প্রত্যাশা পর্ব-০২

0
1099

#গল্প
প্রত্যাশা
#পর্ব_২
-শাতিল রাফিয়া

আমার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে নায়ক উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে সালাম দিল।

বাবা খুবই ক্লান্ত। কুশল বিনিময় করার মত অবস্থা তাঁর নেই। উনি শুধু মাথা নাড়লেন। মা এমন সময় তাড়াতাড়ি এলেন।

নায়কের দিকে তাকিয়ে বললেন- বাবা একটু বোস।

এরপর আমাদের তিনজনকে নিয়ে মা ভেতরে ঢুকে গেলেন। বাবাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মা আমাকে হাত ধরে টেনে কোণায় নিয়ে গেলেন।

এরপর ফিসফিস করে বললেন- বিয়ের পর ছেলেটা প্রথম এসেছে আর এদিকে বাসায় ভাত, ডাল আর ডিম ছাড়া কিচ্ছু নেই। কি লজ্জা! আর ওকে বসিয়ে রেখে আমি যেতেও পারছি না। তুই… আচ্ছা না থাক। আমি প্রমিকে পাঠাই। তুই গিয়ে কথা বল।

মা ঘুরে চলে যাওয়ার আগেই আমি হাত টান দিয়ে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- এটা কে?
মা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললেন- কি বললি?
আমি শান্ত সুরে আবার জিজ্ঞেস করলাম- এটা কে?
– কে মানে? তুই ইরফানকে চিনিস না? তার ছবি-টবি কিছু দেখিসনি?

মুহূর্তে আমার মুখ শক্ত হয়ে গেল! তার মানে ঠিক সন্দেহ করেছিলাম। না আমি ইরফানকে কখনো দেখিনি। বিয়ের আগে তাকে দেখার কোন ইচ্ছে আমার হয়নি। বিয়েটা তো আর মন থেকে করিনি। বিয়ের পরে তাকে দেখার যেটুকু ইচ্ছে জন্মেছিল, ইরফান বিয়ের রাতে আমাকে রেখে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে যাওয়ায় সেই ইচ্ছেও মরে গেছে। এক বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে তার ওপর!

আমি কঠিন গলায় মাকে প্রশ্ন করলাম- সে এখানে কী করছে?
মা অবাক হয়ে উত্তর দিলেন- কী করবে আবার? তোকে নিয়ে যেতে এসেছে। আচ্ছা তুই গিয়ে কথা বল। আমি প্রমিকে খাবার কিনতে পাঠাই।
আমি মাকে বললাম- কাউকে কোথাও পাঠাতে হবে না। আড়াইশো টাকা দিয়ে যে গ্রিল হাফ মুরগি কিনে আনবে সেটা হয়তো সে ছুঁয়েও দেখবে না। সে আরো অনেক ভালো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। এই আড়াইশো টাকার মুরগি নয়।
– কী বলছিস এসব?
– ঠিকই বলছি মা। পঁচিশ লাখ লিখতে কয়টা শূন্য দেব সেটা যেমন আমাদের হিসাব করতে হয়, সেরকমই আড়াইশো লিখতে ক’টা শূন্য লাগে সেটা ওদের চিন্তা করতে হয়!

মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ইরফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে মোবাইলে কিছু একটা করছিল।

আমাকে দেখে বলল- চল?

আমি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম। মনে হচ্ছে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। যে মানুষটাকে বিয়ে করেছি, তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে এটা কি ধরনের বাক্যালাপ হল?

ইরফান মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে রওনা দিয়ে আমার থেমে গেল।

পেছন ফিরে মাকে বলল- আসি।
মা বললেন- অনেক কষ্ট করলে। কিছু খাওয়াতেই পারলাম না। বুঝতেই পারছ বাবা…
মাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সে যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বলে- ঠিক আছে।

অবশ্য তার বিরক্তিটা সে তাড়াতাড়ি লুকিয়েও ফেলল। বুঝতে পেরেছি আমাকে নিতে আসার কোন ইচ্ছেই তার ছিল না। এসেছে হয়তো শাশুড়িমায়ের কথায়।

আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ইরফান নিজেই গাড়ির দরজা খুলে দিল। আমি সামনে বসলাম। ইরফান ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। আমাদের এই ভাঙাচোরা এলাকার তুলনায় তার গাড়ি অনেক দামী, অনেক স্ট্যান্ডার্ড, হাইফাই। সেটা নিয়ে অবশ্য তাকে বিচলিত মনে হল না। সে বেশ স্বাভাবিকভাবেই রওনা দিল।

পথে সে কোন কথাই বলল না। আমি যে তার নতুন বিবাহিত স্ত্রী, তার পাশেই বসে আছি, এটা মনে হয় সে ভুলেই গেছে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে গাড়ি সিগন্যালে আটকাল।
সে হঠাৎই এফএম রেডিও অন করে।

একজন আরজে বলছেন – “পছন্দের মানুষকে প্রিয় গান শোনাতে আমাদের ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট করুন। এখন প্লে করছি জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী হাবিব ওয়াহিদের কণ্ঠে ‘হৃদয়ের কথা’ সিনেমা থেকে ‘ভালবাসবো বাসবো রে বন্ধু’ গানটি। গানটি অনিক তার গার্লফ্রেন্ড নীলাকে ডেডিকে…”

এটুক বলতেই ইরফান রেডিও স্টেশন পাল্টে দিল।

এরপরের চ্যানেলে ‘নয়নও সরসী কেন ভরেছে জলে’ বাজছে।

আবার বদল।

এরপরের চ্যানেলে আরজে বললেন- “লিসেনার্স চলুন আজ জোছনায় ভিজে আসি। শুনে আসি এই ‘মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি’ চমৎকার ট্র‍্যাকটি…”

ইরফান ঘটাং করে রেডিওটা বন্ধ করে বলে- দুচ্ছাই! সবখানে শুধু প্রেম আর ভালোবাসা! শালার!

আমি হা করে তার কান্ডকারখানা দেখছি!

গালিটা দিয়ে সে জিহ্বায় কামড় দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- স্যরি! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। তুমি যে পাশে আছ খেয়াল ছিল না। সবসময় বন্ধুদের সাথে এভাবেই কথা বলি তো!

আমার ক্রোধে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। চোখে পানি চলে আসল!

সে অবাক হয়ে, অপ্রস্তুত হয়ে বলে- কাঁদছো কেন? স্যরি বললাম তো!
আমি অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম- ভালোই তো পার্টি, ক্লাব, মদ-গাঁজা আর নারীসঙ্গ নিয়ে ছিলে। হঠাৎ এই বিয়ে করার ভূত মাথায় কেন চাপলো?

সে আমার প্রশ্ন শুনে আমার দিকে চমকে তাকাল! তার মুখে হঠাৎই একটা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।
আমি হঠাৎ তার হাসি দেখে কেঁপে উঠলাম। সে দেখতে যতটা না সুন্দর, হাসলে তাকে শতগুণ বেশি সুন্দর লাগে। কেমন নেশা ধরিয়ে দেয় সেই হাসি!
ততক্ষণে সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে।

সে হাসিটা ধরে রেখেই সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি টান দিল।

এরপর ধীরে ধীরে উত্তর দিল- বিয়ে করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না প্রত্যাশা। তবে কি জানো, বিয়েটা আমাকে করতেই হতো। সবাই এমন চাপাচাপি করছিল। কী আর বলব! মনে হচ্ছিল বনে-বাঁদাড়ে পালিয়ে যাই।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম- বিয়েটা আমাকেই করতে হল? বনে পালিয়ে যেতে! আমার মত এত লোয়ার ক্লাস এক…
আমার কথার মাঝখানেই ইরফান বলল- তোমার ক্লাস, কাস্ট এসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। আমি কখনোই মানুষের এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার কাছে তোমাকে বিয়ে করা আর আমাদের হাই ক্লাস সোসাইটির কাউকে বিয়ে করা একই কথা। তার কারণ তুমি থাকবে তোমার মত, আমি আমার মতো। আমি যেমন তোমাকে ঘাঁটাব না, তুমিও আমার পার্সোনাল লাইফে কোন ইন্টারফেয়ার করবে না? ওকে?

আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না।

ইরফান আবার বলে- বাই দ্যা ওয়ে, তবে একটা কথা কিন্তু সত্যি।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে সে বলে- তোমার ছবি দেখে আমার মাথা সত্যিই কিছুক্ষণ হ্যাং হয়ে গিয়েছিল। তুমি দেখতে যেরকম সুন্দর, ঠিক সেরকম নিজেকে মেন্টেইন করেছ! কিভাবে করলে বল তো? আই মিন মেয়েরা নিজেকে ফিট রাখার জন্য জীমে যায়, চেহারার উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে পার্লারে যায়। বাট স্যরি টু সে, তোমাদের ইকোনোমিক কন্ডিশন তো এরকম ছিল না!

আমার ইচ্ছে করল ইরফানের টুঁটি চেপে ধরি! এগুলো কী ধরনের কথা! ছি! সে কি চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে আমার অবস্থান দেখিয়ে দিচ্ছে?

আমার উত্তর না পেয়ে ইরফান আবার বলে- তো যেটা বলছিলাম, আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করবে না। ওকে?
এইবার আর না পেরে আমি মুখ খুললাম- নো। নট ওকে। তোমার মা আমাকে নিয়ে এসেছেন তোমাকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য। আর এইজন্য উনি আমার মাকে লোন দিয়েছেন, বাবার চিকিৎসার টাকা দিয়ে আমাকে বেঁধে রাখছেন। আ…

কথা শেষ না করে আমি হঠাৎই হাউহাউ করে কান্না করে দিলাম। ইরফান এবার হঠাৎই গাড়িটা একসাইডে দাঁড়া করাল।

এরপর আমার দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর গলায় বলল- শোন প্রত্যাশা। আমি তোমাকে সোজাসুজি কয়েকটা কথা বলি।
আমি চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- বল।
– প্রত্যাশা রোজ রোজ একই খাবার খেতে কারোরই ভালো লাগে না। আমিও ঠিক সেরকম প্রতিদিন অফিস কর, বাসায় এসে স্ত্রীর সাথে সময় কাটাও, পরদিন আবার অফিস যাও, সপ্তাহান্তে ঘুরতে যাও, এই একই কাজ বারবার করতে পারব না।

আমি বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম!

ইরফান বলে- আবার সেরকমই সবসময় বাইরের খাবার খেতেও ভালো লাগে না। তখন মানুষের ফ্যামিলির দরকার হয়, কাছের মানুষের দরকার হয়। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বোঝাতে চাইছি?

আমি ডানে বামে মাথা নাড়লাম।

ইরফান স্বাভাবিক গলায় বলল- আমি প্রতিদিন বাসায় আসব না। আবার এমনও নয় যে কোনদিনই আসব না। আমি আসি আর না আসি, যা ইচ্ছে তাই করি না কেন, তুমি এসবে মাথা ঘামাবে না। আমিও তোমার কাছে কিচ্ছু আশা করব না, কিচ্ছু চাইব না। তুমি তোমার মতো থাকবে, আমি আমার মতো।

তার কথা শুনে আমি অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি।

জিজ্ঞেস করলাম- খাবার খাওয়া আর একসাথে থাকার বিষয়টা কি এক?
– আমার কাছে এক।
– কিন্তু সবাই তো থাকছে। তোমার মতো জঘন্যরকম চিন্তাভাবনা করলে তো কেউ একসাথে থাকতেই পারতো না।
– আমিও একসময় সবার মতই ছিলাম। সবার মতই চিন্তা করতাম।
– তাহলে বিয়েটা করেছ কেন?
– বললাম তো সবাই মিলে ঘ্যানঘ্যান করে জীবন নরক বানিয়ে দিচ্ছিল।
আমি এবার চিৎকার করে বললাম- চমৎকার! নিজের জীবন নরক হয়ে যাচ্ছিল বলে তুমি বিয়ে করে আমার জীবন নরক বানিয়ে দিলে ইরফান?
ইরফান কঠিন গলায় উত্তর দেয়- প্রত্যাশা আমি তোমার জীবন দোজখ বানাইনি। বরং তুমি উপকৃত হয়েছ আমাকে বিয়ে করে। তোমার বাবার চিকিৎসা হচ্ছে, তুমি সেফলি থাকতে পারছ। তোমার বাবার চিকিৎসাটাই কিন্তু মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট এই সময়ে।

আমি নিষ্পলক চোখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইলাম! সে আমাকে কতটা ছোট করল সে কি জানে? সে কি আমাকে লোভী ভেবেছে? আমি তো চাকরি করে তাদের লোন শোধ করে দেব। আমাদের মত মেয়েদেরও যে আত্মসম্মানবোধ আছে সেটা হয়তো সে মনেই করে না।
আমার চোখ ছলছল হয়ে গেল।

ইরফান হঠাৎই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- স্যরি। আমি যদি কোনভাবে তোমাকে হার্ট করে থাকি, দেন আই অ্যাম স্যরি! আমি আসলে অনেক টায়ার্ড। দুপুরে এসেছি, এরপরে বিকেলেই মা তোমাকে আনতে পাঠিয়ে দিলেন। তার মধ্যে এসব কথাবার্তা! সব মিলিয়ে অসহ্য লাগছে। আই নিড রেস্ট! আই অ্যাম ভেরি স্যরি, প্রত্যাশা।

আমি অন্যদিকে তাকালাম। ইরফান আবার গাড়ি স্টার্ট করল।

বেশ কিছুদিন পার হয়েছে…

আমার একেকটা দিন বিষাক্ত লাগে। বাবার অবস্থার কোন উন্নতি নেই। কারণ বাবা ঠিকমতো কেমো নিতে পারছেন না। কেমোর ধকল সহ্য করতে পারছেন না। তাঁর শরীর ভীষণ খারাপ।

তার ওপর আমার শাশুড়িমা আমার ওপর প্রচন্ড অসন্তুষ্ট। আমি এসেও তার ছেলেকে বেঁধে রাখতে পারছি না। এটা নিয়ে তিনি সারাক্ষণ তার অসন্তোষ প্রকাশ করে যাচ্ছেন।

একদিন বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললাম- আপনার ছেলে তো বাসায়ই থাকে না। আমি তার সাথে কথা বলব কখন?
শাশুড়িমা কঠিন গলায় বললেন- কেন বাসায় থাকবে না? সুন্দরী বউ এনে দিয়েছি তার পরেও বাসায় কেন থাকবে না? তুমি একটু সেজেগুজে থাকতে পার না ও আসার পর? একটু হাসিখুশি থাকতে পার না? সবসময় মুখটাকে মরা মাছের মত করে রাখ। কত করে বললাম একটা স্লিভলেস ব্লাউজ বানাও, অথবা কত ধরনের জামাকাপড় পাওয়া যায় আজকাল…
আমি তার কথার মাঝখানে আঁতকে উঠে প্রায় চিৎকার করে বললাম- মা প্লিজ। আমাকে এতটা নিচে নামাবেন না। আমি এটা কখনোই পারব না। আমার মানসিকতা এত নিচু নয়।

আমি কিছুতেই শাশুড়িমাকে বোঝাতে পারি না এই সম্পর্ক শুরু করার আগে আমার সাথে ইরফানের মনের মিল হওয়া প্রয়োজন। আমি আগে তার মনের ভেতর ঢুকতে চাই। আগে আমি তাকে ভালবাসি, ভাল করে বুঝি, সে আমার মনে এসে ধরা দিক এরপর।
কিন্তু ইরফান অধিকাংশ দিন বাসায় ফেরে না। কোন কোন দিন আবার একাই বাসায় থাকে। আবার কোন কোন দিন আমার শশুড় মশাই অফিস থেকে তাকে ঘাড় ধরে বাড়ি নিয়ে আসেন।

বাসায় থাকলে সে মুখটাকে বিষের মতো বানিয়ে রুমে বসে থাকে। কথা বললেও হু-হা করে উত্তর দেয়। নিজে থেকে কোন প্রশ্ন করে না। কতক্ষণ একা একা বকবক করে যাওয়া যায়?

এরমধ্যে একদিন শাশুড়িমাকে বলেছিলাম- মা আমি চাকরি করতে চাই।
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন- কেন? টাকাপয়সার কি অভাব আছে তোমার? আর তুমি চাকরি করলে সবাই কী বলবে? আমরা বাড়ির বউকে বাইরে কাজ করতে পাঠাই!

তার চিন্তাধারা দেখে আমি মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলাম!

এরপর কোনভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- আমি আপনার লোনের টাকাটা ফেরত দিতে চাই। সেজন্য চাকরি কর‍তে চাই। আপনাদের তো অনেক পরিচিত আছে। একটা অফিসে ঢ…
– এক কথা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করবে না তো! আর আমি আগেই বলেছি টাকা ফেরত দিতে হবে না। আমি তোমার বাবার চিকিৎসার সব টাকা দেব। তার বদলে দয়া করে তুমি সংসারে মন দাও। ইরফানকে আটকে রাখ নিজের মায়ায়।
– তাহলে আমি মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যাই?
শাশুড়িমা মাথায় হাত দিয়ে বললেন- যা পড়েছ, অনেক হয়েছে।
আমি রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কেন? আপনারা শিক্ষিত ছেলের বউ চান না?
– যে বউ ছেলেকেই ধরে রাখতে পারে না, সে শিক্ষিত না মূর্খ সেটা দিয়ে কী আসে যায়?

উনার মানসিকতা দেখে আমার আর উত্তর দেওয়ার কোন রুচি হল না।

যেহেতু আমাকে ওরা চাকরিতে ঢোকাবে না আমি নিজেই আমার সিভি বিভিন্ন অফিসে পাঠালাম। অনেক ক্ষেত্রে ক্রাইটেরিয়া ম্যাচ করে না। তবুও পাঠিয়ে দিলাম। তাদের দরকার হলে ঠিকই ডাকবে। একটা ছোট অফিস খুঁজে পেলাম সেখানের সার্কুলারে লেখা ছিল ‘ফ্রেশারস আর এনকারেজড টু এপ্লাই।’ অনেক আশা নিয়ে সেখানেও পাঠিয়ে দিলাম।

টিউশনিতে অনেকদিন যাইনি। স্নেহকে বাদ দিয়ে যেই দুইটা টিউশনি করাতাম সেখানে ফোন দিলাম। বাবার অসুস্থতার কথা জানালাম। দুই পরিবারই আমার সমস্যা বুঝল। এবং আবার পড়ানো শুরু করতে বলল।

পরদিন আমি সকালে তৈরি হয়ে নামলাম।

শাশুড়িমা আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন- কোথায় যাচ্ছ? আজ তোমার বাবার কেমো আছে?
আমি শান্ত গলায় বললাম- মা আমি টিউশনিতে যাচ্ছি।
– টিউশনিতে মানে?
– স্নেহ ছাড়াও আমি আরও দুইজনকে পড়াতাম। তারা আবার পড়ানো শুরু করতে বলেছেন।
শাশুড়িমা বললেন- ক’বার বলেছি যে চাকরি করতে হবে না। তোমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে না? টিউশনি করে কয় টাকা কামাবে তুমি? সেই টাকার আবার গরম দেখাচ্ছ আমাকে?
আমি অনেক কষ্ট করে নিজের মেজাজ ঠান্ডা রেখে বললাম- জ্বি না। আপনার টাকার দরকার না থাকলেও আমাদের আত্মসম্মানবোধ আছে। সেজন্যই টাকাটা ফেরত দেব। আর তাই চাকরিও করব। এখন যতদিন চাকরি না পাচ্ছি, ততদিন আমি টিউশনি করব। আর মাস্টার্সও করব। সেটার জন্যও টাকা যোগাড় করতে হবে। তাই আমার চাকরি করতে হবে।

শাশুড়িমায়ের চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেল।

– এখন টিউশনি করে তুমি বাড়ির মানসম্মান ডোবাবে? আর এত ছোট ঘরের মেয়েদের না আত্মসম্মানবোধ কম থাকাই ভালো।

নাহ! আর পারলাম না। মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।

আমি এবার ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম- আপনাদের বাড়ির বউ চাকরি করতে পারবে না, টিউশনি করতে পারবে না, মাস্টার্স করতে পারবে না। তার কাজটা কী? শুধু স্বামীকে নিজের আঁচলে বেঁধে রাখা? কিন্তু বাড়ির মেয়ে যে চাকরি করছে, ক্যারিয়ার নিয়ে সে এতই ব্যস্ত যে নিজের ছেলেকেই টাইম দিতে পারে না, সেই বেলায় কিছু হয় না, তাইনা? হতে পারে আপনারা অনেক বড়লোক, দুইহাতে পয়সা ওড়াতে পারেন, কিন্তু মন থেকে শিক্ষিত হওয়া এখনো অনেক বাকী আছে।
শাশুড়িমা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন- তুমি ইরিনার সাথে তোমার নিজের তুলনা করছ? তোমার স্ট্যান্ডার্ড দেখেছ? আর ওর স্ট্যান্ডার্ড দেখ। শোন মেয়ে, আমার মেয়ে তোমাদের মত কোন অগাবগা অফিসে কেরানির চাকরি করে না। সে বড় পজিশনে নাম করা অফিসে জব করে। তোমার জবটাও যদি ওই পর্যায়ের হতো, তাহলে কখনোই নিষেধ করতাম না।
– মা, আপু কি প্রথমেই এত ভাল পজিশনে জব পেয়ে গেছেন? হয়তো। আপনারা এত নামীদামী ফ্যামিলি, হয়তো সেই জোরেই পেয়েছেন। কিন্তু আমার বাবা এত হাইফাই না। আমার মামা-চাচারও জোর নেই। তাই আমাকে কেরানির চাকরি দিয়েই শুরু করতে হবে।

সকালের এই চেঁচামেচিতে ইরিনা আপু চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এল। আমার শশুর আর দুলাভাই অফিসের কাজে বাইরে গেছেন।

আপু বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে- সাত সকালে এত চেঁচামেচি কিসের? এটা কি বাসা না বাজার?
শাশুড়িমা মুখ বাঁকিয়ে বললেন- বাজার বানাতে আর বাকি কী রেখেছে? লো স্ট্যান্ডার্ডের মেয়েরা যেরকম হয় আর কি!
আমি কাষ্ঠ হেসে বললাম- অথচ এই লো স্ট্যান্ডার্ডের মেয়েটাকে নিজের ছেলের বউ করার জন্য একদিন আপনি আমার মায়ের কাছে কত অনুনয় করেছিলেন!
এরপর শাশুড়িমা আমার নামে একগাদা নালিশ করলে আপু চোখ কুঁচকে বলে- ওহ মা! যার যা স্ট্যান্ডার্ড বোঝ না? ওদের সোসাইটিটা এরকমই। সকালবেলা উঠে এর-ওর সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে।

ঠিক তখুনি ইরফান বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। তার চুল উশকোখুশকো, জামাকাপড় অগোছালো, চোখ লাল।

সে ঢুকে জিজ্ঞেস করে- সকাল বেলায় বাসায় কি মহাসমাবেশ বসিয়েছ?

ইরফানকে এই অবস্থায় দেখে আমি মুখে বিদ্রূপাত্মক হাসি ফুটিয়ে বললাম- ঠিকই বলেছেন আপু। আমরা তো তাও সকালবেলা এর-ওর সাথে ঝগড়া করি। আর আপনাদের সোসাইটিতে সব কাজ হয় রাতের আঁধারে। রাতেরবেলা স্ত্রীকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে! ছি!
ইরফান যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে- কী হচ্ছে এখানে? কেউ কি আমাকে বলবে?
শাশুড়িমা চেঁচিয়ে বললেন- কী আবার হবে! তোমার বউ চাকরি করতে যাচ্ছে। তাও যেই সেই চাকরি নয়! টিউশনি করতে যাচ্ছেন উনি!
ইরফান অবাক হয়ে বলল- হ্যাঁ তো যাক না! সমস্যাটা কোথায়?
– এই বাড়ির বউ হয়ে টিউশনি করাবে?
– ওর গায়ে কি ট্যাগ লাগানো আছে ও কোন বাড়ির বউ? আর আমি তো বুঝতে পারছি না এই বাড়ির বউ হয়ে টিউশনি করলে কি সমস্যা? কোন কাজই তো ছোট নয়!
শাশুড়িমা কাষ্ঠ হেসে উত্তর দিলেন- গলায় মোটা চেন পরে, হাতে ভারী চুড়ি, দামী শাড়ি পরে, দামী গাড়িতে চেপে টিউশনি করাতে গেলে সবারই চোখে পড়ে।
আমি এবার শান্ত গলায় বললাম- এসব গয়নাগাটি আমি চাইনি আপনার কাছে। আপনিই আমাকে দিয়েছেন। আর আমি একবারও বলিনি আমি টিউশনিতে যাওয়ার জন্য আপনাদের গাড়ি নেব!
চুড়িগুলো খুলে উনাকে ফেরত দিয়ে বললাম- আপনি রেখে দিন আপনার চুড়ি। আমার এসবের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই।
উনি মুখ ঘুরিয়ে বললেন- যেটা আমি একবার কাউকে দেই, তা আর ফেরত নেই না।

চেনটাও খুলতে চাচ্ছিলাম, ইরফান হঠাৎই এগিয়ে এল। আমার হাত থেকে চুড়ি গুলো নিয়ে আমার হাতেই আবার পরিয়ে দিল। এই প্রথমবার ইরফান আমার হাত ধরল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম!

ইরফান শান্ত গলায় বলল- বাইরে আমার গাড়ি আছে। ড্রাইভারও আছে। গাড়ি নিয়ে যাও। আর তোমাকে যখন দেওয়া হয়েছে, এই চুড়িগুলো তোমারই। এটা ফেরত দেওয়ার কিছু নেই।
ইরফান তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে- নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা অনেক বেশি মর্যাদার। সেটা যারা দাঁড়ায় তারাই বোঝে।
এরপর ইরিনা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল- অনেক মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, তারা কিন্তু জানে নিজে ইনকাম করাটা কতটা সম্মানের, তবুও অন্য কোন মেয়েকে আত্মনির্ভরশীল হতে দেখলে তাদের জ্বলে!

শাশুড়িমা আর ইরিনা আপুর জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে দিয়ে ইরফান ওপরে উঠে গেল। আর আমিও বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমি বের হওয়া মাত্র সব ড্রাইভার এলার্ট হয়ে গেল। কেউ কেউ তো গাড়ি স্টার্টও দিয়ে দিল। দারোয়ান তাড়াতাড়ি গেট খুলে দিল। আমি তাদের সামনে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে বের হলাম। একটা রিকশা ডেকে তাতে চড়ে বসে তাদের অবাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। রিকশায় বসে নিজের চুড়ি, চেন, আংটি সব খুলে ব্যাগে রেখে দিলাম। যে যাই বলুক আমার আত্মমর্যাদাবোধ আছে। আর আমি কিছুতেই তার জলাঞ্জলি দেব না।

[চলবে]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে