প্রতিদিন তুমি আমার পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
1193

#প্রতিদিন_তুমি_আমার (সমাপ্তি পর্ব)
আজ তিনতলার রেহান শেখ এর বড় মেয়ে রোদেলার গায়ে হলুদ। সন্ধ্যায় ছাদে বেশ জমজমাটভাবে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অসিফা কচি কলাপাতা রঙয়ের একটা শাড়ি পরে তিনতলা থেকে ছাদে ছোটাছুটি করে চলেছে বারবার। প্রতিবারই হাতে কোনো না কোনো খাবার ভর্তি থালা নিয়ে আসছে। এবার হলুদের বাটি হাতে নিয়ে ছাদে প্রবেশ করতেই সামনে শিখনকে দেখে চমকে ওঠে অসিফা। অসিফার দিকে প্রখর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শিখন বলে ওঠে,

“আর পাঁচদিন বাদে যার এসএসসি পরীক্ষা সে এখন হলুদের অনুষ্ঠানে এসে নাচানাচি করছে। হাউ সুইট!”
ভ্রু কুচকে শিখনের দিকে তাকিয়ে অসিফা বলে ওঠে,

“নাচানাচি কই করলাম? সারাদিন আমাকে ক্ষে’পা’তে না পারলে বোধ হয় আপনার ভালো লাগেনা। তাই না শিখন ভাই?”

“জানিসই যখন তাহলে জিজ্ঞাসা কেন করিস?”
শিখনের দেয়া উক্ত জবাবে থতমত খেয়ে যায় অসিফা। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রল করতে করতে হলুদের স্টেজের দিকে যেতে আরম্ভ করে শিখন। যেতে যেতে অসিফার দিকে না তাকিয়েই বলতে আরম্ভ করে,

“দুটো ছবি তুলে আমার হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে দিস তো। আর কাল সকাল ৬টায় সদর দরজা খুলে রাখিস। কালকেই লাস্ট পড়াব। আর ইংরেজি পরীক্ষার আগে ফাকে একদিন গিয়ে টুকটাক ইম্পর্টেন্ট বিষয় দেখিয়ে দিয়ে আসব।”
অসিফা রা’গে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,

“এখনও পড়ান চলুন। গায়ে হলুদে থেকে করব কি! পারলে আমার বিয়ের দিন এসেও ইংরেজি পড়িয়ে দিয়েন।”

“এমন কালো মেয়েকে এমন সম্ভ্রান্ত পরিবার বউ করে নিচ্ছে! কিভাবে সম্ভব? হুম বুঝেছি! রেহান ভাইর কয়টা টাকা আছে বলেই মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছেন। নাহলে এমন মেয়েকে কে নেবে?” কিছুটা টি’ট’কা’রি’র সুরে বলে ওঠেন চারতলার ডান পাশের ফ্ল্যাটের কাজল বেগম। তার কথাতে তাল মিলিয়ে আরও কয়েকজন মহিলা ফিসফিসিয়ে বলে ওঠেন,

“ঠিক বলেছেন ভাবি।”

“তা আপনাকেও বুঝি আপনার বাবা তার টাকার জোরেই আংকেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিল আন্টি? কেননা আপনার গায়ের রঙও তো রোদেলা আপুর মতোই। তবে! আপনি আপুর চেয়ে অনেক খাটো আন্টি। প্রশ্নটা কিন্তু আপনার দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকেই করেছি। আমার নয়। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিটা মানুষই তার নিজ নিজ গঠন আর বর্ণের দিক থেকে অপরূপ সুন্দর।” কথাগুলো পাশ থেকে কাজল বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে অসিফা। উক্ত কথায় উপস্থিত সকলের টনক নড়ে ওঠে। অসিফা পুনরায় বলে ওঠে,

“আমরা মেয়েরাই না মেয়েদের সবচেয়ে বড় শ’ত্রু। দেখুন তো! অনুষ্ঠানে উপস্থিত কোনো পুরুষ মানুষকে কি দেখছেন রোদেলা আপুর এটা ওটা নিয়ে সমালোচনা করতে? অথচ আপনারা তার অগোচরেই তাকে কোথায় নামিয়ে দিচ্ছেন! তাকে আর তার পরিবার নিয়ে ভাবনাকে কোথায় পৌছে দিয়েছেন! আপনার নিজের সন্তানও তো শ্যামবর্ণের কাজল আন্টি। তাকে নিয়েও কি এমন ধারণা পোষণ করে রেখেছেন? আমার তো তা মনে হয়না। আপনাদের তো অন্যেরটা নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতেই বেশ লাগে। আসলে নিজের চরকার চেয়ে অন্যের চরকাতে তেল দিতেই বেশি মজা।”

“এই মেয়ে তুমি বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বোঝা শিখেছো দেখছি! শুনি তো সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকো। তা বই পড়তে পড়তে কি ব্রেইনটাকে একদম খে’য়ে ফেলেছো নাকি? আদব-কায়দা তো কিছুই জানোনা দেখছি।” (কাজল বেগম)
কাজল বেগমের কথায় মৃদু হাসে অসিফা। অতঃপর হালকা দম নিয়েই বলে ওঠে,

“ক্লাস টেনে পড়া একটা মেয়ের মানসিকতা এতটুকু বিকশিত হওয়া কি স্বাভাবিক নয় আন্টি?” অসিফা কথা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই হঠাত শিখন এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,

“আমার তো মনে হয় বয়সের তুলনায় আপনার মানসিক বিকাশ আর মানসিকতার বিকাশ উভয়ই পিছিয়ে আছে আন্টি। এর জন্য আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবেনা। বেশি বেশি ভালো কাজ করার চেষ্টা করুন। আপনা-আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর আর মানুষকে নিয়ে এমন কু’রুচিপূর্ণ চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খাবেনা। অসিফা আন্টি খুজছে তোকে। যা আন্টির কাছে যা।”

শিখনের আদেশে অসিফা ছুটে স্টেজের দিকে চলে যায় নিলুফা বেগমের কাছে। শিখন একগাল হেসে উপস্থিত মহিলাদের দিকে তাকাতেই তাদের চোখে-মুখে আ’ত’ঙ্কে’র ছাপ ফুটে ওঠে। শিখন হাসতে হাসতেই অসিফার পিছু পিছু স্টেজের দিকে চলে যায়।
—-
আজ অসিফার শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরোতেই মেইন ফটকের সামনে শিখনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অসিফা একগাল হেসে সেদিকে দৌড়ে যায়।

“আপনি এসেছেন?”

“আমার একমাত্র গার্লফ্রেন্ড আসতে বলেছে আর আমি আসব না? পরীক্ষা কেমন হলো?”

“খুব ভালো।”

“চল বাসার দিকে যাই তাহলে। কিছুটা সামনে ফুচকাওয়ালাকেও দেখে এসেছি। একসাথে ফুচকা খাব আজ।” বলে সেদিকে হাটতে আরম্ভ করতেই অসিফা হঠাত শিখনের হাত ধরে টেনে নিয়ে বিপরীত পথে হাটা শুরু করে।

“উলটো পথে যাচ্ছিস কেন?”

“আজ অসিফার তার একমাত্র টেম্পু ড্রাইভারের সাথে রিকশা করে সারা শহর ঘুরতে মন চাইছে।”

“বাসায় যেতে লেট হলে তোকে আংকেল ব’ক’বে তো!”

“আব্বু বাসায় নেই। রাত হবে আসতে। আম্মুকে ম্যানেজ করতে পারব আমি।” বলেই একটা রিকশা ডেকে নিয়ে শিখনের হাত টেনে নিয়ে তাতে চড়ে বসে অসিফা।”

“কই যাবেন আফা?”

“আপনার যেখানে ইচ্ছা হয় সেখানে নিয়ে চলুন। তবে আপাতত সোজা চালাতে থাকেন।”
অসিফার এহেন কথায় রিকশাওয়ালা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শিখন বলে ওঠে,

“সামনের ওই শিশু পার্কটার দিকে চলুন।”
অসিফা মুখ গোমরা করে শিখনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“আমাকে আপনার বাচ্চা মনে হয়? আমি শিশু পার্কে গিয়ে কি করব?”

“তোকে বাচ্চা বলেছি নাকি? বাচ্চা তো আমি। শিশু পার্কে গিয়ে দোলনায় চড়ব আমি! দোলনা দেখলে যে দিশেহারা হয়ে যাবি তাতো নিজেও জানিস।” বাজখাই কন্ঠে কথাগুলো বলে ওঠে শিখন।

শিশু পার্কের সামনে রিকশা এসে থামতেই বাইরে থেকে পার্কের ভেতরের একটা ফাকা দোলনা দেখে চোখ চকচক করে ওঠে অসিফার। কিছু না বলেই রিকশা হতে নেমে ছুটে পার্কের ভেতরে যেতে নিলেই গেটের সামনে থেকে তাকে আটকে দেয় কিছু লোক। প্রবেশের টিকিট না কাটলে ভেতরে ঢোকা যাবেনা। শিখন চোখ দিয়ে ইশারা দিতেই লোকগুলো অসিফাকে ভেতরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। অসিফা একবার শিখনের দিকে তাকিয়ে স্মিথ হেসে দৌড়ে ভেতরে গিয়ে ফাঁকা দোলনাটা দখল করে নেয়।
শিখন টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে অসিফার দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। অসিফাকে ঝড়ের গতিতে দোল খেতে দেখে শিখন মুচকি হেসে ওঠে। এই মুহূর্তে তার পুরনো দিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। খুব ছোটবেলা হতেই তারা একই বিল্ডিং এ থাকছে। ছোটবেলাতে প্রতি শুক্রবার শেফা বেগম ও নিলুফা বেগম অসিফাকে নিয়ে এই পার্কেই আসতেন। শিখনও ছুটিরদিন হওয়ায় প্রায়ই তাদের সাথে আসতে বাধ্য হতো। যদিও ছোটবেলা হতেই তার শিশু পার্কের প্রতি তেমন একটা ঝোঁক ছিল না। অসিফার বরাবরই ছোটবেলা হতে দোলনার প্রতি প্রবল ঝোঁক। ফ্রক পরিহিতা ও ঘাড় অবধি চুলগুলো দু পাশে দুটো ঝুঁটি করা ছোট্ট অসিফা যখন দোল খেত আর খিলখিল করে হাসত, শিখন তখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে শুধু অসিফাকেই দেখত। গোলগাল অসিফার গালদুটো সবসময় টানতে মন চাইতো শিখনের। একদিন সাহস করে যেই অসিফার গাল দুটো ধরে টেনেছিল সে ওমনি অসিফা মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি করে কেঁদেকেটে সব একাকার করে ফেলেছিল। এসব কথা মনে করে আনমনেই হেসে ওঠে শিখন। অসিফার দিকে তাকাতেই তার মনে হতে থাকে এই তো সেই ছোট্ট ফ্রক পরিহিতা গোলগাল অসিফা দোলনায় দোল খাচ্ছে! এই মেয়েটা শুধু একান্তই তার। এই মেয়েটার প্রতি শুধু তারই অধিকার রয়েছে। হঠাত মৃদু ঝ’গ’ড়া’র শব্দ কানে ভেসে আসতেই হুশ ফেরে শিখনের। স্পষ্টভাবে চেয়েই দেখে অসিফা একটা বাচ্চা ছেলের সাথে রীতিমতো ঝ’গ’ড়া করছে। ছেলেটা বারবার তাকে দোলনা হতে উঠতে বলছে আর অসিফা তার বলা এক বাক্যেই স্থির হয়ে আছে,”আমি আগে বসেছি তাহলে আমি কেন উঠব?” পরিস্থিতি অস্বাভাবিক বুঝে শিখন দৌড়ে গিয়ে অসিফাকে টেনে দোলনা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে কিছুটা দূরে। অসিফার হাত ছেড়ে দিয়ে বড়সড় একটা দম ফেলে শিখন বলে ওঠে,

“বাচ্চাটার সাথে ঝ’গ’ড়া করছিলি কেন? আমার তো ভয় লাগছে,দুদিন পরে নিজের বাচ্চা হলে কিভাবে সামলাবি! বাচ্চার চকলেট,চিপস তো নিজেই কে’ড়ে খেয়ে নিবি যা দেখছি।”

“তা নিজে কি বাচ্চার বাপ এমনি এমনি হবেন নাকি? সব তো আপনাকেই সামলাতে হবে।” কথাগুলো বেশ উচ্চ স্বরেই বলে অসিফা। লজ্জায় শিখন আসপাশে তাকাতে থাকে যে কেউ শুনেছে কিনা। পাশে দাঁড়িয়ে কিছু মহিলাকে হাসতে দেখে শিখন দ্বিগুণ লজ্জা বোধ করে মাথা নুয়ে ফেলে। শিখনকে মাথা নুয়ে ফেলতে দেখে অসিফা আসেপাশে তাকাতেই তার সম্ভিত জ্ঞান ফিরে আসে। জিভ কেটে শিখনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“এইরে সরি শিখন ভাই। আমি আসলে খেয়াল করিনি।”
দাঁতে দাঁত চেপে শিখন বলে ওঠে,

“তুই যে হুটহাট এভাবে লজ্জায় ফেলাটা কোথা থেকে শিখেছিস আমি ভেবে পাচ্ছিনা।”

“কেন আপনার থেকে!”
এহেন কথা কর্ণগোচর হতেই শিখন বিস্ফোরিত নয়নে অসিফার দিকে চেয়ে পড়তেই অসিফা চোখ টিপ্পনি কাটে।
—-
বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকাল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। সদর দরজা খোলা পেয়ে নিঃশব্দে পা ফেলে ড্রইং রুম ত্যাগ করে নিজের রুমের দিকে যেতে আরম্ভ করে অসিফা।

“পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুপুর একটায়। তবে এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?” গম্ভীর এক পুরুষালী কন্ঠের এহেন কথা কানে বাজতেই অসিফা চমকে উঠে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছুটা দূরেই আসিফ খন্দকার চোখ-মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন।

“আব্বু তুমি কখন এলে?”

“তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করেছি তার উত্তর দাও আগে। এতক্ষণ কোথায় ছিলে? শিখনের সাথে রিকশায় চড়ে কোথায় গিয়েছিলে?”
শেষের কথাটুকু শুনে ভয়ে কেঁপে ওঠে অসিফা। শিখনের সাথে সে রিকশায় চড়ে কোথায় গিয়েছিল এটা আসিফ খন্দকারের কানে কোথা থেকে এলো ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসে অসিফার। জবাব না পেয়ে আসিফ খন্দকার পুনরায় বলে ওঠেন,

“কি হলো জবাব দাও? ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে রিকশায় উঠেছিলে এটাও মানুষ দেখেছে। তোমাদের নাকি প্রায়ই একসাথে দেখা যায় রাস্তায়? বাসায় এসে পড়ানোর পার্মিশন দিয়েছি বলে কি রাস্তাঘাটে একসাথে চলাফেরা করতেও বলেছি? তোমার দ্বারা এমন কিছু আমি কখনোই আশা করিনি অসিফা।”

আসিফ খন্দকারের এহেন কথায় চোখ টলমল করে ওঠে অসিফার। কিভাবে সব বোঝাবে তা আর মাথায় খেলে না । এর মাঝে নিলুফা বেগমও ড্রইং রুমে এসে উপস্থিত হন।

“অসিফা এত দেরি হলো কেন আসতে? কোথায় ছিলি এতক্ষণ? জানিস কত টেনশন করছিলাম আমরা?”
বড়সড় একটা দম নিয়ে অসিফা বলে ওঠে,

“আমি অনেক অনেক দুঃখিত আব্বু-আম্মু। আমি আসলেই ভুল করে ফেলেছি। আসলে পরীক্ষা শেষ তাই সেই উত্তেজনায় সব গুলিয়ে ফেলেছিলাম। তোমাদের একটা কল করে জানানো উচিত ছিল আমার। আব্বু আমি শিখন ভাইকে পছন্দ করি। কিন্তু তোমাদের সম্মান চলে যাবে এমন কিছু আমি করিনি কখনোই।”

মেয়ের মুখে এহেন কথা শুনে আসিফ খন্দকার নির্বাক হয়ে যান। এমনটা হওয়া হয়তোবা স্বাভাবিক। নিলুফা বেগম বলে ওঠেন,

“তুই সজ্ঞানে বলছিস তো?”

“যা বলছি সজ্ঞানেই বলছি। আমি কখনোই চাইনা আমার জন্য তোমাদের নাক কা’টা যাক। এই কথাটা আমি পরীক্ষার পরেই বলে দিতাম তোমাদের। আমি নিজেই এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছি অল্প কিছুদিন হলো। আমি সত্যিই শিখন ভাইকে অনেক পছন্দ করি আম্মু। আবেগের জোয়ারেও গা ভাসাচ্ছিনা আমি। আমার প্রথম টার্গেটই আমার ক্যারিয়ার। তারপর অন্যকিছু।”

“সন্ধ্যায় সাকলাইন ভাই আর শেফা ভাবিকে শিখনকে নিয়ে বাসায় আসতে বলো নিলুফা।” বলেই বেড রুমের দিকে পা বাড়ান আসিফ খন্দকার। অসিফা অসহায় দৃষ্টিতে একবার নিলুফা বেগমের দিকে তাকায়।

“এখন কি হবে আম্মু?”

“ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। কি হবে তা পরে দেখা যাবে।”

“তুমি আমার ওপরে রে’গে আছো আম্মু? আমি সরি আম্মু। আর কোনোদিন এমন হবেনা।”

“তোর মায়ের রাগ নেই। তোর মা রাগ করেনা।”

নিলুফা বেগমের মাঝে এমন কঠোরতা দেখে আচমকা কেদে ওঠে অসিফা। মেয়ের চোখে পানি দেখে কেঁপে ওঠেন নিলুফা বেগম। দুইহাতে মেয়েকে আগলে নিয়ে বলে ওঠেন,

“কাদছিস কেন বো’কা মেয়ে? আমি রাগ করিনি।”

“আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু। এমনটা আর কোনোদিনও হবেনা। আমার উচিত হয়নি তোমাদের না জানিয়ে যাওয়া। আমি এটাও বুঝিনি কখন শিখন ভাই আমার মন দখল করে নিয়েছে। আর আজকে শিখন ভাইয়ের কোনো দোষ নেই মা। আমিই জোর করে নিয়ে গিয়েছিলাম।”

মেয়ের এমন সহজ-সরল মনোভাব ও স্বীকারোক্তিতে মুগ্ধ হন নিলুফা বেগম। মেয়েটা পারলে তো তাদের আস্থাকে অপব্যবহার করে মিথ্যা কাহিনীও তাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারতো। যেটা বর্তমানে প্রায়ই সংখ্যক টিনেজার করে থাকে। নিলুফা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন,

“সারাজীবন এমনি থাকিস আব্বু-আম্মুর কাছে। তবে জীবনে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় একটাবার তোর আব্বু-আম্মুকে তাতে সামিল করিস। এখন যা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি এখনো খাইনি।”

অসিফা মুগ্ধ নয়নে তার মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। তার আব্বু-আম্মুকে সে তার সাথে দরকারে কঠোর হতে দেখেছে আবার কোমল হতেও দেখেছে। যার জন্যই হয়তো এখন পর্যন্ত জীবনে কোনো প্রবল বাঁধার সম্মুখীন সে হয়নি। ঠিক কোনো না কোনোভাবে তারা তাকে পার করে দেয় সবকিছু হতে। শিখন ছেলেটাও তাকে সকল খারাপ-ভালো মুহূর্তে আগলে রাখে। আব্বু-আম্মুর পরে সেই একজন যে তাকে সঠিক পথে ধাবিত হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে থাকে। এমন মানুষকে কেইবা হারিয়ে যেতে দিতে চায়? অসিফা সৃষ্টিকর্তার দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া জানায় এমন মানুষগুলোকে তার জীবনে পাঠানোর জন্য।
—-
“অসিফাকে তুমি পছন্দ করো?”
আসিফ খন্দকারে এমন প্রশ্নে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় শিখন। অসিফার দিকে তাকাতেই অসিফা মাথা নুয়ে নেয়।

“কি হলো উত্তর দাও?”

“জ্বী আংকেল। আমি অসিফাকে পছন্দ করি এবং ওকেই বিয়ে করতে চাই।”

আসিফ খন্দকার এবার সোজা হয়ে বসে সাকলাইন খান ও শেফা বেগমের দিকে তাকান। শেফা বেগম আমতা-আমতা করে বলে ওঠেন,

“অসিফা না হয় ছোট তাই যা করেছে তা মানা যায়। তবে শিখন বড় হয়ে কিভাবে কান্ডজ্ঞানহীন হলো আমি বুঝতে পারছিনা আসলেই। আমরা অনেক অনেক দুঃখিত আসিফ ভাই।”

“আন্টি শিখন ভাইয়ের দোষ নেই কোনো। আমিই তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি অনেকবার আমাকে রিমাইন্ডার দিয়েছিলেন বাসায় ফেরার জন্য। কিন্তু আমিই শুনিনি। প্লিজ উনাকে দোষ দেবেন না। উনার কোনো দোষ নেই।”
বলেই কেঁদে ওঠে অসিফা। শিখন মুচকি হেসে অসিফার দিকে তাকিয়ে থাকে। শেফা বেগম উঠে এসে অসিফাকে আগলে নিয়ে বলে ওঠেন,

“বোকা মেয়ে কাদছিস কেন?”
শেফা বেগমের কথার মাঝেই আসিফ খন্দকার বলে ওঠেন,

“তুমি যেহেতু অসিফার হতে বেশ বড় তাহলে তোমার এটাও তো বোঝার কথা, এই বয়সটাতে মানুষ আবেগে ভাসতে থাকে। একবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষ ধ্ব’সে পড়ে। তোমার অন্তত নিজের ফিলিংস শেয়ারের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া উচিত ছিল।”
শিখন বিনা বাক্য ব্যয়ে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থাকে। সে কাউকেই জানান দিতে চায়না আসল সত্য কথাটি। ধ্ব’সে পড়া মেয়েটাকে সে কিভাবে পুনরায় নিজ হাতে গড়েছে তা সে জানান দিতে চায়না কাউকে। ‘তামিম’ নামটা মেয়েটার মস্তিষ্ক হতে বের করার জন্য তাকে তো এমনটা করতেই হতো। শিখন নিজেই কখনো চায়নি এত আগে অসিফাকে তার মনের কথার জানান দিতে। তবে পরিস্থিতিই এমন ছিল যে, সে বাধ্য হয়েই অসিফাকে তার দিকে ধাবিত করতে উদ্যত হয়েছিল। নতুবা মেয়েটা হয়তোবা প্রতিদিন পরীক্ষার হল হতে এমন হাসি-খুশি মুখ নিয়ে বের হতে পারতোনা। তামিম নামক ক’ষ্ট’দা’য়’ক অতীতকে নিঃশেষ করতেই শিখন নামের সুখকর বর্তমানের সূচনা করতে সে বাধ্য হয়েছে। নতুবা প্রেমিকের দেওয়া ধো’কা’র দাগ যে এত সহজে মুছে না! তার তন্দ্রাহরণীর দূর্বলতাকেও কাউকে জানাতে চায়না সে। হোক বাবা-মা সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তবে পুরনো অধ্যায় আরেকবার মেললে যে গাথা ইমারত পুনরায় ধ্ব’সে যেতে পারে। তা নিয়েই শঙ্কিত শিখন। তাই চেপে যায় সে।

“আংকেল আমার কর্মকান্ডের জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আশা রাখছি পুনরায় এমন ভুল হবেনা আমার দ্বারা। অসিফাকে আমি আমার জীবনসঙ্গিনী করতে চাই। তবে তা ও মেডিকেলে এ্যাডমিশন নেবার পর।”

“আমি আমার মেয়েকে কোনো অনিশ্চয়তার ঠেলে দিতে চাইনা। তোমার নিজের জীবনেরই নেই কোনো নিশ্চয়তা। তুমি আমার মেয়েকে কিভাবে আগলে রাখবে? ভাই-ভাবি আপনারা প্লিজ ওকে বোঝান একটু। আমার একটাই মেয়ে অসিফা।”

“প্রতিটা বাবা-মা ই তার সন্তানের ভালো চায় আমিও মানি তা আংকেল। আর মেয়েদের নিয়ে তাদের বাবারা যে একটু বেশিই কেয়ারফুল তাও জানি। একজন বাবা কখনোই তার মেয়েকে অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিতে চাননা। তবে আমাকে দেখে নিশ্চয়ই দায়িত্বহীন মানুষ মনে হয়না! সাহস করে দায়িত্ব যখন নিতে চাইছি তবে অবশ্যই নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমার অমূল্য রত্নকে আমি আগলে রাখব। প্লিজ একবার আমার ওপর ভরসা রাখুন আংকেল। আমার রাজনীতির জন্য অন্তত ওর ওপর কখনো কোনো ইফেক্ট পড়বেনা। আপনার মেয়ে আপনার কাছে এসে সবসময় জোর গলায় বলতে পারবে ‘সে সুখে আছে’।”

আসিফ খন্দকার এক পলক নিলুফা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি বলে ওঠেন,

“আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ছেলেটার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েই দেখোনা!”
শেফা বেগমও বলে ওঠেন,

“আমার সেই কবে থেকে শখ এই পুতুলটাকে আমাদের ঘরে নিয়ে সাজিয়ে রাখব। ভাই একটাবার ভরসা করেই দেখুন।”
বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকেন আসিফ খন্দকার। অতঃপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে নিজের একবাহুতে আগলে নিয়ে বলে ওঠেন,

“আমার কলিজার টুকরোকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। আমার আস্থার মান রাখবে আশা রাখছি। আমি কখনোই তোমার হাতে ওকে দিতে চাইনি। তবে অন্যের হাতে তুলে দিলে ও কখনো সুখী হতে পারবেনা। আর আমার কাছে সবচেয়ে আগে আমার মেয়ের সুখ। ভেবে দেখলাম, তোমার কাছেই আমার মেয়ে সবচেয়ে সুখী হবে। তবে একটা শর্ত আছে আমার।”

ডাহুক পাখির ন্যায় চেয়ে থাকা উপস্থিত সকলে একত্রে বলে ওঠে,

“কি শর্ত?”

“অসিফা মেডিকেলে এ্যাডমিশন না নেওয়া পর্যন্ত তোমাদের বিয়ে হবেনা। আর না প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে পারবে। অসিফাকে প্রাইভেট কলেজে ভর্তি করে সেখানের অভ্যন্তরীণ হোস্টেলে রেখে আসব। এইচএসসি কমপ্লিট করে অসিফা মেডিকেলে এ্যাডমিশন নেওয়ার পরেই তোমাদের বিয়ে হবে। আর হ্যা এই দুই বছরে শুধুমাত্র প্রতি শুক্রবারে বিশ মিনিটের জন্য ফোন কলে কথা বলতে পারবে। তার বেশি না। আর শিখনও মাস্টার্স কমপ্লিট করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নেবে ততোদিনে। এই দুই বছরে একে অপরের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা জমাতে থাকো। যেন তা যুগ যুগ ধরে তোমাদের দুজনকে একসাথে বেঁধে রাখতে পারে। রাজি তো?”

“রাজি মানে! আলবাত রাজি শশুর আব্বু।” বলেই অসিফার দিকে তাকায় শিখন। অসিফা হেসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
উপস্থিত সকলে হো হো করে হেসে ওঠে।
—–
চার বছর পর,

ক্লাস শেষ করে সবে মেডিকেলের মেইন ফটক পেরিয়ে বাইরে বেরিয়েছে অসিফা। গ্রীষ্মের তাপদাহে প্রচন্ড গরম অনুভূত হতেই গায়ে জড়ানো ধবধবে সাদা অ্যাপ্রনটা খুলে হাতে নিতেই রাস্তার ওপারে চির-পরিচিত একটা গাড়ি এসে থামতেই ঠোটে হাসি ফুটে ওঠে অসিফার। সাবধানে রাস্তা পার হয়ে গাড়ির সামনে এসে দাড়াতেই হঠাত গাড়ির সামনের দিকের দরজা খুলে যায়। অসিফা গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা শিখন বলে ওঠে,

“আমার একমাত্র ডাক্তার বউয়ের দিন কেমন কাটলো?”

“দিন কেমন কেটেছে তা জানিনা। তবে নেতা সাহেবকে পেয়ে এখন আমার দিনের অবশিষ্ট সময়টুকু ঝা’ক্কা’স কাটবে।”

“আমার একমাত্র বউটা আর বড় হলো না।”

“আপনি থাকতে আমার আর বড় হয়ে লাভ আছে? এমপি হয়ে গেছেন আর ঘরের বউ সামলাতে পারবেন না? এটা কেমন কথা!”

“আমার ঘরের এমপি যে ডে’ঞ্জা’রা’স! সেই তো উলটো আমাকে সামলায়। আমি আর তাকে কি সামলাবো?”

“আমি ডে’ঞ্জা’রা’স মানে?”

“না না তুমি ডে’ঞ্জা’রা’স হতে যাবে কেন? তুমি তো আমার একমাত্র বউ। আমার ডাক্তার বউ।”

“এই যাত্রায় বেচে গেলেন তাহলে। নতুবা আজকে আর ভাত ছিল না আপনার কপালে।”

“তোমার নামে কিন্তু আমি পুরুষ নি’র্যা’ত’নের মা’ম’লা করব বউ।”

“চলুন তাহলে! আমি আপনার সাথে যাচ্ছি। এই এক মিনিট, আপনি একা গাড়ি নিয়ে এসেছেন কেন? ড্রাইভার কোথায় আর আপনার বডিগার্ডসও বা কোথায়?”

“এমপি বলে কি একটু বউ নিয়ে রিল্যাক্সলি ঘুরতে বের হতে পারব না? কতগুলো বছর অপেক্ষা করার পর আমার বউকে পেয়েছি আমি!”

“অযথা কথা না পেচিয়ে সোজাসুজি উত্তর দিন।”

“বডিগার্ড পেছনের গাড়িতে। আজ শিখনের তার একমাত্র বউ নিয়ে সারা শহর ঘুরতে মন চাইছে। তাই আজ ড্রাইভারের ছুটি।”
বলেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শিখন পুনরায় বলে ওঠে,

“লেট’স মেক দ্যা ডে স্পেশাল টুগেদার।”
অসিফা সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে এক ধেয়ে তার নেতা সাহেবের দিকে চেয়ে থাকে। এ দেখা হয়তো জনমভর চলতেই থাকবে। তবুও মুগ্ধতা তার ইতি টানবেনা। কেননা প্রতিটা দিনই এই মানুষটা শুধু তার এবং সে একান্তই এই মানুষটার।

~সমাপ্ত

#আফিয়া_অন্ত্রীশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে