প্রতিদিন তুমি আমার পর্ব-০৬

0
855

#প্রতিদিন_তুমি_আমার (০৬)
“তুমি যে অসিফার ইংলিশ টিচার হিসেবে শিখনকে ঠিক করলে! ও কি আদৌ পারবে অসিফাকে পড়াতে? সারাদিন তো মিছিল-মিটিং করেই কাটিয়ে দেয়। কতটুকু দক্ষ ও ইংলিশে যে ওকেই রাখতে হলো? সেই উচ্চ মাধ্যমিকের পরে তো আর ওর হাতে একখানা বই দেখিনি কখনো।” কথাগুলো বলা শেষ করেই মুখে এক কোয়া কমলা পুরে নেন আসিফ খন্দকার।

“কাউকে যখন আমাদের পছন্দ হয় না তখন তার সবকিছুই আমাদের কাছে নেগেটিভ লাগে আসিফ। তুমি তো ওর রাজনীতির বিষয়টাই দেখো শুধু। কিন্তু কখনো ওর রেজাল্ট জানার চেষ্টা করেছো? শেফা ভাবি যে বছরে বছরে মিষ্টি নিয়ে হাজির হয় তা তো নিশ্চয়ই দেখেছো? সবই শিখনের প্রতি সেমিস্টারে টপ রেজাল্টের জন্য মিষ্টি ছিল। তোমার এই অভ্যাসটা হয়তোবা বদলানো উচিত আসিফ। যাকে তোমার তার কোনো বিষয়ের জন্য অপছন্দ, তার যে সকল দিকই খারাপ এমন তো না। সবারই টুকিটাকি খুঁত থাকেই। আর শিখন রাজনীতি করে এটা তো খারাপ না। বিষয়টা হচ্ছে তোমার রাজনীতি পছন্দ না। আর সবার সবকিছু পছন্দ না হওয়া অস্বাভাবিকও কিছুনা।”
কথাগুলো বলেই নিলুফা বেগম গটগট পায়ে ড্রইংরুম হতে বেডরুমের দিকে চলে যান। আসিফ খন্দকার গম্ভীর দৃষ্টিতে স্ত্রীর গমন পথে তাকিয়ে থাকেন।

রসায়নের হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে সবেমাত্র ইংরেজিটা নিয়ে বসেছে অসিফা। ইংরেজি খাতার কিছু পৃষ্ঠা উল্টাতেই শিখনের হাতের লেখা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। “ট্রি প্ল্যান্টেশন” ও “উইন্টার মর্নিং” প্যারাগ্রাফ লেখা ও পড়া দিয়ে গেছে শিখন। শিখনের হাতের লেখার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেং’চি দিয়ে অসিফা বিড়বিড় করে বলে ওঠে,

“নিজের হাতের লেখার চেহারা দেখো! বলে কি না আমার হাতের লেখা খা’রা’প! বেশ করেছি এয়ার ফ্রেশনার মেরেছি। কাল একদম চায়ের সাথে গুড়ো মরিচ গুলিয়ে খাইয়ে দেব। অসিফা খন্দকারের হাতের স্পেশাল চা!”
পড়ার টেবিলের ওপর মাথা কাত করে রেখে প্যারাগ্রাফ লিখতে থাকে অসিফা। হঠাৎ-ই মাথায় এক রাশ চিন্তা এসে ভর করে। শিখনের সমগ্র আচরণই তার কাছে কেমন উদ্ভট লাগছে। সে যে বিষয়গুলোকে মজার ছলে নিচ্ছে শিখন কি আদৌ তা মজার ছলেই করছে? ভাবনার মাঝেই টুপ করে অসিফার হাত হতে কলমটা খাতার ওপর পরে যায়।
সেই হতে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ের কার্যকলাপ পরীক্ষা করছেন নিলুফা বেগম। ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে অসিফার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মিহি কন্ঠে নিলুফা বেগম বলে ওঠেন,

“দিনকে দিন কেমন উদাসীন হয়ে যাচ্ছিস তুই অসিফা।”
মায়ের কন্ঠ কানে বাজতেই লাফিয়ে উঠে ঠিকঠাক হয়ে বসে অসিফা।

“আম্মু তুমি!”
অসিফার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন নিলুফা বেগম। মেয়ের দিকে প্রখর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠেন,

“এই বয়সে কাউকে মনে ধরতেই পারে। তবে নিজের আবেগকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণে রাখা তোমার জন্য একটা অনেক বড় দায়িত্ব। আবেগের সমুদ্রে ভেসে যেন নিজের ক্যারিয়ার খারাপ না হয়। তোমার কোনো কিছুতেই কোনোদিন আমরা অভিযোগ করব না। তবে নিজের কর্মকান্ডের জন্য যেন নিজেকে কখনো কপাল চা’প’ড়া’তে না হয় বা আফসোস করতে না হয়। এই কথাটা হয়তো আমি আর কোনোদিনও রিপিট করব না। সারাজীবনের জন্য তোমার সফলতা অর্জনে এটা একটা চাবিকাঠি হয়ে দাড়াতে পারে। মাথায় গেথে রেখো। তোমার আব্বু খাবার টেবিলে বসে আছে দ্রুত খেতে এসো।”
আর এক মুহূর্ত দাড়ান না নিলুফা বেগম। দ্রুত পা ফেলে রুম ত্যাগ করেন। অসিফা অবাক দৃষ্টিতে মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। নিলুফা বেগম সবসময়ই তাকে “তুই” সম্বোধন করে থাকেন। তবে উপদেশ দেওয়ার বেলায় হঠাতই তিনি তুই হতে তুমিতে স্থানান্তরিত হন। হয়তোবা সৃষ্ট হওয়া পরিবেশটাকে আরেকটু জোরদার করে তুলবার জন্য! অসিফা মায়ের বলা কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়ায়।
—-
“তুই কি সারা রাত ঘুমাসনি?” ভ্রু কুচকে বলে ওঠে শিখন।
লেখা থামিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শিখনের দিকে তাকায় অসিফা। শিখন কি তবে এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল! অসিফাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শিখন পুনরায় বলে ওঠে,

“কিরে? আমাকে আগে কখনো দেখিসনি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? কি জিজ্ঞাসা করেছি তার উত্তর দে!”

“টেস্ট পরীক্ষার আর এক মাস আছে শিখন ভাই। সব পড়া শেষ করতে করতে ভোর চারটা বেজে গিয়েছিল। তারপর একবারে নামাজ পরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। আর আপনি তো ভোর ছয়টায় পড়াতে আসবেন। তার জন্য তো ঘুম একদম উড়ে গেল আমার। আচ্ছা আপনি বসুন আর খাতা দেখতে থাকুন। আমি চা বানিয়ে আনি। আমারও একটু রিফ্রেশমেন্ট দরকার।”

“ওকে, এ্যাজ ইউর উইস।” (শিখন)

অসিফা চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলেই শিখন বলে ওঠে,

“দাড়া। এখানে বস একটু।”
অসিফা পুনরায় চেয়ারে বসতেই শিখন উঠে দাঁড়িয়ে অসিফার ঘাড় অব্দি ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলোকে গুছিয়ে এক হাতের মুঠোতে নিয়ে পুনরায় বলে ওঠে,
“একটা হেয়ার ব্যান্ড দে তো।”
অসিফা বিনা বাক্য ব্যয়ে টেবিলের ড্রয়ার হতে একটা হেয়ার ব্যান্ড বের করে দিতেই তা দিয়ে চুলগুলো বেধে দেয় শিখন।

“নে এখন যা।”
অসিফা চেয়ার হতে উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শিখনের দিকে তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

টগবগিয়ে ফুটে ওঠা চা কাপে ঢেলে তার ভেতর এক চামচ গুড়ো মরিচ মিশিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে অসিফা বলে ওঠে,

“আপনার এত কেয়ার দেখে এক চামচের বেশি আর গুড়ো মরিচ দিতে মন চাইছেনা নেতা সাহেব। শত হোক মানবতা বলে একটা ব্যাপার আছে তো নাকি!”

“চায়ে গুড়ো মরিচ মেশানো শেষ হলে দ্রুত পড়তে চলুন। আমার ক্লাস আছে নয়টায়।”
উক্ত কথা কানে বাজতেই অসিফা পেছনে ঘুরে দেখে শিখন দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিখনকে দেখেই অসিফার হাত হতে গুড়ো মরিচের চামচটা টুপ করে ফ্লোরে পড়ে যায়।

“আপনি এখানে কি করছেন শিখন ভাই?”

“তোর থেকে চা বানানো শিখতে এসেছিলাম। কিন্তু এসে তো দেখি আমার একমাত্র গার্লফ্রেন্ড আমাকে বাথরুমের বাসিন্দা বানানোর ষ’ড়’য’ন্ত্র করছে।”

“আম্মুকে বলবেন না প্লিজ শিখন ভাই। এই কান ধরেছি আর কোনোদিন প্র’তি’শো’ধ নিতে চাইবো না আপনার থেকে।”
শিখন অসিফার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে অসিফার কানের কাছে মুখ নিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,

“তুমি নিজ হাতে তোমার নেতা সাহেবকে বি’ষ পান করাতে চাইলেও তোমার নেতা সাহেব তা সাদরে পান করে নেবে প্রিয় তন্দ্রাহরণী।”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অসিফার বেডরুমের দিকে পা বাড়ায় শিখন। নিলুফা বেগমকে বেডরুম হতে বের হতে দেখে শিখন বলে ওঠে,

“আন্টি তোমার মেয়ের হাতে যাদু আছে। কি চা বানিয়ে খাওয়ালো! সারাজীবন মনে থাকবে।”
পেছনে পেছনে দৌড়ে আসা অসিফার দিকে এক পলক তাকায় শিখন। সাথে সাথে অসিফা মাথা নুয়ে নেয়। শিখনের পেছন পেছনই সে রুমে প্রবেশ করে। শিখন চেয়ারে গিয়ে বসতেই অসিফা টেবিলের ড্রয়ার হতে কিছু চকলেট বের করে শিখনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,

“প্লিজ চা-টা আর খাবেননা শিখন ভাই। আই এ্যাম সো সরি। আর কোনোদিন এমন হবেনা।”
শিখনের চোখ বেয়ে পানি পড়তে দেখেই অসিফার চোখ ছলছল করে ওঠে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে এক হাতে চায়ের কাপটা কেড়ে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে একটা টিস্যু শিখনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,

“আমি আসলে মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই ছেলে মানুষী করে ফেলি শিখন ভাই। চোখ টা মুছে নিন প্লিজ।”

“নিজে মুছে দিতে পারছিস না?”
অসিফা সন্তপর্ণে শিখনের চোখের পানি মুছে দিতেই শিখন পুনরায় বলে ওঠে,

“তাড়াতাড়ি বাকি পড়া শেষ কর।”
—–
দেখতে দেখতে অসিফার টেস্ট পরীক্ষাও প্রায় শেষের পথে। আজ শেষ পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের মেইন ফটকের বাইরে আসতেই চমকে যায় অসিফা। শিখন মুখে স্মিথ হাসি ফুটিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরেই। হাতের ফাইলটা আরও শক্ত করে আকড়ে ধরে শিখনের দিকে অগ্রসর হয় অসিফা।

“পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”

“ঝাক্কাস।”

“এই মেয়ে এইসব ভাষা কোথা থেকে শিখছিস তুই?”

“শিখতে হয় না এমনিই মুখে চলে আসে। আপনি এখানে কেন?”

“আমার স্টুডেন্টের যেহেতু ইংরেজি পরীক্ষা ভালো হয়েছে সেহেতু সে তার টিচারের পক্ষ হতে অবশ্যই একটা ট্রিট ডিজার্ভ করে। এ্যাম আই রাইট?”
অসিফা কিছুক্ষণ ভেবে বলে ওঠে,

“আলবাত।”

“লেট’স গো।”

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“আমার একমাত্র গার্লফ্রেন্ডের ফেভারিট বার্গার খেতে।”
শিখনের মুখে এহেন কথা শুনে অসিফা মুখ গো’ম’রা করে বলে ওঠে,

“আপনি মানুষের সামনে এভাবে আমাকে গার্লফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড বলেন। মানুষ কি ভাবে বলুন তো?”

“মানুষ কি ভাবে তাতে আমার কি? নিজের প্রেমিকাকে অন্যের সামনে নিজের বলাটা অন্যায়, তা কোথায় বলা আছেরে ক্ষেপি?”

“আমি আপনার প্রেমিকা কবে হলাম?”

“তোর জন্মের সময় থেকে। এবার চল তুই বইন।”

“একবার প্রেমিকা বলে সম্বোধন করেন আরেকবার বইন বলে। এটা অন্যায় না?”
শিখন ভ্রু কুচকে অসিফার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“তলে তলে তাহলে তুমিও টেম্পু চালাতে শুরু করেছো অসিফা! তবে এসএসসি এর আগে তোমার টেম্পু চালানো এলাউ না। এখন আমি চালাবো তুমি পেছনে বসে ঘুরবে। লেট’স গো আমার একমাত্র গার্লফ্রেন্ড।”

অসিফা বার্গার খাচ্ছে আর শিখন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। শিখনকে হাসতে দেখে অসিফা খাওয়া থামিয়ে বলে ওঠে,

“আপনি এভাবে হাসছেন কেন?”

“তুই যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আমার সামনে বার্গার খাচ্ছিস তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে তুই আমাকে কত ভালোবাসিস।”
বলেই চোখ টিপ্পনি কাটে শিখন। ওমনি অসিফা খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,

“শিখন ভাই!”

“আরে আমি মজা করছি। খা তুই। বার্গার তোর এত ফেভারিট?”

“হ্যা। তবে আব্বু তো জাংকফুড খাওয়া একদম পছন্দ করেনা।”

“আংকেল তো তার জায়গা থেকে ঠিকই আছে। তবে আমি তোকে প্রতি সপ্তাহে একটা করে বার্গার ট্রিট দিতে পারি যদি তুই অন্য ছেলেদের দিকে না তাকাস।”

“প্রমিস?”

“প্রমিস।”

“ওকে ডান। এখন চলেন দেরি হয়ে যাচ্ছে। আব্বু আসার সময় হয়ে গেছে।”
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে অসিফা।

“চলো আমার একমাত্র গার্লফ্রেন্ড।”

“যথা আজ্ঞা আমার টেম্পু ড্রাইভার।”

চলবে…
#আফিয়া_অন্ত্রীশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে