নাকে কিচ্ছু নেই হলুদের রঙ ছাড়া।

তীর বসা থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে ইশার কথাই সঠিক। কিন্তু তার নাকে তো কেউ হলুদ ছোঁয়ায় নি তাহলে নাকে হলুদ রঙ হলো কি করে? তীর তড়িৎ বেগে বলে।

–নাকে তো কেউ হলুদ ছোঁয়ায় নি তাহলে নাকের ডগা হলুদ হলো‌ কি করে?

–তীর‌ তোর কি মাথাটা কি পুরাটাই গেছে ভাইয়ার শোকে। মনে নেই আমি তোর গাল থেকে হলুদ এনে তোর নাকে দিয়েছিলাম মজা করে।

–কিন্তু।

–আর একটাও কথা নয়। সারা দিন অনেক খাটাখাটনি গেছে তাই চুপচাপ ঘুমা এসব ভুলভাল না জপে।

বলে ইশা ঠোঁট চেঁপে হেসে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। তীর ঠোঁট ফুলিয়ে ডান হাতটা সামনে ধরে। তার সাথে কি সবটাও বাস্তবে ঘটেছে নাকি সবটা স্বপ্ন ছিলো। তীর কি সত্যি ইশানের শোকে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তীরের ভাবনার মাঝে ইশা বলে।

–লাইট অফ করে চুপচাপ ঘুমা।

তীরের আর কি করা লাইট অফ করে শোয়ে পড়ে। কিন্তু মন বলছে এটা স্বপ্ন ছিলো না তার সাথে বাস্তবে ঘটেছে।
______

ইশান দু হাত মাথার নিচে রেখে ছাদের ফ্লোরে শুয়ে আছে। দৃষ্টি তার দুর আকাশের চাঁদটার দিকে আর মুখে মিটিমিটি হাসি। আজকে ইশান খুব খুশি খুব। ইচ্ছে করছে আকাশ ফাঁটিয়ে হাসতে। ইশান চট করে উঠে বসে। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দ্বারা নাকের ডগায় লেগে থাকা হলুদটা মুজে চোখের সামনে ধরতে শব্দ করে হেসে উঠে। মেয়েটা যে এতোটা ভ’য় পাবে ইশান তা একসেপ্ট করে নি। তাই তীর ভ’য়ে যাতে হার্ট অ্যাটাক না করে তার আগেই চলে যায়। এই সুযোগটা আজকে ইশাই করে দিয়েছে ভাইকে।

ইশান আবারও মাথার নিচে দু হাত দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে। কালকের দিনটা জন্য ইশান অধীর আগ্রহে বসে। কালকেই তার হৃদয়ে জ্বলতে থাকা #প্রনয়ের_দহন নিভে যাবে।

#চলবে_____

#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৫২

তীরের সারাটা রাত কেটেছে নির্ঘুম। ওই ঘটনাটার পর তীর আর দু চোখের পাতা এক করতে পারি নি। বার বার মনে হচ্ছিলো ওর সাথে এই সব কিছু বাস্তবেই ঘটেছে আর ছোঁয়াটাও খুব পরিচিত ছিলো। কিন্তু সেই ছোঁয়ার মালিক তো এতো রাতে এখানে আসবে না আর এখানে আসার কোনো চান্সও নেই। তবে কি সত্যিই স্বপ্ন দেখছিলো তীর নাকি সবটাই বাস্তব। দুটানায় পড়ে গেলো বেচারি। এসব ভাবতে ভাবতে ভোর রাতে তীরের চোখ লেগে আসে। ঘুম ভাঙ্গে ইশার ডাকাডাকিতে। তীর ভ্রু কুচকে বিরক্তিকর স্বরে বলে।

–একদম ডাকাডাকি করবি না। কালকে রাতে ঘুমাতে পারি নাই তাই ডিস্টার্ব করবি না। যদি আরেক বার কানের কাছে এসে হাঁসের মতো প্যানপ্যান করিস তাহলে কিন্তু লা’থি খাবি এই আমি বলে দিলাম।

ইশা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে বলে।

–যার বিয়া তার খবর নাই পাড়া পড়শির ঘুম নাই।

কথাটা বলেই ইশা তীরকে পা দিয়ে গুতো মেরে বলে।

–এই উঠ। তোর না আজকে বিয়ে আর তুই এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস বিয়ে নিয়ে কি তোর কোনো চিন্তা নেই।

ইশার কথা তীরের কর্ণগোচর হতেই তীড়ৎ বেগে উঠে বসে ভ্রু কুচকে ইশার দিকে তাকিয়ে বলে।

–আজকে আমার বিয়ে।

ইশা মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে।

–না আমার বিয়ে আপনার বিয়ে হতে যাবে কেন?

তীর কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বলে।

–আমি বিয়ে করতে চাই না ইশু। এই বিয়েটা তুই কিছু একটা করে বন্ধ করে দে প্লিজ।

ইশা প্রফুল্ল হয়ে তীরের পাশে এসে বসে বলে।

–সত্যি বিয়েটা করতে চাস না তুই।‌

–না চাই না তো।

–ঠিক আছে তাহলে আমি ভাইয়াকে গিয়ে বলি কিছু একটা করে এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে।

তীর চোখ বড় বড় করে তাকায়। ইশা এর মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরুতে নিবে এর মাঝেই তীর বাজখাই কন্ঠে বলে।

–একদম না। তোর ভাইয়ের কাছে গিয়ে এসব কথা একদম বলবি না।

–কিন্তু তুই তো একটু আগে বললি বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়ার কথা।

তীর অসহায় চোখে ইশার দিকে তাকিয়ে বলে।

–ওইটা তো আবেগে বলে ফেলেছি।

ইশা তীরের কাছে এসে বলে।

–ওও তখন আবেগ কাজ করচ্ছিলো এখন বিবেক কাজ করছে আপনার তাই তো।

তীর চুপচাপ বসে আছে। ইশা তা দেখে ঠোঁট কাঁমড়ে বলে।

–এভাবে বসে না থেকে তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফ্রেস হো। একটু পরেই পার্লার থেকে লোক আসবে তোকে সাজাতে।

তীর তাও স্থির হয়ে বসে আছে ইশা তা দেখে বলে।

–কি হলো যা?

তীর অশ্রুসিক্ত নয়নে ইশার দিকে তাকিয়ে বলে।

–আমি তো আজকে চলে যাবো তুই কি আমাকে একটুও মিস করবি না।

ইশা কিছু একটা মনে করে বাকা হেসে বলে।

–তুই বিদায় হলে আমার শান্তি বুঝলি। তোকে আর টলারেট করতে হবে না। আর একটা কথা শুন তোর বাসর রাতের প্রত্যেকটা ঘটনা কিন্তু আমাকে ডিটেলসে বলতে হবে। পারলে ভিডিও করে রাখবি লাইভ দেখার জন্য।

তীর রাগে ইশার দিকে বালিশ ছুড়ে মেরে বলে।

–তোকে আজকে আমি জানে মেরেই ফেলবো শ’য়’তা’ন ছেড়ি।

বালিশটা ইশার গায়ে লাগার আগেই ইশা দৌঁড়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। ইশান চলে যেতেই তীর ডুকরে কেঁদে উঠে। বুকের বা সাইড হাত দিয়ে চেঁপে ধরে বলে।

–এতো কষ্ট হলে জীবনও এই বিয়ের জন্য রাজি হতাম না। ওই ইশান ফরাজীকে কষ্ট দিতে গিয়ে নিজেই মরে যাচ্ছি কষ্টে। ওই বেডা তো কষ্ট পাচ্ছেই না উল্টে আমার বিয়ের সব আয়োজন হেসে খেলে করছে। কে বলবে এই বেডা যে ছ্যাকা খেয়েছে। একেই বলে হয়তো বেডা মানুষ। বাবা-মার কথায় রাজি হয়ে গেলো ভালোই হতো।

তিন দিন আগের কথা। তখন রাত সোয়া দশটা বাজে। তীর বেলকনির দোলনাতে বসে দুরে আকাশের চাঁদটার দিকে এক নজর তাকিয়ে ছিলো আর বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এমন সময় দরজা নক করার শব্দ শুনে তীর দরজা খুলে দেখে বাবা-মা দু’জনে দাঁড়িয়ে আছে। তীর বাবা-মাকে এমন সময় দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বলে।

–মা-বাবা তোমরা এক সাথে হঠাৎ?

আজিজুল আহমেদ মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলে।

–তোর সাথে কিছু কথা ছিলো রে মা।

–ওও তাহলে ভেতরে এসে বসো।

তীরের মা-বাবা এসে বেডে বসে। তীরও বাবা-মায়ের পাশে বসতেই আজিজুল আহমেদ কোমল স্বরে বলেন।

–তুই যখন হয়েছিলো তখন আমি খুব হয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিলো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখী মানুষটা হয়তো আমি। তুই যখন হয়েছিলে গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষকে মিষ্টি খাইয়ে‌ ছিলাম। আর সেই ছোট্ট তীর‌ আজকে এতো বড় হয়ে গেলো আমার চোখের সামনে আর আমি টেরেই পায় নি।

তীর চুপচাপ বসে কথা গুলা শুনে যাচ্ছে বাবার। আজিজুল আহমেদ আবারো বলেন।

–তুই যদি না চাস তাহলে এই বিয়ে হবে না মা। আমরা এই বিয়ে ভেঙ্গে দিবো কিছু একটা করে।

তীর চমকে বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। আয়েশা সুলতানা মেয়ের চমকানো দেখে বলে।

–হুমম। তুই যদি না চাস তাহলে এই বিয়ে হবে না। তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা এই বিয়ে দিবো না। এখন তোর উপরে পুরাটা নির্ভর করছে এই বিয়েটা হওয়া আর না হওয়া। মন যেটা চায় সেটা বলবি তীর‌‌ কেউ তোকে জোর করবে না। এমন কি আমিও না।

তীর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না সে তো এই বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু ইশানের উপর অভিমানটা যে পাহাড় সমান হয়ে আছে। ইশান তো তাকে আর চায় না তাহলে সে কেন বেহায়ার মতো ইশানের দিকে পথ চেয়ে বসে থাকবে। না সে চেয়ে থাকবে নাা সে এই বিয়ে করবে তাও আবার ইশানের চোখের সামনে দিয়ে। ভালোবাসার মানুষটাকে যখন অন্য কোনো পুরুষের হতে দেখব তখন ইশানের কেমন লাগবে সেটা তীর নিজের চোখে দেখতে চায়। তীর চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টেনে নিজের মস্তিষ্ককে ঠান্ডা করে চোখ খুলে বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে।

–এই বিয়ে করবো আমি বাবা। যাই হয়ে যাক না কেন এই বিয়ে আমি করবো।

আজিজুল আহমেদ আর আয়েশা সুলতানা এক জন আরেক জনের দিকে তাকায়। তারা দুজন ভেবে রেখেছিলো মেয়ে তাদের হয়তো বিয়েতে না করে দিবে কিন্তু এখন তো উল্টো হয়ে গেলো। আজিজুল আহমেদ তীর আর ইশানের ব্যাপারে সবটাই জানেন। আয়েশা সুলতানা সবটাই বলেছেন। তাই তো মেয়ের কাছে এসেছে মেয়ের কি ইচ্ছে তা জানার জন্য। তীরের বাবা তীরের মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বলেন।

–ভেবে বলছো তো মা পরে এ নিয়ে আপসোস করবে না তো।

–নাহ বাবা কোনো আপসোস করবো না।

–তাহলে বিয়ের আয়োজন শুরু করবো আমরা।

–হুম শুরু করো।

আজিজুল আহমেদ মেয়েরে‌ মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে চলে যায়। কিন্তু রয়ে যান আয়েশা সুলতানা। মেয়ে যে তার অভিমান করে এমনটা বলেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। তীরের অভিমানটা বরাবরেই একটু বেশি। আয়েশা সুলতানা এখন নিজেকে দোষী মনে করছেন এই সব কিছু জন্য। কেন সে ওই দিন ইশানের কাছে এসব বলতে গেলো, যদি না বলতো এসব তাহলে এমন কিছুই হতো না। আয়েশা সুলতানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই তীর বলে উঠে।

–মা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে আমার ঘুমের প্রয়োজন।

আয়েশা সুলতানা মুচকি হেসে বলে।

–ঠিক আছে তাহলে ঘুমা‌ আমি আসি।

_____

তীরের মেকাপ করা আর চুল বাঁধা কমপ্লিট। মেকাপ করার সময় তীরের না চাওয়া সত্ত্বেও চোখ থেকে বেয়ে পড়ছে নোনা জল। যারা সাজাতে এসেছে তার একটু বিরক্তবোধ করেছে তীরের উপর। এমন নববধূ তারা প্রথম দেখেছে যে সাজার সময়েই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। না জানি বিদায়ের সময় কি করে এই বধূ? চুলের খোপায় কাঁচা ফুল নয় বরং কৃত্রিম লাল টকটকে গোলাপ দেওয়া হয়েছে যাতে করে ফুল গুলা না শুকিয়ে নেতিয়ে না যায়। সবকিছুই ঠিক ছিলো কিন্তু বাদ সজলো তীরের বিয়ের লেহেঙ্গা দেখে। তীর লেহেঙ্গাটা দেখার সাথে সাথে গম্ভীর গলায় ইশাকে বলে।

–এটা এখানে কি করছে?

–কি করছে মানে? এটা তোর বিয়ের লেহেঙ্গা।

–বিয়ের লেহেঙ্গা এটা ছিলো না বিয়ের লেহেঙ্গাটা ছিলো খয়েরি রঙের আর এটা লাল রঙের কি করে হলো? দর্জির কাছ থেকে আসতে আসতে চেইন্জ হয়ে গেলো লেহেঙ্গাটা কি করে?

–দেখ তীর তুই নতুন বউ এভাবে রা’গ দেখালে চলে না। একটু পরেই বর পক্ষরা চলে আসবে আর তোকে যদি এসে রেডি না দেখে তাহলে কি ভাববে বল তো।

তীর কোনো কথা বলছে না দেখে ইশা আবারো বলে।

–বুঝতে পারছি এই লেহেঙ্গাটা ভাইয়া পছন্দ করেছিলো বলে তুই পড়তে চাইছিস না। কিন্তু এখন কিচ্ছু করার নেই এই‌ মুহূর্তে তোকে এটা না পড়া ছাড়া।

–ঠিক আছে এটাই‌ আমি পড়ছি। তবে এটা মনে রাখিস যদি বেকায়দায় না পড়তাম তাহলে কোনো‌ দিনও তোর ভাইয়ের পছন্দ করা জিনিস পড়তাম না আমি। তোর ভাইয়ের চয়েস খুব খারাপ আর জ’ঘ’ন্য।

ইশা হেসে বলে।

–তাহলে তো তুই দেখতে খারাপ আর জ’ঘ’ন্য।

তীর ভ্রু কুচকে বলে।

–মানে।

–মানেটা হলো ভাইয়ের চয়েসের মধ্যে তো তুইও পড়িস। তাহলে তোর ভাষ্যমতে তুই‌ সুন্দরী না। দেখতে জ’ঘ’ন্য আর বিচ্ছিরি।

তীর মুখ ভেঙ্গচি কেটে অন্য দিকে ফিরে যায়। নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে গেছে। তাই আর বেশি কথা বলে‌ নিজের মান ইজ্জত কুয়াতে চায় না তাই চুপ হয়ে যায়।

______

লাল লেহেঙ্গাতে তীরকে অপূর্ব লাগছে। তীর এমনেই অনেক সুদর্শনী কিন্তু লাল রঙটা তীরের সৌন্দর্য যেন আরো ফুটিয়ে তুলেছে। মাথায় লাল দুপাট্টা পড়ে চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে। যেই দেখছে সেই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সময় যতো যাচ্ছে তীরের বুকের ধড়ফড়ানিটা ততো বাড়ছে। ইশানকে ছাড়া কিভাবে থাকবে সারাটা জীবন অন্য এক পুরুষের সাথে ভাবতেই বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠছে। ধমবন্ধকর এক পরিস্থিতি পড়ে গেছে তীর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।‌ আজকে সারা দিনে ইশানকে চোখের দেখাও দেখে নি তীর। কতবার যে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ইশানকে এক নজর দেখার জন্য কিন্তু ইশানের কোনো অস্তিত্বও নেই। তীর মনে মনে বলে।

–কোথায় আছে লোকটা কি করছে তার কি একবারও আমার কথা মনে পড়ছে না। তার তীর যে আজ থেকে অন্য কারোর হয়ে যাবে তাতে কি তার একটু মাথা ব্যাথা নেই।

এমন সময় বাইরে থেকে শোরগোল শুনা যাচ্ছে বর চলে এসেছে। বর আসার কথাটা শুনে বুকের ভেতরের ভ’য়টা আরো বেড়ে গেলো। মন চাইছে বিদায়ের আগেই চিৎকার করে কান্না করতে। আজকে থেকে সে নতুন এক সম্পর্কের সাথে জড়িত হতে যাচ্ছে। নতুন এক মানুষের সাথে সারা জীবন কাটাতে হবে তাকে ইশানের সাথে পুরনো সকল স্মৃতি মন থেকে মুছে দিয়ে। কিন্তু তীর কি অতোও পারবে প্রথম ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের মনের গহীন থেকে মুছে দিতে। হয়তো চেষ্টা করলেও পারবে না। প্রথম ভালোবাসা কি এতো সহজে ভুলা যায়, ভুলা যায় না তো চাইলেও।

______

বরযাত্রীদের খাওয়া দাওয়ার পার্ট শেষ। এবার বিয়ে হওয়ার পালা তীর আর আকাশের। আকাশ তো বেজায় খুশি আর কয়েক মুহূর্ত পরেই তীর সারা জীবনের জন্য তার, একান্তই তার। এখন পর্যন্ত কোনো রকমের ঝামেলা হয় নি আর আসার পর থেকে ইশানকেও আশেপাশে দেখি না। তাই আর কোনো ঝামেলার আশঙ্কা না রেখেই নিজেকে হাসি খুশি রাখছে আকাশ। কিন্তু কে জানতো আকাশের উপর এসে পড়বে চরম এক বিপদ।

আগে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে তারপর ইসলামিক মতে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে। কিন্তু আকাশ যখনেই কাবিননামায় সাইন করতে যাবে কারো পরিচিত কন্ঠ শুনে চমকে যায়। হাত থেকে আপনাআপনি কলমটা নিচে পড়ে যায়। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই ভ’য়ে শুকনো ঢোক গিলে। না চাইতেও মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে।

–ঐশী তুমি এখানে?

আকাশের সামনে দাঁড়ানো যুবতি মেয়েটা কঠোর কন্ঠে বলে।

–হ্যাঁ আমি এখানে তোমার বিয়ে করা স্ত্রী। যাকে তুমি ভুলভাল বুঝিয়ে লন্ডনে রেখে এসেছো এখানে আরেকটা বিয়ে করার জন্য। এক স্ত্রী জীবিত থাকতে অন্য আরেকটা বিয়ে করার হুকুম তো আমি দেয় নি তোমাকে মিস্টার আকাশ শেখ। হে মানছি আমাদের ধর্মে একাধিক বিয়ে করার কথা আছে কিন্তু সেটাও তার বর্তমান স্ত্রীর কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার পর। কিন্তু তুমি তো তা করো নি। আর একদম অস্বীকার করার চেষ্টা করো সব প্রামণ কিন্তু আমার কাছে তাই একদম অস্বীকার করার চেষ্টা করবে না।

বাড়ি ভর্তি সকল মানুষ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে আসলে‌ কি হচ্ছে এখানে? এর মাঝে আজিজুল আহমেদ এসে আকাশকে রা’গী গলায় বলেন।

–আকাশ কি হচ্ছে এসব? মেয়েটা কিসব বলছে?

–আঙ্কেল আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।

ছেলের কথার মাঝে নুরুল শেখ বলেন।

–কি সবটা বুঝিয়ে বলবি তুই? তুই আগে একটা বিয়ে করেছিস আর সেটা সবার কাছে গোপন রেখেছিস। আর এখন আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি।

–বাবা আমি আসলে তীরকে….

আকাশ আর কিচ্ছু বলতে পারলো না তার আগে ছেলের গালে চ’ড় মেরে বলে।

–তুই‌ এতো নিচে নেমে গেছিস আকাশ যে এতো বড় একটা সত্যি তুই আমাদের কাছে গোপন করেছিস। মেয়েটা কি একটাও মিথ্যে কথা বলছে আমার তা মনে হচ্ছে না তোর মুখ দেখে।

আকাশ মাথা নিচু করে বলে।

–বাবা আমি তীরকে ভালোবাসি।

ঐশী এই‌ কথাটা শুনে বলে।

–ভালো তো আমাকেও বেসেছিলে তুমি। আর ভালোবেসে বিয়েও করেছো!

আকাশ এবার চিৎকার করে বলে।

–ওইটা জাস্ট একটা মোহ ছিলো তোমার প্রতি জাস্ট মোহ। কোনো ভালোবাসা টাসা ছিলো না।

বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনে ঘর থেকে আয়েশা সুলতানা আর শাপলা বেগম বেরিয়ে আসেন। তীরও বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় নিচে কি হয়েছে জানার জন্য। যখন আকাশের ব্যাপারটা জানতে পারলো তীর তখন এতো পরিমাণ খুশি হয়েছিলো মন চাইছিলো লুঙ্গি ডান্স গানে নাচ করতে কিন্তু আপতত সেই ইচ্ছেটা বাদ দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না এই‌ মেয়েটা জানলো কি করে আজকে যে আকাশের বিয়ে। কেউ বলে দিয়েছে কিন্তু কে?

আয়েশা সুলতানা যখন আকাশের আরেকটা বিয়ে আছে জানতে পারলো তখন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন। এটা কি করতে চাছিলো মা হয়ে নিজের মেয়ের এতো বড়ো ক্ষতি করতে যাচ্ছিলো। ভাবতেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে নোনা জল।

আকাশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের কথা বলার মুখ আর নেই। নুরুল শেখ হাত জোড় করে আজিজুল আহমেদের কাছে গিয়ে বলেন।

–এই প্রতারকটাকে যা শাস্তি দিবেন সেটাতে আমি কোনো বাঁধা দিবো না। পারলে ওকে আপনারা জেলে দিয়ে দেন। তাহলে যদি ওর একটা শিক্ষা হয়।

আজিজুল আহমেদ কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। স্ত্রীর দিকে তাকান তিনি, স্ত্রী যে তার পাথর হয়ে গেছেন সেটা ভালো করে বুঝতে পারছেন। আজিজুল আহমেদ ঐশী নামের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে অন্য দিকে মুখ ফিরে বলেন।

–আপনারা এক্ষুণি এই মুহূর্তে এখন থেকে চলে যান আপনাদের সকল লোকজন নিয়ে।

নুরুল শেখ আর কিচ্ছু না বলেই বেরিয়ে যান। এক এক করে বরযাত্রীরা সকলে চলে যান। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে আকাশ। আকাশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আজিজুল আহমেদ বাজখাই কন্ঠে বলেন।

–বেরিয়ে যাও এখান থেকে। এখানে যদি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকো তাহলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।

আকাশ নাক ফুলিয়ে ঐশীর দিকে তাকায়। ঐশীও বাঁকা হাসে। আকাশ চারিদিকে নজর বুলিয়ে গলায় থাকা মালাটা এক টান দিয়ে ছিঁড়ে নিচে ফেলে চলে যায়।

#চলবে________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে