#প্রণয় স্রোতে
#পর্বঃ৫
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)
ইয়ারাব এর এক্সিডেন্ট টা বেশ গুরতর।মাথায় বেশ ভারি আঘাত পেয়েছে।যার জন্য সাথে সাথে অপারেশন থিয়েটার এ নিতে হয়েছিল ওকে।তবে সেখানে আর এক কান্ড করে বসে আরাব।সে কিছুতেই ইয়ারাব কে ভেতরে একা ছাড়বে না।নিজে ও যাবে।
ডক্টররা শুরুতে রাজি না থাকলে ও শেষে বাধ্য হয় ওকে ভেতর নিতে যদিও সেটার জন্য অথরিটির পারমিশন নেওয়া লেগেছে। তবে এটাতে কোনো অসুবিধা হয়নি আরাব এর।কারণ অথরিটির লোক আরাবকে চেনে।
এই মূহুর্তে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে ইয়ারাব কে।ভালো মন্দ কিছু বলতে পারবে না তারা।তবে এই মূহুর্তে ইয়ারাব এর যা কান্ডিশন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে সে কোমায় চলে যাবে।ডক্টর যতটুকু পেরেছে শান্তনা দিয়েছে ইয়ারাব এর পরিবার কে।তানভি সমস্ত টা শোনার পর পাগলের মতো বিলাপ করছে।বহ্নি কে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদেছে সে।তানভি এর কান্না দেখে বহ্নি ও পারেনি নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে।কি করে পারবে, আজকের দিনটার জন্য তো প্রত্যক্ষভাবে সেই দায়ী।প্রতিশোধের নেশা তাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো।সেই তো তানভিকে বুঝিয়ে ছিল ইয়ারাব কে বিয়ে করার জন্য।(লেখিকার কোনো দোষ না! সব দোষ বহ্নি এর) তানভি তো নিজের বাবা আর বোন এর কথা শুনেই এই বিয়েটা করেছিল।কিন্তু আজ কেন তাহলে এত বড় শাস্তি পাচ্ছে সে।কাঁদতে কাঁদতে এক সময় জ্ঞান হারায় তানভি।হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় প্রেশার ফল করেছে তানভি এর।তাই ওকে অন্য কেবিনে দেওয়া লাগে।আপাতত স্যালাইন চলছে।মনিমাকে তানভি এর কাছে বসিয়ে বের হয়ে আসে বহ্নি।
নিজে থেকে কাঁদতে যেন ভুলে গেছে সে।যখন তানভি ওকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিল তখন কয়েক ফোটা অশ্রু ঝরেছিল তানভি এর চোখ দিয়ে তবে সেটা ইচ্ছাকৃত নয়।
হসপিটাল থেকে ধীর পায়ে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো বহ্নি।চারিদিকে অনেক বেশি লোক।একটু ফাঁকা জায়গা দরকার নিশ্বাস নিতে।
কোনো কিছু না ভেবে ছাদে উঠে গেল বহ্নি।ভাগ্য প্রশন্ন ছিল বলে হয়তো সেখানে আর কেউ ছিল না।ছাঁদের কিনারা এর কাছে দাঁড়িয়ে রইল বহ্নি।এতটুকু সময়ের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে গেছে পুরো পরিবার এর ওপর দিয়ে।
বহ্নি হঠাৎ খেয়াল করল তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে।তবে পেছনে ফিরতেই যে আরাবকে দেখবে সেটা ভাবেনি সে।বহ্নি এর কি হলো কে জানে,এক ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আরাবকে।এই প্রথমবার আরাবের এত কাছে গেল বহ্নি। সেটা ও নিজে থেকে।খুব শক্ত করে জড়িয়ে রইল বহ্নি।
বহ্নি এর এমন কাজে প্রচন্ড অবাক হলো আরাব!বহ্নি কে ছাঁদে আসতে দেখেছে সে।এতক্ষণে ডক্টর আর ওষুধপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিল।সব ফর্মালিটি শেষ করে ইয়ারাব এর কেবিন এর দিকে যেতে গিয়ে চোখ পরে বহ্নি এর ওপর।আর তারপরই এখানে আসা।
বহ্নি এর কেঁপে ওঠা আর ফোপানি এর শব্দে আরাব বুঝতে পারে মেয়টি কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বহ্নি বলে ওঠে,
“আমি এমনটা চায়নি আরাব! বিশ্বাস করো এমনটা চায়নি! আমার জন্য আজ আমার বোনটা কষ্ট পাচ্ছে। আমি কি করব বলো আরাব? আমি কি করব!”
কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেছে বহ্নি এর। হঠাৎই মুখ তুলে ধরে আরাব বহ্নি এর।নিজেকে শক্ত রেখে, বহ্নিকে বলে ওঠে,
“ভাই এর কিচ্ছু হবে না। দেখো ও ঠিক হয়ে যাবে!”
আরাবের কথায় যেন একটু কাজ দিল।আস্তে আস্তে কমে আসল কান্নার বেগ। তবে হেচকি এখনো বন্ধ হয়নি।আরাব বহ্নি কে জড়িয়ে ধরেই দাঁড়িয়ে আছে।তবে বেশ কিছুক্ষণ পর অস্বস্তি টা ঘিরে ধরল বহ্নি কে।
তানভি এর কান্না দেখে নিজে ও মারাত্মক ভেঙে পড়েছিল বহ্নি। সেজন্যই তো ছাঁদে চলে এসেছিল।কিন্তু সেখানে আরাবকে দেখতে পেয়ে আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি বহ্নি। সমুদ্রের ঢেউ এর মতো আছড়ে পড়েছিল আরাব এর বুকে।কিন্তু এখন।এখন তো বেশ লজ্জা লাগছে তার।
আরাবকে আস্তে করে ছেড়ে দিলো বহ্নি। আরাব ও দিল।বিপদের সময় যে কেউ ই যে কাউকে আকড়ে ধরতে পারে। এটা স্বাভাবিক বিষয়। নিজেকে এই ফালতু এক্সকিউজ টা দিয়ে বুঝালো নিজেকে বহ্নি। বহ্নি এর অবস্থা আরাব হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। তাই নরমালি বহ্নি কে বলল নিচে যেতে বহ্নি ও বিনা বাক্যে নিচে চলে এলো।
আজকে বহ্নি, আরাব,তানভি আর ইয়ারাব এর আজাদ ভিলাতে যাওয়ার কথা ছিল। নিয়মমতো বৌভাত এর পরের দিন যাবে ওরা।নিজেদের মধ্যে ও একই পরিকল্পনা ছিল।তবে সকালে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় যাওয়া ভেস্তে গেল সবার।তবে, তোহান আজাদ নিজের ছোট জামাই এর এমন একটা খবর শুনে হসপিটালে ছুটে এসেছেন। এখানে এসে ইয়ারাব এর কান্ডিশন আর তানভি এর অবস্থা দেখে নিজে ও ভেঙে পড়েন।যতই হোক বিয়ের পরের দিন এমন একটা দুর্ঘটনা কোনো পরিবারেই কাম্য নয়।
নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে তোহান আজাদ এর। মেয়েদেরকে সুখে দেখবে বলেই তো এই বিয়েতে রাজি হন তিনি। এক মেয়ের সাথে অন্যায় হচ্ছে সেটা অবদি চোখে পড়েনি তার।তিনি ভেবেছিলেন ইয়ারাব এর সাথে তানভি এর বিয়ে হলে তানভি সুখেই থাকবে।আর আরাব এর মতো একটা ছেলে বহ্নি এর জীবণে আসলে এক মাসের মিছে প্রেম ভুলে যাবে মেয়েটি।কিন্তু ওপরওয়ালা যে এমন কিছু ভেবে রেখেছিল কে জানতো সেটা!
সকাল পেরিয়ে দুপুর হলো।এখনো সকলেই হসপিটালে আছে।সবার একটাই আশা এই বুঝি ইয়ারাব এর জ্ঞান ফিরল।এই বুঝি ইয়ারাব রেসপন্স করল।কিন্তু সকলে শুধু অপেক্ষায় করে চলেছে। সেই অপেক্ষার অবশন ঘটছে না।
আরাব সকলেকে বাড়িতে চলে যেতে বলেছে। কিন্তু কেউ শোনেনি। ঘড়ির কাটা দুপুর ২ টা এর ওপারে। সকাল থেকে এখনো কেউ কোনো কিছুই মুখে তোলেনি।তানভি এখনো কেবিনে। জ্ঞান ফেরেনি তার।হঠাৎ কোনো রকম মারাত্মক শক নিতে পারেনা তানভি।যদি একবার শক পেয়ে জ্ঞান হারায় তাহলে জ্ঞান কখন ফিরবে কেউ বলতে পারে না।ছোট বেলা থেকেই তানভি এমন।
বহ্নি তানভিকে ছেড়ে যেতে নারাজ।তবে মনিমাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছে আরাব।
সময় গড়ায় নিজের মর্জিমতো! কেউ যেমন তাকে বাঁধতে পারে না,তেমনি কেউ চাইলে ও সময়টাকে তারাতাড়ি পার করতে পারে না।তানভি এর জ্ঞান ফেরে বিকালের দিকে। বহ্নি সেখানেই ছিল। বহ্নিকে দেখে আরো একচোট কেঁদে দেয় তানভি।তবে সেখানেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে এক ওয়ার্ডবয়।হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,
“আপনারা তারাতাড়ি চলুন।আপনাদের পেসেন্ট আর নেই।”
কথাটা বিস্ফোরণ এর ন্যায় লাগে ওখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের কাছে।বহ্নি যেন নিজের জায়গায় জমে গেছে।কি শুনলো ও।যে মানুষ টার ওপর এতো করোধ ছিল সে মানুষ টা আর নেই।এভাবে চলে গেল!
বহ্নি যখন এসব ভাবনায় ব্যাস্ত! তখনই কেঁপে ওঠে কোনো কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে। কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে দেখে তানভি মাটিতে পড়ে আছে।হঠাৎই মাথা ঘুরে পরে যাওয়ায় ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারেনি সে।সজোরে বাড়ি খেয়েছে বেড এর মাথার গ্রিলের সাথে।লবনাক্ত রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফ্লোর।কিন্তু আশ্বর্য বহ্নি শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছে না। চোখের সামনে শুভ্র ফ্লোরটা রক্তে ভেষে যাচ্ছে কিন্তু সে কিছু করতে পারছে না।না পারছে তার বোনেকে তুলে ধরতে,না পারছে ছুটে ইয়ারাব এর কাছে যেতে! ওয়ার্ডবয় এর কথার সত্যতা যাচাই করতে।
এ কেমন পরিস্থিতি যে বহ্নি নিজের মস্তিষ্কে জোর দিতে অচল।সবটা যখন ধীরে ধীরে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে তখনই বহ্নি একটু একটু করে বুঝতে পারছে সে ও চেতনা হারাচ্ছে। তার বোনের পাশেই হয়তো ছিটকে পড়বে ওর অশাড় শরীরটি।
চলবে,
ইয়ারাব কি সত্যি মারা গেল!!!