#প্রণয় স্রোতে
#পর্বঃ৪
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)
দক্ষিণা বাতাসে চারিদিক ভরপুর। ঝড় উঠেছে, হয়তো বৃ’ষ্টি ও হবে।বৃ’ষ্টি হওয়ার পর হয়তো ঝড় শান্ত হয়ে যাবে।কিন্তু যে ঝড় বহ্নি এর মনের মধ্যে চলছে সেটা কি ব’র্ষ’ণ হয়ে থেমে যেতে পারবে।
এক প্রকার নিজের সাথে যু’দ্ধ করে রিসিপশন টা পার করেছে বহ্নি।এত পরিচিত, অপরিচিত লোকের ভীড়ে ও বিষাদের তাড়নায় দ’গ্ধ হচ্ছিল হৃদয়।সেই দ’গ্ধ হৃদয় নিয়েই সৌজন্য হাসি হেসেছে বারবার। হঠাৎই বহ্নি এর খেয়াল হলো আজ প্রায় দুদিন এ বাড়িতে সে।একই সাথে তার আদরের বোনটি ও।অথচ বিনা কারণ ছাড়া একবার ও তানভি এর সাথে কথা বলেনি সে।সামনে অবদি যায়নি।মা চলে যাওয়ার পর ওরা দুই বোনই তো একে অপরের স’ঙ্গী ছিল। ওদের বাবার এই বিয়েতে রাজি হওয়ার প্রধাণ কারণ ছিল ওরা দুই বোন একই সাথে থাকতে পারবে।বাবা হিসেবে কি খুব ভুল কিছু চেয়েছেন তিনি!প্র’শ্ন জাগল বহ্নি এর মনে!
ছোট থেকেই তানভি বহ্নি কে ছাড়া অচল। এজন্যই সে এ বিয়েতে রাজি হয়েছে। সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া তার বোনটি নতুন পরিবারের সাদ উপভোগ করতে,নতুুন মানুষকে নিয়ে ঘর বাধতে আর নিজের বোনের ছায়া তলে থাকতে যে অন্য কোনো কিছু চিন্তা না করেই এ বিয়েটা করেছে। সেটা তো বহ্নি বোঝে।তাহলে কি করে সে পারল! কি করে পারল ব’হ্নি তার বোনকে অবহেলা করতে!!
প্রশ্নটা মনে উদয় হতেই বোনের ছায়াকোনে লুকায়িত মাতৃসত্তা জেনে জেগে উঠল বহ্নি এর।নিজের কাছেই কেমন অপরাধী মনে হতে লাগল। সত্যি তো! সবটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল।ইয়ারাব না জেনে তার সাথে অন্যায় টা করে ফেলেছে। কি’ন্তু সে যে সি’দ্ধা’ন্ত নিয়েছে সেটা তো জেনে শুনেই।আংটি বদলই এখনকার দিনে সব নয়।সে চাইলেই বিয়ে টা ভেঙে দিতে পারত।কিন্তু না জেদের বসে এত বড় একটা সি’দ্ধা’ন্ত নিয়ে নিলো বহ্নি।
আজ রিসিপশনে তানভি অনেক বেশি ঘাবড়ে গেছিল। বিয়ের দিন ওদের বাড়ির আ’ত্মী’য় বেশি ছিল সকলে প্রায় পরিচিত। কিন্তু আজকে হাতে গোনা কয়েকজন বাদে বাকি সবাই ই অপরিচিত। এত অচেনা মানুষের ভীড়ে তানভি বারবার না’র্ভা’স হয়ে বহ্নি এর দিকে চায়ছিল কিন্তু বহ্নি যেন দেখে ও দেখতে পা’চ্ছি’ল না।এতটা নি’ষ্ঠু’র কি করে হলো বহ্নি!
“আমি এত কঠিন কি করে হতে পারলাম!”
নিজেই নিজেকে বলে উঠল বহ্নি। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজলের ধারা।এই মূ’হু’র্তে ঠিক কি করণীয় তার! ভেবে পেল না।আঁখি জোড়া থেকে অনবরত ব’র্ষ’ণ ঝড়ছে যেমনটা প্রকৃতিতে এখন ব’র্ষ’ণ বিদ্যমান।দূর আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চোখে আধার ঘনিয়ে এলে বুঝতেই পারলো না বহ্নি।
অনবরত কারো ডাকাডাকিতে যেন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল বহ্নি এর।সেই সাথে চোখে মুখে তো পানির অ’স্তি’ত্ব স্প’ষ্ট।ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো বহ্নি। চোখ খুলতেই দেখা মিলল আরাবের চি’ন্তি’ত, মলিন মুখখানা।আরাব আস্তে করে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো বহ্নি কে।ধা’ত’স্থ হওয়ার একটু সময় দিল।তারপর উ’দ্বী’গ্ন কন্ঠে জি’জ্ঞে’স করে উঠল,
“তুমি ঠিক আছো?জ্ঞা’ন হারালে কি করে?”
“আমি খুব খারাপ তাই না?আমাকে বিয়ে করে তুমি ভুল করেছো তাই না?”
ভালো মন্দ কোনো কথা না বলে বহ্নি এমন কিছু বলে উঠবে সেটা ভাবেনি আরাব! হঠাৎ এমন কথার কারণ ঠিক বুঝতে পারল না আরাব! তবে এটা বুঝলো এই মুহূর্তে তার অর্ধাঙ্গিনীর মনের মধ্যে বয়ে চলা ঝড়।একটু এগিয়ে গিয়ে বসল আরাব।বহ্নি এর বেশ অনেকটা কাছাকাছি।মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে উঠল,
“তুমি খারাপ নও! হুট করে ঘটে যাওয়া ঘটনা টা ঠিক মতো বুঝতে পারো নি!মেনে নিতে পারো নি! আর কিছু না! দেখো সবটা ঠিক হয়ে যাবে!”
আরাবের কথা শু’নে আরাবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বহ্নি। ম’স্তি’ষ্ক যেন ফাঁ’কা ফাঁ’কা লাগছে।আরাব হয়তো বুঝে নিলো বহ্নি এর অ’ব’স্থা টা।তাই উঠে গিয়ে একটা ঘুমের ওষুধ আর পানি এনে দিল বহ্নি এর কাছে।বহ্নি ও বীনা বাক্যে খেয়ে নিলো সেটা।এই মু’হূ’র্তে ঘুমটা তার সত্যিই প্রয়োজন।
ওষুধ তার কাজ শু’রু করে দিয়েছে।মিনিট দশেক পরেই বহ্নি ঘুমিয়ে গেছে।ঘড়ির কাটা ১২ টার ওপারে। আরাব একবার সেদিকে চাইলো তারপর উঠে গেল বেলকনিতে।চারিদিক ঘুটঘুটে অ’ন্ধ’কা’র। একটু আগে বৃ’ষ্টি হওয়ার জন্য পরিবেশ টা ও বেশ শীতল। জানালা দিয়ে একবার চাইলো ঘু’ম’ন্ত বহ্নি এর মুখের দিকে।তারপর ডুব দিল নিজের ভাবনায়।যে ভাবনা আজ থেকে নয়, শুরু হয়েছে তাদের এ’ন’গে’জ’মে’ন্ট এর দিন থেকে।
বহ্নি কে এর আগে কখনোই বিশেষ নজরে দেখেনি আরাব।তবে এনগেজমেন্ট এর দিন বহ্নি এর মুখের দিকে তাকিয়ে এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল।ধা’ক্কা টা কাটানো সহজ হবে না বহ্নি এর জন্য।তবে বহ্নি যে প্র’তি’শো’ধ নিতে বিয়ে করবে এটা ও আশা ছিল না।তবে পরে যখন বুঝতে পারল তখন চেয়ে ও পারেনি বহ্নি কে আটকাতে।মনের মধ্যে কোথাও একটা বি’শ্বা’স ছিল। যতটা কঠোর নিজেকে ভাবছে বহ্নি, আদে ও ওতটা কঠোর সে নয়।
হুট করে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মানতে না পেরে এমন একটা সি’দ্ধা’ন্ত নিয়েছে সে।ডিপ্রেশন এর বসে কি করতে গিয়ে কি করতে যা’চ্ছে সেটা মাথাতেই নেই ওর।বিয়ের দিন বহ্নি কে দেখে জীবণে প্রথমবারের মতো হার্টবিট মিস করে আরাব।অনুভূতিহীন কোমল মুখটিতে ফুটে ওঠা দৃড় চাহনি যেন ঘায়েল করে আরাবকে। নিজের ওপর নিজেরই হাসি পায় আরাবের।শেষমেষ একটা মেয়ের দৃড় চাহনির প্রেমে পড়ল সে।বহ্নি এর চাহনি তাকে #প্রণয়_স্রোতে ভাসালো। কি অ’দ্ভু’ত তাই না!
এই মেয়েটাকে নিয়ে সে ভাসতে চায়! #প্রণয়_স্রোতে ভেসে যেতে চায় ব’হু’দূর।কি’ন্তু মেয়েটাকি তাকে বুঝতে পারবে! নাকি মিথ্যা মরিচিকার পেছনে ছুটে বেরাবে! উত্তর জানা নেই আরাবের।
________________
সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস হলে ও আজ ঘড়ির কাটা ১০ টার ওপারে যাওয়ার পর ঘুম ভাঙে বহ্নি এর।নিজেকে কেমন হালকা লাগছে! কেন লাগছে জানা নেই বহ্নি এর। তবে তার হালকা লাগছে। পাশে আরাব নেই।তবে বহ্নি বেশি ভাবলো না।ফ্রে’শ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে চারিদিকে চোখ বুলালো বহ্নি। ড্রয়িংরুমে বসে আছে সকলে।সকলে বলতে তানভি আর উজ্জয়ীনি চৌধুরি। আরাব, ইয়ারাব নেই। বাড়ির বউ বিয়ের দ্বিতীয় দিন এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে বিষয় টা য’থে’ষ্ট দৃ’ষ্টি কটু এজন্য নিজের কাছেই খারাপ লাগছে বহ্নির।তবে বহ্নি এর দিকে তাকাতেই তানভি ছুটে এলো।জি’জ্ঞে’স করে উঠল,
“আপুনি!তুই নাকি কালকে খুব অ’সু’স্থ হয়ে গেছিলিস! আমাকে ডাকলি না কেন? জানিস আজ সকালে যখন ভাইয়ার কাছে শুনলাম তখন আমি আর মনিমা গেছিলাম তোর কাছে কি’ন্তু তুই ঘুমিয়ে ছিলিস বলে ডাকিনি!”
তানভি কথা শেষ করার আগে মনিমা বহ্নি এর কাছে এসে দাঁড়ালো। নরম গলায় জি’জ্ঞে’স করে উঠল,
“এখন শরীর কেমন তোমার?”
“জ্বি।এখন ভালো আছি!”
সৌজন্য হেসে বলে উঠল বহ্নি। মনে মনে এক অ’দ্ভু’ত তৃ’প্তি অনুভব হলো বহ্নি এর।এই মানুষগুলো তাকে য’থে’ষ্ট ভালোবাসে।তাহলে কি এই মানুষগুলোর জন্যে ও ইয়ারাব কে ক্ষ’মা করে দিতে পারবে না সে!
নিজে যখন প্রশ্নের বেড়াজালে জ’র্জ’রি’ত তখন দারোয়ান ছুটতে ছুটতে বাড়ির মধ্যে ঢুকলো।তার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। কেমন আতঙ্কগ্রস্ত দেখাচ্ছে দারোয়ানকে।উজ্জয়ীনি চৌধুরি দারোয়ান এর এমন অ’ব’স্থা দেখে তার কাছে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে।তবে দারোয়ান এর কথা শুনে সকলের পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম
দারোয়ান কাঁপা স্বরে বলে উঠল,
“ইয়ারাব স্যার এ’ক্সি’ডে’ন করেছে!”
_________________
হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরী পরিবারের প্রতিটি লোক।তানভি স্ত’ব্ধ। এতটাই স্ত’ব্ধ যে কাঁদতে ভুলে গেছে সে।ইয়ারাব এর এ’ক্সি’ডে’ন এর খবর শুনে আরাব সাথে সাথেই হসপিটালে চলে এসেছিল।
বহ্নি, তানভি আর মনিমা দারোয়ান এর কাছ থেকে খবর শুনে তারপর এসেছে।আজ সকালে একটা কাজে বের হয়েছিল ইয়ারাব।কি’ন্তু মাঝ রা’স্তা’তে এ’ক্সি’ডে’ন হয় ওর।
সকলের মুখ থমথমে।তানভি এর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে কিন্তু কোনো শব্দ বের হ’চ্ছে না।আরাবকে এসে থেকে দেখতে পায়নি কেউ। বহ্নি কয়েকবার খোঁ’জা’র চে’ষ্টা করেছিল কি’ন্তু পারেনি।তানভি এই মু’হূ’র্তে বহ্নিকেই আকড়ে ধরে আছে।আর বহ্নি ও বারবার শা’ন্ত’না দিয়ে যাচ্ছে তার ছোট্ট বোনটিকে।বেশ কিছুক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে আসে ড’ক্ট’র। তবে ড’ক্ট’র একা আসেনি।সাথে আরাব ও বের হয় অপরেশন থিয়েটার থেকে।বহ্নি আরাবকে দেখে অবাক হয় তবে সেদিকে এখন ধ্যা’ণ দেওয়ার সময় নেই। সকলে এখন আগে জানতে চায় ইয়ারাব এর অবস্থা।
চলবে,