প্রত্যাশা পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

1
1370

#গল্প
প্রত্যাশা
#পর্ব_৩ (শেষ পর্ব)
-শাতিল রাফিয়া

রিকশায় বসে আমি মাকে ফোন দিলাম।

– হ্যাঁ প্রত্যাশা বল।
– বাবা কেমন আছেন, মা?
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- একই রকম।
আমি কম্পিত গলায় বললাম- আমার মনে হয় বাবার আর চিকিৎসা করানো হবে না।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কেন?

আমি মাকে সব খুলে বললাম।

এরপর জিজ্ঞেস করলাম- তুমিই বল মা এভাবে কি মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে থাকা যায়? আজ যা হয়েছে আমার মনে হয় না ইরফানের মা আর লোন দেবেন। উনি তো আর লোন দেন না। উনি জাস্ট আমাকে কিনে নিতে চান।
মা নিরাসক্ত গলায় প্রশ্ন করলেন- চলে আসতে চাইছিস?
– হ্যাঁ।
– টিউশনির টাকা দিয়ে কয়দিন চলবে?

আমি কোন উত্তর দিলাম না।

মা আবার প্রশ্ন করলেন- লোন কিভাবে শোধ করবি?

আমি আবারও নিরুত্তর রইলাম। শুধু চোখ উপচে পানি পড়তে থাকে।

মা বললেন- আবেগের বশে এসে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিলে তো হবে না।
– তাহলে তুমি চাও আমি ওখানে থাকি? যেখানে আমার বিন্দুমাত্র সম্মান নেই, সেখানে থাকি?
– আমি জোর করছি না প্রত্যাশা। তুই ইরফানের সাথে কথা বল। তাকে জিজ্ঞেস কর সে কি চায়?
– সে যা চায় তা তো আমাকে আগেই বলে দিয়েছে…
– কিন্তু এভাবে তো জীবন চলতে পারে না। আমি বলব তুই আগে ইরফানের সাথে কথা বল। তারপর সিদ্ধান্ত নে। আর চলে আসতে চাইলে অবশ্যই আসতে পারিস। তোর ওপর আমার ভরসা আছে।

টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরলাম। আমি ভেবেছিলাম ইরফান আবার বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তার গাড়ি বাইরেই দেখলাম। তার মানে সে ঘরেই আছে।

আমি ঢুকতেই শাশুড়িমা ঠান্ডা গলায় বললেন- আমার ঘরে একবার এসো প্রত্যাশা।

আমি চোখ কুঁচকে ফেললাম। কি বলবেন উনি? বাসা থেকে বের করে দেবেন নাকি? দিলে আমিও চলে যাব।

উনার পেছন পেছন উনার ঘরে গেলাম।

উনি গম্ভীরমুখে বললেন- বোস।

আমি চেয়ারে বসলে উনি খাটে আমার সামনাসামনি বসলেন।

এরপর থেমে থেমে বললেন- ইরফান আজ সারাদিন বাসায় আছে। কতক্ষণ থাকবে আমি জানি না।

আমি তার দিকে তাকালাম। উনি কি বলতে চাইছেন?

উনি উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা প্যাকেট বের করে আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন- এটা নাও আর ঘরে গিয়ে খোল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কি এটা?
– রুমে গিয়ে খুলে দেখ। বুঝতে পারবে।

আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে প্যাকেটটা নিয়ে রুমে গেলাম। ইরফান খাটে আধাশোয়া হয়ে টেলিভিশন দেখছে।

আমাকে দেখে বলে- হাই! কেমন হল টিউশনি?

আমি কোন উত্তর দিলাম না। একরাশ কৌতূহল নিয়ে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ইরফান এবার জিজ্ঞেস করে- কি এটা প্রত্যাশা?
– মা দিয়েছেন।
– খোল। খুলে দেখ।

প্যাকেটটা খুলে আমি হতবাক হয়ে গেলাম! আমার নিজেকে কীটের মতো মনে হতে লাগলো। উনি এটা কি দিলেন আমাকে?

প্যাকেটের ভেতর পাতলা ফিনফিনে একটা জর্জেটের শাড়ি! যেটা পরা আর না পরা একই কথা!

রাগে আমি কাঁপতে থাকি! শাশুড়ি মায়ের কথা কানে বাজতে থাকে- ইরফান আজ সারাদিন বাসায়! রুমে যাও!

আমি হঠাৎই চিৎকার করে ভেউভেউ করে কেঁদে দিলাম! ইরফান ততক্ষণে আবার টিভির দিকে মন দিয়েছিল। আমার কান্না শুনে চমকে আমার দিকে তাকালো।

এরপর দ্রুত আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে- কি হয়েছে তোমার?

আমার সব রাগ গিয়ে তার ওপর পড়ল।

আমি তার কলার খামচে ধরে তীব্র গলায় বললাম- তুমি কি চাও? আমি এটা পরে তোমার সামনে আসি?

ইরফান অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো! তারপর শাড়িটার দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে ফেললো।

আমার হাত তার কলার থেকে সরিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল- এরকম কিছু চাইলে অনেক আগেই জোর করতে পারতাম।
আমি ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম- তোমার মা কেন বোঝেন না আমি এত নীচ না? আমার মধ্যেও আত্মসম্মানবোধ আছে? বাবার চিকিৎসার টাকা দিয়েছেন বলে কি উনি আমাকে কিনে নিয়েছেন?

ইরফান আমার গাল থেকে চোখের পানি মুছে দেয়।

সে হঠাৎই আমার দুইগাল তার দুইহাত দিয়ে ধরে বলে- আই অ্যাম স্যরি। স্যরি যে আমার জন্য তোমাকে এত বড় একটা অপমান সহ্য করতে হলো!

আমার কি হলো আমি নিজেও জানি না।

আমি তার হাত ধরে বললাম- ইরফান আমরা কি পারি না একটা স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে? আমরা কি নিজেদের বোঝার জন্য, জানার জন্য একটু সময় দিতে পারি না?
ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- আমাকে ক্ষমা করো প্রত্যাশা! আমি পারব না। আমার পক্ষে আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। কাউকে মন দেওয়া সম্ভব নয়। এসবের ওপর থেকে বিশ্বাস অনেক আগেই উঠে গেছে।
– কিন্তু সব মেয়ে সামারা নয় ইরফান! একজনের কাছ থেকে ধোঁকা খেয়ে তুমি বাকী সব মেয়েকে এক কাতারে কি করে ফেলতে পার?

ইরফানের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল!

সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে- ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে মিলে আমাকে চিট করেছিল। আমাকে শুধুমাত্র ইউজ করেছে ওরা! টাকার জন্য!
ইরফান নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- আমি পারব না প্রত্যাশা।
– ঠিক আছে। ভালোবাসতে হবে না। কিন্তু ঠিক সময় মতো তো বাসায় ফিরতে পার। ছুটির দিনগুলোতে তো বাসায় থাকতে পার। তুমি যেই অভ্যাস গড়ে তুলেছ, তা তো তোমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে ইরফান!
– আমি বাসায় থাকলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে প্রত্যাশা? তখন মা বলবেন নাতি-নাতনিদের কথা!
আমি এবার চোখমুখ শক্ত করে বললাম- তাহলে তুমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো। আমার পক্ষে এত অপমান সহ্য করে আর থাকা সম্ভব নয়। আজ তো তোমার মা অপমানের চূড়ান্ত করলেন!

আমি শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আবার হুহু করে কেঁদে দিলাম!

ইরফান হঠাৎ আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে! আমি কেঁপে উঠলাম! এসময় একটা সাপোর্টের সত্যি খুব দরকার ছিল আমার।

একটুপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে সে বলে- ঠিক আছ তুমি?

আমি চোখ মুছে মাথা নাড়লাম।

ইরফান এবার একটা কাঁচি এনে বলে- ধর।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি করব?
– আহা ধরই না!

আমি কাঁচিটা ধরলে সে শাড়িটা খুলে আমার সামনে ধরে বলে- কাটো এবার। একদম মাঝখান দিয়ে কেটে অর্ধেক করে ফেল।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম- এসব ছেলেমানুষি করছ কেন?
ইরফান মৃদু হেসে বলে- তোমার জন্য! বিশ্বাস করো শান্তি লাগবে অনেক।

আমি সত্যি সত্যি শাড়িটা কেটে ফেললাম মাঝখান দিয়ে। এরপর কি হল জানি না। শাড়িটা আমি ইচ্ছামতো কাটতে লাগলাম। মনের সসম্পূর্ণ ঝাল শাড়িটার ওপর মেটালাম! শাড়িটা কুটি কুটি হয়ে গেল!

ইরফান এবার সব টুকরো প্যাকেটটাতে ঢুকিয়ে বলে- এবার বারান্দা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেও।

আমি এবারও তাই করলাম।

ইরফান আমার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করে- লাগছে না শান্তি?
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম- বুঝতে পারছি না। খুব আজব লাগছে!

আমি এবার হেসে দিলাম।

ইরফান বলে- আমার অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে। বাবা আর দুলাভাই গিয়েছেন। উনারা একসপ্তাহ পরেই ব্যাক করবেন। আমি টু উইকস পর আসব। ফিরে এসে আমি ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দেব।

আমি মাথা নাড়লাম!

ইরফান এগিয়ে এসে বলে- প্রত্যাশা এই দুই সপ্তাহ আমি একটু ভাবতে চাই। কেন যেন…
– কেন যেন কি?
– তোমার সাথে শাড়ি নিয়ে এই কার্যকলাপ করতে করতে মনে হল হয়তো আমাদের মেন্টালিটি ম্যাচ করতেও পারে!

আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম!

ইরফান বলে- আমি তোমাকে জানাব। আর এই দুই সপ্তাহ তুমি তোমার বাবার বাসায় গিয়ে থাকবে। কজ মায়ের কোন ঠিক নেই। কি না কি আবার বলবে!

আমি হঠাৎ করেই ইরফানের জন্য একটা টান অনুভব করি।
***

আজ ইরফানের ফেরার কথা। প্রথম চার-পাঁচদিন ইরফান প্রতিদিন ফোন করেছে। তারপর আর করেনি। আমাদের আহামরি সেরকম কোন কথা হয়নি যদিও। কেমন আছি, বাবা কেমন আছেন, ডিনার হয়েছে কি না- এই কয়েকটা রুটিনমাফিক সাধারণ কথাবার্তা। কিন্তু চার-পাঁচদিন পর তার ফোন না পেয়ে আমার মধ্যে কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করলাম। আমি নিজেই তাকে ফোন করলাম।
ইরফান ফোন ধরল।

স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে বলল- আমি বিজি আছি তো, সময় বুঝে ফোন করব।

কেন জানি না আমার মনে হল সে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি অন্য একটা ব্যাপার আছে। মনে হল সে কোন কিছু নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত।

আজ আমার শশুড়বাড়িতে গেলাম।

শাশুড়িমা আমাকে দেখে বললেন- এসে পড়েছ? কিন্তু ইরফান তো আরো ক’দিন পরে ফিরবে।

আমি কিছুটা অবাক হলাম! ইরফান আজ ফিরবে না, কিন্তু আমাকে একবারও জানালো না!

সবার সাথে হাই-হ্যালো করে ফিরে আসার সময় শুনতে পেলাম শাশুড়িমা বিড়বিড় করে বলছেন – এরপরের বার আসলে একবারে ফিরে যেতে হবে!

ব্যাপারটা কি? আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না। হয়তো উনি আমাকে বাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়ার কথা ভাবছেন।

আমি আজ আবার ইরফানকে ফোন দিলাম।

সে ফোন ধরলো বেশ দেরী করে এবং ধরার পরে বলে- স্যরি। আজ ফিরতে পারিনি। আমার কয়েকদিন দেরী হবে প্রত্যাশা। আমি ফিরে তোমাকে জানাব।
আমি বললাম- তোমার একটা ডিসিশন নেওয়ার কথা ছিল।

ইরফান হঠাৎই চুপ করে গেল!

একটুপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- সব জানাব প্রত্যাশা। আগে ফিরে নেই।

এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ করে করে ইরফান পুরো মাস কাটিয়ে দিল। এই একমাসে কয়েকটা ঘটনা ঘটলো।

বাবার শরীরের উন্নতি হল না। বরং আরো অবনতি হতে লাগল। বাবা কেমোর ধকল সহ্যই করতে পারছিলেন না বলে কেমো বন্ধ করে দেওয়া হলো।
যেই ছোট কোম্পানিটায় আবেদন করেছিলাম, সেখানে আমার চাকরিটা হয়ে গেল। ছোট কোম্পানি, ছোট চাকরি, বেতনও কম। কিন্তু আমার নিজের চেষ্টায় আমার প্রথম চাকরি!

সবচেয়ে খুশি হলেন বাবা। তার চোখে পানি দেখতে পেলাম খবরটা শুনে।

ইরফানকে ফোনে জানিয়েছিলাম।

সে বেশ আনন্দিত গলায় বলেছে- কংগ্রাচুলেশনস!

আমার শশুড়বাড়িতে মিষ্টিসহ গিয়ে খবরটা দিলাম। আমার পোস্ট আর বেতন শুনে আমার শাশুড়িমা হাসতে হাসতে পারলে গড়াগড়ি খান!

একবার বলেই ফেললেন- আর এই টাকা দিয়ে তুমি লোন শোধ করার প্রত্যাশা রাখো, প্রত্যাশা?

আমার ননাশ আর দুলাভাইও দেখলাম ব্যাঙ্গাত্মক হাসি ফুটিয়ে রেখেছে মুখে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম! উনারা এত বড়লোক মানুষ, অথচ কি নিচু চিন্তাভাবনা!
***

ইরফানের ফোন দেখে আমি চমকে উঠলাম!

– হ্যালো।
– প্রত্যাশা আমি ফিরেছি। তোমার বাসার নিচে আছি। চল।

সে এভাবে হুট করে ফিরে এসে বলছে ‘চল’! কি আজব!

নামার আগে আমি আমার টিউশনির বেতনের পুরোটাই নিলাম। এটা আজ আমার শাশুড়িমাকে দেব। তার লোনের প্রথম কিস্তি। আমি নিচে নেমে গাড়িতে উঠলাম। ইরফানের দিকে তাকালাম। সে মুখটাকে গম্ভীর করে রেখেছে।

আমি স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করলাম- কখন এসেছ?
ইরফান উত্তর দিল- তিনদিন আগে।

আমি এবার আরও চমকে উঠলাম! তিনদিন আগে এসেছে অথচ কেউ আমাকে জানায়নি!

– তিনদিন আগে এসেও কিছু বললে না যে?

ইরফান কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগল। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই।

আমি ধীরে ধীরে বললাম- ইরফান, তুমি চাইলে আরো সময় নিতে পার। কি হয়েছে তোমার?

ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কিন্তু কোন জবাব দিল না।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে ইরফান বলে- তুমি সোজা আমাদের রুমে চলে যাবে। কারো সাথে কোন কথা বলবে না।
– কেন?
– কারণ তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। যাও আমি পার্ক করে আসছি।

ইরফানের আচরণ দুর্বোধ্য লাগছে! তবুও আমি তার কথামতোই কারো সাথে কথা না বলে আমাদের রুমে চলে আসলাম। অবশ্য রুমে আসার সময় কাউকে দেখিনি যে কথা বলব!

ইরফান কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমে এল।

আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি হয়েছে একটু বলবে?
ইরফান মাথা নেড়ে বলল- বলব। আমি এখন তোমাকে কয়েকটা কথা বলব। আমার সব কথা মন দিয়ে শুনবে, তারপর তুমি কথা বলবে। ঠিক আছে?

আমি মাথা নাড়লাম।

ইরফান এবার থেমে থেমে বলে- ওখানে গিয়ে আমার সামারার সঙ্গে দেখা হয়েছিল প্রত্যাশা। এন্ড আই কেইম টু নো দ্যাট ও আমার সাথে প্রতারণা করেনি।

আমি হা করে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ইরফান বলে- তোমাকে খুলে বলি। যা হয়েছিল, সব রবিনের দোষ ছিল। রবিন, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। ও সামারাকে পছন্দ করতো। কিন্তু সামারা রবিনকে পছন্দ করত না। তাই রবিন রেগে কতগুলো ফেক ছবি বানিয়ে আমাকে দেখিয়েছিল। সেটা দেখেই আমি সামারার সাথে ব্রেকআপ করেছিলাম, রবিনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। রবিন ভেবেছিল আমি সামারার জীবন থেকে সরে গেলে ও ইজিলি সামারাকে পেয়ে যাবে। বাট হি ওয়াজ রঙ। সামারা বিদেশে শিফট করেছিল। এবার সামারার সাথে দেখা হওয়ার পর আমি চলে যাচ্ছিলাম। বাট সামারা বলেছিল যেন একবার শুধু সত্যিটা জানি। এরপর ও আমাকে আর কখনো ডিস্টার্ব করবে না। এখানে থাকতেও সামারা অনেকবার রিকোয়েস্ট করেছিল আরেকবার দেখা করার। আমি এতটাই হার্ট হয়েছিলাম যে শুনিনি ওর কথা। এবার ওর সব কথা শুনে বুঝতে পারলাম আমি ভুল করেছি। সামারা রবিনের সাথেও যোগাযোগ করিয়েছে, রবিন স্বীকার করেছে ও ইচ্ছাকৃত সামারাকে পাওয়ার জন্য এসব করেছে। সামারাকে পায়নি। কিন্তু ও নিজেও ভালো নেই। ওর ওয়াইফের সাথেও ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর ও এখন অনেক অনুতপ্ত। ও স্বীকার করেছে তখন ঝোঁকের বশে এসব করা উচিৎ হয়নি…

এই পুরো কাহিনি শুনে আমি ফ্যালফ্যাল করে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি এবার বুঝতে পেরেছি সে কি বলতে চাইছে।

ইরফান ধীরে ধীরে বলে- এই ক’দিন আমি সামারার সাথে কাটিয়েছি। তিনদিন আগে ও আমার সাথেই ফিরেছে। আমাদের আবার প্যাচ আপ হয়েছে। এন্ড উই ওয়ান্ট টু ম্যারি। সামারাকে আমি তোমার কথা বলেছি। ও বলেছে আমাদের ডিভোর্স হলে এরপর আমরা বিয়ে করব। ওর প্রবলেম নেই।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইলাম! সে কি বলছে, আর আমি কি আশা করেছিলাম! ইরফানকে ভালো না বাসলেও ওর প্রতি আমি একটা টান অনুভব করছিলাম। সে যখন বলেছিল ‘ভেবে দেখবে’ কেন জানি মনে একটা আশা জেগেছিল! সে আমাকে ভালবাসতে পারবে না, কিন্তু বান্ধবীকে ভুল বুঝেছিল বলে তাকে ঠিক কাছে টেনে নিতে পারবে!

আমার দৃষ্টি দেখে ইরফান আমার কাঁধ ধরে বলে- প্রত্যাশা! আই অ্যাম স্যরি। বাট আমি বলেছিলাম আমি ভেবে দেখব। আর আমি এটাও বলেছিলাম আমি নিজেকে রাজি করাতে না পারলে আমি এসে ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দেব। আমি অলরেডি আমাদের ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দিয়েছি। তুমি চাইলে আমি তোমার বাবার চিকিৎসার দায়ভার নিতে পারি।

বাহ! কি সুন্দর কথা! সে কি আমাকে দয়া দেখাচ্ছে?

আমি হঠাৎই হেসে বললাম- এই বাসায় সবার মধ্যে আমি তোমাকে মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু অন্যান্য সবার মতো তুমিও অমানুষ!

ইরফান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে!

সে ধীরে ধীরে বলে- লোন হিসেবেই নিলে না হয়! আর তুমি টাইম নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নাও!
আমি এবার শান্ত স্বরে বললাম- আমার নেওয়ার কিচ্ছু নেই। এই বাড়ির একটা জিনিসও আমি নিয়ে যাব না।

বাসায় যাওয়ার আগে শাশুড়ি মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে বললাম- আপনি যে লোন দিয়েছিলেন, তার প্রথম কিস্তিটা আজ দিলাম। বাকীটাও দিয়ে দেব।
শাশুড়িমা বাঁকা হাসি হেসে বললেন- রেখে দাও তোমার কাছে। লাগবে না। তোমার বাবার ট্রিটমেন্টে কাজে লাগবে। এখন তো সামারাই আমার ছেলেকে সামলাবে, আমার কাছ থেকে আর লোন নিতে পারবে না।
আমি হেসে বললাম- আমি যেটা পারিনি, সেটা সামারা যেন পারে সেই দোয়া রইল। আমি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারিনি।

টাকাটা টেবিলের ওপর রেখে দিলাম।

আমি বের হওয়ার সময় ইরফান বলে- এসো তোমাকে নামিয়ে দেই।
– এই গাড়িতে তোমার পাশে সামারাকেই মানাবে। আসি। ভালো থেক। আর দোয়া করো তোমাদের দেওয়া অপমান গুলো যেন আমি খুব শীঘ্রি ভুলে যেতে পারি।
***

আজ আমার হাতে ডিভোর্স পেপার এসেছে। সাথে ইরফানের একটা ম্যাসেজ।
“তুমি সাইন করে পাঠিয়ে দিও। এরপর আমিও সাইন করে ফাইনাল করে ফেলব।”

আমি একফোঁটা কাঁদলাম না।

মাকে কথাটা বলে আমি তখুনি সাইন করে দিতাম কিন্তু প্রমি হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে- বাবা ডাকছেন। তাড়াতাড়ি এসো। বাবা কেমন যেন করছেন।

আমি ছুটে বাবার কাছে গেলাম!

বাবা কেমন যেন করছেন!

আমি তার হাত ধরলাম। প্রমিকে এম্বুলেন্স কল করতে বললাম।

বাবা হঠাৎই বললেন- তোকে ইরফান ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে?
– না তো!
– মিথ্যা বলিস না। আমি শুনেছি তোর মাকে তুই বলছিলি!

আমি হঠাৎই হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম! এতক্ষণের জমিয়ে রাখা বরফ গলে গেল বাবার সামনে!

বাবা আমার মাথায় হাত রেখে কষ্ট করে বললেন- কাঁদছিস কেন? তুই কোন দোষ করিসনি। নিজের মানসম্মানও বিসর্জন দিসনি। তুই কেন কাঁদছিস?

বাবা হাঁপাতে লাগলেন।

আমি চিৎকার দিয়ে বললাম- প্রমি করেছিস ফোন?
– আসছে আপু।
বাবা আবার বললেন- শক্ত হ মা। ওদের অপমানের উপযুক্ত জবাব দে। চাকরি পেয়েছিস, আরো ভালো চাকরি খোঁজ। ওদের দেওয়া লোন ওদের মুখে ছুঁড়ে মার। আরো পড়ালেখা করে আরো বড় হ মা!
– বাবা তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ, আর কিছু তোমাকে বলতে হবে না!
বাবা বললেন- আমার দোয়া তোর সাথে থাকবে।

আমি বাবার বুকের ওপর মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগলাম। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেই আমার বাবা পৃথিবী ত্যাগ করলেন। আমরা হসপিটালে নিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা তখন বেঁচে ছিলেন না।

হাসপাতাল থেকে বাবাকে নিয়ে কোথায় মাটি দেব, কি করব, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। প্রমি মাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। কারণ মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।

আমাদের যেসব আত্মীয়স্বজন আছেন, ফোন করলেই ভাবেন আমরা বুঝি টাকার জন্য ফোন করেছি। তারা কেউ ইদানিং আমাদের ফোন ধরেন না। আজ ধরবেন কী না তাও বুঝতে পারছি না।

তাই আমি ইরফানকে একটা ফোন দিলাম। সে তো সাহায্য করবে।

ইরফান একবার রিং বাজতেই আমার ফোন কেটে ম্যাসেজ দিল- “আমি সামারার সাথে একটু বিজি আছি। তুমি সাইন হয়ে গেলে পাঠিয়ে দিও।”

তার ম্যাসেজ দেখে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। আমি এবার আমার এক মামাকে ফোন দিলাম। মামা ফোনটা ধরলেন। বাবাকে বাদ আছর মাটি দেওয়া হল।
***

বাবা মারা গেছেন আজ চারদিন হল। বেঁচে থাকতে কেউ একদিনও খোঁজ নেয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকেই আহা-উহু করতে লাগল। সেই সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে আমার আর ইরফানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে লাগল।

আজ একটু আগে আমার ফুপু বিদায় নিয়েছে। কেউ বেল দিলে প্রমি দরজা খুলে আমাকে ডাক দিল।

আমি গিয়ে দেখি ইরফান আর তার মা দাঁড়িয়ে আছেন। ইরফানের মায়ের মুখে অপরাধী ভাব। ইরফানের চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি।

ইরফান প্রায় ছুটে এসে আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে- তুমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছ?
– না।
– থ্যাংক গড। আমিও করিনি এখনো। আই অ্যাম সো স্যরি ফর ইওর লস! বাট আমাকে মাফ করে দাও প্রত্যাশা! আমাকে আর একবার ক্ষমা করে দাও! আমি… আমি কথা দিচ্ছি আমি এবার সব ঠিক করে দেব।

আমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম- কি বলতে চাও পরিষ্কার করে বল!
ইরফান বলে- সামারা আসলেই চীট করেছে। তখনও করেছিল, এখন আবার করছিল। ওর আর রবিনের প্ল্যান ছিল বিয়ের শপিং এর সব গহনা, শাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। আমি ওদের হাতেনাতে ধরেছি!
-মানে টা কি?

কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ইরফান যেটা বোঝাল সেটা হল- সামারা আর রবিনের আগে থেকেই রিলেশন ছিল। সামারা ইরফানের টাকার জন্য তার সাথে নাটক করেছিল। এরপর রবিন আর সামারার ঝগড়া লেগেছিল। তখন রবিন রেগে গিয়ে ইরফানকে সামারা আর তার কিছু ছবি দেখায়। এরপর ইরফানের দু’জনের কারো সঙ্গেই কোন যোগাযোগ থাকে না। কিন্তু আম আর দুধ আবার মিলে যায়। সামারা আর রবিন বিদেশে চলে যায়। সেখানে বিয়ে করে। কিন্তু ওখানে বেশি সুবিধা করতে পারছিল না বলে রবিন আবার দেশে চলে আসে। সামারা একটা কোর্স করছিল। সেটা শেষ হওয়ার কয়েকদিন বাকি ছিল। তখনই একদিন সে ইরফানকে দেখে।
রবিনের সাথে প্ল্যান সাজিয়ে সে নিজে থেকে একদিন ইচ্ছে করে ইরফানের সামনে পড়ে যায়। এরপর ইরফানকে মিথ্যা ভুলভাল বুঝিয়ে তার সাথে দেশে এসে বিয়ের নাটক সাজায়। তাদের প্ল্যান ছিল বিয়ের সব গহনা নিয়ে আবার পালাবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইরফান সামারাকে একদিন সারপ্রাইজ দিতে তার বাসায় আগেই পৌঁছে যায়। আর সে সামারা আর রবিনকে একসাথে ধরে।

ইরফান হাত জোর করে বলে- চল প্রত্যাশা। আমি সেবার আমার মনকে যখন রাজি করিয়ে ফেলেছি তোমার সাথে একসাথে থাকার চেষ্টা করব বলে, তখনই সামারা এসে আমাকে তছনছ করে দিয়েছে! প্লিজ আরেকটা সুযোগ আমায় দেও। আমরা একসাথে ভাল থাকব প্রত্যাশা!
আমি খুব ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলাম- তোমার কি মনে হয় তুমি আরেকটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখ। আমি কি তোমার টেনিস বল নাকি পুতুল? এই নিয়ে গেলে, এই ফেলে দিলে? আর ভবিষ্যতে তুমি যে আর অন্য কোন সম্পর্কে জড়াবে না সেটার গ্যারান্টি আছে?
ইরফান মাথা নিচু করে বলে- জড়াব না। প্রমিজ।
আমি আজ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম- আচ্ছা ইরফান, তোমার ক্যারেক্টর খারাপ, তোমার মদের নেশা আছে, আরো কত কি! কিন্তু আমার চরিত্রে আজ পর্যন্ত কোন দাগ লাগেনি। তাহলে আমি কেন তোমার সাথে যাব?
এতক্ষণে ইরফানের মা বললেন- আমাদের ভুল হয়ে গেছে প্রত্যাশা। যাও তোমার ব্যাগ নিয়ে এসো। চল আমাদের সাথে। উই আর স্যরি।

আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম।

এরপর ডিভোর্স পেপার সাইন করে নিয়ে এসে ইরফানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম- তুমি মুক্ত। আমি তোমার সাথে থাকব না। বাবা নেই ঠিকই, কিন্তু বাবা বলে গেছেন মাথা নত না করতে।

ইরফান মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

তার মা হতভম্ব হয়ে গেছেন। উনি হয়তো আশা করেছিলেন যে আমি ব্যাগ আনতে গিয়েছি!

আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম- আপনার বাকি টাকাটাও আমি দিয়ে দেব। আপনারা এখন আসতে পারেন।
***

দুই বছর পর।

আজ আমি ভীষণ খুশি। তার দুইটা কারণ।

আজ আমি ইরফানের মায়ের সব টাকা পরিশোধ করেছি। বাড়ি ভাড়া, প্রমির পড়ার খরচ, নিজের মাস্টার্স সব মিলিয়ে টাকা শোধ করতে একটু সময় লেগেছে। কিন্তু আজ আমি পেরেছি।

এই দুই বছরে অনেক স্ট্রাগল করেছি। পাড়া-পড়শী অনেক কথা বলেছে। আমি সবার কথার উত্তর দিয়েছি।

ডিভোর্স নিয়ে কেউ কথা উঠালে আমি বলতাম- আমার কাছে ওদের সবার নাম্বার আছে। আপনি বলুন কার কাছ থেকে ডিভোর্সের কাহিনী শুনতে চান। তাকে ফোন করে দেই।

যখন কেউ বলত আমার জন্য প্রমির বিয়ে হবে না সে উত্তর দিত- আচ্ছা আপনি তো আমার কেউ নন। আমার জন্য আপনার এত চিন্তা কেন? আমি আমার জুড়ি নিয়েই পৃথিবীতে এসেছি।

আমি চাকরির পাশাপাশি শুক্রবার-শনিবার টিউশনি করেছি। পাশাপাশি মাস্টার্স করেছি। প্রমি এখন মেডিকেল কলেজে পড়ছে।

আর আজ দেশের একটা নামকরা কোম্পানি থেকে আমি ডাক পেয়েছি। বেশ বড় পোস্টে আজ আমার চাকরি কনফার্ম হয়েছে। ভাল বেতন, চমৎকার সুযোগ সুবিধা।

ইরফানের সাথে আমি আর কোন যোগাযোগ রাখিনি। সে চেষ্টা করেছিল বেশ কয়েকবার। আমি পাত্তা দেইনি। যখন আমার তার সাপোর্টের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, তখনই সে ছিল না!

আমি এখন ছাদে দাঁড়িয়ে আছি।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম- তুমি বেঁচে থাকতে তোমাকে দেখাতে পারিনি। কিন্তু আজ আমি সফল বাবা। তোমার কথা আমি রাখতে পেরেছি। নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করে, নিজে আত্মনির্ভরশীল হয়েছি।
তোমার কথা আমি রেখেছি বাবা। তোমার ইচ্ছে পূরণ করেছি। তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা।

আমার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
[সমাপ্ত]

1 মন্তব্য

  1. Onek din por ekta golpo porlam jekhane ekta meye k sotti karer respect deoa hoyeche.. Ami nije ekjon atmosomman somponno meye hisebe jani je kotota porjonto ekta meye tolerate korte pare.. Just like the story and the character..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে