#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৭তম_পর্ব
ফ্লাস লাইটটা হাতের কাছে মারতেই দেখলো টকটকে লাল তরল। অজানা ভয়টি ক্রমশ তীব্র হলো দীপ্তের। অমনেই চিৎকার করে জ্ঞান হারালো সে। এদিকে উপর তালার জানালায় কান লাগানো জমজেরা তার চিৎকার শুনেই হাই ফাইভ দিয়ে বলে উঠলো,
“চেরাগআলী এবার বাছা কই যাবা”
কথাটি বলেই তারা পৈশাচিক হাসি দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। গলার স্বরে টান খেয়ে উভয় ই কাঁশতে লাগলো। এই পুরো বুদ্ধিটি এশা আশার। শিল্পী দাদীর নাতনী ফাইজা তাদের বান্ধবী, আসলে ঠিম বান্ধবী বলা চলে না। বি’চ্ছুদ্বয়ের সাথে তার সখ্যতার কারণ তাদের দ’স্যু’প’না। এই দ’স্যু’প’নার কারণে স্কুলে তাদের দাপট ই আলাদা৷ সারা ক্লাসের মেয়েরা তাদের ভয় পায়। বলা তো যায় কখন কার উপর তাদের ক্রোধানল বর্ষণ হয়। ঠিক একারণে ফাইজাও তাদের সমীহ করে চলে। আর বি’চ্ছু’রাও সেটার সম্পূর্ণ ফয়দা তুলে। আজ ফাইজার জন্মদিন বটে কিন্তু তাদের দাওয়াতটি তারা নিজেই নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ফাইজাকে বলেছে আজ এবাড়িতে তারা থাকবে। ফাইজাও বাধ্য তাদের কথা মেনে নিলো। কেক কাটার পর তারা কেক দেবার উছিলাতে নিচে এসেছে। রোকসানা দরজা খুলেছিলো। রোকসানাকে কথায় ব্যস্ত রেখেছিলো আশা এবং ফাইসা। সেই সুযোগে এশা দীপ্তের ঘরে ঢুকে। দীপ্ত বাসায় না থাকার সুযোগে অনলের ঘর থেকে চুরি করা ছোট ব্লুতুথ স্পীকার ঘরের এক গুপ্ত জায়গায় রেখে দেয় এবং পলিথিনের এক ব্যাগ লা জল রং ঘোলা তার বিছানায় দিয়ে দেয়। তারপর দীপ্ত ফেরার অপেক্ষা করে।দীপ্ত ফিরতেই সারা বিল্ডিং এর মেইন সুইচ সিড়িঘড় থেকে বন্ধ করে দেয় আশা। ফলে লোডশেডিং এর একটা পরিবেশ তৈরি হয়। এশা তখন ঠিক দীপ্তের ঘরের উপর তালার ঘরে অবস্থান নিয়েছিলো। সেই জানালা থেকে একটি কর্কশীট কাটা নারী অবয়ব সুতোয় ঝুলিয়ে দীপ্তের জানালার সামনে ধরে সে। দীপ্তের ঘরের জানালা দেওয়া ফলে অন্ধকারে কর্কশীটের সেই কাটা অংশটিকে নিকষকালো নারী অবয়ব মনে হয়। দীপ্তে ফ্লাশ লাইট ধরার আগেই তা নিপুন ভাবে উঠিয়ে নেয় এশা। ফলে ফ্লাশ লাইট মারতেই অবয়ব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। উপরন্তু পুরোনো বিল্ডিং হওয়ায় উপর তালা থেকে খুব সহজেই ব্লুথুত কানেকশন পাচ্ছিলো তারা। ফলে ফাইজার মোবাইল থেকেই ভুতুরে হাসি এবং কথার রেকর্ডিং চালিয়ে দেয়। এই বাড়ির নামে গুজবটিও পাড়ায় তারাই ছড়িয়ে ছিলো। যা বিগত সপ্তাহখানেক দীপ্ত শুনেছে। তার ঘরটির সিলিং ফ্যানেই নাকি ঝু’লে মেয়েটি আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছিলো। ডাক্তার হলেও মানুষের অবচেতন মনে ভীতি জন্মায়। সপ্তাহ খানেক এই ভীতিটা মনে সঞ্চার করেছিলো দীপ্ত। কিন্তু তোয়াক্কা করে নি। তবে আজ তার সাথে হওয়া ঘটনাগুলোয় সেই ভীতি প্রকোষ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। ফলে যখন ই বিছানায় রাখা ঘন তরল তার হাতে লেগেছে অমনি তার মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে দীপ্ত। অন্যদিকে নিজের ফাঁদে আটকানো ঘুঘুর চিৎকারে এশা আশার খুশি যেনো ধরে না। ফাইজা এক কোনায় দাঁড়িয়ে অসহায় কন্ঠে বললো,
“ভাইয়াটা ভালো, এমন করে ভয় দেখানোটা ঠিক হয় নি”
সাথে সাথেই তেঁতে উঠলো আশা৷ ধমকের সুরে বললো,
“অস্ট্রেলিয়ান চেরাগআলীর সাথে উচিত কাজ করেছি। আমাদের সাথে খুব ভাব দেখাচ্ছিলো। নে, এবার ভয়ে কুপকাত হ। আমাদের ধারাপুকে নিয়ে যাবার হু’ম’কি দেয়। কি সাহস! ওর সাথে আর কি কি করি দেখ!”
ফাইজা শুকনো ঢোক গিললো। এশা আশার পৈশাচিক হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীপ্তের সাথে ভালো কিছু হবে না।
দীপ্তের চিৎকারে ছুটে আসলেন সেলিম এবং রোকসানা। ততসময়ে ঘরের লাইট চলে এসেছে। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেখলেন দীপ্তের গা লালে রক্তিম হয়ে আছে। ছেলেটা মূর্ছা গেছে। পানি ছিটাতেই জ্ঞান ফিরলো তার। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“ভু…ভুত, এই ঘরে ভু…ত”
“কি বলছো দীপ্ত, আমি রোকসানা আন্টি”
সেলিম সাহেব উঠে বসালেন দীপ্তকে। দীপ্ত ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। তার জড়তা এখনো কাটে নি। বুকের স্পন্দন লাগাম ছাড়া। পালস অক্সিমিটারে মাপলে ১২০ এর উপর হবে হয়তো। সেলিম সাহেব তাকে বাড়ির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
“কি হয়েছে?”
দীপ্ত পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিলো। তারপর একটু জিরিয়ে পুরো ঘটনাটা বললো। ঘটনাটি শুনতেই রোকসানা রক্তশুণ্য হয়ে গেলো। ভুতে তার বিশাল ভয়। সে উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“আমি এখানে থাকবো না, আমি দেশে যাবো”
কিন্তু সেলিম সাহেব নির্বিকার। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“ডাক্তার হয়ে ভয় পাচ্ছো দীপ্ত! ভুত টুত হয় না। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর রোকসানা তুমি যেতে চাইলে আমি টিকিট কেটে দিবো”
সেলিম সাহেবের এমন নির্বিকার আচারণে বেশ রোকসানার মনক্ষুন্ন হলো৷ বরাবর এই লোকটির এমন দায়সারাভাব। এদিকে ভীত, সন্ত্রস্ত দীপ্ত এখনো থমথমে দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে ভুল ছিলো কি সব!
***********
ক্যালকুলাসের বই এর প্রথম চ্যাপ্টার থেকে ম্যাথ করা শুরু করেছে ধারা। তাকে আজ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাকে প্রমাণ করতে হবে অনল ভাই প্রশ্ন দেয় নি তাকে। তার সাথে ভেদাভেদ করে নি। ভালোবাসাও বেশ অবাককর জিনিস। প্রণয়ের আবেগে মানুষ সব কিছু করতেও দ্বিধাবোধ করে নি। নয়তো যে ধারাকে বকেও অনল পড়াতে বসাতে পারে না সেই ধারা কিনা নিজে নিজে পড়তে বসেছে তাও ভার্সিটি থেকে আসার পর থেকেই। অনল অবশ্য এখনো ফিরে নি। ধারা তাকে ফোন ও করে নি। অভিমানটা বজায় রেখেছে। যদিও বড়মাকে দশবারের মতো জিজ্ঞেস করেছে, “তোমার ছেলে আসে না কেনো?”
বড়মা মটরশুটি ছিলতে ছিলতে বললো,
“তুই ফোন দে”
“না, ওর সাথে কথা নেই”
বড় মা হাসতে হাসতে বললো,
“গোসা হয়েছে নাকি!”
ধারা উত্তর দেয় নি। গোসা হয়েছে বটে। খুব হয়েছে। এবং অনল যদি গোসা না ভাঙ্গায় তবে এই অভিমান থাকবেই। ধারা অংকটি কষতে কষতেই কেটে দিলো। মন বসছে না। মানুষটি আসে না কেনো! এতো দেরি তো হবার কথা নয়। উঠে বারান্দার দিকে যাবে তখন ই কলিংবেল বাজলো। ধারা আবার বসে পড়লো টেবিলে। মিনিট দশেক বাদে ঘরে প্রবেশ করলো অনল। ধারা বেশ মনোযোগী ভাব নিয়ে বসে আছে। অনল এক নজর তার দিকে তাকিয়েই টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কোনো কথা৷ বললো না সে। তবে ধারাও কম নয়, সেও তার রাগ অক্ষত রাখবে। কিছুতেই দমাবে না সে। মিনিট দশেক বাদে গোসল সেরে বের হলো অনল। চুলের গোড়া থেকে পানির রেখা মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। টিশার্টের গলার খানিকটাও ভেজা। টাওয়ালটি দিকে দায়সারাভাবে সে মাথা মুছতে লাগলো। মাঝে আড়চোখে একবার ধারাকেও দেখলো। সে চোখ মুখ খিঁচে তাকিয়ে আছে খাতার দিকে। মুখের ভঙ্গিমাতে অসম্ভব কাঠিন্য। অনল ঠিক তার পেছনে দাঁড়ালো। উঁকি দিতেই দেখলো অংকের একমাথায় এসে আটকে আছে ধারা। কিছুতে সামনে এগোতে পারছে না। অনল ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তারপর পাশ থেকে একটি কলম নিয়ে ঝুকে পরের লাইনটি লিখে দিলো। অনল ঝুকতেই চমকে উঠলো ধারা। পাশ ফিরতেই অনলের সাথে চোখাচোখি হলো। অনলের ভেজা চুল থেকে এখনো জলরাশি পড়ছে। ধারার খাতাটাও ভিজলো কিঞ্চিত৷ ধারা চোখ সরিয়ে নিলো। ধারার এরুপ কাজে অনলের হাসি চওড়া হলো। সে একুয়েশন খানা লিখেই সোজা হয়ে ধারালো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“শুধু শুধু তখন আমি রাগ দেখাই নি। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত সেটা আমার জানা। ব্যাপারটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়। ফ্যাক্ট এর। কেউ বিদ্বান হলে ওরা তোমার উপরের জিনিস। প্রশ্নটি কত কঠিন হতে পারে ধারণা নেই! তারপর ও যদি কেউ মুখ ফুলিয়ে থাকে আমার করার কিছু নেই”
অনলের কথায় ধারার সুপ্ত জিদটা যেনো আরোও ধপ করে জ্ব’লে উঠলো। আত্মদাম্ভিক মেয়েটি ধারা। সে যতই অলসতা দেখাক, কিংবা অনাগ্রহ প্রকাশ করুক না কেনো! কেউ তার দক্ষতার উপর প্রশ্ন করলে সেটা মোটেই সহ্য হয় না তার। অনল এর আগেও তাকে ফেলুরাণী বলতো। তবে আজকের কথাটা যেনো আত্মসম্মানে লাগলো। মনে মনে স্থির করলো তাকে যদি পরীক্ষা দিতেই হয় সে দিবে, এবং সবাইকে দেখিয়ে দিবে তার মার্কটি নিজস্ব অর্জিত। ধারা তাই বিনাবাক্য ক্ষয়ে আরোও মনোযোগ দিয়ে অংক কষতে লাগলো৷ অনল ঈষৎ অবাক হলো৷ ভেবেছিলো হয়তো ধারা হতাশ হবে। কিন্তু না, সে আরোও দ্বিগুণ উৎসাহে পড়াশোনা করছে। যেনো সে প্রতীক্ষাবদ্ধ, যেভাবেই হোক তাকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। অনল অপলক নয়নে চেয়ে রইলো ধারার দিকে। সেই চাহনীতে ছিলো শুধুই মুগ্ধতা।
ধারার পড়া শেষ হলো বেশ রাতে। ঘড়ির দিকে তাকালো সে। তিনটা বাজে। বাহু জোড়া উঁচু করে শরীরে টান দিলো। মাজা ধরে এসেছে বসে থাকতে থাকতে। চোখ বুলালো ঘরে। অনল নেই। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার লাইট জ্বলছে না। ঘরের লাইট এবং বাহিরের নিকষ আধার মিলে আলোআধারী মায়া তৈরি করেছে। সেই মায়ায় অনলকে যেনো আরোও বেশি মায়াবী লাগছে। বিশাল দেহী মানুষটাকে ঘিরেই যেনো রাজ্যের মায়া। গাঢ় অভিমানের জন্য একটু যে কথা বলবে সে আর হলো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। তারপর বিছানাটা ঠিক করেই গা এলিয়ে দিলো ধারা। বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো চোখে। কিছুসময় পর ই অনুভব করলো এক শক্ত হাত তাকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মুখ গুজতেই উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়লো ঘাড়ে। নরম কন্ঠটি কানে ভেসে এলো,
“আমি তোকে বিশ্বাস করি ধারা, নিজের থেকেও তোর উপর আমার অধিক বিশ্বাস। কিন্তু আমি যে তোর ক্ষতি হতে দেখতে পারবো না। কি উত্তর দিবো তখন নিজেকে। আমার জন্য তোর ক্ষতি হলে নিজেকে যে ক্ষমা করতে পারবো না রে। কখনই পারবো না”
ধারা চোখ খুললো না। ঘুমের প্রহরে স্বপ্ন এবং বাস্তবতাকে আলাদা করতে চাইলো না। থাকুক কিছু মিষ্টি স্বপ্ন, ক্ষতি কি!
ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো অনলের বলিষ্ট বুকে। কিছুসময় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। রাতের ওই কথাগুলো কি সত্যি প্রিন্স উইলিয়াম বলেছিলো নাকি তা নিছক স্বপ্ন ছিলো বুঝে উঠতে পারছে না। ধারা বেশি মাথা নষ্ট করলো না। আজ ক্লাস সকালে বিধায় ছুটে তৈরি হলো সে। কোনোমতে একটি রুটি গুজেই ছুটলো ক্লাসে।
বাড়ি থেকে বের হতেই ধাক্কা খেলো এশা আশার সাথে। তাদের বেশ উৎফুল্ল দেখালো। দুটো কি জানে আলাপ করছে আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। কারণ বুঝে উঠতে পারলো না ধারা। জিজ্ঞেস করার সুযোগ ও পেলো না ধারা। ছুটলো সে ক্লাসের উদ্দেশ্যে।
ক্লাসে পৌছাতেই দেখা গেলো বন্ধুমহল জোট বেঁধে আছে। ধারা কাছে যেতেই তাদের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। ধারা অবাক কন্ঠে মাহিকে শুধালো,
“কি হয়েছে? কি নিয়ে আলাপ করছিলি?”
তখন দিগন্ত একটি ছবি বের করে ধারার হাতে মোবাইলটা দিলো। মোবাইলের ছবিটি দেখতেই চোখ বিস্ফারিত হবার জোগাড়। ছবিতে মাধবীকে দেখা যাচ্ছে। সে একটি যুবকের সাথে কথা বলছে। যুবকটি আর কেউ নয় বরং দীপ্ত……..
চলবে
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৮তম_পর্ব
মোবাইলের ছবিটি দেখতেই চোখ বিস্ফারিত হবার জোগাড়। ছবিতে মাধবীকে দেখা যাচ্ছে। সে একটি যুবকের সাথে কথা বলছে। যুবকটি আর কেউ নয় বরং দীপ্ত। দীপ্তকে মাধবীর সাথে দেখতেই মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেলো ধারার। সে ভেবে পাচ্ছে না এদুজনের যোগসূত্র কি! ধারা জিজ্ঞাসু কন্ঠে দিগন্তকে শুধালো,
“এই ছবি কই থেকে পেয়েছিস?”
“কাল তোরা যখন বের হয়ে গেলি, তারপর আমি আর অভীক মাধবীর পিছু নেই। ও খুব চিন্তিত ছিলো। তারপর ও একটা গলির সামনে দাঁড়িয়ে ও কাউকে ফোন করলো। ফোন করার মিনিট পঁচিশের মধ্যেই এই ছেলেটা ওখানে উপস্থিত হয়। এই ছেলেটাই সেদিন ভার্সিটিতে এসেছিলো। তোর বিয়ের কথাটা ফাঁ’স করেদিলো। তাই সাথে সাথেই আমি ছবিটা তুলে নেই। ওরা বেশ কিছুসময় কথা বলছিলো। কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে থাকায় কিছুই শুনতে পাই নি”
ধারা এখনো চেয়ে রয়েছে ছবিটির দিক।তার মনে হাজারো সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিলো অন্তস্থলে। সাথে সাথেই সেলিম আহমেদের সাথে হওয়া শান্ত যু’দ্ধের কথা স্মরণে এলো। মনের ভেতরে সুপ্ত ঘৃণাটা মাথাচাড়া দিলো। বিদ্রোহ করে উঠলো অবুধ চিত্ত। তিতকুটে অনুভূতিতে মুখশ্রীতে জড়ো হলো বিরক্তি। বাবা হিসেবে না স্বীকার করলেও মানুষটি এতোটা নিচে নামবে কল্পনাও করে নি ধারা। ধারার শক্ত মুখশ্রী দেখে মাহি জিজ্ঞেস করলো,
“কি ভাবছিস?”
“ভাবছি কেউ এতোটা নিচে কিভাবে নামে!”
ধারার কথার মর্মার্থটা বুঝলো না বন্ধুমহলের কেউ। তবে নীরব বললো,
“আমরা ওকে এই ছবি নিয়ে ব্লা’ক’মে’ই’ল করতেই পারি, এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আর এতে আমাদের বিবিসি দিগন্ত আমাদের সাহায্য করতে পারে”
“হ্যা, আমি অলরেডি এই ছবি ছড়িয়েও দিয়েছি। মাধবীকে এবার ধরলেই ও আমাদের কাছে সব উগড়ে দিতে পারবে”
ধারা মলিন হাসি হাসলো। যেখানে নিজের বাবা তার সুখটা পায়ে পিসছে প্রতিনিয়ত, সেখানে তার বন্ধুমহল সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তার এবং অনলের অপবাদ মিটাতে। সত্যি, আপনজন রক্তের টানে হয় না, হয় আ’ত্মা’র টানে।
*******
সেলিম সাহেবের মুখ কঠিন হয়ে আছে, সে তন্ন তন্ন করে নিজের কাপড়ের মাঝে নিজের উইলের কাগজখানা খুঁজছেন। কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছেন না। তার স্মরণশক্তি এতোটাও খারাপ নয়। তার স্পষ্ট মনে আছে সে কাগজখানা এখানেই রেখেছিলেন। তাকে বিধ্বস্ত লাগছে। কপালে জমেছে নোনাজলের বিন্দু। কাগজটি হারিয়ে গেলে পুনরায় আবারো তাকে বানাতে হবে। কাগজটি কি কেউ সরিয়ে নিয়েছে! এমন কাজ একজন ই করতে পারে! রোকসানা। ঠিক সেই সময়টিতেই রোকসানার আগমন ঘটলো ঘরে। তাকে দেখেই গম্ভীর কন্ঠে সেলিম সাহেব প্রশ্ন ছুড়লেন,
“তুমি আমার আলমারী ঘাটাঘাটি করেছিলে?”
প্রশ্নটি কর্ণপাত হতেই চমকে উঠলো রোকসানা। আমতা আমতা করে বললো,
“না, আমি কেনো তোমার জিনিসে হাত দিবো?”
“তাহলে আমার উইলের কাগজটি কোথায়?”
রোকসানা থতমত খেয়ে গেলো। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো, লাভ হলো না। সেলিম সাহেবের বিশ্বাস অটল। তিনি জে’রা শুরু করে দিলেন,
“কোথায় রেখেছো রোকসানা কাগজটা?”
“আমি দেখি ই নি কাগজ!”
“আমি আর একবার জিজ্ঞেস করবো! কোথায় আমার কাগজ?”
এবার সংযম হারালো রোকসানা। চিৎকার করে উঠলো সে,
“পুড়িয়ে দিয়েছি আমি!”
“কিহ!”
সেলিম সাহেবের মস্তিষ্কে কথাটা অনুধাবণ হতে সময় নিলো। কেউ কতটা ক্ষুদ্ধ হলে এমন কাজ করতে পারে! তীব্র স্বরে বলে উঠলেন,
“পুড়িয়ে দিয়েছো মানে?”
“মানে টা স্পষ্ট, আমি পুড়িয়ে দিয়েছি। আজব, যে মেয়ে তোমাকে বাবা বলেই মানে না তাকে তুমি সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দিবে আর আমি বসে বসে দেখবো!”
“আমার জিনিস আমার মেয়েকে দিবো, তোমার থেকে তো শুনবো না আমি!”
“কেনো শুনবে না সেলিম! তোমার শুনতে হবে, এই মেয়ের জন্যই তুমি কখনো সন্তান নাও নি। এখন এই মেয়ের জন্য তুমি আমাকে ঠকাবে, আর আমি সেটা মেনে নিবো! অনেক হয়েছে আর নয়। আমি আর নিজের সুখের বিসর্জন দিতে পারছি না।”
রোকসানার কথাগুলো শুনতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না সেলিম সাহেব। তীব্র স্বরে বলে উঠলেন,
“তোমার সুখ বিসর্জিত হয়েছে! সত্যি রোকসানা! তাহলে সব জেনেশুনে আমাকে কেনো বিয়ে করেছিলে? আমি নাহয় স্বার্থপর মানুষ, তোমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য ছিলো আমার উন্নতিতে যেনো বাঁধা না পড়ে। তুমি কেনো রাজি হয়েছিলে! আমি তো বলেই ছিলাম, আমার একটি মেয়ে আছে। আমি আর কোনো সন্তান চাই না। তখন তুমি রাজী হলে কেনো! তখন তো বেশ আনন্দিত ছিলে তুমি। কারণ তোমার কাছে তখন আমার বউ হওয়াটাই জরুরি ছিলো। তোমার কাছে আমার অর্থই সবথেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। বিসর্জন তুমি দাও নি রোকসানা। আমার জন্য যদি কেউ বিসর্জন দেয় সে সুরাইয়া। তুমি নও। আমি তো তোমার প্রাপ্যটা তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমার হক কিন্তু আমি মারি নি। সুতরাং আমার মেয়েকে আমি কি দিবো না দিবো সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যপার। এর মাঝে দয়া করে তুমি এসো না।”
বলেই ঘর থেকে বের হলেন সেলিম সাহেব। রোকসানা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। চোখ মুখ রক্তিম হয়ে রয়েছে তার। লোকটির মনে আজ ও যেন সুরাইয়ার ই বসবাস। কখনোই যেনো সেই স্থান তার হবে না। বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে তার। এখনো মনে আছে মুমূর্ষু সুরাইয়ার জন্য লেখা চিঠিগুলো এখনো সযত্নে উঠিয়ে রেখেছেন সেলিম সাহেব। কখনো পাঠানোর সুযোগটি ই হয় নি। কারণ সেই মানুষটি ই আজ নেই_______
ক্লাস শেষ হতেই মাধবীর মুখোমুখি হলো ধারা। ছবিটি সম্মুখে রেখে বললো,
“এই লোকটিকে কিভাবে চিনো তুমি?”
মাধবী খানিকটা চমকে উঠলো। সে গাইগুই করে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ধারার হুমকির সামনে জোর খাটলো না। ফলে একে একে সকল কথাটা ফাঁ*স করতেই হলো।
****
অনল ল্যাপটপের সম্মুখে বসে রয়েছে। তার মুখখানা শক্ত হয়ে আছে, বিশাল একখানা সুযোগ তার সামনে। অস্ট্রেলিয়ার বেশ বড় একটা কোম্পানি থেকে একটা চাকরির অফার পেয়েছে কাল রাতে। ইন্টারভিউটি হবে অনলাইনে। তারপর তারা জানাবে ফলাফল৷ চাকরির ঝামেলার কারণে অনল আজ সকালে ইন্টারভিউ দিয়েছে। এখন তাদের মেইল এসেছে। অনলের চাকরি হয়েছে। তারা নেক্সট সপ্তাহেই অনলকে জয়েন করতে বলেছে। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে, অনল তো প্রথমেই ধারাকে নিয়ে যেতে পারবে না। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্যালারিও বিশাল, সুযোগটি বেশ চমৎকার। কিন্তু ধারাকে ছেড়ে যাওয়াটা মন সায় দিচ্ছে না। বেশ কতক্ষণ তাকিয়ে রয়েছে ল্যাপটপের দিকে। কিছুই মাথায় আসছে না। কি করা উচিত! অফারটি ছেড়ে চাকরির এই টানাপোড়েন চলবেই। বুঝে উঠতে পারছে না অনল। মাথাটা ধরে এসেছে। একটু গড়িয়ে নিলে মন্দ হয়না। যে ভাবা সেই কাজ। ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো অনল। সাথে সাথেই ধারার ক্যালকুলাস বই টা পড়ে গেলো। মেয়েটি কালকে পড়ে এখানেই রেখে দিয়েছে বই। অনল নিঃশব্দে হাসলো। বইটি তুলতেই তার ভেতর থেকে একটি কাগজ পড়লো নিচে। সেটা তুলে হাতে নিতেই দেখলো গোটা গোটা করে কিছু লেখা। অনল পড়তে লাগলো লেখাগুলো।
অনলভাই,
এই চিঠিখানা বহু কষ্টে লিখতে বসেছি আজ। আমার মনের সকল অগোছালো চিন্তাগুলো একটা কাগজে উপস্থাপন করবো। এটা এতোটা কষ্ট হবে জানা ছিলো না। আমি নিজেও সে বিস্তার ভাবনার জোয়ারে ভাসছি গো। চিন্তাগুলো সব যেনো ভাসমান। আচ্ছা, এই ভালোবাসা কি! এই অনুভুতিগুলো কি! বহুপূর্বে একখানা চিঠি লিখেছিলাম। কই এতো তো কষ্ট হয় নি। এত এলোমেলো ছিলো না তো আমার চিন্তাগুলো। শব্দগুলো ছিলো সুসজ্জিত। তবে তোমার বেলায় এমন কেনো? তোমার বেলায় আমার মস্তিষ্ক অচল কেনো অনল ভাই। আজ মাহি আমায় প্রশ্ন করল, “ভালোবাসিস তাকে?” আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কিভাবে পারবো বলো, এই ভালোবাসা নামক অনুভূতিটি যে অচেনা আমার কাছে। তুমি আমার কাছে কোনোকালেই প্রিয় ছিলে না, ছিলে অতি অপ্রিয় ব্যক্তি। বিরক্ত হতাম তোমার প্রতি কার্যে, অসামান্য রাগ হতো তোমার উপর। অথচ তোমার কাছে এক অকল্পনীয় শান্তি আছে। শতবিপদেও তোমার নামটি ই আমার কল্পনায় আসে অনল ভাই। তোমার জীবনে অন্যকেউ আসবে ভাবতেই তোমাকে হারাবার টলমলে ভয়ে বুক কেঁপে উঠে। এই বিয়েটায় আমার আপত্তিটি ছিলো সর্বাধিক। অথচ দেখো আজ তোমার থেকে দূরত্ব আমার সহ্য হচ্ছে না। সব থেকে তিতকুটে অনুভূতিটিও তোমার উপস্থিতিতে মধুর হয়ে উঠে। তোমার বড় বড় হাতের ফাঁকের উষ্ণতাটি যে আমার সবচেয়ে প্রিয়। তোমার দূর্বোধ্য স্নিগ্ধ হাসিতে বারবার হারাতে চাই আমি। তোমার বলিষ্ট বুকে মুখ গুজে তোমার মাদকতায় ডুবতে চাই। আমার একটা ছোট স্বপ্ন আছে অনলভাই জানো, যা আমাকে প্রায়শ ই ভাবায়। স্বপ্নটি তোমাকে নিয়ে। কোনো এক গোধূলীতে আমি বসে রয়েছি তোমার সাথে। তুমি গান গাইছো, আমি অধীর হয়ে চেয়ে রয়েছি তোমার পানে। কি অদ্ভুত তাই না! যদি আমার এই এলোমেলো চিন্তাগুলো, আমার বদ্ধ মস্তিষ্কে তোমার নামের আবেগ গুলোকে যদি প্রণয় বলে তবে হ্যা, আমি তোমার প্রণয়িনী। বিয়ের রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, আমার কি মনে হয় তোমার মতো দাম্ভিক, আত্মজেদী মানুষটির ভেতর যে র’ক্ত”মাং’সে’র’সে’র হৃদযন্ত্রটি আছে তা আমার জন্য স্পন্দিত হয়! আমি সত্যি জানি না অনল ভাই, তবে তোমার জন্য আমার হৃদয় স্পন্দিত হয়। তোমার মতো আত্নদাম্ভিক, জেদি, রাগী, অসহ্য মানুষটির জন্যই আমার হৃদয় স্পন্দিত হয়, হাজার বার। তোমার প্রতি আমার প্রণয়টা বরাবর ই একটা গোলকধাঁধা, অনল ভাই; নিছক প্রহেলিকা। এই দূর্বোধ্য আবেগের উত্তর আমি আজও পাই নি। অথচ এই প্রণয় প্রহেলিকা যে আমার জীবনের অস্তিত্বে মিশে যাবে কে জানতো! কে জানতো! এই প্রহেলিকার চোরাবালিতে আমি একটু একটু করে গ্রাস হবো। কে জানতো বলো! আমার এই আবেগের কি উত্তর আছে তোমার কাছে অনল ভাই? আমার স্বপ্নটি সত্য হবে? তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে——-
ইতি
তোমার প্রণয়িনী
ধারা
এই চিঠিটি ধারা বহুপূর্বে লিখেছিলো। দেবার সময় টি ই হয় নি। অনল অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন বেসামাল হয়ে উঠেছে। সাথে সাথেই সে ধারাকে ফোন লাগালো। ফোন বাজছে কিন্তু কেউ ধরছে না। এখন ধারার ছুটি হয়ে যাবার কথা। অথচ সে এখনো বাড়িতে ফিরে নি। ফলে বাধ্য হয়ে মাহিকে ফোন দিলো অনল।
******
লাগাতার কলিংবেল বাজছে। কেউ খুলছে না দরজা। জ্বরে ক্লান্ত দীপ্ত বাধ্য হয়ে উঠলো। গতকালের কান্ডের পর তার জ্বর এসেছে। ধুম জ্বর। সে কোনো মতে উঠে দরজা খুললো। খুলতেই খানিকটা চমকে উঠলো, কারণ বাহিরে ধারা দাঁড়িয়ে আছে………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি